প্রিয় বেগম পর্ব ২১

প্রিয় বেগম পর্ব ২১
পুষ্পিতা প্রিমা

কিভাবে মারা গিয়েছেন উনি?
শেহজাদ কঠোরভাবে বলে, আজ কত বড় ভুল করেছ তুমি জানো না। আমি জানিনা সবাইকে কি বলব। কেন ওই কক্ষে গিয়েছ? শুধুই কৌতূহলবশত?
অপরূপা জেদ বজায় রেখে বলে,
আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।
আপনার ভাইজান কিভাবে মারা গেল বললেন না।
শেহজাদ বিরক্তি নিয়ে বলে উঠে,
অপঘাতে। নদীতে ঝাঁপ দিয়ে নিজের প্রাণ দিয়েছেন বড় চাচার উপর রাগে অভিমানে।
কারণ বড়চাচা ভাইজানকে তাজ্যপুত্র করেছেন।
অপরূপা অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করে,
কেন? কেন তাজ্যপুত্র করেছেন?

কারণ ভাইজান মনে করতেন বড়মার মৃত্যুর পেছনে আমাদের সবার হাত ছিল। বড়চাচাকে খু*ন করতে চেয়েছেন ভাইজান। বড়চাচা তাই তাকে গৃহত্যাগ করতে বাধ্য করেছিল। বড়চাচা অনুতপ্ত না হলেও আমরা অনুতপ্ত। ভাইজান হারিয়ে যাক এটা আমি চাইনি।
অপরূপা তার চোখদুটো মেলে দ্বিধাগ্রস্তের মতো চেয়ে থাকে। কি অদ্ভুত! যারা তার মৃত্যু নিয়ে অনুতাপে ভুগছে সে কত আনন্দে আছে। তাদের ধ্বংস করতে তার কত লীলাখেলা! কতটা নৃশংস খেলায় মেতে উঠেছে সে। মাঝখানে তাকে পুতুলের মতো নাচিয়েছে। কি চায় সে? কেন তাকে এসবের মধ্যে জড়িয়েছে?
কক্ষের চাবি কোথায় পেয়েছ রূপা?
মিঠু নিয়ে এসেছিল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এখন আমাকে এটা বলো যে ওই কক্ষে গিয়ে তুমি কি এমন পেয়েছ? সবাই জানাজানি হলে কি হবে তুমি ভাবতে পারছো?
আমায় শূলে চড়াবে?
শেহজাদ উত্তর দেয় না। খেয়াল করে দেখে অপরূপার কপালের একটা পাশ ফুলে ডবডবে হয়ে আছে। মাঝখানে একটা ফুটো। সেই ফুটে দিয়ে রক্ত বিচ্ছুরিত হচ্ছে। শেহজাদ হাতটা কোনোমতে বেঁধে দিয়ে বলে কপালেও আঘাত পেয়েছ।
অপরূপা দোলনা থেকে নেমে আসে। বলে,
কোনো ব্যাপার না। এর চাইতে বড় আঘাত আমি সয়ে বসে আছি। আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
কেন?

এই যে আমাকে বাঁচালেন। হয়ত মহলের কারো হাতে পড়লে এতক্ষণে আমি বন্দি হয়ে যেতাম সেখানে স্বয়ং সম্রাট আমাকে রক্ষা করেছেন।
শেহজাদ উদগ্রীব হয়ে বলল, তোমার কপালে ঔষধি পাতা লাগিয়ে দিই তারপর..
না থাক। আপনাকে ধন্যবাদ।
কপালে ঔষধ লাগিয়ে কি হবে। তার তো হৃদয় ব্যাথা ।
শেরহাম সুলতান এজন্যই তাকে বলতো আমি তোমাকে রাণীর মতো করে রাখবো । আজ যদি সে অন্যায়ভাবে নিজের ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে রাজ্য কেড়ে নিয়ে রাজা হয়ও অপরূপা সেখানে রাণী কি করে হবে? এ অসম্ভব! কিন্তু কি করবে সে? কোথায় পালাবে?

