প্রিয় বেগম পর্ব ২৫

প্রিয় বেগম পর্ব ২৫
পুষ্পিতা প্রিমা

সিভান কেঁদে উঠলো। বলল, ব্যাথা পেয়েছি ভাইজান। শেরহাম তাকে তুলে। বলে,
‘কেঁদোনা। ‘
চিরকুটটা কুড়িয়ে নিয়ে মেলে ধরে সে । লেখাগুলোতে চোখ বুলিয়ে নিতে নিতে চোখমুখ শক্ত হয়ে উঠে তার। দাঁতে দাঁত চেপে রাগ সংবরণ করে।
সিভান বলল,
‘এটা আমার। দাও ভাইজান।’
শেরহাম কন্ঠ শীতল করে বলল,
‘দেব। আচ্ছা তার আগে বলো তুমি মিঠাই খাবে?’
সিভান দু’পাশে ঘাড় হেলিয়ে বলল,

‘হ্যা। এই কাগজটাও দাও। সুন্দর বউকে দেব। ‘
শেরহাম তাকে বলল, ‘তুমি বসো। এক্ষুণি মিঠাই আর কাগজটা দিচ্ছি।’
সিভান মাথা দুলিয়ে বলল, ‘আচ্ছা। ‘
শেরহাম তার কক্ষে চলে গেল দ্রুতপায়ে। পাঁচ মিনিটেই ফিরে এল। হাতে মিঠাই আর দুটো কাগজ। মিঠাই বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এই নাও।
সিভান মিঠাই খেতে খেতে নাচ দেখতে লাগলো।
শেরহাম উপরে তাকিয়ে দেখলো কেউ নেই তেমন। সে হাঁটুমুড়ে বসলো। বলল,
‘সিভান। আমার দিকে তাকাও।’
সিভান মিঠাই খেতে খেতে তার দিকে তাকালো। চোখের দিকে।
শেরহাম জিজ্ঞেস করলো,
‘মিঠাই খুব মজা?’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সিভান মাথা দুলালো। চোখের দিকে স্থির চেয়ে থাকতে থাকতে তার মাথা দুলে উঠলো। শেরহাম আতরের ঘ্রাণ সিভানের নাকের কাছে শুঁকিয়ে বলল,
‘খুব সুগন্ধ না?’
সিভান পুনরায় মাথা দুলিয়ে বলল, ‘খুব।’
শেরহাম বলল,
‘নীল কাগজটা দেবে সুন্দর বউকে, লাল কাগজটা দেবে তোমার শেহজাদ ভাইজানকে। মনে থাকবে?’
সিভান মাথা দুলিয়ে বলল,
‘হ্যা।’
‘আমার নাম উচ্চারণ করবে না। ঠিক আছে? ‘
‘আচ্ছা।’

‘যদি শেহজাদ ভাইজান জিজ্ঞেস করে কাগজটা কে দিয়েছে, তাহলে বলবে সুন্দর বউ দিয়েছে। আর সুন্দর বউ জিজ্ঞেস করলে বলবে, শেহজাদ ভাইজান দিয়েছে। মনে থাকবে? ‘
সিভান পুতুলের মতো মাথা নাড়ে। শেরহাম বক্রহেসে বলে,
‘মিঠাই খাও। এখন দেবে না। যখন সুন্দর বউ কক্ষে চলে যাবে তখন।’
সিভান মিঠাই খেতে খেতে নাচ দেখতে লাগলো।
গান বাজনা নাচ শেষ হওয়ার পর অপরূপাকে কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো। সবাই তার হাতে বাটা মেহেদী পড়াবে। শেহজাদ নীচে এসে দেখলো সিভান নেই। অপরূপাকেও নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রূপা নিশ্চয়ই এতক্ষণে কাগজটা পেয়ে গিয়েছে? কাগজটাতে সে লিখেছিল সে এই বিয়েতে খুশি কিনা? রূপার উত্তর যদি হয় “হ্যা” তাহলে যা হচ্ছে তা হতে দেবে। আর যদি “না” হয় তবে এই বিবাহ কিছুতেই হবে না।
সিভান এসে একটা লাল রঙের চিরকুট দিল। বলল,

