দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৯

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৯
আফরোজা আশা

রাতের নিস্তাব্ধতার মাঝে দিগন্তের জীপটা চলছে। গাড়ি চালানোর ফাঁকে আড়চোখে কয়েকবার বেলার দিকে দেখছে দিগন্ত। মাঝরাস্তায় দিহান আর বাণী একটা ক্যাফেতে নেমেছে। কিছুক্ষন একা সময় কাটিয়ে আসবে। জীপে আপাতত দুজন মানুষের উপস্থিতি। যত সময় যাচ্ছে গাড়ির গতি বাড়ার থেকে কমছে। আঁধার রজনী ল্যাম্পপোস্টের আলোয় আলোকিত হয়ে রয়েছে। ঘাড় বাঁকিয়ে ছেড়ে যাওয়া একের পর এক ল্যাম্পপোস্টগুলো দেখছে বেলা। জীপটা একটা মোর এ বাঁক নেওয়ার সময় হঠাৎ চিৎকার করে উঠল ও। ওর চিৎকার শুনে সহসা ব্রেক কোষল দিগন্ত। কিছুটা অস্থির হয়ে বেলার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,

‘ কি হয়েছে? ঠিক আছিস? ব্যাথা পেয়েছিস কোথাও? ’
বেলা মাথা ঝাঁকিয়ে না বলল। স্বস্তির শ্বাস টানল দিগন্ত। পরক্ষনেই বেলার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিল,
‘ কিছু হয় নি তাহলে এভাবে ষাঁড়ের মতো চেঁচালি কেনো? ’
বেলা আঙুল উঁচিয়ে মোড়ের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা, গোলাপি মিশেলে হাওয়াই মিঠাই এর দিকে তাক করল। কণ্ঠে একরাশ আবদার এনে দৃষ্টি হাওয়াই মিঠাই এর দিকে রেখে বলল,
‘ ওগুলো নিবো। একটু দাঁড়ান না এখানে। ’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মেজাজ খারাপ হলো দিগন্তের। চোখজোড়া বন্ধ করে নিল। দুসেকেন্ড নিরবে থাকার মাঝে হৃদপিণ্ডের অস্বাভাবিক ধড়ফড়ানি টের পেল। ঝট করে চোখজোড়া খুলে ফেলল ও।ততোক্ষনে বেলা সিটবেল্ট খুলে ঝাঁপ দিয়ে নিচে নেমেছে। নিচে নেমে দিগন্তের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ একটু অপেক্ষা করুন। আমি যাবো আর আসব। ’
দিগন্ত শুনল ওর কথা। সীটে মাথা এলিয়ে দিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল,
‘ টাকা এনেছিস। ’
টনক নড়ল বেলার। আসলেই তো! ওতো টাকা আনেনি সাথে। টাকা কেনো, কিছুই আনেনি সাথে। শুধু মানুষটা এসেছে। ছোট হয়ে এলো মুখটা। বিড়বিড়িয়ে উত্তর করল,

‘ না। ’
‘ তোর শ্বশুড় লাগে? টাকা ছাড়াই দিয়ে দিবে নাকি। ’
‘ নাহ। ’
‘ তাহলে! আর দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট করিস না। চুপচাপ আগের জায়গায় এসে বস। ’
বেলার মন কেমন ছটফটিয়ে উঠল। মনে একটুখানি আশার আলো নিয়ে দিগন্তকে শুধালো,
‘ আপনার কাছে নেই? ’
বুঝেও না বোঝার ভান করল দিগন্ত, ‘ কি? ’
‘ টাকা। ’
‘ না নেই। ’

