তাজমহল পর্ব ৩৩
প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী
তৌসিফ একটা গোল ঠুকে দিতেই তিতলি দু’হাতে তালি দিয়ে লাফিয়ে উঠলো। গোল গোল বলে চিল্লিয়ে উঠলো। শাইনাকে ডাকলো।
“শাইনা এসো এসো। দেখে যাও।”
তার লাফালাফি চিল্লাচিল্লি শুনে শাইনা বেরিয়ে এল। তিতলি আঙুল দিয়ে নিচে দেখালো। তৌসিফ হাসছে দাঁত খেলিয়ে।
শাওন আর তাজদার সিদ্দিকী নিজেদের পরাজয় মানতে পারছেনা।
তিতলি মহাখুশি। কারণ সে তৌসিফের পক্ষে। তৌসিফ অন্য ছেলেপেলেদের নিয়ে একাই খেলছে। অন্য দলে তাজদার আর শাওনের সাথে তাদের দলবল। তাই তিতলি তৌসিফের পক্ষে। শাইনা কারো পক্ষে টক্ষে গেল না। সে শুধু কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে তিতলির পেছনে দাঁড়িয়ে।
খেলা আবার শুরু হলো। সবার গায়ে ভেজা জামা সপসপ করছে বৃষ্টির পানিতে। তাজদার এখন দায়সারাভাবে খেললেও এইবার পুরো মনোযোগ দিল। কপাল কুঁচকে রেখে গোলপোস্টের দিকে তাকিয়ে আছে সে। তারপর পায়ে থাকা বলটা পায়ে পায়ে নেড়েচেড়ে নিয়ে যেতে লাগলো সবার কাছ থেকে বলটাকে আগলে রেখে। কিছুক্ষণ পর তৌসিফের দল গোল খেতেই তিতলি আবার লাফিয়ে উঠলো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
শাইনা অবাক চোখে তাকালো। বলল,”তুমি না তৌসিফ ভাইয়ার পক্ষে?”
তিতলি হাসিমুখে বলল,”আমি যে জিতবে তার পক্ষে।”
শাইনা অবাক না হয়ে পারলো না।
তাজদার তৌসিফকে বলল,”গোল খাওয়া আধ্যাত্মিক কাজ। টেক টু।”
তৌসিফ তিতলির দিকে রেগে তাকালো। হাত দেখিয়ে বলল,”তোকে ঠাস ঠাস করে দেব এসে। পল্টিবাজ কোথাকার।”
তিতলি জিহ্বা বের করে দেখালো।
খেলা আবারও পুরোদমে জমে উঠলো। এবার আর কেউ কাউকে ছাড় দিচ্ছে না। রওশনআরা শাইনাকে ডাকছে। ডাক শুনে শাইনা দ্রুত পায়ে হেঁটে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর তিতলি এসে রওশনআরাকে খবর দিল,
“আম্মু ভাইয়া পায়ে ব্যাথা পেয়েছে। খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছে।”
রওশনআরা শাইনার দিকে তাকালো। শাইনা তিতলির দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করল,”এখন কোথায়?”
“পুকুরের দিকে গিয়েছে। আমি জানতে চাইলাম ব্যাথা পেয়েছে কিনা। বললো পায়নি। কিন্তু ঠিকই খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছে।”
রওশনআরা জানতে চাইল,”কিভাবে ব্যাথা পেয়েছে?”
“পায়ে পায়ে লেগে পড়ে গিয়েছে।”
রওশনআরা চুপ করে রইলো। শাইনাকে বলল,
“গিয়ে দেখে এসো বেশি লেগেছে কিনা।”
শাইনা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল। ঘরে এসে তোয়ালে, নীল রঙের চেক লুঙ্গি আর একটা সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি নিল। পুকুরপাড়ে এসে দেখলো পুকুরে সবাই মিলে সাঁতার কাটছে। তিতলি ঘাটে বসে তৌসিফের ফোনটা ইচ্ছেমতো টিপছে। তৌসিফ বারণ করছে কিন্তু সে শুনছেনা। কাপড়চোপড় সাবান এনে দিয়েছে তাই পারিশ্রমিক হিসেবে আধাঘন্টার জন্য ফোনটা তার।
শাইনা এসে তিতলিকে তাজদারের কাপড়চোপড়গুলো দিল। বলল,”তোমার ভাইয়া সত্যি পায়ে ব্যাথা পেয়েছে?”