‘সুন্দর বউ দিয়েছে। ‘
শেহজাদ উত্তেজিত হয়ে চিরকুটটা মেলতেই দেখলো রূপা সেখানটাতে লিখেছে,
‘আমি স্বেচ্ছায় বিয়েটা করছি। আমি উনাকে ভালোবাসি। উনার সব অপরাধ আমি ক্ষমা করেছি। ভালোবাসায় সাত খুন মাফ সেখানে উনি নিজের অধিকারের জন্য লড়ছে। আপনি উনাকে উনার অধিকার ফিরিয়ে দিলে আমি কৃতজ্ঞ থাকবো।’

শেহজাদ চিরকুটটি পড়া শেষে হাতের মুঠোয় পিষে ফেললো। ক্রোধের তাড়নায় গলার শিরা উপশিরা ভেসে উঠলো। চোখের কোণায় রক্তকণিকা জমাট বাঁধলো। এমন মানবীর প্রেমে পড়লো কিভাবে সে? অথচ প্রথম দেখায় মনে হয়েছিল সে দুর্লভ, অনন্য বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন, যা রূপাতে আছে তা কোথাও নেই। আজ মনে হলো তার জীবনের সবচাইতে বড় ভুলটি ‘রূপা’। কাগজটি দূরে ছুঁড়ে ফেললো সে।
শেরহাম শিঁষ বাজাতে বাজাতে প্রবেশ করলো সদর কক্ষে। শেহজাদকে দেখামাত্র কপাল ভাঁজ করে তাকালো। কাছে এসে কাঁধ চাপড়ে বলল,
কি ব্যাপার? এত হৈহল্লার মাঝেও তোর মন খারাপ কেন? খুব কষ্ট হচ্ছে অপরূপার জন্য? দুঃখীত দুঃখীত রূপার জন্য?

বলেই হেসে উঠলো সে।
শেহজাদ চেয়ে রইলো শাণিত দৃষ্টিতে। শেরহাম কাঁধ চাপড়াতে চাপড়াতে বলল,
‘কোনো ব্যাপার না ভাই আমার। রূপনগরের অলিতে-গলিতে তোর জন্য অসংখ্য প্রেমিকা পাওয়া যাবে। অসংখ্য যুবতী কিশোরী সম্রাটের প্রেমে মজে আছে। তাছাড়া তটিনীর মতো এত সুন্দরী যুবতী রেখে বড় ভাইয়ের ভাবী বেগমের দিকে নজর দিয়ে কোনো লাভ আছে?’
শেহজাদ ওর দিকে প্রখর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চিবুক শক্ত করে কাঁধ থেকে হাত ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল,
‘তুমি রূপাকে ঠকিয়েছ।’
‘কি বলিস। আমি ওর জানপ্রাণ সব। আমাকে কত ভালোবাসে জানিস না? প্রমাণ দেব? দেব প্রমাণ?’
শেহজাদ দাঁতে দাঁত কটমট করে বলল,
‘খোদার কসম করে বলতে পারি তোমার কোনো জিনিসের প্রতি আমার কভু লোভ ছিল না। বরঞ্চ আমার সবকিছুর উপর তোমার নজরদারি ছিল। বলতে বাধ্য হচ্ছি রূপাও তার একটা। ‘
শেরহাম ওর কলার চেপে ধরে বলল,

‘নিজেকে সবকিছুর রাজা মনে করা বন্ধ কর। তোর কিছু নেই। না রাজত্ব না অন্য কোনোকিছু। তুই একটা কোথাকার ভিখিরিনীর ছেলে হয়ে আমার সাথে নিজের তুলনা দিচ্ছিস? রূপা সঠিক মানুষকে ভালোবেসেছে। তোকে ভালোবাসলে আজকে ওর আফসোস হতো যে কেন ও এমন ভিখিরিনীর ছেলেকে ভালোবাসলো? ‘
শেহজাদের দেহরক্ষী কাশিম আর কামীল একলাফে ছুটে এসে বন্দুক তাক করলো শেরহামের দিকে। পরপর হুড়মুড়িয়ে ঢুকে এল শেরহামের দেহরক্ষীরাও। একপ্রকার হৈচৈ পড়ে গেল। সায়রা, তটিনীরা সবাই ছুটে এসে শেরহামকে শান্ত হওয়ার অনুরোধ জানালো। শেহজাদ ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল শেরহামকে। বলল,
‘তোমার অহংকার চূর্ণ বিচূর্ণ হবে একদিন। ঠিক হবে। আমার কথা মিলিয়ে নিও। আমি ভিখিরিনীর ছেলে হতে পারি তোমার মায়ের মতো পাপীর সন্তান নই।’

