দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৩
আফরোজা আশা
ভোরসকাল থেকে শুরু হয়েছে পাটোয়ারী বাড়ির কাজ-কারবার। বৃষ্টি ব্যতিত বাড়ির একটা মানুষও বসে নেই। সবাই দৌড়ের উপর আছে। বাণীও এতোক্ষন টুকটাক কাজ সেরে নিয়েছে। হুট করে ভার্সিটিতে গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস পরে গিয়েছে। তাই হাতের কাজটুকু শেষ করে ও ভার্সিটি চলে গিয়েছে।
“ বেলা! বেলা! বাগানে গিয়ে পাকা লেবু পেড়ে আন। কিরে শুনতে পাচ্ছিস না,” রান্না করতে করতে বেলার মা আমেনা চিৎকার ছুড়ল।
ড্রয়িংরুমের সোফার কুশন পাল্টাছে বেলা। পাশেই বৃষ্টি মাথায় হেয়ার প্যাক লাগিয়ে বসে বসে ফোন দেখছে। মায়ের চিৎকার শুনে বেলা বৃষ্টিকে বলল, “ আপা, বাকিগুলো তুই লাগিয়ে নে। আমি বাগানে যাই। ”
ফোন থেকে মুখ তুলে বিরক্তিকর চাহনিতে চাইল বৃষ্টি। কড়া গলায় জবাব দিল,
“ করতে পারলে কর, নাহলে করার দরকার নেই। আমি কোনো কাজ করতে পারব না। দেখছিস না নেইল’সগুলো বড় করেছি। ভেঙ্গে যাবে। আমার কাছ থেকে কোনো কাজ আশা করবি না। ”
দরজা দিয়ে বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে মেঝো মেয়ের কথা শুনে দাঁড়িয়ে পড়ল রহমান পাটোয়ারী। বাজারের ব্যাগটা বেলার কাছে এগিয়ে দিয়ে বৃষ্টিকে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ তোমার মতো অলস আর অহংকারী একটা মেয়ে আমার ঘরে জন্মেছে ভাবলেই নিজের উপর ঘৃণা লাগে। সারাবাড়ির লোক খেটে মরছে আর তুমি জমিদারের মতো হুকুম ছুড়ছ। আম্মার আস্কারাতে এতো লাই পেয়েছো তুমি। তারপর জোর গলায় স্ত্রীর উদ্দেশ্যে হুংকার ছুড়ে বলল, আমেনা… তোমার মেয়েকে মানুষ বানাও। মেয়ে বড় হয়েছে বলে ছাড় পাচ্ছে। আমার ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙলে কিন্তু তোমাকে সহ তোমার মেয়েকে বাইরে ছুঁড়ে মারব। ”
বাবার এতো তিক্ত কথা শুনেও কোনো হেলদোল নেই বৃষ্টির মাঝে। বরং কথাগুলো শুনেও না শোনার ভান করে উঠে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। রহমান সাহেব অবাধ্য মেয়েকে পিছন থেকে রক্তচক্ষু নিয়ে দেখছে। বৃষ্টি রুমে গিয়ে শব্দ করে দরজা আটকে দিল।
রান্নাঘরের দরজার সামনে ভীত চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছে আমেনা। না পারে মেয়েকে শাসনে আনতে আর না পারে স্বামীর মন রাখতে। দুদিক থেকেই বাঁধা সে।
মায়ের অসহায় চোখের দিকে চেয়ে বেলা বাবার কাছ ঘেঁষে মিনমিন করে বলল,
“ এতো ভালো একটা দিনে এভাবে রাগারাগি করো না আব্বু। বাড়ি ফিরে বড় আপা এসব শুনলে মন খারাপ করবে। বৃষ্টি আপা একটু এরকমই জানো তো। ওর জন্য আম্মুকে কষ্ট দিও না। আমার ভালো লাগে না এসব। ”
ছোট মেয়ের কথা শুনে রহমান হালকা শান্ত হলো। বেলার মাথায় হাত রেখে স্মিত হেসে বলল,
“ এসব নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে না আম্মু। আজ একটু কাজ বেশি তাই আম্মুর হাতে হাতে কাজ এগিয়ে দেও। কিন্তু পড়ায় গাফিলতি করবে না। আর কিছুদিন বাদে এসএসসি পরীক্ষা তোমার। মন দিয়ে পড়াশোনা করবে। ”
