দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ২১

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ২১
আফরোজা আশা

হতবুদ্ধির ন্যায় থ মেরে একটা জায়াগায় বসে আছে রায়হান। কি থেকে কি হলো! কেনো হলো কিছুই মাথায় আসছে না। কে ছিল মেয়েটা? হুট করে উড়ে এসে ওর জীবনের সাথে জড়িয়ে গেল। না চেনে, না জানে! মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে ঘটা ঘটনা কি ওর জীবনের গতি ঘুরিয়ে দিল!
চোখ বন্ধ করে সজোরে চুল খামচে ধরল রায়হান। প্রচণ্ড রাগ আর বিরক্তিতে ছেঁয়ে আছে মন।
কিছুক্ষন আগের ঘটনা ভেসে উঠল মনসাপেটে।

বাইকে ফুল স্পিড তুলে ফাঁকা রাস্তা নিজ মন মতো চলছিল রায়হান। একটা জঙ্গলের মতো রাস্তায় গিয়ে বাঁধল বিপত্তি। এতো সকালে মানুষজন খুব একটা নেই। যা দু-একজন আছে সেগুলো শহরের দিকে। মাত্র গ্রামের রাস্তায় ঢুকেছিল রায়হান। শুনশান ফাঁকা রাস্তার পাশে ঝোঁপের আড়াল থেকে একটা মেয়ের চিৎকার কানে বারি খেতেই চলন্ত বাইক এ ব্রেক কোষে। জঙ্গলের ওদিক থেকে ভেসে আসছে আওয়াজ। রায়হান বাইক সাইডে পার্ক করে সন্দেহবশত যেখান থেকে শব্দ আসছে সেদিকে পা বাড়ালো। আস্তে আস্তে যত ভেতরে যাচ্ছে ততো বেশি আওয়াজ আসছে। কাছাকাছি এসে থেমে গেল ওর পা জোড়া। সামনের দৃশ্য দেখে সহসা হুংকার ছুড়ল।
একটা মেয়েকে ধরে রেখেছে দুজন ছেলে। জোর-জোবরদস্তি করার চেষ্টা করছে। মেয়েটা সামনের দিকে ঘুরে নিজেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু পুরুষালি শক্তির দুটো মানুষের সাথে কি আর একটা কিশোরী মেয়ে পেরে উঠে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রায়হানের হুংকার শুনে ছেলেগুলো বিচ্ছিরি গালি ছুড়ে ওর দিকে তাকায়। তারপর দুজনে একে অপরের সাথে চোখাচোখি করে মেয়েটাকে ধাক্কা মেরে রায়হানের দিকে ছুড়ে দেয়। রায়হান ওদের মারার জন্য পা এগিয়ে ছিল কিন্তু মেয়েটাকে পড়ে যেতে দেখে ওকে ধরল। আরেকটুর জন্য গাছে সাথে লেগে মাথা ফাটেনি। রায়হান ঠিক সময় না ধরলে মেয়েটা এতোক্ষনে গাছে সাথে বারি খেয়ে মাথা ফাটাতো।

মেয়েটাকে দাঁড়া করাতে চাইলো কিন্তু পারল না। অতিরিক্ত ভয় আর এতোক্ষন ছেলেগুলোর সাথে কোস্তাকুস্তি করার কারণে শরীরে কোনো শক্তি অবশিষ্ট নেই। ঢলে পড়ল সেখানেই। রায়হান বারবার ডাকল ওকে কিন্তু কোনো সাড়া পেল না। ঘাসের উপরে ওকে শুইয়ে দিয়ে ওর মাথা কোলের উপরে নিল ও। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে তাই চেহারা দেখে নি এখনো। সেভাবেই ডাকল আরো কিছুক্ষন। কিন্তু মেয়েটার নড়চড় নেই। আশেপাশে কেউ নেই যে সাহায্য চাইবে। পানি লাগবে এখন। মেয়েটাকে একা ফেলে যেতেও পারছে না রায়হান। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ছোট মেয়ে। এতো ধকল সইতে পারে নি। রায়হান না আসলে মেয়েটার সর্বনাশ হয়ে যেত।

