প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৮৩ (২)

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৮৩ (২)
আদ্রিতা নিশি

পুরো রাজশাহী শহর ঘুরে বাইকে আনন্দে মজে সবাই অবশেষে চৌধুরী বাড়ি ফিরেছে সন্ধ্যার সময়। আবির ও অরিন নিজেদের বাসায় চলে গেছে ওদিক দিয়েই। রাতের খাবার খেয়ে এবং একচোট জমজমাট আড্ডার পর যে যার মতো ঘুমোতে গিয়েছে। ঘড়ির কাঁটা ঠিক দশটা। অরিত্রিকা বিছানায় হেলান দিয়ে আধো ঝিমুনির মধ্যে বই হাতে বসে আছে। সামনে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা, হাতে মাত্র দুই মাস সময়। পড়াশোনা নিয়ে তার আগ্রহ বরাবরের মতোই কম।কিন্তু এবার সারহানকে হেলাফেলা করা যাবে না। মানুষটা এমন হুমকি দিয়েছে যা তার কিডনি লক করে দিয়েছে। সে যদি পরীক্ষায় ফেল করে, তবে বদমেজাজি মানুষটা তাকে রেখে বাবুকে নিয়ে আলাদা রুমে থাকবে এবং অরিত্রিকার কাছে আসবে না, ভালোও বাসবে না। অরিত্রিকার মুখ গম্ভীর হলেও মনে মনে সে হেসেই চলেছে। জানে এসব আসলেই সারহানের আদরের ধমকি ছাড়া কিছু না। তবুও, প্রিয় মানুষটার মানসম্মান রাখার স্বার্থে পাশটা তো করতে হবে। দরজা বন্ধ করার শব্দে অরিত্রিকার ঘুম ছুটে যায়। সে দু-চোখ কচলে সামনে তাকায়। সারহানকে আসতে দেখে ওষ্ঠকোণ প্রসারিত হয়ে আসে। কিন্তু মানুষটার হাতে গ্লাস ভর্তি দুধ দেখে হাসি গায়েব হয়ে যায়। চোখ – মুখ কুঁচকে আসে। দুই মাস ধরে নিয়ম করে দুধ খেতে খেতে তার অবস্থা কাহিল।

“নাউ ফিনিশ ইট।”
সারহান এগিয়ে এসে দুধের গ্লাসটা বাড়িয়ে দিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলল। অরিত্রিকা নাক মুখ সিটকে বলল;
“খেতে ইচ্ছে করছে না। আপনি খেয়ে নিন।”
সারহান শান্ত চাহনিতে তাকাল। মেয়েটা প্রতিদিন এমন কথা বলে। ভালো খাবার খাবে না অথচ অন্যসব খাবার দেখলে যেন হুশ থাকে না। সে পাশে বসল। ভ্রুকুটি নাচিয়ে বলল;
“এক মিনিটের মধ্যে এটা ফিনিশ করবি। কোনো এক্সকিউজ চলবে না।”
অরিত্রিকা ঠান্ডা হুমকিতে হচকচিয়ে গেল। অসহায় চাহনিতে তাকিয়ে গ্লাসটি নিয়ে গমগমে কন্ঠে বলল;
“আমার বাবুটার জন্য সবকিছু সহ্য করছি।”
সারহানের কপালে সূক্ষ্ম ভাজ পড়ল। গম্ভীর কণ্ঠে টেনে বলল;
“শুধু তোর বাবু? হুম!”
অরিত্রিকা থতমত খেল। চোরা চাহনিতে তাকিয়ে ঢকঢক করে সম্পূর্ণ দুধ খেয়ে গ্লাসটা বাড়িয়ে দিল সামনে। অতঃপর সাফাই গেয়ে বলল;
“উহু!আমাদের বাবু।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সারহান গ্লাসটি হাত থেকে নিয়ে উঠে গিয়ে টেবিলের ওপর রাখল। তারপর এগিয়ে এসে অরিত্রিকার হাত থেকে বইটা নিয়ে রেখে দিল। অরিত্রিকার মুখশ্রী চকচক করে উঠল৷ অবশেষে পড়াশোনা থেকে মুক্তি পেল। সে আয়েশ করে শুয়ে পড়ল বিছানায়। সারহান রুমের লাইটটা নিভিয়ে দিয়ে এসে আস্তে ধীরে অরিত্রিকার পাশে খানিকটা দুরত্ব বজায় রেখে শুয়ে পড়ল। যেদিন থেকে জেনেছে তার বউটা প্রেগন্যান্ট সেদিন থেকে সাবধানতা অবলম্বন করে চলছে যেন অসাবধানতাবশত লেগে না যায়।অন্ধকারাচ্ছন্ন রুমের বাহির হতে থাই গ্লাস গলিয়ে আসা ক্ষীণ আলোয় অন্ধকার ঘুচেছে। অরিত্রিকা সেই আবছা আলোয় পিটপিটিয়ে চায়। অস্পষ্ট দেখতে শ্যামমানবের অবয়ব। সে নিঃশব্দে হাসল। তারপরে চুপচাপ কাছ ঘেষে দুরত্ব কমিয়ে প্রশস্ত বুকে মাথা রেখে আলতো ভাবে জড়িয়ে ঘাপটি মেরে রইল।
“কি চাই?”