তিতলি বলল,”সবাইকে বলছে ব্যাথা পায়নি। কিন্তু খুঁড়িয়ে হাঁটছে কেন?”
শাইনা তাজদারের দিকে তাকালো। ফুটবলটা পানিতে ভাসিয়ে রেখে সেটাতে বুকের ভর রেখে সাঁতার কাটছে। শাওন শাইনাকে দেখিয়ে দিল।
তাজদার তাকে দেখামাত্রই কপাল কুঁচকে ফেললো। শাইনা বলল,”পায়ে নাকি ব্যাথা পেয়েছেন?”
তাজদার বলল,”কি? আবার বলো।”
শাইনা বলল,”উঠে আসুন।”
তাজদার ঘাটে এসে বসলো। শাইনা বলল,
“পায়ে ব্যাথা পেয়েছেন?”
“সত্যি বলবো নাকি মিথ্যে বলবো?”
শাইনা রেগে গিয়ে বলল,”আমি আপনার সাথে মশকরা করছি?”
তাজদার বলল,”তোমার কথা সিরিয়াসলি নিতে পারছিনা। সরি। তুমি আমার জন্য এতটাও উতলা নও।”
শাইনা দাঁত কিড়মিড় করলো। ভাইবোন সবাই চারপাশে আছে। তারমধ্যে এইসব কথার কোনো মানে হয়? সে বলল,
“যদি ব্যাথা পেয়ে থাকেন তাহলে তাড়াতাড়ি পানি থেকে উঠুন। পা পানির মধ্যে ডুবানো থাকলে পা ফুলে যেতে পারে। আমি কিন্তু কথাটা সিরিয়াসলি বলছি।”
বলেই সে সেখান থেকে চলে গেল। তাজদার গোসল সেড়ে বাড়িতে এল। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েই হাঁটছে।
তাশফিন আজ খেলতে পারেনি। কলেজে গিয়েছিল। সে কলেজ থেকে আসামাত্রই তিতলি তাকে বলছে, আজ উঠোনে খেলা হয়েছে। মেঝ ভাইয়াও সেখানে ছিল। খুব মজা হয়েছে।
শাইনা সেখানে আসামাত্রই তাশফিন মাথা নিচু করে চলে গেল। ও শাইনাকে বেশ লজ্জা পায়। শাইনা ওকে লজ্জা পেতে দেখে হাসে। সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই শাইনা তিতলিকে বলল,
“তোমার ভাইয়া এসেছে?”
“হ্যাঁ, ঘরে গিয়েছে।”
শাইনা ঘরে চলে গেল। ঘরে ঢুকে তাজদারের পায়ের দিকে তাকালো। জোহরা বেগম জিগ্যেস করেছে পায়ে ব্যাথা পেয়েছে কিনা। তাজদার বলেছে সে ব্যাথা পায়নি। সে নিজেই যখন বলছে ব্যাথা পায়নি সেখানে কার কি করার আছে?
শাইনা কড়াভাবে জিগ্যেস করলো,
“আপনি সবাইকে মিথ্যে বলেছেন? আপনি সত্যি ব্যাথা পাননি?”
তাজদার তার দিকে ফিরলো। বলল,”যে সেবা করবে তাকেই সত্যিটা বলবো।”
শাইনা কপাল কুঁচকে জিগ্যেস করলো,”কে সেবা করবে?”
তাজদার বলল,”আপনি।”
“ব্যাথা যখন পাননি তখন সেবা করবো কেন?”
তাজদার বিছানায় বসলো পা টেনে। বলল,
“ওদের মিথ্যে বলেছি। আমি সত্যিই ব্যাথা পেয়েছি। হাঁটতে পারছিনা।”
শাইনা জানতে চাইল,”গোঁড়ালিতে ব্যাথা পেয়েছেন?”