কিছু বুঝে উঠার আগেই শেরহাম ওর মুখ বরাবর ঘুষি বসালো সাথে সাথে। সায়রা চেঁচিয়ে উঠে শেহজাদকে ধরে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিল। খোদেজা, শাহানা সকলেই ছুটে এল। আঁতকে উঠলো।
শেহজাদও পাল্টা দুটো ঘুষি বসিয়ে দিল। সাথে সাথে শেরহাম ছিটকে পড়লো। শেহজাদ হাতের কব্জিতে মুখ মুছে নিয়ে গর্জে বলল,
আমার সাহস আর বীরত্বের পরীক্ষা নেবে না খবরদার। হাতের সাথে পাও চলতো যদিনা তুমি আমার বড় ভাই হতে।
তটিনী ওর হাত ধরে টেনে ধরে বলল,
দয়া করে শান্ত হও। এখান থেকে চলো।
শেহজাদ ওর হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। শাহাজাহান সাহেব এসে ওর হাত ধরে ডাকলো,
পুত্র চলো এখান..

শেহজাদ হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
পুত্র ডাকবেন না, ছাড়ুন।
শেরহামের দিকে অগ্নিময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বেরিয়ে গেল সে।
অপরূপা সমস্তটা দেখলো চুপচাপ। সিভানের দেয়া চিরকুটটা হাতে নিয়ে শেহজাদের যাওয়া দেখলো। চিরকুটটিতে লেখা ছিল
‘মোবারক বাদ রূপা। নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা। আমি ভাইজানকে একটা সুযোগ দিয়েছি। তুমিও দাও। ভাইজান তোমাকে ভালোবাসে।
ইতি
শেহজাদ সুলতান।
অপরূপার গাল বেয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো নীরবে। এখন সে কোথায় যাবে? যার উপর ভরসা করেছে সেও এমন কথা বললো। এ কেমন ভালোবাসা! সত্যি কি তাকে কেউ আদৌ ভালোবেসেছিল?

‘তোমার ঠোঁট ফেটে গেছে। মলম লাগিয়ে দিই। দয়া করে জেদ করো না। ‘
তটিনীর হাতটা খপ করে ধরে ফেললো শেহজাদ। কেদারা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল,
‘ভেতরে যাও। আর আমাকে নিয়ে চিন্তার কোনো দরকার নেই।’
‘আমি তোমাকে নিয়ে চিন্তা করব না? ‘
‘নাহ। বললাম তো যাও। ‘
তটিনী কেঁপে উঠলো। শেহজাদ পুনরায় কেদারায় বসে চোখ বুঁজে বসে রইলো। তটিনী তার গাল মুছে বলল,
‘তুমি রূপাকে ভালোবাস কিন্তু আমাকে নিকাহ করবে বলেছ কেন?’
শেহজাদ ঝট করে চোখ মেলে তার দিকে ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
‘কি বললে?’

তটিনী ভয়ে ভয়ে জবাব দেয় ‘ জানি আমি সবটা। ‘
‘যাও এখান থেকে। আমি কাউকে ভালোটালো বাসিনা। এসব কাজ আমার জন্য না। তোমাকেও আমি নিকাহ করব না। আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখবে না। আমি শূন্য। আমি পালিতপুত্র। আমি ভিখিরিনীর ছেলে। এখান থেকে যাও এখন নইলে আমার চাইতে খারাপ কেউ হবে না। যাও। ‘
তটিনী কেঁপে কেঁপে উঠলো। কামীল এসে বলল,
‘আপনি ভেতরে যান’।

তটিনী কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল। শেহজাদ হাওয়ায় একের পর এক বন্দুকের গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে ক্লান্ত হয়ে বন্দুক হাত থেকে ফেলে দিল। তারপর মন্থরগতিতে দাঁড়িয়ে গায়ে চাদর জড়িয়ে পেছনে ফিরতেই দেখলো তার লোকবল সবাই মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে। শেহজাদ গর্জে বলল,
‘তোমরা এখনও আমার সাথে কি করছো? আমি তোমাদের সম্রাট নই। যাও এখান থেকে। ‘
সকলেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। কাশিম বলল,