সারহান মেয়েলী শরীরটা অতি সাবধানে জড়িয়ে ধরল। ওষ্ঠ কামড়ে হেসে নিচু স্বরে বলল। মেয়েটার নিত্যদিনের আচরণ তার বুকে মাথা রেখে ঘুমানো। অরিত্রিকা লাজুক হাসল। ফিসফিসিয়ে বলল;
“সানিয়াত আর সানিয়াতের আম্মা আদর চায়।”
সারহান আরেকটু দৃঢ়ভাবে আলিঙ্গন করল। ওষ্ঠপুট ছুঁইয়ে দিল মেয়েলী চুলের ভাঁজে। হাতটা দিয়ে আদুরে ভঙ্গিতে ছুঁয়ে দিল মৃদু উঁচু মেয়েলী উদরটা। আলতো করে নেড়ে বাবুটাকে আদর করে দিল। এতো সুন্দর অনুভূতি হচ্ছে যা অবর্ণনীয়। এ মুহুর্তে নিজেকে সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে।অরিত্রিকা আদুরে বিড়ালছানার ন্যায় মিশেছে প্রিয় মানুষের বুকে।
“নেতাসাহেব?”

অরিত্রিকা কুন্ঠা ঠেলে ডেকে ওঠে। সারহান ছোট্ট করে প্রতিত্তোর করল;
“হুম।”
অরিত্রিকা কেমন আনমনা ভাব নিয়ে বলল;
“আমাকে ছাড়া আপনি থাকতে পারবেন?”
“মানে?”
“উমম… অনেকে বাচ্চা ডেলিভারির সময় মা*রা যায়। আমিও যদি ম*রে যাই, আপনি কি আমায় ছাড়া থাকতে পারবেন?”
“ফাইরুজ! কি বলছিস তুই?”
“বলুন না।”

অরিত্রিকা গুরুগম্ভীর পুরুষালী কন্ঠস্বর শুনে চমকে যায়। তবুও আগ্রহী কন্ঠে আওড়ায়। সারহান বক্ষস্থল চিনচিনে ব্য*থার উৎপত্তি হয়। কেমন যেন দমবন্ধকর লাগে। এই চঞ্চল মেয়েটাকে ছাড়া এক মুহুর্ত কল্পনা করা মৃ*ত্যুসম ব্যাপার। সে প্রতিনিয়ত দুশ্চিন্তায় নিমজ্জিত থাকে। তবে তা আড়াল করে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে। এ ভাবনার সমাপ্তি ঘটায় এক দীর্ঘ শ্বাস টেনে। কন্ঠে কোমলতা এনে আওড়ায় ;
“ফাইরুজ, তোকে ছাড়া এক মুহূর্তও কল্পনা করা আমার কাছে মৃ*ত্যুর সমান। তুই আমার জীবনে কতটা গভীরভাবে জড়িয়ে আছিস, তা ভাষায় বোঝানো সম্ভব নয়। তোর জীবনে যদি কোনো বিপদ আসে, আমি চাই সেটা আগে আমায় আঘাত করুক, তোকে কখনো না ছুঁক।”
অরিত্রিকা খারাপ লাগা কর্পূরের ন্যায় মিলিয়ে গেল। অন্তঃকোণে বইয়ে গেল শিহরণ। সে তৃপ্ত হাসল। তবুও বলল;
“আমার যদি কিছু হয়ে যায়, আপনি বাবুকে অনেক আদর দিবেন। অনেক ভালোবাসবেন যেন মায়ের অভাব বুঝতে না পারে।”