তাজদার পা নাড়তে নাড়তে বলল,”গোটা পায়ে ব্যাথা।”
শাইনা ব্যঙ্গ করে বলল,”গুঠা খায়ে ব্যাঠা। আমি যখনই ভাবি একটু বাড়িতে যাব তখনি আপনার কিছু না কিছু করতেই হবে। পায়ে বেশি ব্যাথা লাগলে ডাক্তারের কাছে যান। আমি তৌসিফ ভাইয়াকে বলছি। আর হ্যাঁ এক মুখে দশকথা বলবেন না একদম। ওরা আমাকে বলবে, তোমার জামাই বলছে ব্যাথা পায়নি, তুমি এত উতলা কেন?”
তাজদার বলল,”তুমি সাফ সাফ বলে দেবে আমি বউ তাই আমার চিন্তা বেশি।”
শাইনা এবার সত্যি সত্যি রেগে যাচ্ছে। এটা মজা উড়ানোর সময়? এইসব সেনসিটিভ বিষয় নিয়ে চুপ করে বসে থাকা যায়? পায়ে সত্যি সত্যি ব্যাথা পেয়ে থাকলে ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত। সে নিজেকে সংযত করে বলল,
“আমি কি তৌসিফ ভাইয়াকে ডাকব?”
তাজদার দুই পাশে মাথা নাড়লো। শক্ত কণ্ঠে বলল,
“আমার পেইন আমি বুঝি। আর আমি পেইন নিয়ে চুপ থাকার মানুষ না শাইনা মমতাজ। তুমি নিজের কাজ করো। সামান্য পেইন নিয়ে আমি কারো সিমপ্যাথি চাই না।”
শাইনা বলল,”আবারও বলছি। আপনি একরকম কথা বলবেন। দশরকম কথাবার্তা বলে কনফিউজ করবেন না। আপনার পেইনের কথা যদি কাউকে না বলেন সেটা বুঝবে না। আর সে না বুঝলে তার উপর ক্ষোভ রাখার অধিকারও আপনার নেই। আপনি আমাকে সাফ সাফ সত্যি কথা বলুন। ব্যাথা লাগছে কি লাগছেনা?”
তাজদার সোজাসাপটা বলল,”লাগছে।”
শাইনা তার পায়ের কাছে এসে দাঁড়ালো। বলল,”দেখান।”
তাজদার বলল,”ব্যাথা দেখা যায়?”
শাইনা বলল,”না যায় না। ব্যাথা দেখা গেলে আপনি আমাকে নতুন করে কোনো ব্যাথা দিতেন না। পা’টা এভাবে সোজা করে রাখুন। আমি মলম মেখে দেব। আর কোনো কথা শুনতে চাই না। প্লিজ মুখ খুলবেন না।”
শাইনা মলমের কৌটা নিয়ে এল। তাজদার প্যান্ট গোঁড়ালির একটু উপরে তুললো। শাইনা মলম মালিশ করে দিতে গেলে তাজদার পা সরিয়ে নিল ব্যাথায় কুঁকিয়ে উঠে।
শাইনা বলল,”বেশি ব্যাথা?”
“গোঁড়ালিতে কিছু-মিছু হয়েছে।”
শাইনা বলল,”সেজন্যই তো বলছি ডাক্তারের কাছে যান।”
তাজদার তার দিকে তাকিয়ে ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলল,” শাইনা মমতাজ তুমি তোমার হাতের জাদু জানলে ডাক্তারের কাছে যেতে বলতে না।”
শাইনার ঠোঁটে মৃদু হাসির রেখা ভেসে উঠল, কিন্তু সে জোর করে তা চেপে রাখল। মলম মালিশ করতে করতে শান্ত গলায় বলল,” তাই নাকি? জানতামই না। একটা কথা সত্যি বলি আপনি খুব কাঁচা খেলোয়াড়। খেলায়, অভিনয়ে, আর ডায়লগে। এই মুখস্থ করা সংলাপগুলো আমি খুব সহজেই ধরে ফেলতে পারছি।”
“তুমি কোনোদিন ওইসব প্রেমেট্রেম করোনি। অবশ্য এত কঠোরভাবে কথা বলো প্রেম হবে কি করে?”