তাকে নীরবে চোখের জল ফেলতে দেখে শেহজাদ উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে উঠলো,
কিছু না বললে আমি বুঝব কি করে তোমার কি হয়েছে? তোমার চোখে জল কেন? কষ্ট হচ্ছে? কপালে যন্ত্রণা হচ্ছে নিশ্চয়ই। চলো ভেতরে চলো। ডাক্তার ডেকে নিয়ে আসবো আমি। বলব তুমি না জেনে খুলে ফেলেছ।
না না। দয়া করে আপনি চলে যান। আপনার আম্মা জানতে পারলে আমার রক্ষে থাকবে না। আপনি নিজেকে আমার এসবে জড়াবেন না।
শেহজাদ রুক্ষ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। সে তো জড়িয়েই আছে শুরু থেকে। আর ছাড়া পেল কই?
প্রচন্ড বিতৃষ্ণা নিয়ে বলল,
যার সাথে জড়িয়েছ সে তোমাকে রেখে পালিয়েছে আর খোঁজও নেয়নি। নিজের ভালো তো পাগলেও বুঝে। আর তুমি তো নির্বোধ, আমার দেখা শ্রেষ্ঠ বোকা । এইসব মেয়েদের দেখলে আমার রাগ হয়। এরা নিজের জন্য না সবার জন্য ক্ষতিকর।

অপরূপার নাসিকাগ্র কাঁপতে কাঁপতে থাকে পরোক্ষ অপমানে। ফুঁপিয়ে উঠে বলে,
ক্ষতিকর বলেই তো আপনার আম্মা তার রাজপুত্রের সামনে যেতে বারণ করেছেন। তাহলে উনার রাজপুত্র কেন আমাকে রক্ষা করছেন?
এই ক্ষতিকর কীট থেকে নিজেকে মুক্ত রাখুন। আমি আপনার আশেপাশে যাই না আপনিও থাকবেন না। কেন এখনও দাঁড়িয়ে আছেন?
স্বয়ং সম্রাটের সাথে এমন ব্যবহার? শেহজাদ ক্রুদ্ধকন্ঠে বলে উঠলো,
কেন দাঁড়িয়ে আছি তা তুমি জানতে পারবে না। না বুঝতে পারবে। তোমার মতো নির্বোধ মেয়ের এতটা বুদ্ধি হয়নি যে আমার ছলাকলা বুঝতে পারবে। আমি তোমাকে সাহায্য করেছি মানে এই না আমি তোমাকে..
থেমে যাচ্ছেন কেন?
সম্রাট রাস্তার কুকুর বিড়ালকেও দয়া দেখায়। মনে করো তোমাকে দয়া দেখিয়েছি।
শেহজাদ হাতে থাকা ঔষধি পাতাগুলো দূরে ছুঁড়ে মারে। চলে যায়।
অপরূপা চোখ চেপে জল ফেলে গাল মুছে। এই মহলে আর এক মুহূর্তও নয়। কিন্তু এত এত রক্ষী পেরিয়ে পালাবে কি করে সে?

শেহজাদকে উদভ্রান্তের মতো হেঁটে আসতে দেখে খোদেজা পথ আটকে দাঁড়ালো।
কোথায় গিয়েছ? রূপা মেয়েটা কোথায়? এদিকে ওই কক্ষের দরজা খোলা। আমার উত্তর চাই শেহজাদ।
আমার পথ আটকাবেন না আম্মা। আমার কাছে কোনো উত্তর নেই।
তুমি যতবড় সম্রাট হও আমার কাছে তুমি আমার সন্তান। আমাকে উত্তর দিতে তুমি বাধ্য।
রূপা যেখানে থাকার কথা সেখানে। আমি
আপনার সামনেই তো আছি আম্মা। অযথা সন্দেহ করবেন না। আমি তটিনীকে নিকাহ করছি। কেন কেন শুধু রূপাকে টানছেন? দয়া করে আমার মাথা নষ্ট করবেন না।
খোদেজা পথ থেকে সরে দাঁড়ায় । শেহজাদ পা বাড়াতেই খোদেজা বলে,

বিবাহের বন্দোবস্ত করছি তাহলে। মত দাও। নয়ত ওই মেয়েকে মহলের বাইরে রেখে এসো। সে উপস্থিত থাকতে পারবে না বিবাহের সময়।
শেহজাদ নিদারুণ মনোবেদনা লুকোতে গর্জন তুলে বলে,
কোনো মেয়েকেই আমি চিনিনা। আপনার যা ইচ্ছে তাই করুন। যাকে ইচ্ছে মহলে রাখুন, যাকে ইচ্ছে বাইরে। আমাকে জড়াবেন না। আমি কেউ নই।
তুমি রুঢ়স্বরে কেন কথা বলছো শেহজাদ? এটা একজন রাজার গুন নয়।
সবসময় ভালো করে কথা বলব এমন কোথায় লেখা আছে? রাজার বাইরেও আমি একজন মানুষ। আমাকে আমার মতো করে থাকতে দিন।
খোদেজা আর কিছু বলার আগেই গটগট পায়ের আওয়াজটা মিলিয়ে গেল।