হঠাৎ একদল মানুষের আগমন হলো সেখানে। রায়হান খেয়াল করে নি ওদের। মাথা নিচু করে মেয়েটার গালে জোরে জোরে চাপড় মারছে আর ডাকছে। কিন্তু দূর থেকে লোকগুলোর চোখে তা আপত্তিকর দৃশ্য হিসেবে উপস্থাপন হলো।
রায়হানের কানে ভেসে এলো একটা ছেলের আওয়াজ,
‘ দেখতাছেন চেয়ারম্যান সাব! কইছিলাম না। জঙ্গলে আইসা নষ্টামি করতাছে পোলা-মাইয়া দুইডা। দেহেন! ধরেন দুইডারে। ওদের নষ্টামি বাইর কইরা দেন। ’

চকিত সামনের দিকে তাকালো রায়হান। হকচকালো অনেক। যে ছেলেটা কথাগুলো বলল সে ছেলেই মেয়েটার সাথে জোরাজোরি করছিল। ওর পাশে আরেকজনও আছে। মেয়েটাকে কোল থেকে সরিয়ে কিছু বলতে চাইলো কিন্তু পারল না। কয়েক জন লোক ওর কাছে এসে ঘিরে ধরল ওকে। বয়স্ক একজন ওর সামনে এসে চড়া গলায় বলল,
‘ আমার এলাকায় এসব করার সাহস পাও কিভাবে? তোমাদের মতো ছেলেমেয়েদের জন্য সমাজ রসাতলে যাচ্ছে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ।’

রায়হান রাগী গলায় বলল, ‘ এইই! খবরদার। ফালতু কথা বলবেন না কেউ। ওই ছেলে দুটো এই মেয়েটার সাথে জোরাজুরি করছিল। আমি আসাতে পালিয়েছে। আর আপনাদের ডেকে এনে নাটক করছে। ইচ্ছে তো করছে হারামজাদা দুটোকে পুঁতে দেই এখানে।’
রায়হানের কথা কানে তুলল না কেউ। সবাই একসাথে চড়াও হলো ওর উপরে। ওর কাছে যা কিছু ছিল সব ছিনিয়ে নিল। ফোন করে দিগন্তকে যে ডাকবে সে উপায়ও রইল না আর। কেউ কেউ ওকে মারতে চাইলো। এদিকে মেয়েটারও হুশ নেই। অনেক কথা কাটাকাটি চলল ওদের মাঝে। ওরা এতো মানুষ আর রায়হান একা। তাই এতোজনের সাথে পেরে উঠল না। রায়হানকে ধরে বেঁধে গ্রামের একটা কাজীর বাড়িতে আনল। মেয়েটাকে আনা হয়েছে তবে ওর জ্ঞান ফেরে নি এখনো। কাজীকে ঘুম থেকে তুলে ওদের বিয়ে দিতে বলল।

এ কথা শোনার পর ফুঁসে উঠে রায়হান। কিছুতেই করবে না বিয়ে। মামার বাড়ির আবদার নাকি! কিন্তু পারছে কই এতো লোকের সাথে। রাগে-ক্ষোভে দাঁতে দাঁত চেপে একেবারে চুপ করে গেল। ও যে এই লোকদের সাথে পারবে না সেটা বোঝা হয়েছে। যারা বুঝতে চায় না তাদের হাজার চেষ্টা করেও বোঝানো সম্ভব না।
কয়েকটা মহিলা মিলে মেয়েটার মুখে পানি ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরালো। জ্ঞান ফিরতেই মেয়ে কাঁদা শুরু করল। ভেবেছে হয়তো ওর ক্ষতি করে ফেলেছে ছেলেগুলো। কিন্তু যখন আসল ঘটনা বুঝল তখন চিৎকার করে ছোটাছুটি শুরু করল। চেনা নেই জানা নেই একটা ছেলেকে বিয়ে করে নেবে। সবার কাছে বারবার বলল রায়হান ওর জীবন বাঁচিয়েছে। ওরা যা ভাবছে সেরকম কিছু না। ওরা দুজন দুজনকে চেনে না। এখন পর্যন্ত কেউ কাউকে দেখেও নি। কিন্তু কেউ কানে তুলল না ওর কথা। উপায়ন্তর না পেয়ে পালানোর চেষ্টা করল সেটাতেও ব্যর্থ হলো। অতঃপর অল্প কিছু সময়ের মাঝে রায়হান আর অচেনা সে মেয়েটাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হলো।

