দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ১৫

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ১৫
আফরোজা আশা

সারাদিন পড়ার টেবিলের সাথে আঠার মতো লেগে আছে বেলা।বাণীর বিয়ের এক সপ্তাহ হয়ে গিয়েছে। বেলার হাতে আর মাত্র চারদিন বাকি। তারপর এসএসসি শুরু। সারাদিন অনেক পড়েছে। এখন প্রায় বিকেল হয়ে এসেছে। গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ছে বেলা। এর মাঝে চোরা দৃষ্টিতে চারপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে আস্তে করে বেলার রুমে আসল বৃষ্টি। বেলার টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই চমকে উঠল বেলা। সারাক্ষণ সুন্দরভাবে সাজেগুজে বেড়ানো বৃষ্টির চেহারার অবস্থা কেমন বিশ্রি হয়ে গিয়েছে। চুলগুলো উস্কোখুস্কো হয়ে কেমন পাগলের ন্যায় ঠেকছে। চোখের নিচে গাঢ় কালো দাগ পড়েছে। বৃষ্টি হড়বড়িয়ে বেলার হাত টেনে ধরে ওর হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিল। ফিসফিসিয়ে বলল,

‘ এটা! এই কাগজটা নিয়ে বড় রাস্তার মোরে যাবি এখন। আমার একটা বন্ধু অপেক্ষা করছে। ওর হাতে দিবি এটা। ’
‘ বৃষ্টি আপা! এতে কি আছে? ’
মনে মনে ক্ষোভ হলো বৃষ্টির কিন্তু বাহিরে নরম থাকলো। এখন বেলাকে কিছু বলা যাবে না। নাহলে নিজের কাজ হবে না যে!
‘ এটাতে আমার প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো নোট করা আছে। আমার ফ্রেন্ড চেয়েছে। আমাকে তো আব্বু বের হতে বারণ করেছে। নাহলে আমিই দিয়ে আসতাম। যা না বেলা! একটু তাড়াতাড়ি যা! আমার ফ্রেন্ড তোকে চিনে। তুই শুধু মোরের কাছে যা। ’
বোকা বেলা ভাবল হয়তো আসলেই আপার পড়াশোনার জন্য প্রয়োজনী কিছু আছে এতে। তাই বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘ আচ্ছা আপা। আমি একটু পরে যাবো। ’
বৃষ্টির মন চাইছে বেলার গলা চেপে ধরতে। বাড়িতে কেউ নেই এখন। এটাই সুযোগ। আর এই মেয়েটা নাটক করছে। শক্ত গলায় বলল বৃষ্টি,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘ না। পরে না। এখনি যাবি তুই। ’
‘ কিন্তু…’
কেমন করে যেন গর্জে উঠল বৃষ্টি। বেলার দিকে হিসহিসিয়ে বলল, ‘ যেতে বলেছি মানে যাবি। এখনি যাবি। যা বলছি। ’
বৃষ্টির এরকম অস্বাভাবিক আচরণে ভয়ে কুকড়ে গেল বেলা। চেয়ার থেকে উঠে রুমের বাহিরে ছুটে এলো। বাড়িতে কেউ নেই। সবাই হাসপাতালে গিয়েছে। বেলার দাদির হুট করে শ্বাস কষ্ট শুরু হয়েছিল। তাই বাড়িতে এখন শুধু ও আর বৃষ্টি আছে। ভয়ে থর থর করে কাঁপছে বেলা। হাতের মুঠোয় থাকা কাগজটা এক পলক দেখে নিয়ে বাহিরের দিকে পা বাড়ালো। উদ্দেশ্য বড় রাস্তার মোরে গিয়ে এটা বৃষ্টির ফ্রেন্ডের হাতে দিবে। এটুকুর জন্য কেমন করল বৃষ্টি ওর সাথে। ছোট মনটাতে বোনের জন্য অনেক অভিমান জমা আছে বেলার।