মুখ লটকালো বেলা। নিরাশ গলায় বলল, ‘ ওহ! আপনিও আমার মতো ফকির। ’
চুউউউ শব্দ করল দিগন্ত। বেলার দিকে বিরক্তিকর দৃষ্টি ছুড়ে বলল, ‘ জ্বি না। আমার পকেট ভরা আছে কিন্তু তোর এসব বাচ্চামো খাবারের জন্য সিকি পরিমাণও ব্যয় হবে না। ’
‘ কেনো? কি দোষ করেছে ওগুলো? ’
‘ ওদের দোষ নেই। সব দোষ তোর আর তোর বাপের। ’
‘ আমার আব্বু আবার কি করল? ’
রাগী গলায় দিগন্ত বলল, ‘ তোর মতো একটা নাদান এনেছে পৃথিবীতে। ’
দিগন্তের কথার সারমর্ম বুঝল না বেলা। অবুঝ গলায় বলল,
‘ কিভাবে? ’
বেলার প্রশ্নে বাঁকা চোখে ওর দিকে চাইল দিগন্ত। গম্ভীর গলায় বলল, ‘ তুই না সায়েন্স এর স্টুডেন্ট? ডিএনএ চ্যাপ্টার নাই তোর বইয়ে? ’

‘ হ্যাঁ আছে জীববিজ্ঞান এ। ’
‘ তাহলে আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কেনো? কিভাবে! ’
মুহূর্তেই বেলা একগাল হেসে বলল, ‘ ও চ্যাপ্টার তো আমি স্কিপ করেছি। প্রথমেরগুলো যা পড়েছি সেখান থেকেই কমন পাবো তাই ওটা বাদ রেখেছি। ’
দাঁতে দাঁত চাপলো দিগন্ত। রাগে শরীর-মন জ্বলে উঠল। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠল,
‘ উঠ! গাড়িতে উঠ! অসভ্য মেয়ে মানুষ। যেটা পড়া দরকার সেটা পড়বে না! আজ বাড়ি ফিরেই ওই চ্যাপ্টার শেষ করবি। কাল যদি শুনেছি শেষ করতে পারিস নি তাহলে কানের গোড়া নড়িয়ে দেবো, বেয়াদব। ’

‘ বেয়াদব বলবেন না। এটা শুনতে পঁচা লাগে। আমি তো অনেক ভালো মেয়ে, বেয়াদব নই। ’
‘ আলবাৎ বেয়াদব। তুই বেয়াদব, তোর চৌদ্দ গুষ্টি বেয়াদব। ’
হুট করে বেলাও রেগে গেল। ছোট চোখজোড়া পাকিয়ে তাকালো দিগন্তের দিকে। ফুঁসে উঠে বলল,
‘ একদম বেয়াদব বলবেন না। আমার চৌদ্দ গুষ্টি অনেক ভালো। আমিও ভালো। ’
‘ তাই না কি! ’
‘ হুমউউ, তাই। আপনি চেনেন না আমাকে! ’
‘ নাহ। চিনি না। তোকে চিনে আমার লাভ? ’
নিভে গেল বেলা। মুখটা খাটো হয়ে গেল। আসলেই তো! ওকে চিনে দিগন্তের কি হবে। কিছু বলল না আর। ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে সাদা-গোলাপি হাওয়াই মিঠাইগুলোতে অসহায় দৃষ্টি ফেলে গাড়িতে উঠে বসল। মুখ লটকিয়ে চুপ করে রইল। তা দেখে দিগন্ত না ভঙ্গিতে দুপাশে মাথা নাড়িয়ে বিড়বিড়ালো,

‘ তোকে তুইও ততোটা চিনিস না , যতটা আমি চিনি। আস্ত বেয়াদব হচ্ছে দিন দিন, গাধাটা। ’
তারপর হাত নাড়িয়ে একটু দূরে হাওয়াই মিঠাই হাতে দাঁড়িয়ে থাকা মাঝ বয়সী ছেলেটাকে ইশারায় ডাকল। দিগন্তের ইশারা পেয়ে ছেলেটা মুহূর্তের মাঝেই হাজির হলো ওদের কাছে। পান চিবানো লাল দাঁত বের করে সালাম ঠুকল দিগন্তের উদ্দেশ্যে। বিগলিত ভঙ্গিতে খ্যাস খ্যাস গলায় বলল,
‘ ভাই! অনেক দিন পর দেখা পাইলাম। কেমন আছেন, ভাই? ’
দিগন্ত মাথা নাড়িয়ে গম্ভীর স্বরে আওড়ালো, ‘হু।’
তারপর ছেলেটাকে বলল, ‘ ওর হাতে দু’রঙের দুটো দিয়ে বাকিগুলো গাড়ির পেছনে রাখ। ’
দিগন্তের কথা কর্ণপাত হতেই কণ্ঠে একরাশ বিস্ময় নিয়ে বলল বেলা , ‘ এতোগুলো মিঠাই কি হবে? ’
‘ তুই সহ তোর চৌদ্দগুষ্টি খাবি। ’

