প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ১৫

প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ১৫
সাইয়্যারা খান

সকাল নয়টা বাজে। বাড়ীর সামনের দোকানটায় সাটার তুলছে। লম্বা সেই শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো পৌষ’র। এটা রোজই হয়। বিরক্তকর শব্দটা ঘুম ভেঙে দেয়। ভাঙা ঘুম নিয়ে উল্টে রইলো পৌষ। আজ হেমন্তের অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান হবে রাতে। বাড়ীতে কাজ বেশি। পৌষ জানে চাইলেও বেশিক্ষণ ঘুমানো যাবে না। এদিক ওদিক করে উঠবে ঠিক তখনই হুড়মুড়িয়ে ওর ঘরে ঢুকে পিহা। পৌষ মুখ কুঁচকে তাকালো। বিরক্ত স্বরে বললো,
“এভাবে আসিস কেন? আমার কি প্রাইভেসি নেই? যখন যার মন চায় তখন সে ঢুকে পরে।”
পিহা আপার কথা ধরে না। দ্রুত ভেতরে ঢুকে। পৌষ’র রুমের পর্দা গুলো খুলতে খুলতে আস্তে করে বলে,

“আপা, উঠবে না?”
“নাহ, শুয়ে শুয়ে আজ তোর মায়ের গীত গাইব। কিরে সুর মিলাবি?”
পিহা অসহায় দৃষ্টি ফেলে তাকালো। পৌষ আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো। হাত পা ঝাড়া দিয়ে সোজা বাথরুমে চলে গেলো। পিহা আপার বিছানাটা ঝেড়ে দিলো। বাথরুমে তখন গান গাইছে পৌষ। পিহার হাসি পেলো। আপা যে কি অদ্ভুত অদ্ভুত গান গায়।
পৌষ কণ্ঠে সুর ধরে রেখেই বের হলো,
“ও বন্ধু তুমি কই কই রে..
এই প্রাণও বুঝি যায় রে…”
“কে আপা?”
“তোর দুলাভাই, সম্রাট।”
পিহা পৌষ’র দিকে তাকিয়ে বললো,
“আপা খাবে না?”
পৌষ তাকালো বোনের দিকে। কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

পিহা যেন এই অপেক্ষায় ছিলো। এজন্যই এসেছে ও আপার কাছে। সকালে দোকানে গিয়েছিলো পিহা। সেঝ চাচির লং লাগবে, তার মাথা ব্যথা। বাসায় লং নেই তাই আপাতত কাজ সারতে পাশের দোকান থেকে আনতে বললো। পিহা দোকানে যেতেই দোকানদার টিটকারি মে’রেছে। রোজই এমন করে সে। বুড়ো লোকটার বদ অভ্যাস মেয়েদের দেখলে টিটকারি করা।
পিহার কথা শুনে পৌষ’র মাথাটা সকাল সকাল গরম হলো। চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
” শালার বুইড়া, আজ দেখ তোর ভীমরতি কিভাবে বের করি।”

ওরানাটা গায়ে দিয়ে পৌষ বাঘিনীর মতো বেরিয়ে এলো। জৈষ্ঠ্য নিজের ঘর থেকেই দেখেলো পৌষ রেগে হনহনিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। কি হয়েছে বুঝতে নিজেও তারাহুরো করে বেরিয়ে গেলো। কোন দিকে কাকে ডাকবে বুঝতেও সময়টা পেলো না। দেখলো বাড়ীর বাইরে ডেকোরেশনের জন্য থাকা অতিরিক্ত বাঁশ থেকে একটা বাঁশ হাতে তুললো পৌষ। জৈষ্ঠ্য চোখ বড় করে তাকালো। পিহা নিজেও পেছনে এসেছে। আপা বাঁশ দিয়ে কি করবে ওর বুঝে এলো না। পৌষ বরাবর তাকালো দোকানে। দু’জন কাস্টোমার দাঁড়িয়ে তারমধ্যে একজন সিগারেট টানছে। পেছন থেকে পৌষ মানুষটাকে চেনে নি। চেনার জন্য পরিশ্রমটাও পৌষ করলো না। সরাসরি বাঁশ দিয়ে বারি মা’রলো দোকানের সাটারে। দোকানদার হায় হায় করে উঠতে উঠতেই সিগারেট টানতে থাকা লোকটা ভয়ে সিগারেট ফেলে লুঙ্গি তুলে দৌড় দিলো। পিহা তারাতাড়ি চোখ ঢাকলো। পৌষ খ্যাঁকিয়ে উঠলো,
“শালার বুইড়া, বের হ। বের হ দোকান থেকে। তোর টিটকারি আমি ছুটাচ্ছি। বাইর হ তুই নাহয় দোকানে ভাংচুর করব।”