দায়সারা কবুল বলে রায়হান চলে আসতে চাইলেও আবারো আরেকদফা চড়াও হলো সবাই। মেয়েটাকে ওর সাথে পাঠালো। তারপর দুজনকে গ্রামের সীমানা থেকে তাড়িয়ে দিল।
বাইকের কাছে এসে রায়হান রাগে গজগজিয়ে ছন্নছাড়াভাবে একের পর এক টায়ারে লাথি মারতে শুরু করল। ওর পেছনে যে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে খেয়াল নেই ওর। রাগ অন্যদের উপরে না। রাগ নিজের উপরেই ঝারছে। কি দরকার ছিল মাঝরাস্তায় থামার। দুনিয়ায় কে, কার, কি করছে করুক সেসবে তো ওর যায় আসে না। কত মেয়েকে টিজ করে বেড়ায়! সে রায়হান একটা মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে অযথা একটা ঝামেলায় জড়িয়ে গেল। এটাকে কোনো বিয়ে বলে! চেনা নেই জানা নেই, এমন কি মুখটাও দেখেনি। না-ই বা দেখার প্রয়োজন আছে। রাগে হিতাহতজ্ঞান হারিয়ে চুল টেনে ধরল রায়হান। পিছু না ফিরেই চেঁচিয়ে উঠল,

‘ যা চলে যা এখান থেকে। চুপচাপ নিজের রাস্তা মাপ। নাহলে খুন করে ফেলব এখনি। তোকে আমি মানি না। না তোর মুখ দেখেছি আর না কখনো দেখতে চাই। ফালতু একটা স্বপ্ন আমার জীবনে এটা। তোর মতো মেয়েকে কে কবুল বলবে! থুউউ! তোকে ছেলেরা ছুঁয়েছে। তুই ওদের-ই যোগ্য। যা দূর হো। জীবনে কোনোদিন-ও তোর সাথে আর দেখা হবে না আমার। যা হয়েছে সব ভুলে যাবি। ’
কথা টা বলে আর এক সেকেন্ড-ও দাঁড়ালো না রায়হান। বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে গেল।
এদিকে এলোমেলো শরীরে মেয়েটা চোখে অজস্র অশ্রু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রায়হানের একেক টা কথা ওর বুকে গেঁথে গিয়েছে। ধপ! করে বসে পড়ল মাটিতে। শব্দ করে কাঁদতে শুরু করল।

বেলা প্রায় অনেকটা হয়েছে। ঘড়ির কাটা সকাল দশটার ঘরে। দিগন্তের বাইক এসে থামল টিন দিয়ে তৈরি সুবিশাল এক সৌখিন বাড়ির সামনে। বাড়ির চারপাশ নানা গাছ-গাছালিতে ঘেরা। ফুলের গাছগুলোতে ফুল ফুটেছে। বাহির থেকে দেখেই চোখ জুরিয়ে গেল বেলার। বাইক থেকে নেমে বাড়ির চারপাশ চোখ বুলিয়ে বিস্ময়ভরা কণ্ঠে ডেকে উঠে,
‘ দিগন্ত ভাইইইইই! ’
বেলার পাশে দাঁড়িয়ে চোখমুখ কুঁচকে দিগন্ত ছ্যাঁত করে জবাব দেয়, ‘ বল। ‘
-‘ এটা আপনাদের বাড়ি? ’
ঠোঁট কামড়ে ধরে দিগন্ত বলে, ‘ নাহ। এটা তোর শ্বশুড়বাড়ি।’
বেলা মুখ লটকে বলে, ‘ আপনার যদি ছোট ভাই থাকতো তাহলে সত্যিই এটাকে আমার শ্বশুড়বাড়ি বানিয়ে নিতাম। বাড়িটা কি সুন্দর! ’