দিগন্তের কথায় ঠোঁট উল্টালো বেলা। ছেলেটাও অবাক গলায় বলল, ‘ আগের গুলা শেষ হইছে। নতুন কইরা পুরা ঝুড়ি ভরাইয়া নিয়া বের হইছি এখনি। আপনে এতোগুলা নিবেন, ভাই? ’
দিগন্ত আগের মতোই গম্ভীর গলায় বলল, ‘ হুম। বেশি কথা না বলে যা বলেছি তা কর। ’
ছেলেটা ওর হাতের বড় ঝুড়িটা থেকে একটা সাদা, আরেকটা গোলাপি মিঠাই বের করল। বেলাকে দেওয়ার জন্য ওর দিকে হাত বাড়াতে যাবে তখনি দিগন্ত বলে উঠল, ‘ থাম। ’

এদিকে বেলা নিরব দর্শকের মতো টুকুর টুকুর চোখে একবার ছেলেটার হাতের মিঠাইগুলো দেখছে, আরেকবার দিগন্তকে দেখছে। ওগুলো নেওয়ার জন্য তড় সইছে না মনে। দিগন্ত একটু হেলে গিয়ে ছেলেটার হাত থেকে মিঠাই দুটো নিয়ে বেলার দিকে বাড়িয়ে দিল। বেলা ছোঁ মেরে নিয়ে নিল ওগুলো। চোখ-মুখে খুশির ঝলক উপচে পড়ছে। হেলে যাওয়ার দরুন বেলার অনেকটা কাছাকাছি এসেছে দিগন্ত। কাছ থেকেই দেখল বেলার আনন্দিত মুখাবয়ব। ঠোঁট এলিয়ে হাসতে চেয়ে হাসল না। নিজের সীটে বসে ছেলেটাকে বলল বাকিগুলো গাড়িতে দিতে। ছেলেটা তাই করল। সমস্ত মিঠাইগুলো পেছনের সীটে রেখে দিগন্তের পাশে এসে দাঁড়াল। লাল টকটকে দাঁত কপাটি বের করে হেসে বলল, ‘ দিছি ভাই। আর কিছু লাগবো? ’
দিগন্ত মানিব্যাগ থেকে চকচকে এক হাজার টাকার দুটো নোট বের করে ছেলেটার হাতে দিয়ে বলল, ‘ নাহ। বাড়ি চলে যা। ’

টাকাগুলো দেখে চোখজোড়া চকচক করে উঠল ছেলেটার। মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল,
‘ হো ভাই, বাড়ি যামু। একটু সবার সাথে আড্ডা দিয়া লই। তারপর সোজা বাড়ি যামু। ’
শুনল ওর কথা দিগন্ত। তারপর গাড়ি স্টার্ট দিল। আর তাকালো না বেলার দিকে। এদিকে দুহাতে দুটো হাওয়াই মিঠাই নিয়ে খুশিতে আত্মহারা বেলা। কোনটাকে সে আগে খাবে সেই ভাবনা ডুবে গিয়েছে।
দূর থেকে একজোড়া চোখ গভীর দৃষ্টি মেলে দেখল ওদের। দিগন্তের জীপ চলে যেতেই গাড়ির কাঁচ নামালো ফাহাদ। বদমেজাজি, রাগী, কাঠখোট্টা দিগন্ত তালুকদার একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে এতো কথা বলছে ব্যাপারটা সুবিধার ঠেকল না ওর নিকট। বেলাকে চিনতে একটুও অসুবিধা হয় নি ওর। সেদিন থেকে খুঁজে বেড়াচ্ছে ওকে। আর আজ পেল তাও দিগন্তের সাথে। কিছু একটা ভেবে পকেট থেকে ফোন বের করে কাউকে গুরুগম্ভীর গলায় বলল, ‘ সব ডিটেলস দিতে বলেছিলাম মেয়েটার। ওগুলো এখনি পাঠা। এক ঘণ্টার মধ্যে সব চাই আমার। ’
বলে ফোনটা ছুড়ে মারল পাশের সীটে। বেলাকে দিগন্তের সাথে দেখে কেমন ছটফট লাগছে ওর। মাথার চুলগুলো পেছনের দিকে ঠেলে দিয়ে জোরে টেনে ধরল। চোখ বন্ধ করতেই আবারো ভেসে উঠল বেলার ভয়াতুর চেহারার কান্নারাত চোখজোড়া। আনমনেই মুচকি হাসল ফাহাদ।