বুড়ো লোকটা মালামালের ভয়ে তারাতাড়ি দোকান থেকে নামলেন। পৌষ এমন এক বারি দোকানের মেঝেতে মারলো যে দোকানদার দৌড় দিলো। পেছনে তাকে তাড়া দিচ্ছে পৌষ। জৈষ্ঠ্য খেই হারিয়ে ফেললো। কই যাবে সে? আপার পিছু নাকি বাড়ীতে কাউকে ডাকতে? উল্টো পথে সে বাড়ীতেই ঢুকলো গলা উঁচিয়ে ডাকতে লাগলো,
“হেমু ভাই! হেমু ভাই! চৈত্র রে তারাতাড়ি বাইর হ। হেমু ভাই!”
হেমন্ত সহ শ্রেয়া তারাতাড়ি বেরিয়ে আসে। বাকিরাও ছুটে এসেছে। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই জৈষ্ঠ্য হড়বড়িয়ে বলতে লাগলো,
“হেমু ভাই, তারাতাড়ি এসো। আপা দোকানদারকে বাঁশ দিয়ে পেটাচ্ছে।”
“কিহ!”
চমকে গেলো হেমন্ত। ছোট চাচা হায় হায় করে বললেন,

“ওরে ওটা পৌষ? আমি তো দেখি নি। সিগারেটটা মাত ধরালাম, এমন সময় দোকানে বাঁশের বারি। ভয়ে লুঙ্গি তুলে দৌড়ে বাড়িতে ঢুকলাম।”
ছোট চাচি বেজায় রাগলেন। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন,
“কিছু হলেই লুঙ্গি তুলে কেন দৌড় দিতে হবে? মানইজ্জত কিচ্ছু বাকি রইলো না।”
রেগে তিনি চলে গেলেন বাইরে। না জানি পৌষ কোন আকাজ করছে। এদিকে ছোট চাচা বড় বড় চোখে তাকিয়ে বলতে লাগলেন,

“লুঙ্গি তো পরো না তাই বুঝো না। যেমন শান্তি তেমন জ্বালা। না তুলে দৌড় দিলে পেঁচিয়ে পড়ব না আমি? তখন তুমি বিছানায় বসিয়ে আমার মলমূত্র পরিষ্কার করবে? সেটা তো করবে না। তখন উল্টো বলবে, কেন লুঙ্গি তুলে দৌড় দিলাম না।”
হেমন্ত দৌড়ে গিয়ে পৌষ’কে ধরেছে মসজিদের সামনে থেকে। সকাল বেলা, বন্ধের দিন তাই মানুষ কম। পেছনে বড় চাচা সহ বাকিরা এসেছে। হেমন্ত পৌষ’কে দিলো এক ধমক,
“থাম বলছি। থাপ্পড় মারব নাহয় এখানেই।”
পৌষ মানে না। বাঁশও ছাড়ে না। শুধু বলে,
“ওরে একটা বারি মারব শুধু হেমু ভাই। ওর তেল চর্বি বের করে ছাড়ব।”
হেমন্ত সহ জৈষ্ঠ্য মিলে বাঁশ সরালো। দোকানদার লুকিয়েছে যেতে চাইছে কিন্তু তার আগেই বড় চাচা পৌষকে যেতে বলে দোকানদারকে বললেন,