ফুলকলিকে মফিজের ঘরে রেখে খিলখিল করে হাসতে হাসতে যুবতীর দল হঠাৎ করে অপরূপাকে দেখতে না পেয়ে বিচলিত হয়ে পড়ে। তার কিয়ৎক্ষণ পরেই দক্ষিণ পাশের একটা কক্ষ খোলা নিয়ে মহলের ভেতর বিরাজ করে তুমুল হৈচৈ মাতামাতি। শেরতাজ সাহেব সেই নিস্তব্ধতা কাটিয়ে ভীষণ চেঁচিয়ে উঠেন। কাজের বুয়া আর রক্ষীদের উদ্দেশ্য রুক্ষমূর্তি ধারণ করে বলেন,
কার এত দুঃসাহস ওই কক্ষের তালা খুলেছে? মুখো খোলো সবাই। নয়ত গর্দান যাবে আজ।
একজন বলে উঠে,

আমি সম্রাটে সুলতানকে ওখানে দেখে চলে এসেছি হুজুর। উনি আমায় চলে আসতে বলেছেন।
ঠিক তখনি সম্রাট তার কক্ষ থেকে নীচে এসে সভায় আসন গ্রহণ করে। ভারী পোশাক বদল করে সে আরামদায়ক পোশাক পরিধান করে এসেছে। চোয়াল শক্ত। চোখমুখে নিদারুণ কঠোরতা। কর্কশ স্বরে বলল,
আমি খুলেছি। আমাকে জিজ্ঞেস না করে এভাবে চেঁচানোর কোনো প্রয়োজন ছিল না চাচাজান।
শেরতাজ সাহেব বিশ্বাস করে উঠতে পারেন না। শাহজাহান সাহেব বলেন,
আমাদের একথা বিশ্বাস করতে বলো না পুত্র। তলোয়ার দুটো নীচে ফেলে রাখা। চাবিটা প্রায় বেঁকে গেছে। সবকিছু ইঙ্গিত করছে কেউ কৌতুহলবশত ওই কক্ষের কাছে গিয়েছে। এবং দরজা খুলেছে। কারণ ছাড়া কেউ ওই কক্ষের কাছে কেন যাবে? তুমি কি লুকচ্ছ?

মতিবানু আতঙ্কিত হলো অপরূপার কথা ভেবে। হায় খোদা! রূপা মেয়েটি নয়ত?
তন্মধ্যে সভায় উপস্থিত হয় খোদেজা। অপরূপাকে টেনে এনে সবার সামনে ছুঁড়ে ফেলে বলে,
এই মেয়ে করেছে। তার পোশাকে কালি, কপাল আর হাতের আঘাত সব কথা বলে দিচ্ছে। এই মেয়ে ছদ্মবেশে মহলে এসেছে। এই মেয়ে সব নষ্টের মূল। আমি আগেই বলেছি।
অপরূপা মুখ থুবড়ে পড়ে শেহজাদের পায়ে কাছে। শেহজাদ দাঁড়িয়ে পড়ে। সায়রা সোহিনীরা সবাই আঁতকে উঠে।
শেরতাজ সাহেব রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে দাঁড়িয়ে যান। শাহাজাহান সাহেব বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকেন। শেহজাদের পায়ের কাছে গিয়ে পড়ায় অপরূপা মুখ তুলতেই শেহজাদকে দেখে। শব্দহীন চোখের জল গড়াতে থাকে।
শেরতাজ সাহেব এগিয়ে এসে বলেন,

এই মেয়ে কেন খুলেছ ওই কক্ষের দরজা? উত্তর দাও। কি উদ্দেশ্য তোমার? কি উদ্দেশ্য নিয়ে এই মহলে এসেছ? তোমার কঠিন শাস্তি হবে। সত্যি কথা বলো। কে তুমি?
শেহজাদ নিরুত্তর। শক্ত খোলসের মধ্যেকার তুলতুলে শামুকের মতো মনটা আকুপাকু করতে থাকে কান্নারত মেয়েটির জন্য। কিন্তু যতদিন না সে তার মর্ম বুঝবে ততদিন সে আর নিজেকে জাহির করতে যাবে না। যদিও সে জানেনা সে অতটা কঠোর হতে পারবে কিনা রূপার সাথে। রূপাকে সে ভালোবাসে।
সায়রা এসে অপরূপাকে তুলতেই খোদেজা ডাক দেয়।
সায়রা ছাড়ো ওই মেয়েকে। ওই মেয়ে ছদ্মবেশী। সে ধ্বংস করতে এসেছে। এখন আমার কথা বিশ্বাস হলো তো ভাইজান?

