দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৩৫ (২)

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৩৫ (২)
আফরোজা আশা

‘ তোর সাথে আমার কি ’ কথাটা শুনে একটু থমকালো বেলা। ছটফটে ভাব কমিয়ে প্রগাঢ় ভাজ ফেলে, কুঁচকে রাখা ভ্রুঁজোড়া শিথীল করলো। চোখে এখনো টলমলে ভাব। সেভাবেই দিগন্তের নেত্রপানে গভীর মায়াবী এক সরল দৃষ্টিতে চাইলো। জেদীভাব ছেড়ে নরম স্বরে আওড়ালো,
‘ জানি না। ’
বেলার সম্মোহিত চাহনিতে আটকালো দিগন্ত। স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্যতা ছেড়ে,দৃষ্টি বেলাতে নিবদ্ধ রেখে শান্ত গলায় বললো,
‘ জানিস না তাহলে এতো জোর খাটাচ্ছিস কেন? ’
পরিবর্তন নেই বেলার। পূর্বভঙ্গিতে থেকে জবাব দিল,
‘ আমি জোর খাটাই না তো। মনে যা আসেছে তাই করছি। ’
‘ কি আসছে মনে? ’
শুকনো ঢোক চাপলো বেলা। জড়তাহীন সহজ গলায় উত্তর করলো,

‘ বললাম না কয়েকবার। আপনাকে ভালো লাগে। আপনি সামনে এলে আপনাকে ছেড়ে বাকি সবকিছু ঝাপসা দেখি। আপনার দিকে খুব ভালোভাবে তাকালে আমার মাথা ঝিম ধরে, দুনিয়া গোল গোল ঘুরে। আপনার আশেপাশে থাকতে ভালো লাগে। গালিগুলাও ভালো লাগে। একটুও ভয় লাগে না। আপনাকে দেখতে যদি আমার এতো ভালো লাগে, অন্যদেরও নিশ্চয়ই ভালো লাগবে। এটা ভাবলেই কেমন যেন হিংসা হয় অনেক। ভেতরে জেদ আসে, রাগ আসে, কাঁদতে ইচ্ছা হয় খুব করে। আবার, আপনার সাথে কথা বলতে ভালোলাগে। আপনার কণ্ঠস্বর ভালো লাগে। আপনার মুখশ্রী দেখতে ভালো লাগে। আপনার গলার ওই উঁচু জায়গাটাও ভালো লাগে। সব, সবকিছুই ভালো লাগে। পুরো আপনিটাকেই ভালো লাগে। খুব বেশি ভালো লাগে।’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বেলার লম্বা কথা মন দিয়ে শুনলো দিগন্ত। দুজনেই মুখোমুখি বসে আছে। দৃষ্টি একে অপরের দিকে। নিজেদের মাঝে দূরত্বটুকু কিঞ্চিৎ কমিয়ে বেলার কাছাকাছি এলো। একহাত উঠিয়ে চুলের নিচ গড়িয়ে পুরোটা হাতটা গলিয়ে দিল ঘাড়ের দিকে। ঘাড় বেয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে মাথা উঁচু করে ধরলো। দুজনের মাঝে দূরত্ব খুব বেশি নয়। দিগন্তের উষ্ণ নিশ্বাসের উপলব্ধি হতে জমে গেল বেলা। অনুভূতির তাড়নে দম আটকে এলো। দিগন্ত বেলার ঘাড়-মাথা নিজের দাবাং হাতের মাঝে চেপে ধরে নিগূঢ় ভাবে বললো,

‘ নাদান কোথাকার! মেয়ে মানুষ তুই ; কথাগুলা বলার সময় তোর চোখমুখ বেয়ে লাজুকতা উপচে পড়বে। কিন্তু লাজ-লজ্জার বিন্দুমাত্র লেশ নাই তোর মধ্যে। সবকিছুতেই বেয়াদবি! এরকম বেয়াদব মেয়েকে আমার ভালো লাগে না। ’
ইষৎ কেঁপে উঠলো বেলার শরীর। দিগন্তের এতো কাছে এসে কথা বলায় শরীরের লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল। কাঁপাকাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
‘ ভা..ভালো লাগে ব লতে গেলে ল..লজ্জা পেতে হয়? ’
‘ হুম ’
‘ আচ্ছা ’
‘ কি? ’