“দোকান ঠিক রাখতে চাইলে ভালো হন। নামাজি মানুষ, বয়স হয়েছে। নাতির মতো বাচ্চাকে টিটকারি মারেন আপনি। আমার মেয়ে সহ অন্য কারো মেয়ের সাথে আরেকদিন এই ঘটনা ঘটবে তখন বাঁশের বারিটা আপনার দোকানে পড়বে।”
ওদের নিয়ে বাড়িতে ঢুকেন বড় চাচা। হেমন্ত পৌষ’কে শাসালো ভীষণ ভাবে। পৌষ পাত্তা দিলো না তাতে। রান্নাঘরে ঢুকে নিজের মতো চা বানালো। তার জন্য কেউ চা বানিয়ে রাখে না। পৌষও পছন্দ করে না। নিজের চরকা নিজে চালাতেই পছন্দ করে।
বড় চাচি পিহাকে ধমক দিলেন। সব রেখে কেন পৌষ’কেই বলতে হলো তার? আর মানুষ ছিলো না?
খাবার টেবিলে সবার সামনে হেমন্ত পুণরায় বেশ স্বাভাবিক ভাবে বললো,

” উকিল ডাকলে না আব্বু?”
“সিদ্ধান্ত বদলাও।”
হেমন্ত হেসে ফেললো। বড় চাচা সহ বাকিরা জানে হেমন্ত মুখে বলছে না। ও এই কাজ করেই দেখাবে, বাড়ীতে নতুন বউ। আজ অনুষ্ঠান। ঝামেলা হলে মানইজ্জত দুটোই যাবে। সেঝ চাচা ঝাড়া গলায় বললেন,
“দেখ হেমন্ত, চাইলেই সব হয় না।”
“কিন্তু চাইলেই এ বাড়ীতে আজ এই কথা উঠতো না সেঝ চাচ্চু যদি সকলে সহানুভূতি দেখাতো।”
শ্রেয়া মাথা নিচু করে আছে। হেমন্ত কাল রাতে ওকে অনেক কিছুই জানিয়েছে যা শোনার পর থেকে ওর নিজেরই মায়া হচ্ছে পৌষ’র জন্য। হেমন্ত সবার দিকে তাকালো একবার এরপর বললো,
” কাল রাতে এতকিছু হলো, কই আপনাদের কেউ তো বদলালো না? সবার নাস্তাটা হয়, চা সবাই পায়। ওর জন্য এক কাপ চা কি বেশি হয়ে যায়? বেশি দুধের চা আপনারা ঠিকই খান। ওর পাতলা চা কেন খায়?”
“ওকে কেউ কিছু বলেছি… ”

সেঝ চাচিকে থামিয়ে হেমন্ত বললো,
“রোজ ক্যাঁচক্যাঁচ কার ভালো লাগে? চা পাতার বয়াম লুকিয়ে রেখেছিলেন সেঝ চাচি। এই খবর আমি জানি অথচ সংসারে পৌষ’র সম্পত্তির ভাগ ঠিকই লুটেপুটে খাচ্ছেন।”
“হেমন্ত!”
সেঝ চাচা ধমক দিতেই হেমন্ত বললো,
“সত্যি কথা গায়ে লাগে। এটাই স্বাভাবিক। হুল ফুটালে ব্যথা পাবেই সেঝ চাচ্চু৷”
পৌষ চা নিয়ে এসে থমথমে পরিবেশ দেখে একটু চমকালো। কি হলো আবার? পাত্তা না দিয়ে শ্রেয়াকে একটা ডিম সেদ্ধ দিয়ে ইনি, মিনিকে বললো,
“খেয়ে আমার কাছে আসবি।”