বেশ কিছুক্ষন হাঁটার পর চলে এলো মোরের কাছে। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল। কিন্তু অপেক্ষারত কোনো মানুষ নজরে এলো না। হঠাৎ পেছন থেকে একটা ছেলে ডাকল ওর নাম ধরে। বেলা চকিত সেদিকে তাকালো। তাতক্ষনাৎ ভয়ে দুটো শুকনো ঢক গিলল। এই লোকটা বৃষ্টি আপার ফ্রেন্ড! দেখতে তো কেমন বিচ্ছিরি লাগছে। কেমন যেন মাতাল-গুন্ডা প্রকৃতির লোকটা। গলায় ইয়া বড় বড় মালা ঝুলছে। মুখের মধ্যে একটা কাঠি ঢুকিয়ে রেখেছে, সাথে ইয়া বড় বড় চুল। এটা দেখতেই কেমন গা গুলাচ্ছে বেলার।
লোকটা আবারো খ্যাঁস খ্যাঁস গলায় বলল, ‘ তুমি বৃষ্টির বোন না?’

‘ জ..জ্বি। ’
লোকটা কেমন নজরে যেন তাকালো বেলার দিকে। ভালো লাগল না ওর। গুটিয়ে নিল নিজেকে। হাত বাড়িয়ে কাগটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ এই যে বৃষ্টি আপা দিয়েছে। ’
এদিকে লোকটা লোভাতুর চাহনি দেখছে বেলাকে। বেলার এগিয়ে দেওয়া হাতটা ইচ্ছাকৃতভাবে স্পর্শ করে কাগজটা নিল।ছিটকে হাত সরিয়ে নিল বেলা। লোকটাকে একদম ভালো লাগছে না ওর। কোনো কথা না বলে পিছু ঘুরে চলে যেতে চাইলে সামনে আরো দুটো ছেলে এসে দাঁড়ালো।
ভয়ে বেলার কলিজা শুকিয়ে গেল। কাঁপাকাঁপা গলায় বলল,
‘ স..সরে দ..দাঁড়ান। আমি য..যাবো। ’

ছেলেগুলো কেমন বিকৃতভাবে হাসল। বেলার কানে খুব নোংরা লাগল হাসির আওয়াজ। হাসফাস করতে করতে চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকালো। মানুষজন খুব একটা নেই। আজ শ্রমিক দিবস। দোকানপাট সব বন্ধ। সাথে গাড়ি-ঘোড়াও চলছে না তেমন একটা। বেলার মন কেমন কু ডাকছে। পিছন ফিরে বৃষ্টির ফ্রেন্ডটার দিকে তাকালো। ভয়ার্ত গলায় বলল,
‘ ভাইয়া আমাকে একটু বাড়িতে এগিয়ে দিবেন। ওই ছেলেগুলো কেমন পথ আটকে দাঁড়িয়েছে। ’
যার কাছে সাহায্য চাইলো বেলা সেই যে ওদের এনেছে এটা তো বোকা বেলা জানে না। কাঠি দিয়ে দাঁত গুতিয়ে লোকটা বলল,
‘ আহহ! তোর মতো একটা খাসা মেয়েকে এতো দেরি করে পাঠালো বৃষ্টি। ’
‘ কি বলছেন ভাইয়া? ’
পেছনের ছেলে দুটো বেলার কাছে এসে খুব বিশ্রি শব্দ উচ্চারণ করল। যেগুলো বেলার কানে বিষের ন্যায় ঠেকল। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল নোনতা পানি।
একজন বলল,‘ বুঝোস না কি বলে? তুই মা*টা হেব্বি সুন্দর। আজ রাইতে আমাগো পার্টি হবে। ’