সারহান হঠাৎ চেতে গেল;চিবিয়ে চিবিয়ে বলল;
“ রাতের বেলায় মাথায় আউল ফাউল চিন্তা কোথায় থেকে আসছে?”
অরিত্রিকা কেঁপে উঠল;
“আমি তো এমনি জানতে চাইলাম।”
“যতসব আজগুবি চিন্তা তোর মাথায় এসে ভর করে। তুই ইনিবিনিয়ে কি জানতে চাইছিস বল?”
“না মানে…”
“বলতে বলেছি।”
“আমার কিছু হয়ে গেলে আপনি আরেকটা বিয়ে করবেন কিনা জানতে… চাইছি।”
অরিত্রিকা শুকনো ঢোক গিলে মিনমিন করে বলল। সারহান বিমূঢ় চাহনিতে আবছা মেয়েলী অবয়বটা দেখল একপলক। রাত-বিরেতে তার পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে? সে রুদ্ধ শ্বাস ফেলল। কন্ঠে দৃঢ়তা এনে বলল;
“আর একটা কথা বললে তোর খবর আছে। চুপচাপ মুখ বন্ধ করে ঘুমা।”
অরিত্রিকা চক্ষুদ্বয় বন্ধ করল। ক্ষীণ কন্ঠে শাসিয়ে বলল;
“শুনুন, আপনি শুধু আমার। আমার যদি কিছু হয়ে যায় তাও অন্য মেয়েকে বিয়ে করতে পারবেন না। যদি ওমন করার চিন্তা ভাবনা করেন তাহলে আমি ভূত হয়ে আপনার ঘাড়ে চাপবো। তারপর ঘাড় মটকিয়ে আমার সাথে নিয়ে যাব।”

সারহান না হেসে গম্ভীর কণ্ঠে বলল;
“না ঘুমালে আমি তোর মাথায় কিন্তু বই চাপিয়ে দেব। সারারাত না ঘুমিয়ে পুরো বই কমপ্লিট করতে হবে।”
“আপনি একটুও বদলালেন না নেতাসাহেব। রোমান্টিক সময়ে সিরিয়াস কথা বলেন। এভাবে চললে তো নিরামিষ হয়ে যাবেন। একটু বেশী করে বউকে ভালোবাসতে শিখুন।”
“একটু বেশী ভালোবাসতে গিয়েই তো বাবা হয়ে গেলাম।”
সারহান নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল। অরিত্রিকা ঝট করে চক্ষুদ্বয় খুলে ফেলল। তার কান দুটো গরম হয়ে গেল। এ মানুষটা তাকে সবসময় লজ্জায় ফেলে দেয় কেন? আর আগে বাড়িয়ে কোনো কথা বলবে না। দরকার হলে মুখে কুলুপ এঁটে থাকবে।