দুই বোন মাথা নাড়ে। হেমন্তর অনুষ্ঠান কিছুদিন পর হওয়াতে ওদের মেহেদীর রঙ ফিকে হয়েছে। দুই বোন আপার কাছে ঘ্যানঘ্যান করেছে আবার যাতে তাদের মেহেদী পড়ানো হয়।
পৌষ গিয়ে সোফায় বসে পা দুলিয়ে চা পান করছে। ওর মনে হচ্ছে কাহিনি কিছু একটা ঘটেছে। সকাল সকাল অতটা মাথা ঘামালো না ও। হেমন্ত খেয়ে উঠে পৌষ’কে বললো,
“শ্রেয়ার মেহেদীও হালকা হয়েছে। আবার দিয়ে দিবি আজ।”
মুখ বাকিয়ে পৌষ বললো,
” যার বউ সে দিক। আমি পারব না।”
“মুখটা খুব চলে তোর। মানুষ বানাতে পারলাম না৷”

পৌষ চোখ তুলে তাকালো। যখন হাসলো হেমন্ত গলে গেলো। পৌষ ডান হাতের তালু চুলকে বললো,
“হেমু ভাই, ডান হাতটা চুলকাচ্ছে। ডান হাতের তালু চুলকালে কি জানি হয়। কি হয় বলতে পারো?”
হেমন্ত চোখে হাসলো। শ্রেয়া ওখান থেকেই বললো,
“টাকা আসে পৌষ।”
“এক্কেবারে হক কথা ভাবী। কি হেমু ভাই, বউ কি বলে তোমার?”
“মেহেদী দিবি আগে। পছন্দ হলে টাকা দিব।”
“বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না হেমু ভাই।”
হেমন্ত হাসতে হাসতে বসলো ওর পাশে। চোখের কোণে পানি জমলো। বললো,
“দোকানদারকে যেই দৌড়ানি দিলি তুই।”
“ওটাকে আজ আইক্কা ওয়ালা বাঁশ গিলাতাম আমি। শালা বুইড়া খাটাস।”
“উমম, গালি দেয় না।”
“শালা গালি না।”
হেমন্ত হঠাৎ দেখলো আরো পাঁচটা ছোট বড় মানুষ ওকে ঘিরে নিজেদের হাত ইচ্ছে মতো চুলকাচ্ছে। হেমন্ত কপাল চুলকে বললো,
“চুলকে চামড়া তুলে ফেল। এরপর টাকা দিব। সব-কয়টা একই গাছের শিকড়।”

বিকেল নাগাদ বাড়ীতেই মানুষ এলো শ্রেয়াকে সাজাতে। হেমন্ত তার বউ সহ চার বোনকে সাজাতে বলেছে। ইনি, মিনি বায়না ধরে নাহয়। তাদের ঐ অপরিচিত মহিলা মুখে একটু পাউডার দিয়ে দিবে, এতেই শান্ত তারা। শ্রেয়ার মেহেদী শুকানোর পরই পৌষ সরিষার তেল ডলে দিয়ে বললো,
“ভাবী, হেমু ভাই কিন্তু তোমাকে ভালোবাসে। দেখো কত সুন্দর রঙ ধরেছে।”
শ্রেয়া লজ্জা পেলো। পৌষ উঠে বললো,
“লজ্জা পেতে হবে না এখন। সাজতে বসো। আমি আমার বাহিনীর খোঁজ নিয়ে আসি।”
দাঁড়াতেই কোমড়টা টনটন করে ওঠে পৌষ’র। অনেকটা সময় বসা ছিলো। হেমন্ত ব্যাস্ত। সেই ব্যাস্ততার মাঝে রুমে উঁকি দিয়ে বললো,