-‘ ছোট ভাই কি দরকার? আমাকে চোখে পড়ে না। ‘
খিলখিলিয়ে হাসে বেলা। ঝটপট করে উত্তর করে,
‘ আপনি তো আমার থেকে এতো বড়। ‘
দিগন্ত শান্ত কণ্ঠে বলে, ‘ তোকে না আমি এতোক্ষন ঘুরালাম বেলা। বিশ্বাস কর! আমার মন-মেজাজ এখন অনেক ভালো আছে। বেয়াদবি করিস না। মেজাজ খারাপ হলে তোর কানের নিচে-ই পড়বে। ‘
বলে বেলার হাত ধরে ভেতরের দিকে হাঁটা ধরল ও। কিন্তু বেলার মুখ তো নিশপিশ করছে। মাথায় কত প্রশ্ন ঘুরছে। সেগুলো না বললে থাকতে পারবে না। তাই আবারো বলে উঠে,

‘ দিগন্ত ভাই! ‘
-‘ হু ‘
-‘ শুনেন। ‘
-‘ বলেন। ‘
দিগন্তের এতো আহ্লাদী ডাকে দুষ্টুমি বাড়লো বেলার। মুখ টিপে হেসে আবার ডাকে,
‘ শুনেন না ‘
বেলার কাহিনী দেখে হাঁটতে হাঁটতেই মুচকি হাসে দিগন্ত। জবাব দেয়,
‘ বলেন না ‘
-‘ আপনি আগে শুনেন তো। ‘
-‘ আপনি আগে বলেন তো। ‘

এসব পাগলামো করতে করতে দুজনে বাড়ির উঠোনে চলে এসেছে। ঘরভর্তি মানুষ দেখে নিজের হাতের মাঝে ধরে রাখে বেলার নরম ছোট হাতটা ছেড়ে দিল দিগন্ত। দিগন্তের হাত ছেড়ে দেওয়া মন ভার হলো বেলার। ভালো-ই তো লাগছিল, ছাড়ার কি দরকার। মন খারাপ করে বোকা বেলা মুখ বেঁকিয়ে ভেংচি কাটে।
দিগন্ত আর বেলাকে দেখে রকেয়া তালুকদার ওদের কাছে এলো। নাতিকে জরিয়ে ধরে আদর-সোহাগ করল। বেলার সাথে কথাবার্তা বলার এক ফাঁকে হুট করে বলে উঠল,

‘ কিরে দিগু! রায়হান কোথায়? ’
রায়হানের কথা শুনে ভ্রুঁ কোঁচকালো দিগন্ত।
‘ কোথায় মানে? ও আসে নি এখনো? ’
দিলদার তালুকদার ওদের পাশে এসে বলল,
‘ ও তো এখনো আসে নি। দিহানরা সেই আটটায় এসেছে। ও এসে বলল, তুই আর রায়হান একসাথে আসছিস। তাই আমরা ভেবে নিয়েছি তোরা দুটোই ঘুরেফিরে তারপর আসবি। ’
চিন্তার গাঢ় ভাজ পড়ল দিগন্তের কপালে। রায়হানের অনেক আগেই এসে যাওয়ার কথা। বেলাকে বাণীর কাছে পাঠিয়ে দিল। তারপর রায়হানের ফোনে কয়েকবার চেষ্টা করল কিন্তু সুইচ অফ দেখাচ্ছে। রায়হানকে খোঁজার জন্য যেতে চাইলে তখনি রায়হানের বাইক এসে থামল ওদের সামনে। বাইক রেখে বাড়িতে ঢুকে সবার সাথে কুশল বিনিময় করল রায়হান। কিন্তু দিগন্তের ধারালো দৃষ্টি ওর উপরে রয়েছে। সবার সাথে কথা বলা শেষে দিগন্তের কাছে এলো ও।
রায়হানকে ভালোভাবে পরখ করে দিগন্ত বলল,