বেলা দুপাশে ঘাড় নাড়িয়ে সায় জানালো বাবার কথায়। রহমান সাহেব আমেনার দিকে একপলক রাগীচোখে তাকিয়ে হনহন করে আবার বাইরের দিকে চলে গেলেন। বেলা বাজারের ব্যাগটা মায়ের কাছে এনে দিয়ে বলল,
“ আব্বুর কথায় মন খারাপ করিও না। বৃষ্টি আপার কাজকর্ম দেখে যে কেউ এভাবে বলবে। ওর এই বাজে স্বভাবগুলো করেছে তোমার বুড়ি শ্বাশুড়ি। আমি বুঝি না! আমার বাবা-চাচ্চু কত ভালো মানুষ অথচ তাদের মা হয়ে বুড়িটা এতো পাজি। কেনো আম্মু?”
-“ কই লো লাটসাহেবের বেটিহগ্গল! ডাক পারতাছি কখন থিক্কা কারো খোঁজ নাই! একটারেও মানুষ বানাবার পারে নাই। আমার বৃষ্টিটা ছাড়া সবডিরেই অমানুষ করতাছে। বেলা গড়াইয়া যাইতাছে একডা বুড়ি মান্নুষ না খাইয়া রইছে কারো হুশ নাই। বৃষ্টি.. ও বৃষ্টি.. মনু দাদির কাছ থিক্কা একটু শুইনা যা বইন! বৃষ্টিরে..”
চোখ উল্টালো বেলা। -“ দেখলে, অবশ্য ঠিকি বলছে বুড়ি। বৃষ্টি আপার মতো ভালো নাতনি এ জীবনে চোখে দেখে নাই সে। আসলে বুড়ির কোমরের সাথে ব্রেইনও হেলে গিয়েছে। যাক গে, আমি বাগানে গেলাম, তুমি গিয়ে তোমার শ্বাশুড়ির খেদমত করো। ”
কথা শেষে এক দৌড় লাগালো বেলা। আমেনা কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে ছোট জা কে রান্নার দ্বায়িত্ব দিয়ে শ্বাশুড়ির রুমের দিকে গেল।
সকাল গড়িয়ে দুপরের শেষভাগ চলছে। তালুকদার বাড়ি থেকে মিতালী, ওর স্বামী জয়নাল তালুকদার, দিগন্তের বাবা জুনায়েদ তালুকদার, দিহান, দিশা, দিগন্তের দাদা-দাদি দিলদার তলুকদার আর রকেয়া তালুকদার সবাই এসেছে অনেকক্ষন আগেই। খাওয়ার পাট চুকিয়ে লিভিংরুমে বসেছে সবাই। সবার মাঝে শাড়ি পরিহিত বাণী গুটিসুটি মেরে বসে আছে। যদিও সব নিজের মানুষ তাও এই সময় লজ্জাটা যেন বেশ করে ঘিরে ধরেছে ওকে। চোখ-মুখে কেমন লাজুকতা ছড়িয়ে গিয়েছে। দিহান একদৃষ্টিতে বাণীর সেই লাজুক রাঙা মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। বাণীকে সেই ছোট থেকে পছন্দ করে ও। কিন্তু কখনো প্রকাশ করেনি। দিহান খুব চাপা স্বভাবের একটা ছেলে। বাণীকে যে ও পছন্দ করে এ কথা না কাউকে বলেছে, আর নাইবা কাউকে কখনো বলতে পারত। অথচ ভাগ্যের পরিহাসে আর মিতালীর হুট করে নেওয়া সিদ্ধান্তের জোরে, গোপনে একতরফা ভালোবেসে চুপ করে লুকিয়ে থাকা প্রেমিক দিহান আজ এসেছে বাণীকে নিজের অর্ধাঙ্গিনীরূপে তুলে নেওয়ার দিন-তারিখ ঠিক করতে। কিছুটা স্বপ্নের মতোই লাগছে ওর কাছে এসব।
বেলা চুপটি করে বাণীর পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বড়রা সব কথায় ব্যস্ত। এর মাঝেই বৃষ্টি মুখে-চোখে ভরা সাজ দিয়ে নিচে আসল। চোখ ঘুরিয়ে সব জায়গায় দেখল, কোথাও নেই দিগন্ত। মিতালীর কাছে এসে বলল,
“ ফুপি দিগন্ত ভাই আসে নি? দেখতে পাচ্ছি না যে। ”
মিতালী কিছুক্ষন ভ্রু কুঁচকে বৃষ্টির উপর নিচ চোখ বুলালো। তারপর ঠান্ডা গলায় বলল, “ আসেনি এখনো। ব্যস্ত আছে কিছুক্ষন পর আসবে। কিন্তু তুমি এতো সেজেগুজে কোথায় যাচ্ছো?”