শাইনা তার দিকে চোখ তুলে তাকালো। বলল,
“আমি প্রেমট্রেম সব করেছি। আপনি এভাবে বিয়ে করে না নিলে ঠিকই প্রেম করেই বিয়ে করতাম।”
তাজদারের কপাল কুঁচকে গেল।
“তুমি এইসব বলে আমাকে পেইন দিতে পারবেনা মমতাজ। তুমি প্রথম এবং শেষবার শুধু আমার প্রেমেই পড়বে। এটাই ফাইনাল।”
শাইনা এবার সত্যি সত্যি হেসে ফেললো। বলল,”উফ কত শখ!”
তাজদার স্বীকার করে বলল,”আমি তোমাকে বিয়েই করেছি শখ করে।”
শাইনা তার মুখের দিকে তাকালো। বলল,”আপনাকে এইসব কুপরামর্শ কে দিচ্ছে বলুন তো?”
“আমার মতো এত ভালো রিসার্চার আবার অন্য কারো পরামর্শ নিতে যাবে কেন?”
“আচ্ছা, তারপর?”
“তারপর আর কি। আমি তোমাকে এমন ফাঁদে ফেলবো যে তুমি আর উঠতেই পারবে না। ডানে বামে, পূর্ব-পশ্চিমে, উত্তর-দক্ষিণে শুধু আমাকে দেখবে।”
শাইনা প্রশ্ন করলো,”আপনি আমাকে ডানে বামে, পূর্ব-পশ্চিমে, উত্তর-দক্ষিণে দেখেন?”
প্রশ্নটা শুনে তাজদার কপাল কুঁচকে ফেললো। শাইনা বলল,”আগে নিজেকে নিয়ে রিসার্চ করুন। আমি খুব জটিল বিষয় না যে আমাকে নিয়ে রিসার্চ করতে হবে। আমাকে চিনে ফেললে আপনি সেদিন আফসোস করবেন এই ভেবে যে, সবচেয়ে সহজ অঙ্কটা মিলাতে আপনার এত দেরী হয়েছে।”
কথাটা বলেই শাইনা বেরিয়ে গেল। তাজদার কপাল কুঁচকে রেখে ভাবনায় ডুবে গেল। শাইনা মমতাজ অফকোর্স এ প্লাস বি হোল স্কয়ারের সূত্রের মতো সহজ নয়। ইন্টিগ্রাল ই টু দ্য পাওয়ার এক্স স্কোয়ার ডি এক্স এর মতোই দুর্বোধ্য সে।
শাইনা গোসল সেড়ে বের হলো ওয়াশরুম থেকে। বের হওয়ামাত্রই দেখলো তাজদার সিদ্দিকী ঘরময় হাঁটছে। কিছুক্ষণ হেঁটে পা ঝাড়া মারছে। আবার কিছুদূর হাঁটছে। শাইনা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে তার কান্ডকারখানা দেখলো। তাজদার হাঁটতে হাঁটতে তাকে দেখামাত্রই থেমে গেল।
শাইনার মাথায় এখনো লাল গামছা বাঁধা। এই ধরণের গামছা তাজদার সিদ্দিকীর কোনো কালেই পছন্দ না। দেখতেই গেঁয়ো লাগে। কিন্তু শাইনা মমতাজের মাথায় লাল গামছাটা দারুণ মানিয়েছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থেকে অবশেষে সে চোখ সরালো।
শাইনা বালতিটা নিয়ে চলে যাচ্ছিল। তাজদার হেঁটে হেঁটে তার সামনে এসে দাঁড়ালো। শাইনা তার দিকে চোখ তুলে তাকালো। আবার কি সমস্যা এই লোকের?
তাজদার শাইনার পেছনে হাত নিয়ে গেল। শাইনা একটু পেছনে হেলে গিয়ে তার মুখের দিকে তাকালো।
“কি?”
