দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ২৯

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ২৯
আফরোজা আশা

রাস্তার পাশ ঘেঁষে দুই বাঁদর একে অন্যের হাত ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছে। মুখ জুড়ে হাসির শেষ নেই। দুজনের হাতে একটা করে আইসক্রিম। কথা বলছে, খাচ্ছে আর হাঁটছে। অনেকদিন পর বের হয়েছে বেলা আর রাইমা। একাই বের হয়েছে দুজনে। মূলত রহমানের কথায় নতুন বই কিনতে বেরিয়েছে বেলা। কিন্তু বই না কিনে ঘুরে বেড়াচ্ছে দুজন। বৃষ্টিকে সাথে যেতে বলেছিল রহমান। বেলা তা শোনেনি। বড় হয়েছে বলে জেদ ধরে একা একা বাড়ি থেকে বের হয়েছে। রাইমাকে সাথে নিয়ে দুজনে এখন ঘুরছে আর খেয়ে বেড়াচ্ছে।

এক পর্যায়ে হাঁটার গতি রোধ হলো বেলার। হাত ফস্কে আধ খাওয়া আইস্ক্রিমটা পড়ে গেল মাটিতে। ধুলোয় মাখিয়ে গেল সেটা। চোখের সামনে দিয়ে লাল-কালো মিশেলের জীপ গাড়িটা পাশ কাটিয়ে চলে গেল। যতদূর দেখা গেল দেখল বেলা।
চোখ টলমলে হয়ে এসেছে ওর। মুখ আঁধারে ছেয়ে গিয়েছে। দিগন্তের পাশে কালো বোরখায় আবৃত মেয়েটা চিনতে দেরী হয় নি ওর। নিজের বোন থাকতে অন্য মেয়েকে পাশে বসিয়েছে কেনো লোকটা? সামনে রায়হানের সাথে দিশাকে না বসিয়ে মাইশাকে বসালেই হয়ে যেত। বেলার হাসি-খুশি মন নিমিষেই ভারী হয়ে গেল।
পাশ থেকে রাইমা ওর হাত ঝাঁকিয়ে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘ থামলি কেন? চল। ’
বলতে বলতে বেলার মুখের দিকে তাকাতেই চেঁচিয়ে উঠল,
‘ কিরে! কি হলো? কাঁদছিস কেন? ঝাল লেগেছে? ’
বেলা নাক টেনে বলল, ‘ আইসক্রিমে ঝাল থাকে? ’
রাইমা দুপাশে না ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘ তাহলে কি হাসতে হাসতে চোখে পানি এসেছে? ’
বেলা আবারো মাথা নাড়িয়ে না বলল। কোমড়ে হাত রেখে দৃষ্টি চিকন হলো রাইমার। বেলাকে পুনরায় বলল,
‘ হয়েছেটা কি? ’
বেলা ছলছল নেত্রদ্বয় নিয়ে রাইমাকে বলল, ‘ কান্না আসছে। ’

-‘ কেন? ’
-‘ দিগন্ত ভাইকে দেখে। ’
দিগন্তের নাম শুনে একহাত উঠিয়ে মুখ ঢাকলো রাইমা। অবাক গলায় বলল, ‘ আবার মার খেয়ে কাঁদছিস নাকি! এবার কেনো মারলো? ’
-‘ এখন মারে নি তো। ’
-‘ তাহলে? ’
-‘ জানি না। আগে আমাকে গালি দিলেও কত কেয়ার করত আর এখন আমার জায়গায় মাইশা আপুর কেয়ার করছে। আমার রাগ লাগছে খুব। কান্না আসছে কেনো জানি। ’
মুখ বাঁকালো রাইমা। বোকা গলায় বলল,

‘ এহহ! তাতে তোর কি? দিগন্ত ভাই যাকে ইচ্ছা তাকে কেয়ার করবে। তুই কাঁদবি কেন? ’
বেলা চোখ-মুখ কুঁচকে নিল। নাকের পাটা ফুলিয়ে তেজী গলায় বলল,
‘ কেনো করবে? ওই মাইশা আপুর জন্য সেদিন আমাকে মেরেছিল। তারপর থেকে এখনো আর দেখা হয়নি। কথা বলে নি আমার সাথে। আমার কি যেন হয়েছে রাইমা। ভালো লাগছে না কিছু। ’
রাইমা চরম বিস্ময় নিয়ে বলে উঠল,