‘ কিছু হয়েছে? তোকে দেখতে ঠিক লাগছে না? ’
আপাতত সব কথা চেপে গেল রায়হান। হালকা হেসে বলল,
‘ কি হবে? কিছুই হয় নি। তোর বোন তো এলো না। তাই একা একা-ই আশপাশ ঘুরে এলাম। ’
রায়হানের কথা কেনো যেন বিশ্বাস হলো না দিগন্তের। গম্ভীর স্বরে বলল,
‘ সত্যি বলছিস? কোনো সমস্যা হলে বল? আমি দেখছি। ’
প্রসঙ্গ পাল্টাতে রায়হান বেলাকে নিয়ে দিগন্তকে খোঁচাখোঁচি শুরু করল। রায়হানকে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে দেখে নিজের মনের সন্দেহটুকু গিলে নিল দিগন্ত। কিছু হলে নিশ্চয়ই রায়হান ওর থেকে গোপন করবে না।

একটা ছোট পুকুরের ধারের পাশে বসে এক রূপসী তরুণী। কাঁধের চারপাশে খোলা লম্বা চুলগুলো অবহেলায় মাটি গড়িয়ে পানির মধ্যে গিয়ে পড়েছে। কাপড়-চোপড়ে ময়লা লেগে আছে।
উদাস ভঙ্গিতে বসে নদীর স্বচ্ছ পানিতে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। সকালে বেরোলো মায়ের কাছে যাবে বলে। শর্টকার্ট রাস্তার জন্য জঙ্গলের রাস্তা ধরে হাঁটল। এই যেন কাল হলো ওর জীবনে। এই কয়েকঘণ্টায় ওর চরিত্র এ দাগ লাগল। শুধু কি চরিত্র! সাথে তো ভাগ্যেও দাগ লেগে গেল। জীবন কোথায় এসে দাঁড় করিয়ে দিল ওকে। অভাগা জীবনটাতে কি ঝড়-ঝামেলার কমতি ছিল যে আরো বড় দূর্ভোগ জুটল কপালে।
চোখ দিয়ে পানি ঝরছে অনবরত। আরো কিছু সময় সেখানে বসে থাকল। তারপর ছড়িয়ে থাকা বড় চুলগুলো হাত খোঁপা বাঁধল। পুকুর থেকে পানি তুলে হাত মুখে পানির ছিটা দিল। জামায় ময়লা লেগে থাকা জায়গাগুলো পানি দিয়ে পরিষ্কার করে নিল। শরীর চলছে না আর। কেমন যেন অসাড় হয়ে আসছে হাত-পা।

আস্তেধীরে হেঁটে নিজের গন্তব্যের কাছে আসতেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বাইকটা দেখে চমকালো ভীষণ। ওর চিনতে ভুল হয় নি। যতুটুকু দেখেছিল এটা ওই লোকের বাইক।
পায়ের কদম টেনে পিছিয়ে যেতে শুরু করল ও। মনে প্রশ্ন উদিত হলো,এ বাড়িতে এসেছে ওই লোক। তার মানে শহর থেকে যাদের আসার কথা ছিল তাদের মধ্যেই কেউ হয়। আর এক মূহুর্ত এখানে থাকা যাবে না। চলে যাবে এখান থেকে ও। ভেবে-ই পিছু ফিরতে নিলে পেছন থেকে কেউ ওর নাম ধরে ডাকল,
‘ মাইশা। এদিকে আয়। ’
শুকনো ঢোক চেপে পেছন ফিরে চাইল মাইশা। দিগন্ত ডাকছে ওকে। এ ডাক উপেক্ষা করে চলে যাওয়া সাজে না ওর।
গুটিগুটি পা ফেলে দিগন্তের সামনে এলো মাইশা। সালাম দিল ওকে। দিগন্ত নিল ওর সালাম। তারপর হালকা হেসে বলল,