তাজদার তার মুখের উপর নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“মমতাজ তোমাকে জলপাই রঙের শাড়ি আর লাল গামছায় খুব সুন্দর লাগছে। মনে হচ্ছে জলপাই আর মরিচ বাটা একসাথে। খচখচ করে খেতে দারুণ লাগবে। লেট মি ট্রাই এ লিটল।”
বলেই শাইনার কোমরে জোরে একটা চিমটি দিয়ে বসলো সে। শাইনা একঝটকায় দুই তিন পা দূরে সরে গেল। কোমরে হাত চেপে ধরে রাগে ফোঁস ফোঁস করে উঠলো সে। কি বলবে কিছু খুঁজে পেল না। বালতিটা নিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তাজদার তার মাথার গামছাটা একটানে খুলে নিয়ে ডাকল,”এই লুজার!”
শাইনা খোলা চুলে পিঠে ঝাঁপিয়ে পড়লো। চুল এখনো ভেজা। তাজদারের দিকে ফিরলো বালতিটা ধপ করে মেঝেতে রেখে। তেড়ে এসে বুক বরাবর খামচি দিতেই তাজদার সঙ্গে সঙ্গে তাকে শক্ত হাতে ধরে টেনে এনে গলার পাশে ভেজা চুলে মুখ ডুবিয়ে দিল। শাইনার শরীর শিউরে উঠল। সবশেষে তাজদার তাকে নিজেই ঘরের বাইরে রেখে আসতে আসতে বলল,
“তুমি আমার সামনে ভেজা চুলে আর আসবে না। আমার সব রিসার্চ বৃথা যাবে। গো এওয়ে।”
বলেই শাইনার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিল।
শাইনা বলল,”আমি আপনাকে হাতের কাছে পেলে খামচি দিয়ে রক্ত আনবোই।”
তাসনুভা এবার স্পষ্ট বলে দিয়েছে সে বিয়েশাদি করবে না। ওই বাড়ি থেকে আবারও একটা সমঝোতার প্রস্তাব এসেছিল। বলা হয়েছিল দুই বাড়ির মুরব্বিরা বসে কথা বলুক। এভাবে সম্বন্ধ ভেঙে ফেলা মুখের কথা নয়। কিন্তু তাজউদ্দীন সিদ্দিকী একেবারে বেঁকে বসেছেন। ওরা নিজেরাই সমঝোতা করতে চাইছে দেখে হয়তো তিনি একটু দামেই উঠেছেন। তাসনুভা ওই ব্যাপারে কোনো মতামত দেয়নি। সে এড়িয়ে যাচ্ছে বিষয়গুলো।
রওশনআরা তিক্ত বিরক্ত হয়ে তাসনুভাকে বলল,”তুমি এখন বিয়ে না করলে কখন করবে? তোমার ছোট বোন আছে একটা। তোমাকে তার কথাটাও ভাবতে হবে।”
তাসনুভা টেবিলে খেতে বসেছে। খেতে খেতে বলল,
“ওকে বিয়ে দিয়ে দাও।”
তিতলি শাইনার পাশে দাঁড়িয়েছিল। সে খুশিতে ছটফট করে উঠলো। মিনমিন করে বলল,
“ওরেহ ওরেহ আমার বিয়ে।”
শাইনা তার কথা শুনে হেসে ফেলে বলল,”বিয়ে না ছাঁই। আপু শুনলে কান বরাবর দেবে।”
তিতলি বলল,”ধুর, ওরজন্য আমি বিয়ে না করে বসে থাকবো নাকি?”
শাইনা বলল,”বিয়ে মানেই প্যারা। এখন খুশি লাগছে।”
তিতলি বলল,”আমার কাছে বিয়ে মানেই মজা। খাব, দাব, আর জামাই না ঘুরবো। শোনো প্যারা হিসেবে দেখলেই প্যারা লাগে। বুঝছো?”
শাইনা ভৎসনা করে বলল,”বাবাহ মনে হচ্ছে তুমি কতোদিন সংসার করেছ।”
তিতলি সামনে থাকা চুল পেছনে ছুঁড়ে দিয়ে বলল,”আমি মনে মনে একদম পাক্কা গিন্নি।”
“আচ্ছা? কর্তাটা কে?”