ভোরের স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পড়েছে প্রকৃতির বুকের। সূর্যের আলো আস্তে ধীরে আছড়ে পড়ছে পৃথিবীতে। এই ভোর সকালে পাটোয়ারী বাড়িতে ধুমছে কাজ চলছে। চলবেবে নাই বা কেনো! আজ বাণীর গায়ে হলুদ। হলুদের সবকিছু আয়োজন ছাদে করা হয়েছে। আর রান্নাবান্নার আয়োজন করেছে বাড়ির পেছনের দিকে বাগানে। এতো সকালেও পুরো বাড়ি মানুষজনে ভর্তি। এতো এতো সাড়া-শোরগোলের মাঝে দুটো রুমের দরজা আটকানো। একটা বৃষ্টির আরেকটা বেলার। বৃষ্টিকে আটকে রেখেছে রহমান পাটোয়ারী তবে এটা বাড়ির মানুষ ছাড়া কারো বোঝার ক্ষমতা নেই। আর বেলা দরজার খিল দিয়ে পাগলের মতো পড়ছে।

গতকাল রাতে শপিং শেষে যখন ওদের নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিল তখন দিগন্ত ওকে বারবার ওয়ার্নিং দিয়েছে ডিএনএ রিলেটেড চ্যাপ্টারটা শেষ করার। সাথে ঘুষ হিসেবে সব মিঠাইগুলো ওর রুমে পাঠিয়েছে। বেলার পরীক্ষা দেখে ওর রুমের দিকে কোনো ভেজাল নেই। পুরো বাড়ি মানুষে ভর্তি থাকলেও বেলার রুমের এদিকটা কোনো রূপ সাড়াশব্দ করা বারণ। এর জন্য কঠোর নির্দেশ দিয়েছে রহমান পাটোয়ারী। এক মেয়ের বিয়ের জন্য আরেক মেয়ের পড়ার ক্ষতি হতে দিতে নারাজ তিনি।

পড়ার তালে ঝকছে আর খাচ্ছে বেলা। কিছুক্ষনের মধ্যে শেষ করতে হবে। তারপর দুদিন আর বই হাত দিয়েও ছুঁবে না। বোনের বিয়েতে কেউ আবার পড়াশোনা করে নাকি! পরীক্ষা ভার মে যাক, আগে বিয়ে শেষ হবে তারপর পড়াশোনা। টানা আরো তিন ঘণ্টা সময় নিয়ে পড়া শেষ করল বেলা। চারদিকে খোলা বই, খাতাগুলো সুন্দর করে গুছিয়ে নিল। বায়োলজি বইটা ঠিক করে রাখতে গিয়ে আবারো মনে পড়ল দিগন্তের হুমকিটা,
‘কাল যদি শুনেছি শেষ করতে পারিস নি তাহলে কানের গোড়া নড়িয়ে দেবো, বেয়াদব।’

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৮

আর বেয়াদব উপাধি শুনতে চায় না বেলা। সে নিতান্তই ভালো মেয়ে। তাই পড়া শেষ করেছে। কিন্তু বুঝে পড়ে নি কিছুই। ঝাড়া মুখস্থ করেছে। তাতে কি! দিগন্ত বলেছে চ্যাপ্টার শেষ করতে, সোজাসাপ্টা বেলা পাটোয়ারী তাই করেছে। মুখস্থ করুক আর বুঝে পড়ুক এখন আর বেয়াদব বলতে পারবে না দিগন্ত!

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ১০