‘ সর্বনাশ! এই বেলা! কাহিনী কি তোর? জ্বেলাস; জ্বেলাস ভাব কেনো? ’
বেলা রাগ নিয়ে বলল, ‘ জানি না! কিছু জানি না আমি। ওদেরকে দেখার পর থেকেই ভেতরে কেমন অস্থির লাগছে। ’
রাইমা কপালে হাত রেখে বড় বড় চোখে তাকিয়ে বলল,
‘ সেকিরে! দিগন্ত ভাইয়ের হাতে চড় খেয়ে তুই কি তার প্রেমে পড়ে গেলি? হায়! হায়! এ কি সর্বনাশী কান্ড! ’
টলটল চোখজোড়া নিয়ে রাইমার উপর তেঁতিয়ে উঠল বেলা,
‘ ধুর! খুব বেশি কথা বলিস তুই। দেখছিস না আমার কান্না পাচ্ছে। তুই না আমার বেস্টু। মন ভালো করতে পারছিস না কেনো? উফফ! তোকেই বিরক্ত লাগছে এখন। কেউ ভালো না। থাক গেলাম। ’
বলেই ধুপধাপ পা ফেলে বাড়ির পথে চলে গেল বেলা। এদিকে রাইমা হতবাকের ন্যায় থ মেরে চেয়ে আছে বেলার যাওয়ার দিকে। অবশিষ্ট আইসক্রিমটুকু গলে টলে হাতে মাখিয়ে গিয়েছে। বেলার অদ্ভুত আচরণ দেখে রীতিমতো বোকা বনে গিয়েছে ও।

রাতের প্রহর চলছে। পুরো রুম জুড়ে অন্ধকারের ছড়াছড়ি। শুনশান নিরবতা পালন করছে সারা রুমময়। শুধু সিলিং ফ্যানের বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ ভাসছে। এই অন্ধকার রুমে বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছে বেলা। চোখে ঘুম ধরা দিচ্ছে না। যেভাবেই শুচ্ছে শান্তি মিলছে না। অনেকক্ষন ঘুমানোর জন্য যুদ্ধ করল কিন্তু ঘুম বাবাজি কিছুতেই আসলো না। মাথায় চিনচিনে ব্যাথা করছে। শোয়া থেকে উঠে বসল বেলা। একটু এগিয়ে হাতড়িয়ে জানালার পাল্লা খুলে দিল। চাঁদনী রাতের হালকা আলোক ছিটায় পড়ল এতোক্ষনের গুমোট অন্ধকার রুমটাতে।

বালিশের নিচে হাতিয়ে একটা বাটন ফোন টেনে আনলো। এটা আমেনার ফোন। মায়ের কাছ থেকে সময় দেখবে বলে বাহানা দিয়ে নিয়ে এসেছে বেলা। ফোন ঘেটে একটা নাম্বার বের করে সেদিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষন। রাত প্রায় দুটো বাজে। এতো রাতে নিশ্চয়ই ঘুমিয়েছে। এই ভেবে ফোনটা আবার রাখতে নিল কিন্তু পরক্ষনেই মুখ বাঁকিয়ে কল লাগিয়ে দিল। ঘুমালে ঘুমাক বেলার কি! ওর ফোন দিতে ইচ্ছে হয়েছে যখন তখন দিবেই।
প্রথম বারেই ফোন তুলল অপরপাশের বান্দা। ফোন রিসিভ হতে দেখে আশ্চর্য হলো বেলা। কেনো যেন ভয়ও পেল। তড়িঘড়ি করে লাইন কেটে দিল। কি সাংঘাতিক! লোকটা এতো রাতেই জেগে আছে। বেলা ভেবেছিল ঘুমিয়ে গিয়েছে। ফোন দিলে ধরবে না। তাই সহজ সরল মনে ফোন লাগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এটা কি হলো! ঠোঁট উল্টে কেঁদে দিল বেলা। কান্নার কোনো আওয়াজ নেই। শুধু চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। নিজের মুড সুইংয়ের উপর নিজেই বিরক্ত বেলা। এখনি হাসছে তো পরক্ষনেই কাঁদছে। বেশির ভাগ কাঁদতেই ভালো লাগছে। শান্তি লাগছে!