আরেকজন বলল, ‘ হো। ভাই আগে কিন্তু আমাগো ভাগ দিবেন তারপর ওরে কালাবাড়িত দিয়া আইবেন। দেখলেই তো লোভ লাগতাছে ভাই। শরী*লডা কি সুন্দর! ’
সব কথার মানে না বুঝলেও শব্দগুলো যে খারাপ সেটা ঠিকি বুঝতে পারছে বেলা। পালানোর জন্য ছুটতে গেলেও পারল না। পেছন থেকে একজন ওর হাত ধরে আটকালো। ছটফট করতে লাগল বেলা। মুখ খুলে চিৎকার করে চাইলে আরেকজন ওর মুখের সামনে একটা কাগজ ধরল। অচল হয়ে গেল বেলা। শরীরের ভর ছেড়ে দিল। ধপ করে শব্দ তুলে পড়ে গেল মাটিতে। শরীর একদম অবশ হয়ে গিয়েছে। চোখ দুটো জোড়া লাগানোর আগে দূর থেকে ভেসে এলো মাগরিবের আজানের ধ্বনি। তারপর আর চোখ খুলে রাখতে পারল না। দুচোখের পাতা এক হয়ে গেল।

ধরণীগাত্রে সন্ধ্যা নেমেছে কিছুক্ষন আগে। রাসেল পাটোয়ারী রিনা পাটোয়ারীকে নিয়ে মাত্র বাড়ির সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। হাসপাতালে বেলার দাদীর কাছে এখন রহমান আর আমেনা আছে। বাড়িতে দুটো মেয়েকে একা রেখে গিয়েছে তাই রিনাকে বাড়িতে রাখতে এসেছে রাসেল। সবার জন্য খাবার নিয়ে আবার হাসপাতালে যাবে সে। রান্না-বান্না করা হয় নি তেমন। রিনা পরণের পোশাক পাল্টে গলা ছেড়ে ডাকল বেলাকে কিন্তু কোনো সাড়া পেল না। রাসেল স্ত্রীকে রান্না শুরু করতে বলে বেলার রুমের দিকে গেল। তবে যাওয়ার আগে বৃষ্টির কাছে গিয়ে দেখল ও ঘুমিয়ে আছে। বাড়ির তিনটা মেয়েই রাসেলের কাছে খুব আদরের।

নিজের সন্তান নেই তাতে ওর আফসোস হয় না খুব একটা। ছোট আব্বুর অন্তপ্রাণ তিন মেয়ে আছে তার। কিন্তু বড় হয়ে বৃষ্টিটা কেমন যেন হয়ে গেল। কারো সাথেই ঠিকভাবে মিশে না। বৃষ্টির পাশে বসল রাসেল। নীরবে কিছুক্ষন মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। বৃষ্টি ঘুমিয়েছে ভেবে আর কিছু খেয়াল করল না। বেলার রুমে দিক গেল। রুমে ঢুকে চারপাশে চোখ বুলালো কিন্তু কোথাও নেই বেলা। পড়ার টেবিলে বই খাতা পরে আছে। কয়েক বার ডাকল, কোনো সাড়া নেই। ওয়াশরুম, রুমের সাথে ফুলগাছে ভর্তি ছোট বেলকনিটা দেখলো, পেল না। কেমন যেন খটকা লাগছে রাসেলের মন। তড়িঘড়ি করে পুরো বাড়ি খুঁজল। আশপাশের কয়েকটা জায়গায় খুঁজল কোথাও নেই বেলা। রাসেলের বার বার উপর নীচে যাওয়া দেখে রান্নাঘর থেকে বের হলো রিনা। রাসেলের চোখমুখ কেমন শুকনো লাগছে। রিনা ভাবল হয়তো মা কে নিয়ে রাসেল চিন্তিত অনেক। স্বামীর কাছে গিয়ে বলল,