সকালের আবহাওয়া আজ অন্যরকম। শরতের অম্বরে ধূসর-কালো মেঘের আনাগোনা। সূর্যের দেখা মিলেনি। প্রকৃতিতে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। কেমন যেন অতিরিক্ত ভেপসা গরমের আবির্ভাব ঘটেছে। হয়তো ঝুপঝাপ বৃষ্টি আসবে। অরিত্রিকা বেলকনিতে বসে থেকে আরামসে আমের আচার খাচ্ছে। টক-ঝাল-মিষ্টি আচার দেখতে লোভনীয় , খেতেও স্বাদ। সে খাচ্ছে আর বাহিরের গুমোট পরিবেশ দেখছে। সকাল এগারোটা পেরিয়েছে। চৌধুরী বাড়ির লোকজন অরিনের বাড়িতে গিয়েছে। আবির সকালে কল দিয়ে সবাইকে জরুরী ভাবে ডেকেছে। কেন ডেকেছে তা জানা নেই। অরিত্রিকা, সারহান, ইশরা আর সাদাত ব্যতিত সবাই সেখানে গেছে।
সারহান গোসল করে টি-শার্ট পড়ে ফোনটা হাতে নিয়ে এসে চেয়ারটা টেনে অরিত্রিকার পাশে বসল। মেয়েটি তখুনো অন্য ধ্যানে নিবিষ্ট। সে গলা খাঁকড়ি দিয়ে বলল;

“সবার সাথে যেতে দেইনি তাই এখনো রাগ করে আছিস?”
অরিত্রিকার ভাবনার জাল ছিন্ন হয়। সে দৃষ্টি ফিরিয়ে সরাসরি তাকাল সারহানের দিকে। দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে বলল;
“উহু! রেগে নেই।”
“তাহলে চুপচাপ আছিস কেন?”
“বাহিরের আবহাওয়া দেখছিলাম। মনে হয় বৃষ্টি হবে।”
“হুম। বৃষ্টি হবে।”
“কতোদিন বৃষ্টিতে ভিজি না।”
অরিত্রিকা বিমর্ষ গলায় বলল।তখুনি ফোনের কর্কশ শব্দে চতুর্দিক প্রতিধ্বনিত হলো। সারহান ফোন স্কিনে নজর রাখতে দেখল আবির কল করেছে। সে কল রিসিভ করে কানে গুঁজল। অপর পাশ থেকে ভেসে আসলো কন্ঠস্বর;
“দোস্ত! আমি পিছিয়ে নেই।”
সারহানের কপাল কুঁচকে গেল। দৃঢ় কন্ঠে বলল;

“মানে?”
আবিরের উচ্ছসিত কন্ঠস্বর ;
“শালিকা আছে তোর আশেপাশে।”
“হুম।”
“তাহলে লাউডে দে।”
সারহান ফোন লাউড স্পিকারে দিল। আবির শব্দ করে হেসে উচ্ছসিত কন্ঠে বলে উঠল;
“দোস্ত!”
সারহান বিরক্তিসূচক কন্ঠে বলল;
“দ্রুত বল।”
অরিত্রিকা আগ্রহী ভঙ্গিমায় কথাগুলো শুনছে। কিন্তু বুঝতে পারছেনা ভাইয়ার আনন্দের কারণ।
আবির উচ্চ স্বরে বলল;
“এতোদিন আফসোস করেছি তুই বিয়ে করলি পরে বাপ হলি আগে। এখন আমার কোনো আফসোস নেই। আমি কিন্তু এবার তোর থেকে পিছিয়ে নেই। আমি বাবা হচ্ছি দোস্ত! তুই আর শালিকা মামা-মামী, খালামনি-খালুজান হচ্ছিস।”

অরিত্রিকা বিস্মিত হলো। সে খালামনি হচ্ছে? তারমানে অরিন আপু প্রেগন্যান্ট? সারহানের মুখ অতিশয় গম্ভীর হয়ে গেল। এ ছেলে বাবা হওয়া নিয়েও প্রতিযোগিতা করে? সে খুশি হয়েছে তবে তা গোপন রাখল। গাম্ভীর্যতা এঁটে প্রতিত্তোর করল;
“ কংগ্রাচুলেশনস। অবশেষে তোর মনের ইচ্ছে পূরণ হলো।”
আবির হেসে বলল;
“হুমম। আহ! শান্তি লাগছে। এদিনটার জন্য কতো…”
সারহান চাপা স্বরে ধমকে বলল;
“বাপ হচ্ছিস এবার অন্তত মুখে লাগাম টান।”
আবির হুহা করে হেসে দিল। অরিত্রিকা বিস্মিত ভাব গিলে প্রাণোচ্ছল কন্ঠে বলল;
“অভিনন্দন ভাইয়া। আপুকে আমার তরফ থেকে অভিনন্দন জানিয়ে দিয়েন।”
“আচ্ছা শালিকা। পরে কথা বলছি।”
আবির কল কেটে দিল। অরিত্রিকা হেসে বলে উঠল;
“আমাদের বাড়িতে দুটো পুচকু আসবে।”