“আমার বউকে যাতে সবচাইতে বেশি সুন্দর দেখায় ওভাবেই সাজাবেন।”
মেয়েটা হাসলেও শ্রেয়া আড়ষ্ট হয়ে রইলো। তার ভীষণ লজ্জা লাগছে। হেমন্ত ছুটে গিয়ে পৌষ’কে দেখলো একবার। ও মিষ্টির প্যাকেট গুনছে। হেমন্ত রেগে ধমক দিয়ে বললো,
“তোর কাজ নেই? এখানে প্যাকেট গুনছে দাঁড়িয়ে। সাজতে বস যাহ। আলাদা মেয়ে এনেছি না? খবরদার যদি লেহেঙ্গা না পরিস! তোদের চারটার জন্য একই রকম তিন সাইজ খুঁজতে প্রচুর বেগ পেতে হয়েছে।”
পৌষ আঙুলের কড়ে ধরেই বললো,
“সেঝ চাচি বললো গুনে রাখতে। তুমি গোসলে যাচ্ছো না কেন?”
“যাব। তোকে আগে পাঠাই। তোর বিশ্বাস নেই।”
হেমন্ত সত্যিই পৌষ’কে সাজতে বসিয়ে গেলো। পৌষ শুরুতেই বলে দিলো,
“ঠিক যতটুকু না দিলেই নয় ততটুকু। ঠিক আছে?”
“জি আপু।”

মেয়েটা সুন্দর করে সাজাচ্ছে। তাকে বলা হয়েছে পৌষ’কে সুন্দর করে সাজাতে।
সেজেগুজে তৈরী পৌষ এদিক ওদিক দৌড়াচ্ছে। বড় চাচি একবার বললেন ছাদে গিয়ে চাচাকে ডেকে দিতে। পৌষ দৌড়ে গেলো সেখানে। সেখানে গিয়ে চাচাকে ডেকে আনতে গিয়ে সেঝ চাচা ধমক দিলেন। পৌষ এতগুলো পুরুষের মাঝে ডাক দেওয়াতে ধমকটা খেয়েছে। এদিকে ছোট চাচি পৌষ’কে ডাকছে। ওনার শাড়ীর কুঁচি ধরার মানুষ পাওয়া যাচ্ছে। পৌষ কুঁচি ধরেই বললো,
“তোমার জামাই কই ছোট চাচি?”
“কি জানি, লুঙ্গি উড়িয়ে দৌড়াচ্ছে কোথায় কে জানে।”
পৌষ হাসতে হাসতে বললো,
“বুড়ো হয়ে যাচ্ছো, তোমাদের প্রেম যাচ্ছে না।”
“নিজের হলে বুঝবি।”
দাঁত কেলিয়ে পৌষ ফট করে বললো,
“সম্রাট চেয়ারম্যানকে এনে দাও তাহলে।”
ছোট চাচি হাসলেন। এই মেয়ের যে কত-শত ইচ্ছে তার ইয়াত্তা নেই।

বাড়ীতে মেহমান দিয়ে ভর্তি। বিশাল বড় জায়গা বাড়ীর সামনে। অনুষ্ঠান ওখানেই কিন্তু বেশিরভাগই বাড়ীতে আসছে কারণ হেমন্ত বউ বসায় নি ওখানে। বউ তার অহরহ মানুষ দেখবে সেটা পছন্দ না হেমন্তের তাই বাড়ীর ভেতরে স্টেজ করেছে। শ্রেয়াকে বসানো হয়েছে ওখানে। পিহা সহ ইনি, মিনি ওখানে আছে। কিছু আবার খাস মেহমান আসছে হেমন্তর। তাদের ভেতরেই বসানো হবে, ওভাবেই ব্যাবস্থা করা হয়েছে। ছবি তোলার মাঝেই ডাক পড়লো হেমন্তর। তার খাস মেহমানরা এসেছে। হেমন্ত তারাতাড়ি বাইরে এলো তাদের এগিয়ে নিতে। তৌসিফ তালুকদার গাড়ি থেকে নেমে হাত মেলালো হেমন্তর সাথে। তুহিনও এসেছে আজ। তুরাগ আসে নি। তাদের সবাইকেই দাওয়াত করা হয়েছে তবে তুরাগের ছেলে আদিত্য এসেছে। হেমন্ত ওদের নিয়ে ভেতরে এলো। তৌসিফ ঢুকতে ঢুকতেই হঠাৎ সেদিনের মাইরের কথা ভাবলো। আনমনে সে চমকালো। এত ব্যাস্ততার মাঝে তার তো সেটা মনে থাকার কথা নয়। ভেতরে ঢুকে ওদের বসাতে নিলেই তৌসিফ বললো,