‘ আম্মাকে নিয়ে আপনি কি খুব চিন্তা করছেন? এখন তো আম্মা আগের থেকে ভালো আছে। সুস্থ হয়ে তাড়াতাড়ি এতো চিন্তা করবেন না। ’
রাসেল স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ভয়ার্ত গলায় হাফাতে হাফাতে বলল,
‘ বেলাকে কোথাও পাচ্ছি না। পুরো বাড়ি আশপাশ সব জায়গায় খুঁজলাম নেই ও। ওতো কাউকে কিছু না বলে বাইরে যাওয়ার মেয়ে না। ’

চমকে উঠল রিনা। বাড়িতে আসার পর থেকেই বেলাকে ডাকছে কিন্তু কোনো সাড়া নেই। কোনো কথা না বলে রাসেলকে পাশ কাটিয়ে বেলার রুমের দিকে ছুটল। সবকিছু চেক করল আবার। তারপর বৃষ্টির কাছে গিয়ে ওকে জোরে জোরে ডাকতে লাগলো। অনেক ডাকাডাকির পরও ঘুম ভাঙল না বৃষ্টির। অবাক হলো রিনা। এতো ডাকার পরও মানুষ কিভাবে ঘুমিয়ে থাকতে পারে। কেমন যেন কু ডাকছে মন। পাশের টেবিল থেকে পানির জগটা হাতে নিতে গিয়ে চিৎকার করে উঠল ও। ওর চিৎকার শুনে রাসেলেও দৌড়ে এলো রুমে। টেবিলে পরে থাকা ঘুমের ওষুধের পাতাটা হাতে তুলে নিয়ে কাঁদতে লাগল। বুঝতে বাকি নেই বৃষ্টি কেনো উঠছে না এতো ডাকাডাকির পরও। রাসেল আসতেই রিনা আহাজারি করে বলল,

‘ বৃষ্টি যে ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিয়েছে। কতগুলো ছিল তা তো আমি জানি না। এগুলো তো আম্মার ওষুধ, ভাবি খাওয়ায় প্রতিদিন। মেয়েটাকে বাঁচাও গো। ’
দিশেহারা হয়ে পড়ল রাসেল পাটোয়ারী। কি করবে না করবে মাথা কাজ করছে না। কোনো মতে রহমানের নাম্বার ডায়াল করে ওকে ফোন লাগালো। শর্টকার্টে বলল বৃষ্টি সুইসাইড করেছে আর বেলাকে খুঁজে পাচ্ছে না। সব শুনে রহমানের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। একপাশে মা আরেকপাশে দুই মেয়ে। কোনদিকে যাবে! রাসেল আর রিনাকে বলল বৃষ্টিকে নিয়ে এখনি হাসপাতালে আসতে। তাই করল তারা। আসার সময় বাড়ির গাড়ি নিয়ে এসেছিল। দুজনেই বৃষ্টিকে ধরাধরি করে গাড়িতে আনল। রাসেল ড্রাইভিং সীটে বসে তাড়াহুড়ো করে গাড়ি স্টার্ট দিল। পেছনে বৃষ্টির মাথা কোলের মাথা নিয়ে ওকে ডাকছে আর কাঁদছে রিনা। কিছুক্ষনের মাঝেই হাসপাতালে পৌঁছে গেল। রহমান আর আমেনা মেয়ের কাছে এসে আসল তাতক্ষনাৎ। আমেনা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বুক ফাটিয়ে কাঁদতে লাগল। নারী ছেঁড়া ধন কিনা ওর সামনেই পরে আছে নিথর হয়ে। রহমান আমেনাকে সরিয়ে বৃষ্টির চিকিৎসার ব্যবস্থা করল তাড়াতাড়ি।
হাসপাতালের সামনে এসে থামল দিগন্ত। জীপ থামাতেই মিতালী নামল। দিগন্তের দিকে ফিরে বলল,