‘ পরের বার থেকে লজ্জা পাবো। তাহলে আপনারও ভালো লাগবে আমাকে। ’
দিগন্তের সরু চোখে বললো, ‘ ভালো লাগবে না। ’
বেলার চোখ ছাপিয়ে এলো আবারো। জোড়ালো গলায় বললো,
‘ লাগবে। ’
দিগন্তের ভাবাবেগ নেই।
‘ লাগবে না। ’
কিড়মিড়িয়ে উঠল বেলা। চোখমুখ লাল হয়ে গেল। সেকেন্ডের মাঝে টুপটুপ করে গড়িয়ে পড়লো অশ্রুকণা। দাঁতে দাঁত পিষে ফোঁপাতে ফোঁপাতে জেদী গলায় বললো,
‘ লাগবে, লাগবে, লাগবে। আপনার আমাকে ভালো লাগতেই হবে। ’
বেলার এহেন জোর-জুলুমে আপনা-আপনি অধর প্রসারিত হলো দিগন্তের। হুট করে শব্দহীন হাসলো কিছুটা। দিগন্তের হাসি দেখে বেলার কান্না থেমে গিয়েছে। রাগ-জেদ-অভিমান উধাও হয়ে চোখেমুখে নেমেছে একরাশ মুগ্ধতা। মহোনীয় দৃষ্টি হাস্যরত দিগন্তকে দেখছে সে।

বেলার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো দিগন্ত। এক সময় বেলার ঘাড় ছেড়ে ওকে একটু দূরে সরিয়ে দিল।
‘ এখন ভালো লাগছে। যা এখান থেকে। তোকে না বলেছি আমার আশেপাশে আসবি না। তোর বাপ আমাকে বলে দূরে থাকতে। আমি এক কথার মানুষ, দূরেই থাকি। তুই বারবার কথার অমান্য করিস। বেয়াদব! ’
বেলা এতো কিছু শুনলো কি না বোঝা গেল না। কেবল ভ্যাবলার মতো তাকিয়েই আছে। দিগন্ত যে ওকে ছেড়ে দিয়েছে সেটাও হয়তো টের পায় নি এখনো। কান ভারী হয়ে এসেছে ওর। দিগন্ত হাসি থামালেও বেলার মনে সেটার প্রতিচ্ছবি গেঁথে গিয়েছে। চোখের সামনে সেই দৃশ্যই ভাসছে শুধু। দুনিয়া দুলছে নাকি, বেলার মাথা ঘুরছে সেটাও উপলদ্ধি করতে পারছে না বেলা। শরীর ক্রমশ অসাড় হয়ে আসছে।
বেলাকে টলতে দেখে ধমকালো দিগন্ত। কিন্তু তা কাজে দিল না। ততোক্ষণে শরীর ছেড়ে দিয়েছে বেলা। মেঝেতে জোরে মাথা বারি লাগার আগ মূহুর্তে দিগন্ত ধরে ফেললো ওকে।

গাছ থেকে লেবু দুটো পেরে নিয়ে ভেতরে দিকে হাঁটা ধরলো মাইশা। ভোর-সকালের কারণে হালকা ঠান্ডা ভাব রয়েছে প্রকৃতি জুড়ে। ঘাসগুলোতে শিশিরবিন্দু জমে পিচ্ছিল হয়ে আছে। কিছুটা হেঁটে যেতেই পা স্লিপ করলো ওর। সামলাতে চেয়েও পারলো না। লেবু দুটো হাত থেকে উপচে পরে গেল। চিৎ হয়ে ঘন ঘাসের উপর পড়ল মাইশা নিজেও। খোপা করে রাখা লম্বা কেশগুচ্ছ খুলে মুখের সামনে ছড়িয়ে গেল। ব্যাথায় কাতড়ে উঠলো মাইশা। সামনে থেকে দুটো আওয়াজ একসাথে পাওয়া গেল,
‘ আহ! ’

নাকে হাত চেপে চোখবন্ধ করে আছে রায়হান। মাত্র দিগন্তদের বাড়ির গেট পেরিয়ে ভেতরে এসেছে। কোথা থেকে একটা ভারী জিনিস এসে ওর নাকে আছাড়ে পড়লো। নাকটা হয়তো ভেঙ্গে গিয়েছে। নাকে হাত ঘষতে ঘষতে চোখ মেলে তাকালো দেখার জন্য তাতক্ষনাৎ চমকালো ও, চোখজোড়া বড় হয়ে এলো। সামনে পড়ে থাকা মেয়েটাকে হুবহু সেদিনের অজ্ঞানরত মেয়েটার মতো লাগছে। ঠিক এভাবেই চুলের আড়ালে মুখ লুকিয়ে রায়হানের কোলে পড়েছিল মেয়েটা। পরিধেও বস্ত্রটাও একই। ব্যাকুল হয়ে সেদিকে এগিয়ে গেল রায়হান। মাথার কাছে আলগোছে বসে হাত বাড়িয়ে মুখের সামনে থেকে কিছুটা চুল সরিয়ে দিল। ভেসে এলো চোখে বুজে রাখা ব্যাথাতুর এক সুন্দর রমণীর মুখশ্রী। চেনে রায়হান? হ্যাঁ! চেনে মেয়েটাকে। দেখেছে কয়দিন আগেই।