তিতলি লাজুক হেসে বলল,”মুখটা দেখিনা। পেছন থেকে দেখি, হেঁটে যেতে দেখি, বসে থাকতে দেখি।”
শাইনা তার কথা শুনে না হেসে পারলো না।
রওশনআরা আর জোহরা তাসনুভাকে বোঝাচ্ছে।
“নুভা দেখো বিয়ের পর তোমার যা ইচ্ছা তাই করবে। তুমি বুটিক শপ দিতে চাও তো? তোমার আব্বা বলেছে তোমাকে পুঁজি দেবে। আর কি চায়?”
তাসনুভা বলল,”যারা সামান্য কক্সবাজার যাওয়া নিয়ে এত কথা শুনিয়েছে তারা আমাকে আরও অনেক কথা শোনাতে পারে। আমার লাইফের একটা গোল আছে। বিয়ে করে হাঁড়ি পাতিল মাজার জন্য আমি পড়াশোনা করিনি।”
কথাটা বলেই সে শাইনার দিকে একপলক তাকালো। তিতলিও তার কথার ইঙ্গিত বুঝে মুখ ভার করে নিল। সারাক্ষণ খোঁচাখোঁচির তালে থাকে। ভাগ্যিস সে বড় বোন হয়নি। নইলে সারাক্ষণ চড়াতো এই মেয়েকে।
তাসনুভাকে কেউ বুঝিয়ে উঠতে পারলো না। আনোয়ারা বেগম বলল,
“তোমার সমবয়সী মেয়েরা কয়েক বাচ্চার মা হয়ে গেছে। দেখতেই তো পাচ্ছ?”
তাসনুভা কাঠকাঠ ভাষায় বলল,
“তারা মায়ের পেট থেকে পড়ার সাথে সাথে জামাই চিনে ফেলেছে। সারাক্ষণ জামাই জামাই করলে বিয়ে তো দিতেই হবে। ওদের সাথে আমার তুলনা কেন? স্ট্রেঞ্জ!”
তার এমন কথায় সবাই তাজ্জব বনে গেল। রওশনআরা বলল,
“আমি কিন্তু সত্যি সত্যি তিতলিকে বিয়ে দিয়ে দেব। তাজ দেশ ছাড়লে আর কখন আসে আমি জানিনা। রায়হানের সংসার বাড়ছে। আমি তোমাদের বিয়ে দিয়ে ফেলতে চাই। আমি আর তোমার বাবা আজ আছি কাল নেই।”
তাসনুভা বিরক্ত হয়ে বলল,”বলেছি তো আমি বিয়ে-র ক্ষেত্রে টোটালি অফ। এইসব বিয়েটিয়ের প্রতি আমার কোনো আগ্রহ নেই। আমি আমার লাইফটা এনজয় করতে চাই। এইসব প্যারার মধ্যে একবার পড়ে গেলে আমি নিজেকে নিয়ে চিন্তা করাটাই ভুলে যাব। আমি বিয়ে নিয়ে কোনো কথাই বলতে চাই না আর।”
আনোয়ারা বেগম বললেন,
“আমি বুঝতে পারছি সম্বন্ধ ভেঙে যাওয়ায় তুমি কষ্ট পেয়েছ। কিন্তু তারাও একটা সমঝোতায় যেতে বলছে। আমি বলছিলাম যে..
তাসনুভা উনাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
” কষ্ট? সরি দাদু। আমি কোনোপ্রকার কষ্ট পাইনি। আমার কোনোকিছুই ফিল হচ্ছে না। আমার কোনো ইমোশনাল এটাচমেন্ট ছিল না ওদের সাথে। আমি বিন্দুমাত্র কষ্ট পাইনি। বরং আমি খুব খুশি এটা ভেবে যে ঠিক সময়ে ঠিক ডিসিশনটা নেওয়ার সুযোগ এসেছে আমার কাছে। আমি এখন বিয়ে করবো না। দ্যাটস ইট!”
রওশনআরা হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। তাসনুভা খেয়েদেয়ে চলে যাচ্ছিল নিজের ঘরে। তৌসিফের সাথে দেখা হলো। তৌসিফ বলল,
“তুই নাকি সেন্টমার্টিন যাচ্ছিস?”