শেরতাজ সাহেব হুংকার ছাড়ে।
চাবুক নিয়ে এসো। পঞ্চাশ ঘা দাও। মুখ না খুললে আরও পঞ্চাশ। যতক্ষণ প্রাণ আছে ততক্ষণে চাবুক মারবে। একথা মহলের বাইরেও যাবে না।
কাশিম নামক দৈত্যের মতো লোকটির ঘাড়ে আদেশ পড়ে। লম্বা লম্বা পা ফেলে লোকটা চাবুক হাতে এগিয়ে আসে। অপরূপা ভয়ে সিঁটিয়ে যায় শেহজাদের দিকে। চোখের আকুলতায় আশ্রয় চায়। কেন যেন অবচেতন মনটা বারবার বলে উঠছে, “ওই মানুষটার কাছে তোর আশ্রয় আছে। সে তোকে চায়। ভালোবাসে। একটুখানি চেয়ে দেখ, কখনো ফেরাবে না।”

অপরূপা তার চাউনি দেখে ব্যাকুল স্বরে বলে উঠে, সম্রাট আপনি জানেন আমি কোনো অন্যায় করিনি।
কাশিম নামক লোকটা অপরূপার দিকে নিজের বিশাল হাতের থাবা বাড়িয়ে দিয়ে নরম হাতটা ধরে টেনে নিয়ে যায়। আবারও ছুঁড়ে ফেলে দেয়। অপরূপা ফের শেহজাদের দিকে তাকায়। লোকটা সপাং সপাং করে চাবুক তুলে মারতেই চাবুকটা আটকে যায় শেহজাদের হাতে।
মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে যায় পরিবেশ। তটিনী হকচকিয়ে যায়। খোদেজা শাহানা আর হামিদা সহ সকলের চোখ ছানাবড়া হয়ে ওঠে।
শেহজাদ চাবুক কেড়ে নিয়ে দূরে ছুঁড়ে মেরে বলে, ওর গায়ে একটা আঁচড়ও যেন না পড়ে। দূরে যাও। আমার আদেশ।

কাশিম মাথা নত করে দূরে সরে গেল।
অপরূপা পেছনে গিয়ে শেহজাদের পিঠের পেছনে নিজেকে আড়াল করে দাঁড়ায়।
শেহজাদ হুংকার ছেড়ে বলে, মহলে এত লোকের সম্মুখে কোনো নারীর গায়ে আজ অব্দি কোনোদিন চাবুকের ঘা পড়েনি। আজও পড়বে না।
খোদেজা চেঁচিয়ে উঠে,
শেহজাদ নিজের ধ্বংস ডেকে এনো না। এই মেয়ে তোমার ধ্বংস। তোমার জন্য অশুভ। তোমার প্রাণনাশিনী। নিজের প্রাণের মায়া থাকলে এই কুহকিনীকে ছেড়ে দাও। তুমি অন্ধ হয়ে গেছ। এই বিষকন্যা তোমাকে অন্ধ করে দিয়েছে।
খোদেজার কথায় বিদ্যুৎ স্পৃষ্টের মতো চমকায় সকলে। তটিনী তৎপর হয়ে শাহানার কাছে ছুটে গিয়ে বলে
আম্মা এসব কি হচ্ছে?
শাহানা নিরুত্তর।

অপরূপা শেহজাদের পিঠের পোশাক খামচে ধরে দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকে। শেরতাজ সাহেব এসে হেঁচকা টান দিয়ে কাশিমের দিকে ছুঁড়ে মারে অপরূপাকে। বলে,
বের করে দাও। প্রথমদিন থেকেই তাকে সন্দেহজনক লেগেছিল। সে বিপদজনক। এক্ষুনি বের করে দাও।
কাশিম তার হাতের মুঠোয় অপরূপার হাত ধরতেই শেহজাদ ডাক দেয়।
ওকে ছাড়ো। আমার আদেশ।
পা এগোতেই শাহজাহান সাহেব তার হাত ধরে ফেলে। পিতার দিকে প্রচন্ড বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকায় শেহজাদ।
আব্বা আপনিও?
আমি তাকে এনেছি। আর আমিই বলছি তার চলে যাওয়াটা জরুরি। আমার কসম লাগে তুমি পা বাড়াবেনা।
আমায় ছেড়ে দিন আব্বা।