মেকি হাসল বৃষ্টি। একটু হেলেদুলে বলল, “ কোথাও যাবো না তো। এমনিই হালকা একটু সাজলাম। তোমরা সবাই এসেছো তারউপর বিয়ে বাড়ির মতো আমেজ তাই আরকি। ”
দিশা পাশ থেকে অবাক কণ্ঠে বলল, “ একটু সেজেছো? ”
বৃষ্টি হাসি থামিয়ে বলল, “ কেনো? খারাপ লাগছে আমায় দেখতে? ”
দিশা ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকে বলল, “ না.. না! ভীষণ সুন্দর লাগছে। ”
ভাব যেন দ্বিগুন বেড়ে গেল বৃষ্টির। সকলের সামনে থেকে কিছু না বলেই চলে গেল বাইরের দিকে। রহমান সাহেব চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলেন। এতো বেয়াদপ হয়েছে তার সন্তান! বড়দের সামনে এসে সালাম তো দিলই না, কিভাবে চলে গেল। মাথা কাটা যাচ্ছে তার।
বেশ অনেকসময় নিয়ে আলোচনা শেষে দিহান আর বাণীর বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করা হলো। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহেই শুভকাজটা সেরে ফেলবে। হাতে মাত্র ১২ দিন সময় রয়েছে। সব কথাবার্তা শেষে মিষ্টিমুখ করছে সবাই। এরই মাঝে পাটোয়ারী বাড়ির দরজার দিগন্তের পদযুগলের আগমন হলো। বাইকের শব্দে সবাই ঘুরে তাকালো ওর দিকে। বাণীর পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা বেলা ঘাড় উঁচিয়ে একপলক দেখল। তারপর মুখ বেঁকিয়ে মাথা নিচে নামিয়ে দিল। সবার সামনে দিগন্তের হাতে থাপ্পড় খেয়ে অপমানিত হতে হয়েছে বেলাকে। ষোড়শী রমনীর আতে ঘা পড়েছে মারাত্মকভাবে। ঠোঁটের একসাইড এখনো ব্যাথা করছে। ভেতরের দিকে কেটে গিয়েছে বলে রক্ষে। নাহলে সবাই বুঝত বেলা পাটোয়ারী চড় খেয়ে মান খইয়েছে। সোফার কোণে দুহাত রেখে পা দিয়ে নখ খুঁটতে শুরু করল বেলা। দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ করল। দিগন্ত এসেছে মানে কিছুক্ষন ওকে নিয়ে আদিক্ষেতা চলবে সবার।
সবাই এটা ওটা জিজ্ঞেস করল দিগন্তকে। দিগন্ত ছোট ছোট শব্দে উত্তর দিল। রহমান পাটোয়ারী সোফায় বসেই আছে। মেয়ের ব্যবহারে এমনিই মেজাজ বিকৃত হয়ে আছে, এখন দিগন্তের ব্যবহার দেখে ষোলকলা পূর্ণ হলো। এসেই কেমন ভাব নিয়ে কথা বলছে, এতোগুলো গুরুজন সামনে সালাম-কালাম কিছুই নেই। মিতালী ভাইয়ের মনোভাব ঠিকি বুঝতে পারছে। দিগন্তের কাছাকাছি