মাই লাভ মাই লাইফ পর্ব ১৪

মাই লাভ মাই লাইফ পর্ব ১৪
নাবিলা ইষ্ক

ফুলের তোড়াটা নিয়ে আমি নীরব রইলাম। ওমন একটা কথার কী কোনো জবাব হয়? হয় হয়তো-বা। তবে আমার ভারী লজ্জা লাগছিলো। সবাই কেমন চেয়ে আছে আমাদের দিকে। আংকেল আর বাবা আড়ে আড়ে তাকিয়ে নিজেদের মধ্যে হাসছেন। মা আর আন্টি যে বিড়বিড়িয়ে ‘মাশাআল্লাহ্’ আওড়ালেন তা তার ঠোঁট নাড়ানোতেই বুঝতে পারলাম। আমি দ্রুতো তার পাশ থেকে সরে যেতে চাইলাম তখুনি তিনি বেশ লুকিয়েই লেহেঙ্গার ওড়নাটা টেনে ধরলেন। চোখ দুটো আমার বড়ো বড়ো হয়ে এলো। এতো এতো মানুষ চারিপাশে! উনি কী পাগল? ভয়ার্ত আমি অন্ধের মতন ওড়না টানতে থাকলাম। পিছুও ফেরার সাহস পেলাম না। এতে যেন তাশরিক ভাইয়া আনন্দ পেলেন। দেখলাম ওড়না মুঠোয় গুছিয়ে নিয়েছেন অনেকটা। ঠিক আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়ে আছেন। আরেকটু ঘনিয়ে এলেই ছুঁয়ে যাবে এমন অবস্থা। আমি ফিসফিস করলাম অসহায় গলায় –

‘ছাড়ুন।’
তাশরিক ভাইয়া ভীষণ আশ্চর্য নিয়ে বললেন –
‘তোমাকে ছাড়বো কীভাবে? ধরিইতো নাই। ধরতে বলছো?’
আমি সতর্কতার সাথে সামনে তাকালাম। কেউ তাকিয়ে আছে কি-না! না, সবাইকে বেশ ব্যস্তই মনে হলো। দ্রুতো ওড়না টেনে বললাম –
‘ওড়না ছাড়ুন।’
তাশরিক ভাইয়া হাসলেন। মৃদু স্বরে। মাথাটা নুইয়ে বিড়বিড় করে বললেন –
‘নেকলেসটা মানিয়েছে। আমার ভাবনার চেয়েও।’
রীতিমতো দমবন্ধ হয়ে এলো আমার। কণ্ঠ সামান্য কাঁপল –
‘ধ-ধ… ধন্যবাদ।’
ধন্যবাদটুকু এতো সুন্দর নেকলেসের জন্য দেয়া। কিন্তু উনি কৃতজ্ঞ বোধ তো করলেনই না উল্টো আমার মতন একই সুরে বললেন,
‘ই-ইট..ইটস ওকে।’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ভেঙাচ্ছে! আমাকে ভেঙাচ্ছে! আমার এমন দশা তার জন্যই তো হয়। তিনি কাছে এলেইতো রোগীদের মতো শ্বাস কষ্ট হয়, শরীর কাঁপে। আমি দাঁতে দাঁত পিষে ওড়না জোরসে টান দিলাম। এবার তিনি নিজ থেকে ছেড়ে দিলেন। আমি দ্রুতো কদমে হেঁটে এসে যোগ হলাম সুফিয়াদের সাথে। ওরা অহনা আপুর অপেক্ষা করছে। নিশু ভাইয়াকে স্টেজে বসানো হয়েছিলো। তার বন্ধুরা তাকে নিচে নামিয়ে হাসিঠাট্টায় মেতে উঠেছে। তাশরিক ভাইয়া সেদিকেই গিয়েছেন। স্টেজের এপাশে আমি, ওপাশে তিনি। ওখানে নীরব ভাইয়া… নিশু ভাইয়া, তাশরিক ভাইয়া সহ বাকিদের নিয়ে চিৎকার করে গেয়ে উঠেছেন –
‘আজ মেরে ইয়ার কী শাদি হ্যে…..’
গানের সাথে তাদের ভাইয়াকে ঘিরে একপ্রকার নাচও শুরু। আংকেল হাসতে হাসতে চ্যাঁচালেন এযাত্রায় –
‘মিউজিক ওন করতে বলবো নাকি!’
তাদের বন্ধুদের একজন চিৎকার করে বলল, ‘প্লিইইজ আংকেল। তাড়াতাড়ি!’