‘ ভেতরে চল। আম্মার সাথে দেখা করে আবার চলে যাস। ’
দিগন্ত গম্ভীর গলায় উত্তর দিল, ‘ আমি গিয়ে কি করব? ওই বুড়ি আস্ত একটা শ…’
‘ দিগুউউউ! ’
থেমে গেল দিগন্তের মুখ। মিতালীর দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে দেখল রাগে ফুঁসছে। তবুও ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল,
‘ তোমার মা হলে কি হবে? বুড়িটা এক নাম্বারের বজ্জাত। ওই বজ্জাতের পেট থেকে বের হওয়া তিনটা আবারো ভালোই।’
বলেই মিতালীকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে জীপ ছেড়ে দিল।
পেছন থেকে মিতালী রাগে কটমটিয়ে বলল,
‘ একবার আয় শুধু আজ বাড়িতে। ভুলেও যদি নাক-মুখ ফাটিয়ে এসেছিস তাহলে হাঁড়ে হাঁড়ে টের পাবি আমি কত ভালো। ’
মিররে মিতালীর রাগী চেহারা দেখে ঠোঁট কামড়ে হালকা হাসল দিগন্ত। মিতালীর কথাগুলো কানে গেল ওর কিন্তু কিছু বলল না।

আপন মনে গাড়ি চালাতে শুরু করল। খোলা জীপটা বেশ জোরে ছেড়েছে। রাস্তা-ঘাট ফাঁকা আরামে চালাচ্ছে। শোঁ শোঁ করে বাতাস এসে গায়ে লাগছে। কিন্তু মন-মেজাজ কেনো যেন ভালো নেই তাই পরিবেশটা উপভোগ করতে চাইলেও পারছে না। পাশের সীটে অবহেলায় পরে থাকা ফোনটা হাতে নিয়ে পাসওয়ার্ড খুলতেই বেলা আর প্রত্যাশার হাত ধরে বাড়ির ভেতরে যাওয়ার একটা ছবি ভেসে উঠল। ছবিটা একপলক দেখে ফোনটা আগের জায়গায় ছিটকে দিল। ফলস্বরূপ বন্ধ হয়ে গেল ফোন। কিন্তু ফোন যে বন্ধ হলো সেটা ঘুণাক্ষরেও টের পেল না দিগন্ত। অকারবেই মনটা অশান্ত হয়ে আছে। আশান্ত মন নিয়েই বাতাসের ঝাপটা গায়ে লাগাতে লাগাতে বিড়বিড়িয়ে বলে উঠল,
‘ আহহ! বেয়াদব মেয়ে বড় হো তাড়াতাড়ি। এই পরিবেশে বউয়ের অভাব বোধ এর জন্যই হয়তো মনে শান্তি নাই আমার। তোকে যদি একদিনে বড় করে দেওয়া যেতো তাহলে দুনিয়ায় আমার থেকে খুশি কেউ হতো না রে। সব দোষ তোর বাপের। তোর বাপের জন্যই তুই এতো দেরি করে এসেছিস। নাদান জন্ম দিয়েছে তোর বাপ আর কষ্ট পাচ্ছি আমি। শালার জীবন আমার!’

টং ঘরের সামনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে দুই দল। দুই দলেরইই সবার হাতে হকিস্টিক। দিগন্ত আর ফাহাদ দুজন দুজনের দিকে অগ্নি চোখে তাকিয়ে আছে। দুটো আগুনের ফুলকি একে অপরকে গ্রাস করতে চাইছে। ফাহাদ রাগী গলায় হুংকার ছুড়ল,
‘ বলেছি না, এদিকে আসবি না তোরা। কোথা কানে ঢুকে না নাকি। টংঘরের ওদিকেই তোদের শেষ সীমানা। এদিকে পা বাড়াস কোন সাহসে! ’
দিগন্ত গমগমে গলায় হুংকার ছাড়ল,
‘ কেনো? টং ঘর কি তোর বাপের নামে লেখা? শালা পুঁতে দেই এখানে? ’
ফাহাদ দাপটের স্বরে বলল, ‘মেনে নে দিগন্ত। এক এলাকায় দুই রাজা থাকা যায় না। ’
দিগন্তও একবাক্যে জবাব দিল, ‘ এটা তোর এলাকা না। ’
তারপর আবার ফাহাদকে ব্যাঙ্গ করে বলে উঠল,