কান্নার মাঝে খেয়াল করল ফোনের আলো জ্বলছে। সাথে বিপ বিপ করে শব্দ ভাসছে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরল বেলা। দিগন্তের নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। এখন কি করবে! ফোনটা তুলবে নাকি তুলবে না? তুললেও কি বলবে? এতো শত ভাবনার মাঝে বড় একটা শ্বাস টানলো তারপর ফট করে ফোন তুলে কানে চেপে ধরল। আর টু শব্দও নেই মুখে। চুপচাও সেভাবেই থাকল। সেকেন্ড গড়ালো, মিনিট গড়ালো। অবশেষে মিনিট পাঁচেক যাওয়ার পর অপর পাশ থেকে গম্ভীর স্বরের ধমকি এসে বেলার কানে ধাক্কা খেলো,

‘ এতো রাতে না ঘুমিয়ে ফোনে কি করছিস? কাকে ফোন দিতে গিয়ে আমাকে দিয়েছিলি? ’
কথা বলবে না বেলা। কেনো যেন মনের ভেতরে জেদ আসছে প্রচুর। জেদ নিয়েই চুপ করে রইল। জবাব দিল না দিগন্তের প্রশ্নের।
দিগন্ত পুনরায় বলল, ‘ এই অসভ্য মেয়ে! কথা বলছিস না কেনো? ’
তবুও কথা নেই বেলার মুখে। দিগন্ত কিছুটা নরম হলো। হালকা আওয়াজে ডাকল,
‘ বেলা! ’
ডাক শুনে আরো কান্না পেল বেলার। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। দিগন্ত নিরবে শুনল ওর কান্নার স্বর। বেলকনির মেঝেতে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে দিগন্ত। একহাতে সিগারেট জ্বলছে আরেক হাতে ফোন ধরে রেখেছে। বেলার কান্নার স্বর শুনে একটা শুকনো ঢোক চাপলো। অতঃপর আবারো নরম গলায় ডাকলো,

‘ বেলা! কথা বল। ’
কান্নারত গলায় ধীর স্বরে বেলা বলল, ‘ না। ’
এতোদিন পর বেলার আওয়াজ শুনে প্রশান্ত হলো দিগন্তের মনকুঠুরি। চোখজোড়া বন্ধ করে মাথা এলিয়ে দিয়ে দেওয়ালের সাথে রাখল।
‘ ঘুমাস নি কেনো? ’
-‘ কথা বলব না। ’
-‘ কাকে ফোন দিতে চাইছিলি? ’
-‘ কথা বলব না। ’
-‘ কাঁদছিস কেনো? ‘
-‘ বলব না। ’
-‘ আমাকে ফোন দিতে চাইছিলি নাকি অন্য কাউকে? ’
-‘ কথা বলব না মানে বলব না। ’
-‘ রাখছি। ’
দিগন্তের রাখছি শুনে অস্থির হলো বেলার মন। চটপট গলায় বলল,

‘ আপনি অনেক পাল্টে গিয়েছেন। আগেই ভালো ছিলেন। মাইশা আপু আসার পর থেকে খারাপ হয়ে গিয়েছেন। ’
চোখ বন্ধ রেখেই হালকা হাসল দিগন্ত। প্রশ্নাত্মক গলায় বলল,
‘ কিভাবে খারাপ হলাম? ’
বেলা নাক টেনে বলল, ‘ আগে সব সময় গালি দিতেন আবার ভালোভাবে কথাও বলতেন। বেয়াদব বলতেন। বিরক্ত হতেন। এখন কেমন যেন হয়ে গেলেন। একবারো বেয়াদব বললেন না। বিরক্ত হয়ে ধমকালেন না। আপনি খুব খারাপ। ’
-‘ গালি দিলে মানুষ খারাপ হয় জানতাম। এখন গালি না দিয়ে আমি খারাপ হয়ে গেলাম? তোর সব উল্টো হিসেব কেনো রে? ’