আজ মেরে ইয়ার কী শাদি হ্যে গানটা ছাড়া হলো। নিশু ভাইয়া সামনে দাঁড়িয়ে। তাকে ঘিরেই উনাদের সেই কী নাটক! নাটক, ডান্স..ভাইয়ার লেগ পুলিং মিলিয়ে এক অন্যরকম অবস্থা। সবাই আমরা হাসছিলাম তাদের কাণ্ডে। হাসতে হাসতেই আমার নজর গিয়ে পড়ল তাশরিক ভাইয়ার ওপর। এদিকেই চেয়েছিলেন। আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। ঘুরেফিরে ফের তাকালাম। এবারে তিনি ব্যস্তভাবে উনার সাথে বাকিরাও গাইছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই অহনা আপুর এন্ট্রি হয়। তার মাথার ওপরে দোপাট্টা ধরে রাখা হয়েছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে খুব মৃদু আওয়াজে গান বাজছিলো। আমরা সবাই হৈচৈ করে উঠলাম। নিশু ভাইয়া স্টেজে দাঁড়িয়ে ছিলেন। অহনা আপু স্টেজের কাছাকাছি আসতেই তিনি নিজে নেমে আপুকে হাত ধরে উঠালেন। তখন সবাই তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এবারে নিজেদের সিটে বসলেন। তাদের মধ্যে কাপড় দেয়া। তাদের সামনে কাজী বসবেন।

আমি সুফিয়াদের সাথে একদম স্টেজ ঘেঁষে দাঁড়ালাম। তারা একে ওপরকে কবুল বলবেন এই ব্যাপারটা কোনোভাবে মিস করা যাবে না। কাজী বিয়ের খুতবা পাঠ করেন। এরপর জিজ্ঞাসা করেন। ভাইয়া অবশ্য সুস্পষ্টভাবে তিনবার একঝটকায় কবুল বলে ফেলেছিলেন। এতে সবার মধ্যে চাপা হাসি লক্ষ্য করা গেলো। অহনা আপু কিছুটা সময় নিলেও কবুল বলেন। আনন্দে সবাই হৈচৈ করে উঠল। বাবা আর আংকেল পাশাপাশি ছিলেন বলে সেমুহূর্তে দু-জন কোলাকুলি করে ফেললেন। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম আন্টির পাশে। আন্টি আমাকে অহনা আপুর সম্পর্কে বলছিলেন আবেগী হয়ে। তার চোখজোড়া ছলছল করছিলো। মা এসে আন্টিকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। আমি তাদের পেছনে। তাশরিক ভাইয়া কোথা থেকে যেন উড়ে আসলেন আমার পাশে। আমি চমকাতেও পারলাম না। উনি দু-হাত মেলে দিয়ে আদেশে সুরে আওড়ালেন –

‘আসুন বেয়াইন, কোলাকুলি করি।’
আমি দু-পা সরে যেতে নিয়ে আঁতকে উঠে বললাম, ‘ছিহ!’
তাশরিক ভাইয়া আমার চেয়েও আরও নাটকীয় ভঙ্গিতে আঁতকে উঠে বললেন –
‘হোয়াট? ছিহ? কেনো? কোলাকুলি হচ্ছে মিউচুয়াল এফেকশন, মাই বেইবি গার্ল। হুয়াই আর ইউ সো ইনোসেন্ট, হুম? তুমি আমার সাথে একবার কোলাকুলি করেই দেখো না।’
লজ্জায় আমার মুখ থেকে যেন ধোঁয়া বের হওয়া বাকি। চোখ পাকিয়ে তাকানোর চেষ্টা করে আওড়ালাম –
‘এমন বুঝি সবার সাথেই কোলাকুলি করেন? তাইতো এতো জানেন। মিউচুয়াল এফেকশন!’
তাশরিক ভাইয়া মুহুর্তে ভেজা বেড়াল হয়ে গেলেন। দু-হাত দু-পাশে তুলে সেরেন্ডার হবার যেই ভাণ-টা করলেন এতেই আমার হাসি পেলো। তবে হাসলাম না। চোখমুখ একটু গম্ভীর রাখতে চাইলাম। তিনি করুণ মুখে শুধালেন –
‘তুমি আমাকে কী ভাবো বলোতো, বেবিডল?’
আমি আড়চোখে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে চাইলাম। মনের ভেতরে তাকে নিয়ে পূর্বের যা ভাবনা এসেছিলো তাই বললাম –