সারহান হাস্যজ্জ্বল অর্ধাঙ্গিনীর পানে তাকাল৷ মেয়েটি খালামনি হওয়ার সুখবরে বেশ খুশি হয়েছে। অরিত্রিকা হেসে হেসে তার খুশি – আনন্দ প্রকাশ করতে লাগল আর সারহান? সে তো অনিমেষ বিমুগ্ধ নয়নে নীরব শ্রোতা হয়ে প্রাণোচ্ছল কন্ঠ শুনতে লাগল।
সময়টা দুপুর। বাহিরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে। প্রকৃতির বুকে বইছে দমকা হাওয়া। অরিত্রিকা গোসল সেরে রুমে এসে বিছানায় বসেছে। মাথায় তোয়ালে জড়ানো। পাশেই লেভি বসে আছে ভদ্র ভঙ্গিতে। অবুঝ প্রাণীটির এখন এ রুমে অবাধ বিচরণ। সারহান পূর্বের মতো রাগ করে না। বরঞ্চ আদর না করলেও যত্ন করে। দমকা হাওয়ার শব্দে তার মনোযোগ বিঘ্নিত হয়। সে সরাসরি তাকায় বেলকনির দিকে। বাহিরে ঝড়, বৃষ্টি মিশেল অবস্থা।
“নিচ চল। তোর খাওয়ার সময় হয়ে গেছে।”

পুরুষালি কন্ঠস্বর কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই অরিত্রিকা দৃষ্টি ফিরিয়ে সরাসরি চায় সামনে। তার দৃষ্টি দন্ডায়মান মানুষটির দিকে স্থির হতে স্তম্ভিত হয়ে যায়। এক লাফে দাঁড়িয়ে গোলগোল চোখ করে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পরখ করে। এ কি অবস্থা? টি-শার্ট, মুখে হলুদ রঙের মতে কি যেন লেগে আছে। সেসব ছাপিয়ে তার চোখে বিঁধল মানুষটার ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। সে দ্রুত পায়ে ছুটে গেল। শঙ্কিত হয়ে বলল;
“এসব কি অবস্থা আপনার? কি করছিলেন বলুন তো?”
সারহান শীতল চাহনিতে তাকাল উদ্বিগ্ন সুশ্রী মুখপানে। সটান হয়ে দাঁড়িয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জবাব দিল;
“তোর জন্য রান্না করছিলাম।”

অরিত্রিকার মুখ হা হয়ে গেল। বিস্মিত কন্ঠে বলল ;
“কি আপনি আমার জন্য রান্না করছিলেন?”
সারহান স্বাভাবিক ভাবে বলল;
“হুম।”
“আপনাকে কে রান্না করতে বলেছে? ইশ! কি অবস্থা করেছেন নিজের। এদিকে আসুন মুখে লেগে থাকা হলুদের গুঁড়ো মুছে দিচ্ছি।”
“লাগবে না মুছে দেওয়া। আগে চল।”
“কিন্তু…”

সারহান কোনো কথা না শুনে অরিত্রিকাকে এক প্রকার জোর করে নিয়ে গেল। টেবিলে সাজানো ভুনা খিচুড়ি, ইলিশ মাছ ভাজি আর বেগুন ভাজি— সাথে সালাদ আছে। অরিত্রিকা ডাইনিং রুমে ঢুকে খাবারের পসরা দেখে অবাক হয়ে গেল। সে তো সকালে বলেছিল এসব খাবার খেতে ইচ্ছে করছে। মানুষটা তার জন্য রান্না করেছে ভাবতেই মনটা পুলকিত হয়ে গেল। ভালোলাগায় সিক্ত হলো সে। হঠাৎ তার দৃষ্টি আটকালো চেয়ারে বসে কপালে হাত দেওয়া সাদাতের দিকে। মাথা, মুখ ভর্তি সাদা ময়দায় ভূতের মতো লাগছে। তারমানে দুই ভাই মিলে যুদ্ধ করে রান্না করেছে। সে শব্দ করে হেসে উঠল। সাদাত মুখ গম্ভীর করে তাকাল। গমগমে কন্ঠে বলল;