‘আপনি আমাদের সম্রাট। আমাদের গন্তব্য আপনার কাছে। আপনি ছাড়া আমাদের গতি নেই। ‘
‘সবারই বিকল্প গতি থাকে। খুঁজে নাও। যা বলছো সবটা মিথ্যে। আমাকে ছাড়া ঠিকই দিন কেটে যাবে। কেউ কাউকে ছাড়া মরে না। দিব্যি ভালো থাকে। এখান থেকে যাবে কি যাবে না? নাকি বন্দুক তুলতে হবে? ‘
সকলেই হাঁটুভেঙে মাটিতে বসে অস্ত্র নীচে রেখে দিল। বলল,
‘আমাদের মাফ করুন। আমরা আপনাকে রেখে কোথাও যাব না। ‘
শেহজাদ তাদের দিকে চেয়ে রইলো রোষাগ্নি দৃষ্টিতে। তারপর গটগট পায়ে হেঁটে মহলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর হেঁটে চলে গেল।

অপরূপা চুপচাপ বসে আছে স্তব্ধ হয়ে। ওর হাতে বাটা মেহেদী পড়াচ্ছে একদল যুবতী। সোহিনী আছে তাদের সাথে। সে খুব খুশি। সেও মেহেদী পড়বে।
শেরহাম আশেপাশেই আছে। অপরূপাকে সে চোখেচোখে রাখছে। একটুও আড়াল হতে দিচ্ছে না। কাল আকদ পড়ানো শেষ হলেই তবে শান্তি। নিকাহ সম্পন্ন হোক আজকের ঘুষি দুটোর মূল্য সে সুদে-আসলে ফিরিয়ে দেবে শেহজাদকে।
হঠাৎ হট্টগোলের শব্দ ভেসে এল মহল প্রাঙ্গন হতে। একজন রক্ষী এসে বলল, হুজুর আমাদের রক্ষীদের উপর অত্যাচার চলছে। বন্দি করছে সম্রাটের রক্ষীরা। আপনি দ্রুত চলুন।
শেরহাম হন্তদন্ত পায়ে চলে যেতেই খোদেজা এসে অপরূপার হাত টেনে নিয়ে গেল। সোহিনী বলল,
বড় মা ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?

সায়রা বলল, দয়া করে চুপ থাক। খোদা এত অন্যায় সইবেন না। রূপাকে ব্যবহার করছে বড় ভাইজান।
সোহিনী বলল,কি বলছিস এসব?
শবনম আর আয়েশার সাহায্যে সোহিনীর হাতমুখ বেঁধে কক্ষবন্দী করলো সায়রা। সোহিনী গোঙাতে লাগলো। সায়রা বলল, আমায় মাফ কর বোন। এছাড়া উপায় নেই।
মহলের পেছন দিকে নিয়ে যেতে দেখে
অপরূপা খোদেজাকে বলল, আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা।
খোদেজা তার হাত ছেড়ে দিয়ে বলে, তুমি কি এই বিয়ে করে সারাজীবন এই পাষাণ ছেলেটার হাতে মরবে? নাকি পালাবে? সিদ্ধান্ত নাও।
অপরূপা আশ্চর্য হয়ে বলল, পালাবো? আমি? কিভাবে? আমি পালাতে চাই। আমাকে সাহায্য করুন। কিন্তু এতে আপনার কি লাভ?

খোদেজা তাকে টেনে এনে সামনাসামনি মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে বলল, আমার লাভ? আমি লাভ-লোকসান বুঝিনা। আমি বুঝি আমার পুত্রের সুখ। আমার পুত্রের শান্তি। তুমি এই মহলে থাকলে ও শান্তি পাবে না। ও ভেঙে গিয়েছে আরও ভেঙে পড়বে। আমি ওকে এত কষ্ট পেতে দেখতে পারব না। তুমি ওর ভাইয়ের বেগম হয়ে এই মহলে থাকার চেয়ে ওর চোখের সামনে না থাকাটাই ভালো। দয়া করে চলে যাও।
অপরূপার গাল বেয়ে জল গড়ায়। নিঠুর পৃথিবীর সবাই তার কাছ থেকে মুক্তি চায়। মা চেয়েছিল, তারপর চাচী, এখন শেহজাদ সুলতান।

খোদেজা তার দিকে একটা পুটলি বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এখানে দুটো পোশাক, কিছু পয়সা, কিছু শুকনো খাবার আর পানি আছে। আমি মা হয়ে তোমাকে অনুরোধ করছি তুমি পালিয়ে যাও এখান থেকে। আমার সাধ্য নেই তোমাকে পুত্রবধূ করার। তুমি ওর জীবনে এলে ওকে শান্তি দেবেনা শেরহাম। প্রাণে মেরে ফেলবে। পালাও।
অপরূপা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
কিন্তু এমন অন্ধকারে আমি পালাবো কি করে?
দপদপ পদধ্বনির শব্দ কানে আসতেই খোদেজা সহ সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। কামীল এসে চোখ নত করে বলল,
সালাম মা বেগম।