” পরে বসি। বউ কোথায় তোমার?”
হেমন্ত হেসে স্টেজের দিকে নিয়ে গেলো। শ্রেয়া তাদের চেনে। যথেষ্ট নামডাক তাদের। সালাম জানাতেই তৌসিফ একটা বান্ডিল দিলো শ্রেয়ার হাতে। শ্রেয়া কি করবে ভাবতেই হেমন্ত শুধু বললো,
“ভাই, এটা.. ”
তৌসিফ থামিয়ে বললো,
” এটা মুখ দেখে তোমার বউকে দিলাম হেমন্ত।”
হেমন্ত আর না করলো না। একে একে সকল মেহমান ভেতরেই আসছে বউ দেখতে। হেমন্ত খেতে তাড়া দিলো। তৌসিফ ভাই, ভাতিজা সহ তাদের কিছু লোক নিয়ে খেতে বসে। হেমন্তর তিন চাচা সহ বাকিরা তাদের বেশ খাতির যত্ন করছে।

খাওয়া শেষে তৌসিফ হাত ধুচ্ছে টেবিলেই হঠাৎ কিছু পানি ছিটকে আসতেই তৌসিফ কপাল কুঁচকালো। তার সাদা পাঞ্জাবিতে কালো কোক পড়েছে। সম্মুখেই এক পিচ্চি। হেমন্ত তারাহুরো করতেই তৌসিফ বললো,
“সমস্যা নেই। আমি পরিষ্কার করে নিব।”
হেমন্তের ঘরে বাসর সাজাচ্ছে লোকজন। তৌসিফ’কে পৌষ’র ঘরে দিয়ে হেমন্ত বললো,
“ভাই, পাঞ্জাবি আনাব?”
“আরে না, ঠিক আছে। তুমি নিচে যাও। আসছি আমি।”
হেমন্ত যেতেই তৌসিফ পাঞ্জাবি খুললো। পার্টি অফিস থেকে সোজা এখানে এসেছে। বাথরুমে ঢুকে আগে হাত মুখ ধুচ্ছে তৌসিফ। আবারও সেদিনকার কথাটা মনে পরলো ওর।
এদিকে পৌষকে সেঝ চাচি ডেকে বললেন,

” মিষ্টির প্যাকেট গুনেছিলি?”
“হ্যাঁ। রান্নাঘরে রাখা আছে।”
“আচ্ছা। আমার সাথে চল তো একটু। ঐ দিকে পানের ডালা।”
পৌষ লেহেঙ্গা সামান্য উঁচু করে যাচ্ছিলো ঠিক তখনই বড় চাচির সাথে ধাক্কা খেলো। পৌষ ভাবলো, যাহ। ধমক এখন একটা খাবে জোরসে কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে তেমন কিছু ঘটলো না। বড় চাচি পৌষর পেছনের ফিতাটা টেনে বললেন,
“কিরে এটা খোলা কেন? তারাতাড়ি ঘরে গিয়ে ঠিক কর।”
“একটু বেঁধে দাও। কখন খুললো?”
বড় চাচি নেড়েচেড়ে যেন বাকি গিট গুলোও খুললেন। পৌষ বিরক্ত হয়ে বললো,
“রাখো। আমিই করে নিব।”

পৌষ’র রুম সামনেই। ঘরে ঢুকে দরজা আড়াল করে আয়নার সামনে পিঠ দিয়ে ফিতা বাঁধতে পৌষ যখন ব্যাস্ত ঠিক তখন দু’জন মানুষ ওর জীবনের চক্র ঘুরাতে সবচাইতে জঘন্য কাজ করলো। বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো সেঝ চাচি। পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে তারা দু’জন এই পরিকল্পনা করেছেন অতঃপর দু’জনই নিচে চলে গেলেন। হেমন্তকে জিজ্ঞেস করলেন,
“পৌষকে দেখেছিস?”
“এখানেই তো ছিলো।”
“কখন থেকে খুঁজে চলছি৷ মিষ্টির প্যাকেট…”
“দেখলাম বিকেলে গুনে রাখলো।”
হেমন্ত অতটাও ভাবলো না যতটা তার ভাবা দরকার। সে তো আর জানে না মানুষের আড়ালে যে মানুষ থাকে। তাদের এক ভিন্ন চেহারা থাকে। কিছু অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য থাকে।