“হাসছিস কেন?”
অরিত্রিকা হাসতে হাসতে বলল;
“তোর এ অবস্থা কি করে হলো?”
“ময়দার কন্টেইনার মাথার ওপর পড়েছিল।”
“ময়দা দিয়ে সাদা খিচুড়ি বানাতে চেয়েছিলি নাকি?”
“পরোটা বানাতে চেয়েছিলাম। মা এসে রান্নাঘর আর ময়দার বেহাল অবস্থা দেখে আমাদের দুই ভাইকে আজ আস্ত রাখবে না।”
“ভাই তোকে দেখতে সাদা বানরের মতো লাগছে। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে আয়।”

অরিত্রিকা হাসি বজায় রেখে চেয়ার টেনে এসে বসল। এর মাঝে দেখা পাওয়া গেল ইশরার। সে গোসল করে খাবার খেতে এসে দেখল গরম গরম খাবার টেবিলে। সেসব বাদেও আরও একজনের দিকে নজর গেল। মুহুর্তে দম ফাটা হাসিতে ফেটে পড়ল। হাসতে হাসতে বলল;
“নিজের কি হাল বানিয়ে রেখেছিস?”
সাদাত উঠে পড়ল চেয়ার থেকে। কটমট করে তাকিয়ে বলল;
“হাসছিস লজ্জা করছে না? মেয়ে হয়ে রান্না করতে পারিস না কেন?”
“কে বলেছে রান্না করতে পারি না?”
“কেমন রান্না করতে পারিস জানি আমি। অরিত্রিকা বানায় পারমাণবিক পায়েস আর তুই বানাবি ক*কটেল তরকারি।”

“এই আমায় অপমান করছিস কেন? এতো বড় বড় লেকচার দিচ্ছিস তুই রান্না করতে পারিস?”
“সামনে যেসব দেখছিস ভাই আর আমি মিলে রান্না করেছি।”
কথাটা বলে সাদাত গটগট করে হেটে ফ্রেশ হতে চলে গেল। অরিত্রিকা এবং ইশরা একে ওপরের দিকে তাকাল। তাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো সারহান ও সাদাত রান্না করেছে। কিছুক্ষণ পরে দুই ভাই ফ্রেশ হয়ে আসলো। তারপর প্লেটে খাবার বেড়ে পরিবেশন করল, নিজেদের প্লেট বেড়ে বসে পড়ল চেয়ারে।
“সত্যি আপনি রান্না করেছেন?”
অরিত্রিকা সামান্য খাবার মুখে তুলে বিস্ময়াভিভূত কন্ঠে বলে উঠল। খাবারগুলো খাওয়ার উপযোগী এবং সুস্বাদু! সারহান গম্ভীর কণ্ঠে বলল;
“হুম।”
অরিত্রিকা পূর্বের ন্যায় বলল;

“আপনি তো রান্না করতে জানেন না। কিভাবে এতো টেস্টি রান্না করলেন?”
“ইউটিউব দেখে।”
“বাহ! ভালোই হলো রান্না শিখেছেন। এবার মাঝে মাঝে আমাদের রান্না করে খাওয়াবেন।”
অরিত্রিকা ভ্রু নাচিয়ে বলল। সারহান নিঃশব্দে হাসল। ইশরা খাবার খেয়ে দেখল সত্যি স্বাদ হয়েছে। সে সাদাতের দিকে তাকাল। একগাল হেসে বলল;
“প্রতিটা মেয়ের ইচ্ছে থাকে হাসবেন্ডের হাতের রান্না খাওয়ার।”
সাদাত ইশরার দিকে তাকাল। গমগমে কন্ঠে বলল;
“প্রতিটা ছেলের ইচ্ছে থাকে ওয়াইফের হাতে রান্না খাওয়ার। তবে ভাই আর আমার কপালে জুটবে নাকি সন্দেহ আছে।”
ব্যস!অরিত্রিকা ইশরা সাদাতের সাথে লেগে গেল। সারহান হতাশা পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখল। একজন নাকি তার বাচ্চার মা হবে আর বাকি দুজনের নাকি বিয়ে হবে!