‘ নিজেকে রাজা ভাবিস তুই! অবশ্য রাজাই তবে এখানের না মেয়েবাজিতে। মেয়েবাজের রাজার নাম বলতে বললে সবাই বিনা ভাবনাতেই তোর নাম নিবে। ’
চোয়াল শক্ত হয়ে গেল ফাহাদের। তারপর কিছু একটা মনে পড়তেই ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল।
‘ তোর বাপের ক্যারেক্টার সার্টিফিকেটও সবার জানা। কে জানে বাপ যেমন ছেলেও সে রকম কিনা। ’
রাগে মেজাজের খেই হারিয়ে ফেলল দিগন্ত। ফাহাদের কলার টেনে ধরে ঝাঁঝালো গলায় হুংকার ছেড়ে বলল,
‘ লজ্জা লাগে না আবার পুরনো কথা টানছিস। শালা ফেইলিয়ার! তুই আবার মুখ দেখিয়ে বেড়াচ্ছিস। একটা মেয়ে তোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিল সেই তুই আবার বুক ফুলিয়ে আমার সামনে আসিস। পুরুষ নামের কলঙ্ক তুই শালা। ’
মূহুর্তেই ফাহাদের চোখ-মুখ রাগে লাল হয়ে গেল। দিগন্তের মুখ বরাবর দিল এক ঘুষি। ছিটকে গেল একটু দূরে দিগন্ত। ঠোঁটের কোণের বের হওয়া রক্ত মুছতে মুছতে বাঁকা হেসে তাকালো ফাহাদের দিকে। বিড়বিড় করে ঠোঁট নাড়িয়ে আবারো বলল,

‘ ফেইলিয়ার! ’
রক্ত চক্ষু নিয়ে দুহাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলল ফাহাদ। ভুল ও করেছে। অতীত টেনে এনে এখন নিজেই কষ্ট পাচ্ছে।
এদিকে দিগন্ত উন্মাদের মতো চুল টেনে ধরে রেখেছে। রাগ-ক্ষোভ সামলাতে না পেরে শেষ পর্যন্ত পাশের মোটা গাছটাতে সোজোড়ে আঘাত হানল। থেতলে গেল হাতের উপরিভাগের চামড়া। রায়হান মাত্র এসেছে। এসেই দিগন্তের এই অবস্থা থেকে দৌড়ে এলো ওর কাছে। দিগন্ত আবারো গাছে ঘুষি মারতে নিলে ফাহাদ এসে আটকে ধরল ওর হাত। পেছনে এসে দাঁড়ালো রায়হানও। ফাহাদের হাত ঝটকা মেরে সরিয়ে দিল দিগন্ত। দীর্ঘশ্বাস ফেলল ফাহাদ। রায়হানকে দিগন্তের কাছে থাকতে বলে চলে গেল নিজের গাড়ির কাছে। ওর হুকুম পেয়ে ছেলেরাও চলে যেতে বাধ্য হলো।

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ১৪

গাড়িতে বসে স্টারিংয়ের উপর একের পর এক আঘাত করতে শুরু করল। রাগে হিতাহতজ্ঞানশূন্য হয়ে আবারো অতীত টানল। ভালোই তো ছিল সারাদিন। নিজেকে শুধরানোর জন্য কত কিছু করল। অথচ এক নিমিষেই সব নিজ হাতে ঘেঁটে দিল।
অতঃপর গাড়ির সর্বোচ্চ স্পিড তুলে বাউন্ডুলের মতো মনের শান্তি জন্য চলল ফাহাদ। মূহুর্তেই বিষাক্ত হয়ে গিয়েছে শরীর-মন।

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ১৬