এসে ওকে চোখ দিয়ে ইশারা করে বলল সালাম দিতে। দিগন্ত ঠোঁট কামড়ে ধরল। একটা বাচ্চা মেয়ের কাহিনীতে ওকে এখন ভালো ছেলে সাজার অভিপ্রায় চালাতে হবে। ভাবলেও বিরক্ত লাগে ওর। যে ছেলে কারো কথা শোনে চলে না, কারো বাধ্যবাধকতা মানে না, সে ছেলেকে এখন রহমান পাটোয়ারীর কাছে পোষ মেনে খোশ আলাপ ছাড়তে হবে।
চোখ বাঁকিয়ে মাথা নিচু করে থাকা বেলাকে দেখল ও। মনে মনে আবারো অসভ্য মেয়ে বলে গালি ছুড়ল। বেলার মুখ দেখলেও মেজাজ একটু ভালো থাকত কিন্তু অপদার্থ মেয়ে মুখটা এমন নিচে হেলিয়েছে যে চুলগুলো ব্যতিত পুরো মানুষটা সোফার আড়ালে ডুবে গিয়েছে। দিগন্ত কয়েক কদম এগিয়ে রহমান পাটোয়ারীর সামনে গিয়ে হালকা আওয়াজে সালাম দিল। কিছুটা নরন হলো রহমানের মন। যতটা খারাপ ভাবে ততোটাও নয়। হালকা হেসে সালামের জবাব দিয়ে বলল,
“ এতো দেরী করলে যে বাবা! বিকাল হয়ে এলো বলে। খাবার-দাবার সব ঠাণ্ডা হয়ে গেল। সবার সাথে আসতে! ”
নরম গলায় কথা বলার চেষ্টা করলেও পারল না দিগন্ত। কিছুটা ভারী আওয়াজে বলল,
“ কাজ ছিল আমার। ”
রহমান মুখ খুলল কিছু বলার জন্য তার আগেই মিতালী তাড়া দিয়ে বলল, “ আমরা তো আছি রাত পর্যন্ত। দিগু যা বাবা, আগে কিছু খেয়ে নে। সেই সকালে না খেয়েই বেড়িয়েছিস। তারপর বেলার দিকে ফিরে বলল, বেলা যা তো মা দিগুকে খাবার বেড়ে দে। আমরা ততোক্ষনে বাকি সবকিছু গুছিয়ে ফেলি। ”
আমেনা হাসফাস করে বলল, “ আপা আমি যাচ্ছি। বেলা ঠিকঠাকভাবে দিতে পারবে না। ”
মিতালী চোখ রাঙিয়ে তাকালো আমেনার দিকে। কড়া গলায় বলল, “ এসব আবার কেমন কথা বড়ভাবি। মেয়ে বড় হয়েছে পরের ঘরে দিতে হবে না! বাণী নাহয় আমার ঘরে যাচ্ছে কিন্তু বেলাকে তো অন্য ঘরে দিবে নাকি! এখন থেকেই এসব না শেখালে পরে কি হবে বুঝতে পারছো। বেলা.. যা দিগুকে ডাইনিং এ নিয়ে গিয়ে খেতে দে। সুন্দর করে সার্ভ করবি কেমন! ”
দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ২
ফুপির কথা রাগ লাগল বেলার। মায়ের দিকে তাকাতেই আমেনা ইশারা করল যেতে। অসহায় বেলার আর কি করার উপায়ন্তর না পেয়ে সোফার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো। মাথা তুলে তাকালো না কারো দিকে, শুধু আস্তে করে বলল,
“ আমার সাথে আসুন। ”