-‘ আপনি ঘুমান নি কেনো? এতো রাতে জেগে কি করছেন? ’
-‘ তোকে কৈফিয়ত দিতে হবে? মুখ তো ভালো চলছে এখন। আমার সাথে উঁচু আওয়াজে কথা বলছিস। দিলে ভয় লাগে না। ’
বেলা মুখ লটকিয়ে জবাব দিল, ‘ লাগছে না তো। এখন কি করব? ’
-‘ ভয় পাবি আমাকে। আমার সাথে উঁচু আওয়াজে কথা বলবি না। মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। ’
-‘ আচ্ছা। ’
-‘ কি আচ্ছা? ’
-‘ আপনাকে ভয় পাবো না। উঁচু আওয়াজে কথা বলব যেন আপনার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। ’
বেলার কথা শুনে দুই ভ্রুঁর মাঝে ভাঁজ পড়ল দিগন্তের। গম্ভীর গলায় বলল,
‘ সুর পাল্টে গেল কিভাবে? উল্টো কথা বলা শুরু করেছিস কেনো? ’
-‘ আপনি মানুষটা পাল্টাতে পারলে আমার সুর পাল্টানো আর এমন কি আহামরি ব্যাপার! ’
-‘ বেশি কথা বলছিস না। আগের থেকে বেয়াদব হয়ে যাচ্ছিস। ’
এককান থেকে আরেককানে ফোন নিয়ে জানালা দিয়ে বাহিরের পানে তাকালো বেলা। উদাস গলায় ডাকলো,

‘ দিগন্ত ভাই! ’
-‘ হু ’
-‘ আপনি মাইশা আপুকে গ্রামে পাঠিয়ে দেন। ’
-‘ নাহ ’
দিগন্তের উত্তর শুনে কেঁপে উঠল বেলার গলা। জোরে জোরে কয়েকবার পলক ঝাপটে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে উঠল,
‘ না কেনো? আপনাদের বাড়ির একটা কাজের মেয়েকে নিয়ে এতো ভাবনা কেনো হবে আপনার। ওকে সাথে নিয়ে ঘুরেন কেনো? এতো ভালো লাগে… ’
আর বলা হলো না বেলার। টুট টুট শব্দ তুলে লাইন বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে দিগন্ত। সেটা দেখে চোখমুখ লাল হয়ে গেল বেলার। চুপ করে থম মেরে বসে রইল সেভাবেই। অশ্রুকণা গড়াচ্ছে সেদিকে খেয়াল নেই। পলকও ফেলছে না আর। কি যেন ভাবছে তো ভাবছেই।

শহর জেগে উঠছে ধীরে ধীরে। সকাল হয়েছে ধরণীগাত্রে। চিন্তিত মুখে পুরো ঘরময় পায়চারি করছে রহমান। বেলার মাথার কাছে বসে জলপট্টি দিচ্ছে আমেনা। বৃষ্টি থার্মোমিটার হাতে নিয়ে আবারো চেক করল বেলা শরীরের তাপমাত্রা। থার্মোমিটারের পারদ দেখে চিন্তিত স্বরে বলল,

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ২৮

‘ কমছেই না তো। ১০৫° এ উঠেছে। ওর হুশ জ্ঞান কিছু নেই। ’
আমেনার চোখের পাতা ভেজা। রহমানের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ হাসপাতালে নেওয়া দরকার। আর দেরী করা ঠিক হবে না। গায়ে হাত দেওয়া যাচ্ছে না। আমার বাচ্চা মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে দেখছেন না। ’
রহমান বেলার কাছে এসে ওর গালে কপালে হাত দিয়ে দেখল। কয়েকবার ডাকলো ওকে কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নেই।

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৩০