কাশিম অপরূপাকে টেনে নিয়ে যায়। অপরূপা চেঁচিয়ে বলে,
আমি কোনো অন্যায় করিনি। সম্রাট আমি মিথ্যে বলছি না। আমাকে বিশ্বাস করুন।
শেহজাদের হাতে শিকল পড়া। বাবার হাতের মুঠোয় চাপা পড়ে থাকে তার হাত। তাকে আকুল হয়ে ডাকতে থাকা মেয়েটার ডাকে সাড়া দিতে পারেনা। শুধু বলে,
রূপা কোনো অন্যায় করেনি আব্বা।
শেরতাজ সাহেব খেঁকিয়ে উঠে বলে,
করেছে, সামনে আরও করবে। যে ভুল আমি করেছি সেই ভুল তোমাকে করতে দেব না আমি। সম্রাট তুমি। তোমাকে একটা আশ্রিতার জন্য এতটা ব্যাকুল হওয়া মানাচ্ছে না। তোমাকে চেনা যাচ্ছে না। আমি নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছি তোমার মাঝে। তুমি হেরে যাচ্ছ শেহজাদ।
পিতার দিকে রোষপূর্ণ চোখে তাকিয়ে থাকে শেহজাদ। শাহাজাহান সাহেব নিজ জায়গায় অটল। আজ তিনি বিচলিত হবেন না।

ক্রুদ্ধ অশ্বের তীব্র হ্রেষাধ্বনি ভেসে তখনি। অশ্বটা হুংকার ছাড়ছে। সারামহল কাঁপিয়ে তুলছে। সবার হৃৎপিণ্ডটা যেন লাফিয়ে উঠলো প্রায়। অশ্বের এমন হ্রেষাধ্বনি অশুভ লক্ষ্মণ। প্রচন্ড হুংকারে সবাই ভড়কে যায়। ভীতি জাগে মনে।
শাহাজাহান সাহেবের হাত আলগা হয়ে আসে। সবাই ছুটে যায় সদর দরজার বাইরে। আর দেখে অপরূপাকে প্রায় ছুঁড়ে ফেলেছে কাশিম। কস্টিপাথরে গিয়ে পড়ায় অপরূপার নাকঠোঁট কপাল ফেটে রক্ত মাখামাখি হয়ে গিয়েছে। ঠিক তার সামনেই হুংকার ছাড়তে ছাড়তে এসে থামে একটি কালো রঙের অশ্ব। রাজকীয় সাজের অশ্বটির চোখমুখে প্রচন্ড ক্ষোভ যেন উপচে পড়ছে। মাটি খুঁড়ে লাফিয়ে উঠে অপরূপার সামনে থামলো সেটি। তার পেছনে আরও কয়েকটি অশ্ব হুংকার ছেড়েই যাচ্ছে।

সবাই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে দেখে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে আসছে পাগড়ি পড়া একটা লোক। অপরূপা তাকে দেখে হতবিহ্বল চোখে চেয়ে রইলো। নিজের দু চোখকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। মাথার পাগড়ি খুলে শ্যাম লোকটা এসে হাঁটুভেঙে বসলো অপরূপার সামনে। অপরূপা থুবড়ে পড়া থেকে উঠে বসলো। লোকটা তাকে তুলে তার ঠোঁটের কোণার রক্ত মুছে দিল বৃদ্ধাঙ্গুলের সাহায্যে। অপরূপাকে দাঁড় করিয়ে তার হাত ধরে টেনে নিয়ে এল। অপরূপার চোখ তখনও নিবদ্ধ লোকটার মুখপানে।
শেহজাদ দ্রুতপদে বাইরে এসেই লোকটাকে দেখে থমকে গেল। ক্ষুরধার, শাণিত চাহনি নিক্ষেপ করে চেয়ে রইলো। কে সে? এত চেনা চেনা!

লোকটা দু’হাতে তালি দিতে দিতে শেহজাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে উপহাস করে বলে,
বাহ! রূপনগরের সম্রাটের মহানুভবতার প্রমাণ আজ স্বচক্ষে পেলাম। কি মহান তিনি!
শেহজাদ অপরূপার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। দেখে, অপরূপা কেমন অবসন্ন চোখে লোকটার দিকে পলকহীন, অভিব্যক্তিহীন, শব্দহীন চেয়ে আছে।
শেরতাজ সাহেব এগিয়ে আসে। কথা বলতে গিয়ে কথা আটকে আসে।
এই এই কে তুমি? কে?
উনার কন্ঠস্বর কেঁপে উঠে।

প্রিয় বেগম পর্ব ২০

সবাইকে ঠেলে সোহিনী এগিয়ে আসে। গালে হাত চেপে ঝরঝরে কেঁদে উঠে লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে দুগালে হাত রাখে। ডাকে,
আমার ভাইজান। শেরহাম ভাইজান।
সবার পায়ের নীচের মাটি কেঁপে উঠে।

প্রিয় বেগম পর্ব ২২