তাসনুভা দায়সারাভাবে বলল,”হ্যাঁ।”
তৌসিফ দাঁত কিড়মিড় করে বলল,”তোর কিছুদিন পর মার খাওয়ার স্বভাব আছে। মেঝ ভাই তোর সব কর্মকাণ্ড সূক্ষ্ম ভাবে খেয়াল করছে। ধরে লাথি দেবে। যা একবার সেন্টমার্টিন।”
তাসনুভা বলল,”অবশ্যই যাব। আমাকে জ্ঞান না দিয়ে পারলে এই বাড়ির সবকটাকে বোঝাও আমি এইসব বিয়েটিয়ে নিয়ে ভাবতে চাইছিনা এখন।”
“বুড়ো বয়সে বিয়ে করবি?”
“হ্যাঁ, মনের মতো কাউকে পেলে। নইলে কাউকেই নয়।”
“তুই কারো মনের মতো হবি কিনা সেটা নিয়ে বিস্তর সন্দেহ আছে আমার মনে।”
তাসনুভা রেগে গিয়ে বলল,”ভাইয়ে আমার ভালো লাগছেনা এইসব নিয়ে কথা বলতে।”
তৌসিফ পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে বলল,”তোর সাথে কথা বলা মানেই সময় নষ্ট।”
তিতলি নেচে-গেয়ে আসছিল রান্নাঘর থেকে।
“বিয়ে হবে, বিয়ে হবে” বলে গুনগুন করে গানও গাইছিল। তৌসিফের সামনে পড়ে যেতেই লজ্জা পেল। তারপর লজ্জা কাটাতে ছুটে এসে বলল,
“আম্মু বলছিল আপু বিয়ে না করলে আমাকে দিয়ে দেবে। আমার খুব খুশি লাগছে। ইয়ো ইয়ো।”
তৌসিফ কপাল কুঁচকে তার কথাটা মনোযোগ দিয়ে শুনলো। তারপর বলে উঠল,
“ও আল্লাহ তুমি এ কোন লেভেলের পাগল ছাগলের সাথে আমাকে উঠবস করাচ্ছ আমি জানিনা। এরা কারা? কোথাথেকে আসে এইসব? একজন বিয়ে করবে না, আরেকজন বিয়ে করার জন্য লাফাচ্ছে। ভাই দূর হ বাড়ি থেকে। একবার চলে গেলে আর আসিস না। তোদের মতো ননদ থাকলে আমার বউটা শান্তিতে থাকতে পারবে না। দূর হ একেকটা।”
তিতলি গাল ফুলিয়ে বলল,
“আমি কি শাইনাকে জ্বালাচ্ছি যে তোমার বউকেও জ্বালাবো?”
তৌসিফ হতাশার সুরে বলল,
“শাইনাকে তার বর নিজেই জ্বালায় তাই তোদের এইসব ও গায়ে মাখছেনা। আমার বউ আনবো তোরা সবকটা চলে গেলে। এই ভেজালের মধ্যে বউ আনবো না।”
তিতলি বলল,”তোমাকে বউ দিচ্ছে কে? চাকরি আছে? টাকা কামাও? ভন্ডামি করার জায়গা পাওনা?”
“কি বললি?”
তিতলি ফুড়ুৎ করে একদৌড়।
শাইনা সারাদিন আর তাজদারের সামনে আসেনি। অবশ্য তাজদার নিজেই বাড়ি ছিল না। জরুরি কাজের কথা বলে বেরিয়ে গিয়েছে। রাতে ফিরলো। শাইনা ঘরে এসে গুনগুন করে গান গাইছিল,
“ও আমার রসিয়া বন্ধুরে,
তুমি কেন কোমরের বিছা হইলা না।”
গানটা প্রতিবেশীদের বাড়িতে চলছিল কিছুক্ষণ আগে। যদিও গানটা তার বিরক্ত লাগছিল। কিন্তু আনমনে সে নিজেই সেটা গাইছে তখন থেকেই। এটা তার পুরোনো স্বভাব। একবার কোনো গান শুনলে সেটা গুনগুন করে গাইতেই থাকে।
তাজদার যে ঘরে আছে সেটা সে খেয়াল করেনি। যখন খেয়াল করলো তখনই তার নাকটা ফুলে গেল। তাজদারের দিকে আঁড়চোখে তাকালো। তাজদার বলল,
“ডাক্তার দেখিয়ে এসেছি। ডাক্তার সিটি স্ক্যান করিয়েছে। বলেছে ছোটখাটো একটা অপারেশন দিতে হবে।”
শাইনা চোখ বড় বড় হয়ে গেল।
“কি বলেন?”