তৌসিফ যখন দরজা খুলে বেরিয়ে এলো তখন তার গায়ে শুধু স্যান্ডো গেঞ্জি। পৌষ’র পিঠে এলোমেলো হওয়া গিট যা ঠিক করার চেষ্টা করছে সে। দু’জন দু’জনকে দেখে এতটাই চমকালো যে কিছু বলার ভাষা পেলো না৷ পৌষ তারাতাড়ি দরজার দিকে ছুটলো, ঠিক তখনই দেখলো দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করা। পৌষ পেছনে ঘুরেই বললো,
“এখানে কি করছেন?”
“একই প্রশ্ন আমারও।”

খট করে দরজা খুললেন সেঝ চাচি। তার সাথে তিনজন এলাকার মহিলা। পৌষ’কে খোঁজার নাম করে তারা এসেছেন এখানে। ঢুকে কিন্তু তারা কিছুই দেখলো না তেমন, যতটা দেখলে ছিঃ ছিঃ করা যায়। বেশ দূরত্বে দাঁড়িয়ে তৌসিফ পৌষ। হোক তৌসিফ পাঞ্জাবী ছাড়া, হোক পৌষ’র লেহেঙ্গার উপরের পিঠে গিট এলোমেলো তা তো খারাপ দেখাচ্ছে না তাহলে নোংরামি শব্দটা কে বললো? পৌষ অবাক হয়ে দেখলো তার ঘরের ভেতরে বাইরে মানুষ গিজগিজ করছে। ওর মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে গেলো যখন দেখলো ওর বাড়ীর মানুষের সামনেই কেউ কেউ ওর চরিত্রে আঙুল তুললো। এদের মাঝে কাকে যেন খুঁজলো পৌষ। সে এলো। দৌড়ে এসেছে সে। হ্যাঁ, হেমন্ত এসেছে। পৌষ শুধু ডাকলো,
“হেমু ভাই?”

হেমন্ত ওর হাতটা শক্ত করে ধরে। ধমকে ওঠে সবাইকে,
“ফালতু কথা বলবেন না কেউ।”
“চোখে দেখেছি। নষ্টামো করছিলো তোমার চাচাতো বোন৷ নেতা মানুষ দেখেই বিছানায় ডেকে বসেছে। পুরুষ মানুষের আর কি দোষ?”
পৌষের মাথাটা যেন খুলে গেলো। তেড়ে গিয়ে জোরে এক ধাক্কা দিলো মহিলাকে। রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললো,
“বের হ আমাদের বাড়ী থেকে। তুই নষ্টামো করিস। তুই নষ্ট।”
সকলে আরেকদফা নানান বাক্য শোনালো। তৌসিফ ততক্ষণে পাঞ্জাবী পরেছে। চোখ দুটো লাল হয়ে এসেছে তার। তুহিন সহ আদিত্য দাঁড়িয়ে তার সাথে। তুহিনের মাথা কিছুটা গরম ধরনের। ও ভয়ংকর কিছু করার আগেই তৌসিফ বললো,

“আপনার স্বামীর সাথে থাকছেন কত বছর ধরে চাচি?”
মহিলা চমকে তাকালেন। তৌসিফ তালুকদার মুখ খুলেছে। কত বছর থাকছে কেন জিজ্ঞেস করছে? তুহিন কটমট দৃষ্টি ফেলে বললো,
“কার নামে কথা বলেন? স্বামী আজ বাসায় ফিরবে তো?”
মহিলা ভয় পেলেও বাকিরা যেন ছাড়লো না। মূহুর্তে ছড়িয়ে গেলো। তালুকদার বাড়ীর মেঝ ছেলের সঙ্গে হেমন্তের চাচাতো বোন ধরা খেয়েছে। কেউ কেউ বললেন এদের বিয়ে পড়িয়ে দাও। সকলে যখন ছিঃ ছিঃ শুরু করলো তখন প্রতিবাদ টিকলো না৷ পৌষ, হেমন্ত নানান ভাবে বুঝানোর চেষ্টা করছে। পৌষ সেঝ চাচির দিকে তাকিয়ে বললো,
“আপনি দেখেছেন সেঝ চাচি। আপনি সব জানেন৷ সত্যিটা বলে দিন।”