শরতে পেরিয়ে প্রকৃতিতে এসেছে শীতের আমেজ।সকালের কুয়াশা মিলিয়ে গিয়ে সূর্যের নরম আলো দালানকোঠার ফাঁক গলে নেমে আসছে রাস্তায়। সূর্যের সোনালী রশ্মির হালকা উষ্ণতায় শীতের কনকনানি কমিয়ে দিচ্ছে। হাওয়ার তেমন দোলাচল নেই। তবুও মৃদু শীতল হাওয়ার সাথে এই নরম রৌদ্রস্নাত শহরের কোলাহলকেও কিছুটা প্রশান্ত করে তুলছে। পদ্মা নদী হতে ধেয়ে আসা মৃদুমন্দ শীতল হাওয়ায় এবার শীতের প্রকোপ বেশি। পুরোপুরি শীতের আবহ পড়লে মাত্রা বাড়ার সম্ভবনা বেশী।

অরিত্রিকা দোলনায় বসে দোল খাচ্ছে ও শীতের নরম রোদ গায়ে মাখছে। কিছুক্ষণ পূর্বে গোসল সেরেছে। তারপরই সারহান কোলে করে ছাদে এনে বিয়ে দিয়ে তার চুলগুলো ভালোভাবে মুছে দিচ্ছে যেন চুলের ভাঁজে পানি না থাকে। অরিত্রিকা আটকে মাসের গর্ভবতী। দুইদিন পরেই নয় মাসে হবে। এমন গর্ভভরা অবস্থায় সাবধানে চলাফেরা করছে। সারহান এবং চৌধুরী বাড়ির সবাই নজরে রাখছেন। ডেলিভারি ডেট দশদিন পর দিয়েছেন ডাক্তার। সেই কথা অনুযায়ী তানিয়া বেগম ও সাথী বেগম সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। যখন তখন ডাক্তারের কাছে ছুটতে হতে পারে।
“সারহান ভাই… উম সানিয়াতের বাবা!”

সারহান অরিত্রিকার মাথার চুলগুলো ভালোভাবে মুছে দিয়ে তোয়ালেটা নাড়া দিতে গিয়েছিল। সেটা টাঙানো সরু দড়িটায় মেলে রাখতেই মেয়েলী কন্ঠস্বর শুনতে পেল। খানিকটা শঙ্কিত হয়ে চপল পায়ে ছুটে আসল। অরিত্রিকা একগাল হেসে সারহানের হাত খানা টেনে তার উঁচু উদরে রেখে আমোদিত কন্ঠে বলে উঠল;
“দেখুন বাবু নড়ছে!”

সারহান স্বস্তির শ্বাস ফেলল। ভেবেছিল হয়তো অসুবিধা হচ্ছে। সে মেয়েটার পাশে বসল। এক পলক তাকাল গর্ভবতী স্ত্রীর গোলগাল মুখপানে। কয়েক মাসে মাতৃত্বের আভা ফুটে উঠেছে সর্বাঙ্গে। এমত অবস্থায় সৌন্দর্য এবং বিমোহন ছড়াচ্ছে। সে শান্ত চাহনিতে হাতের দিকে তাকায়। নিশ্চুপ থেকে অনুভব করে সন্তানের নড়াচড়া। তার অন্তঃকোণ পুলকিত হয়ে যায়। এক অজানা সুখের নাগাল পায়। দুইমাস আগে যখন সারহান জানতে পেরেছিল সে ছেলে বাচ্চার বাবা হচ্ছে তখনকার অনুভূতি বলে প্রকাশ করার মতো ছিল না। তবে আফসোস ছিল নিজে অরিত্রিকার সাথে ডক্টরের কাছে ব্যস্ততার কারণে যেতে পারে নি। আজমল সাহেব মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই দিনগুলোর কথা মনে হতেই ওষ্ঠকোণে ফুটে ওঠে চিরচেনা সেই নিঃশব্দ হাসি।