‘প– প্লেবয়?’
তাশরিক ভাইয়াকে স্তব্ধ হতে দেখা গেলো। তিনি কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে আওড়ালেন,
‘What the hell did you say? Play boy?…play boyyyy…’
তিনি যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। তার এমন ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া দেখে আমিও থতমত খেলাম। দ্রুতো শুধরে নিতে চাইলাম নিজেকে –
‘মানে– আপনি না তো। মা..মানে আপনাকে.. না মানে আপনার কথার ধরন, চালচলন অনেকটা ওমনই লাগে আরকি। ফা- ফাজিলদের ম ত ন।’

বলেই আমি মিইয়ে গেলাম। দ্রুতো তার সামনে থেকে পালাতে উতলাম হলাম। তবে আমার ভাবনার আগেই তার হাত কাজ করলো। এবারে আর ওড়না নয়। আমার হাতটাই বেশ সাবলীলভাবে, লুকিয়ে খপ করে ধরে সামনে দাঁড় করালেন। ভ্রু তুলে মাথাটা নুইয়ে আনলেন আমার সমান। শুধালেন হেয়ালি করে –
‘আমাকে তোমার প্লে-বয় মনে হয়? জানো প্লে-বয়রা কী করে থাকে এক্সাক্টলি?’
আতঙ্কে ধড়ফড়িয়ে উঠলো আমার ভেতরটা। মনে হচ্ছে, আবারো নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারলাম। কী দরকার ছিলো বলার? আমি হাত ছুটিয়ে নিতে চেয়ে কোনোরকমে বললাম –

‘মানে না মানে মনে হতো।’
তাশরিক ভাইয়া আরও কাছে আসতে আসতে আওড়ালেন –
‘আবার ফাজিল ডেকে গা লি দিলে।’
আমি দ্রুতো মাথা নাড়িয়ে বললাম – ‘না না। বিশ্বাস করুন, গালি দিই নাই। এক্সাম্পল দিচ্ছিলাম’
তাশরিক ভাইয়ার কণ্ঠ খাদে নেমে এলো প্রায় –
‘তাই বুঝি? এক্সাম্পল? আমিও তাহলে প্লে-বয়ের একটা এক্সাম্পল দিই? তুমি পরিচিত হও কাছ থেকে?’
হৃৎপিণ্ড লাফাচ্ছিলো রীতিমতো। আমি বোধহয় এখানেই জ্ঞান হারাবো।
‘পরিচিত হতে চা – চাই না।’
তাশরিক ভাইয়া মিষ্টি করে বললেন –

‘Why not, my sweetest little baby girl? As your future husband-to-be, that’s my responsibility.’
আমি যে ফেঁসে যাচ্ছি ঠিক বুঝতে পারলাম। লোকটা এতো ধুরন্ধর। কোথাকার জল কোথায় নিচ্ছে! আমি হাত ছাড়িয়ে নিঃশব্দে সরে যেতে চাইলাম। তিনি হাত ছাড়লেন। আমি স্বস্তির শ্বাস ফেলবো তখুনি যাওয়ার আগে আওড়ে গেলেন –
‘Do you know what a playboy means? I’ll show you soon, my darling.’