‘ কত বড় হয়ে গিয়েছিস তুই! পড়াশোনা কেমন চলছে? ’
মাথা নাড়িয়ে মাইশা ধীর আওয়াজে বলল, ‘ ভালো চলছে ভাইয়া। ’
-‘ সামনেই তো এডমিশন। মন দিয়ে পড়। আর যা যা লাগে সব গুছিয়ে রাখিস। আমরা ঢাকা ফেরার সময় তোকে নিয়ে যাবো। এডমিশন ক্লিয়ার করে তবে আবার ফিরবি। ’
কি উত্তর দিবে খুঁজে পেল না মাইশা। শুধু বলল, ‘ আচ্ছা। ’
পরক্ষনেই একটা গলার স্বর শুনে চমকে উঠল ও। হ্যাঁ! এটা ওই লোকের-ই গলা। দিগন্তের কাছে-ই আসছে ওকে ডাকতে ডাকতে। এলোমেলো হলো মাইশার দৃষ্টি। দিগন্তকে তড়িঘড়ি করে বলল,
‘ ভাইয়া আমি মায়ের কাছে যাচ্ছি। একা এতো কাজ সামলাতে পারবে না। পড়ে কথা হবে। ’

বলে-ই জায়গা ত্যাগ করল। দিগন্ত বেশ অবাক হলো মাইশার ব্যবহারে। দিশা যতটা চঞ্চল, মাইশা ঠিক তার উল্টো। শান্ত, নম্র-ভদ্র একটা মেয়ে। মেয়েটার বাবা নেই। ওর বাবা মারা যাওয়ার পর ওকে সহ ওর মাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল ওর বাবার বাড়ির লোকজন। ওর মাকে আশ্রয় দিয়েছিল দিলদার তালুকদার। তখন থেকেই সারাদিন এ বাড়িতে কাজ করে। বাড়িসহ রকেয়া আর দিলদার এর সব কাজ সামলায়। মাইশাকে দিশার মতোই স্নেহ করে দিগন্ত। শুধু দিগন্ত না তালুকদার সকলেই বেশ ভালোবাসে ওকে।

এতিম মেয়েটা ছোট থেকে ওদের চোখের সামনে বড় হয়েছে। আগে এ বাড়িতে থাকলেও দুবছর আগে একটা বাসা ভাড়া নিয়েছে ওর মা। কতদিন আর অন্যের বাড়িতে মা-মেয়ে পড়ে থাকবে। এজন্য তালুকদার বাড়ির সকলে ওর মাকে বেশ গালাগাল করেছে। বাড়ি থাকতেও অযথা টাকা খরচ করে ভাড়া নেওয়ার কি দরকার! কিন্তু শোনে নি মাইশার মা।

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ২০

নিরুপায় হয়ে এবাড়িতে আশ্র‍য় নিলেও আত্মসম্মান প্রখর তার। সব সময় ছোটাছুটি করে কাজ করে। দুদণ্ড বসে না। কারো কাছে ঋণী থাকতে চায় না মাইশার মা। তাই পরে আর কেউ কিছু বলে নি। দু মা-মেয়ের সারাদিন কাটে এ বাড়িতে-ই। মাইশাও পড়াশোনার ফাঁকে সব কাজে মাকে সাহায্য করে টুকিটাকি। বাকিটা সময় রকেয়া অথবা দিলদার এর সাথে গল্প-গুজব, আড্ডায় কাটায়। আর রাতে চলে যায় নিজেদের বাড়ি।

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ২২