“বাবু আমাদের কোলে আসার জন্য অধৈর্য হয়ে যাচ্ছে। দেখুন কি নড়াচড়া করছে?”
অরিত্রিকার উচ্ছসিত কন্ঠস্বর। সারহান নীরবতা ভেঙে স্বভাবসিদ্ধ বলল;
“হুমম। একদম তোর মতো ছটফটে হয়েছে। আর মাত্র কয়েদিন তারপরে আলহান আমাদের কাছে থাকবে।”
অরিত্রিকা মিষ্টি হাসল;
“ওর ছোট্ট হাত, পা ছুঁয়ে আদর করতে পারব। কত্তো কিউট হবে।”
সারহান প্রাণোচ্ছল প্রাণবন্ত মুখখানার পানে চেয়ে রইল। যে মেয়ে সারাক্ষণ ছটপট, উড়নচণ্ডীর মতো নেচে বেড়াত সে এখন অতি শান্ত হয়ে গেছে। কিন্তু কথার ধরণ বদলেনি। বাবু আরেকটু কিক করতেই অরিত্রিকা হাসি থামিয়ে ডেকে বলল;
“সানিয়াত আর আমার ক্ষুধা লেগেছে নেতাসাহেব। আমি এখানে বসে আছি। আপনি গিয়ে আমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসুন।”

সারহান উঠে দাঁড়াল। শান্ত কন্ঠে বলল;
“আমি না আসা পর্যন্ত এখানে বসে থাক।”
অরিত্রিকা মিষ্টি হেসে মাথা দুলালো। সারহান কিয়ৎ সময় তাকিয়ে থেকে নিচের দিকে পা বাড়াল। কিছুক্ষণ পরে ছাদে এসে হাজির হলো ইশরা। তার কোলে লেভি! অরিত্রিকাকে দেখা মাত্রই এক লাফ দিয়ে ছুটে গেল। নরম শরীরটা ঘেষে দিল মেয়েলী পাঁজরে। অরিত্রিকা হাসল এহেন কান্ডের। দু’হাতে ছোট্ট তুলতুলে শরীর খানা ধরে কোলে নিয়ে চুমু খেল। লেভি ডেকে উঠল তখুনি।

“আবির ভাইয়া আর অরিন আপু আসবে আগামীকাল। ছোট মামু বলল, পনেরো দিন থাকবে।”
কথাটা শুনে লেডিকে আদর করা বাদ দিয়ে সামনে তাকায়। উচ্ছসিত ভাব নিয়ে বলল;
“তাই। কতোদিন পর আপুকে দেখতে পাব। সেই তিনমাস আগে এসেছিল। তারপরে আর আসেনি।”
ইশরা গিয়ে বসল পাশে। বলল;
“হুমম।”
“সাদাত কোথায় রে?”
“কোথায় আবার!বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে।”
“ওহহ।”
“হুমম।”

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৮৩

সাদাত এবং ইশরার এনগেজমেন্ট পেছানো হয়েছে। অরিত্রিকা এবং অরিনের বাচ্চা হওয়ার পরে একটা নির্দিষ্ট দিন ঠিক করে শুভ কাজটা করিয়ে দেওয়া হবে। এ চারমাসে পরিবর্তন সবকিছুতে পরিবর্তন এসেছে। আনন্দের খবরের মাঝে খারাপ খবর হলো ইসমা বেগমের বারো বছরের জেল হয়েছে আর নয়ন তালুকদারের ফাঁ*সির আদেশ হয়েছে ও নিশাদের ফাঁ*সি হওয়ার কথা থাকলেও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। কেন এমনটা হয়েছে তা রহস্যময়।

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৮৪