স্বস্তির শ্বাস আর ফেলতে পারলাম না। গলায় বুকে আটকে রইলো। বুকের ভেতরটা তখনো ক্রমান্বয়ে বিট করে যাচ্ছে। আমি হুড়োহুড়ি জুড়ে মায়ের সাথে লেগে গেলাম। আজ আর আমি মায়ের পাশ ছাড়ছি না। কোনোভাবেই না। আড়চোখে দেখলাম তাশরিক ভাইয়া কাজে ব্যস্ত হয়েছেন। নিশু ভাই আর অহনা আপু কাবিননামায় সাক্ষর করছেন। তারপর তাদের সামনে থেকে দোপাট্টা সরিয়ে দেয়া হয়। আপুর মাথায় বড়ো ঘোমটা টানা। ওটা ভাইয়া উঠিয়ে কপালে চুমু খায়। এতে ফের শোরগোল শুরু হলো। গানও পাশাপাশি বেজে উঠল। আমার মেয়ে কাজিনদের গ্রুপ ডান্স ছিলো। ওরাই আগে গেলো নাচতে। তখনো আমার পা পুরোপুরি নাড়ানো সম্ভব না। কমসে কম আমাকে চৌদ্দদিন পা-য়ে জোর দিয়ে নাচগান সহ বিভিন্ন কার্যক্রম করতে নিষেধাজ্ঞা দেয়া। তাই আমার আর নাচা হলো না। আমি ওদেরটাই হাততালি দিয়ে সবার সাথে দেখছিলাম। ওদের নাচের মধ্যে ভাইয়ার বন্ধুরাও ঢুকেছিলো বেশ শালীন ভাবেই। ওরা নাচছিলো ‘দো ধারি তালওয়ার’ গানে। যেমন মেয়েরা নেচেছিলো –

Ha taaj-o-takhat main toh lakho gira du,
Saare arash wale dharti pe laa doo…
Main hoo husan mujhse bachke hi rehna,
Main hi mukaddar bana doo mita doo..
ভাইয়ারা আবার তার পরের লিকসে এন্ট্রি নিয়েছিলেন। এতে অবশ্য হট্টগোল বেড়েছিলো। অনেকেই শিশ বাজিয়েছে –
Teri minnat karu, teri khatir maru
Teri darr ke siwa na thikana
Tu toh thodi mithi, thodi si hai zeherili re
Jaise garmi ki ho tapti dupheri re
Haule se tu kare dil pe halla re
Teri tarife karta mohalla re, ho bate hai meri hathiya
Haye naino ka karti hu shikar, main do dhari talwar yar…

নাচ শেষে ভাইয়ার বন্ধুরা মিলেও নেচেছেন। তাশরিক ভাইয়াকে অবশ্য কোথাও দেখলাম না। তিনি একেবারে যেন গায়েব। আমি স্বস্তি পাবো কী? উল্টো ঘুরেফিরে চোখ তাকেই খুঁজছিলো তার কথাই ভাবছিলাম। আমরা সবাই বসেছি একপাশে। সামনে স্টেজ। আমাদের সবার সামনে ভাইয়া আর অহনা আপু। আমার ডান পাশে আন্টি। আন্টির পাশে মা। বাবা, আংকেল উনারা আবার ও পাশে। আমার বাম পাশে বা পেছনে সিট নেই।

মাই লাভ মাই লাইফ পর্ব ১৩

আমি মাথাটা তুলে ভালোভাবে আশপাশটা দেখতে চাইলাম এমনসময় হটাৎ ভেতরটা অন্ধকার হয়ে গেলো। বাবা তখুনি শব্দ করে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের লোকদের ডাকছিলেন। আমিও অন্ধকারে তাকানোর একটু চেষ্টা চালাচ্ছিলাম। এমন সময় হঠাৎ পেছন থেকে কেউ ঘাড় ধরে পেছনে ফেরালো। আমি যে ভয়ে, আতঙ্কে চিৎকার করবো সেই সময়ও পাইনি। উষ্ণ কিছু ছুঁয়ে গেলো ঠোঁট। শক্ত করে। মৃদু আপত্তিকর চুমুর শব্দ ভাসলো আমার কানে। পাথর হওয়া আমার কানের কাছে তাশরিক ভাইয়ার কণ্ঠ –
‘কী? প্লে-বয়ের এক্সাম্পল পেলেতো?’

মাই লাভ মাই লাইফ পর্ব ১৫