সেঝ চাচি মুখই খুললেন না। তৌসিফ মনোযোগ দিয়ে দেখলো সবটা অতঃপর গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
” ওর সাথে আমার বিয়ে ঠিক অনেক দিন আগে থেকে। আমার হবু স্ত্রীর সাথে সময় কাটাচ্ছি তাতে যে আপনাদের এত সমস্যা হবে বুঝতেই পারি নি নাহয় আপনাদের বাড়ী বাড়ী গিয়ে অনুমতি নিয়ে আসতাম।”
পৌষ অবাক হয়ে গেলো। এই মিথ্যা কেন বলছে তৌসিফ তালুকদার। কি স্বার্থ তার। একজন মহিলা বলেই ফেললেন,

“গা বাঁচাতে বলছেন।”
“আপনার কথা রাখতে আজ বিয়ে করে দেখাতে পারলাম না কারণ আপনার ঐ মুখের কথার মূল্য আমার কাছে নেই। শিঘ্রই বিয়ে হবে।”
তৌসিফ থামলো। তবুও যখন মানুষ কথা বলতে লাগলো তখন তুহিন রেগে গেলো। কোমড় থেকে পি’স্তল বের করতেই সকলে চুপ করে গেলো। একে একে সকলে বিদায় নিলো। যা রটার ততক্ষণে রটেছে। তৌসিফ কাউকে ফোন দিচ্ছে তখন। পৌষ এগিয়ে এসে দাঁড়ায় সেঝ চাচির সামনে। মেয়েটা আজ এতটা ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়েও কাঁদছে না৷ চোখে রাগ আর হাসির মিশ্রণ যা খুব কদাচিত দেখা যায়। পৌষ মুখে হাসি টেনেই বললো,

“তোমার তো মেয়ে নেই চাচি, নাহয় আজ আমার ভেতরের জলন্ত অগ্নিকুন্ড তুমি সহ তোমার মেয়েকে ধ্বংস করে দিতো। অভিশাপ মুখে দেওয়া লাগে না৷ আমি পৌষও দিলাম না তবে আমার আল্লাহ আছে মেঝ চাচি। আমার ভাই দুটো তোমার ছায়া থেকে দূরে থাকুক। আজ আমাকে তুমি বে’শ্যা বানালে, আমি নাহয় তাই হলাম। তুমি ভালো থেকো।”
হেমন্ত মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। তৌসিফ হঠাৎ ওর কাঁধে হাত রেখে বললো,
“বাইরে এসো। কথা আছে।”
হেমন্ত উঠে গেলো। তুহিন, আদিত্য যখন বের হলো পৌষ তখন একে একে গালি ছুড়লো সকলের উদ্দেশ্যে। ভয়ংকর সব গালি দিতে দিতে বলতে লাগলো,

প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ১৪ (২)

“বেরিয়ে যা। বেরিয়ে যা আমার ঘর থেকে। এখনই বের হ।”
হাতের কাছে কাঁচের জগটা যখন ছুঁড়ে দিলো তখন সত্যিই সকলে বেরিয়ে গেলো। দরজাটা তখনও খোলা। পৌষ বাথরুমে ঢুকলো। সেখানেই পা ছড়িয়ে বসে রইলো। তাকে আজ কি বানিয়ে ছাড়লো সবাই? উত্তরটা যেন এই চার দেওয়াল দিলো,
“নোংরা, বে’শ্যা”।

প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ১৬