তাজদার বলল,”হুম।”
শাইনা এগিয়ে গিয়ে তার পায়ের দিকে তাকালো। সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,”সত্যি বলছেন?”
তাজদার তাকে তখুনি ধরে ফেললো। শাইনা চেঁচিয়ে উঠলো,”আম্মা!”
তাজদার হিসহিসিয়ে বলল,”আরেহ সবাই শুনবে।”
শাইনা চোখ বড় বড় করে চেয়ে রইলো। কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠলো,”শুনে ফেলেছে?”
তাজদারও ভয় পাওয়ার ভান করে বলল,”হ্যাঁ।”
শাইনা কান পেতে শুনলো কেউ কিছু বলছে কিনা। তাজদার সেই ফাঁকে শাইনার একটা ওড়না নিয়ে শাইনার কোমরের সাথে নিজেকে শক্ত করে বেঁধে নিল। শাইনা তার আরও কাছে চলে এল। ছটফট করে উঠে তার দুইহাত তাজদারের বুকের সাথে ঠেকিয়ে রেখে বলল,
“সব আপনার শয়তানি। আপনি কোনো ব্যাথা পাননি পায়ে। মিথ্যেবাদী।”
তাজদার বলল,”কোমরের বিছা হইলাম। শোনো মমতাজ আমি আর মাত্র কয়েক মাস আছি। তুমি প্রিপারেশন নাও।”
“কীসের?”
“আইএলটিএস।”
“আমি ইংরেজিতে কাঁচা। তার চেয়েও বড় কথা আমি যাব না আপনার সাথে। তাহলে আইএলটিএস কেন দেব? যখন যাব তখন প্রিপারেশন নেব।”
তাজদারের সাথে সে এখনো ওড়নার বাঁধনে বাঁধা। তাজদার বলল,
“আমি তোমার ক্লাস নেব আজ থেকে। এখন থেকে ক্লাস শুরু। আইএলটিএস মিনস আই লাভ তাজদার সিদ্দিকী।”
শাইনার ভ্রু কুঁচকে গেল। তাজদার তাকে চমকে দিয়ে বলল,”আমার পায়ের উপর পা রাখো। কুইক।”
শাইনা হকচকিয়ে গিয়ে বলল,”আপনার পায়ে না ব্যাথা?”
“যেটা বলছি সেটা করো। কোনো প্রশ্ন করবে না।”
“ছিঃ, আমি পারব না।”
“রাখো, নইলে সারারাত এভাবে বেঁধে রাখবো। তোমার শ্বাশুড়ি ডাকলেও যেতে পারবে না।”
তাজমহল পর্ব ৩২
শাইনা বলল,”আমার অনেক ওজন।”
“যেটা বলছি সেটা করো মমতাজ।”
বলেই শাইনার দু-হাত তার ঘাড়ের পেছনে নিয়ে গেল। শাইনা উপয়ান্তর না দেখে তার পায়ের উপর পা রাখলো। তাজদার তার পেটে একটা চিমটি কাটলো। শাইনা ‘আল্লাহ” ডেকে চেঁচিয়ে উঠে তার গলায় খামচি দিল একদম নখ দিয়ে গেঁথে।
তাজদার আবারও চিমটি দিতেই শাইনা ছটফটিয়ে উঠে খামচি দিয়ে সরে টরে যেতে চাইলো। তাজদার তাকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
“চিমটি প্লাস খামচি ইকুয়াল?”
শাইনা তার ভ্রু নাচানো দেখে ভয়ে ভয়ে চিৎকার দিল,”তিতলি!”