এদিকে কোমড়ে বেশ আঘাত পেয়েছে মাইশা। ব্যাথায় টনটন করছে কোমড়। ডান পা টাও কেমন অবশ হয়ে গিয়েছে। ব্যাথার কারণে গলা দিয়ে আওয়াজও আসছে না। হালকা নড়ানড়ি করার চেষ্টা করলো তাতেই ব্যর্থ। মুখের ওপর কারো হাতের উপস্থিতি টের পেয়ে পানিভর্তি নয়ন টেনে খুললো মাইশা। রায়হানকে দেখতে পেয়ে লজ্জা পেল আকসাৎ। লোকটার সামনে পড়েছে ভেবে অস্বস্তিতে আবারো চোখ বুজলো। ব্যাথা আর লজ্জায় নিশ্বাস টানতেও কষ্ট হচ্ছে ওর।
মাইশা ক্ষণকাল দেখলো রায়হান। ও বোকা নয়। ওর চতুর মস্তিষ্ক দিগন্তের কথার রেশ আর মাইশার সাথে সব সমীকরণ মেলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। যদিও পুরোপুরি শিয়র হতে পারলো না। কিন্তু যা আঁচ করেছে তা ভুল, সেটাও মানতে নারাজ ওর মন। গলা ঝেড়ে বললো,
‘ ব্যাথা পেয়েছো খুব? ’
মাইশা উত্তর দিতে পারলো না। সেভাইবেই গাঁট বেঁধে পড়ে রইল। রায়হান বুঝলো হয়তো মাইশার মনোভাব। কিছু না বলে ভেতরের দিকে চলে গেল। সদর দরজার সামনে আসতেই দিশা আর বৃষ্টিকে পেল। রায়হান ওদের মাইশার কথা জানালো। শুনে তড়িঘড়ি করে বাগানের দিকে গেল দুজনে।

কাঁদছে আর মায়ের শরীর ঝাঁকিয়ে বারবার ডাকছে প্রত্যাশা। মনার হুশ নেই। জ্বরে ঘরে জ্ঞান হারিয়েছে হয়তো। ঘুম ভাঙার পর থেকে মনাকে এক নাগাড়ে ডেকেই চলছে প্রত্যাশা। এতো ডাকার পরও উঠতে না দেখে ভয় পেয়েছে অনেক। বালিশের পাশে পড়ে থাকা ফোনটা ছোট দুহাতের মাঝে তুলে নিল। কল লিস্টের প্রথমেই জ্বলজ্বল করছে সেইভ করা একটা নাম্বার। ছোট প্রত্যাশা পড়তে পারে না এখনো। তবে পাশে ছবিটা চেনে। ফোন চালাতে পটু না হলেও মায়ের দেখে দেখে কিছুটা আয়ত্ত্ব হয়েছে। কল চিহ্নের চাপ দিয়ে ফোন দিল নাম্বারে। এটা ওর পাপার নাম্বার। কয়েকবার রিং বাজতেই অপরপাশ হতে ফোন রিসিভ হলো। ভেসে এলো আধ-বয়স্ক পুরুষালি আওয়াজ।

‘ কিছু লাগবে? ’
বাবার আওয়াজ ভেসে ঠোঁট ভেঙ্গে কেঁদে উঠলো প্রত্যাশা। ফোলা গালদ্বয় লাল হয়ে গিয়েছে। আটকা আটকা গলায় বলল,
‘ মাম্মা উঠছে না। ভয় পেয়েছি পাপা। ’

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৩৫

মেয়ের কান্নারত আওয়াজ শুনে শোয়া থেকে উঠে বসলো জুনায়েদ। ফোন কানে চেপে মেয়ের সাথে কথা বললো কিছুক্ষন। মিষ্টি বুলি আওড়ে প্রত্যাশাকে বোঝাতে সক্ষম হলো এক পর্যায়ে। ফোন কাটলো না। প্রত্যাশার সাথে কথা বলতে বলতে তৈরি হয়ে বাইরের দিকে ছুটল।

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৩৬