খোদেজা নিজেকে শান্ত করলো। উনার আদেশেই মহল প্রাঙ্গনে ঝামেলা বাঁধিয়েছে কাশীম। কামীল বলল,
সম্রাটের আদেশ না পাওয়া অব্ধি আমি উনাকে পালাতে সাহায্য করতে পারব না।
আমি সম্রাটের মাতা। আমার আদেশ তোমাকে মানতেই হবে।
কামীল মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকলো। খোদেজা বলল,
ওকে পালাতে সাহায্য করো। ঘাটের কাছে নিয়ে যাও। আমি সম্রাটের ভালো চেয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যাও।
কামীল আদেশ পালনে রাজী হলো। পুটলিটা নিয়ে অপরূপাকে বলল,
চলুন।

সায়রা এসে অপরূপার মুখ বেঁধে দিল কালো রঙের ঝালরযুক্ত কাপড় দিয়ে। গায়ে সাদা রঙের চাদর জড়িয়ে দিল। বলল, বিদায়। সাবধানে থেকো। তারপর শক্ত করে জড়িয়ে ধরতেই অপরূপার সাথে সেও কাঁদতে লাগলো।
খোদেজা শেষমুহুর্তে অপরূপাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি নিরুপায়।
অপরূপা বারংবার পিছু ফিরে চাইতে চাইতে মহল ত্যাগ করলো কামীলের পিছু পিছু।
অন্ধকারে মিলিয়ে যেতেই খোদেজা সায়রাকে বলল, সোহিনীকে ছেড়ে দাও এবার।
সায়রা বলল, শেরহাম ভাইজানকে কি জবাব দেবেন?
‘আমি বলব যা বলার। ও কি আমায় মেরে ফেলবে নাকি? ‘

‘উনি সব পারেন আম্মা। আমার ভয় করছে। ‘
‘ভয় পেওনা। আল্লাহ আছেন। উনি সব দেখছেন। নিশ্চয়ই আমাদের রক্ষা করবেন।’
সায়রা মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। শাহানা এসে বলল,
‘পালিয়েছে?
খোদেজা মাথা হেলিয়ে বলল,
‘হ্যা।
হামিদা কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এল। বলল,
‘ভাবীজান সিভান কেমন যেন হয়ে আছে। আমার খুব ভয় করছে। ও আমার সাথে কথা বলছে না। ‘
সায়রা বলল, কি বলছেন ছোটমা? কি হলো ওর?
‘জানিনা। আমার ভয় করছে। শেহজাদকে একটু খবর দাও কেউ।’
সায়রা আর দাঁড়ালো না। সিভানকে নিয়ে কান্নাকাটির রোল পড়ে গেল। সাফায়াত ডাক্তার নিয়ে এল। শেহজাদের খোঁজ করলো। কিন্তু শেহজাদের খোঁজ পেল না। কাশীমকে ডেকে জিজ্ঞেস করতেই কাশীম বলল,
সম্রাট মহল ছেড়েছেন।

তা শুনে খোদেজা ধপ করে বসে পড়লো।
সাফায়াতের দিকে একটা চিরকুট বাড়িয়ে দিল কাশীম। বলল,
যাওয়ার পূর্বে এটি আপনাকে দিতে বলেছেন উনি।
সাফায়াত সেটি নিয়ে খুললো। দেখলো শেহজাদ লিখেছে,
আমার ভাই, আমার প্রিয় বন্ধু সবাইকে আগলে রাখার দায়িত্ব দিয়ে গেলাম। আমাকে শান্তিতে বিরতি নিতে দাও। বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছি এই হার জিতের খেলায়। আমাদের আবার দেখা হবে। ততদিন সাবধানে থেকো। ভালো থেকো। ভালো রেখো।
ইতি
তোমার ভাইজান।
সাফায়াত কাগজটা হাতের মুঠোয় মুড়িয়ে বলল,
এ কেমন গোলকধাঁধায় আমাকে ফেলে গেলে ভাইজান?

অপরূপা কামীলের পিছু পিছু যেতে যেতে বলল, আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? ঘাটে?
‘ঘাটে যাওয়া যাবে না। শেরহাম সুলতানের রক্ষীরা ওখানে আছে। ‘
‘তাহলে?’
‘আপাতত চুপ থাকুন। আমি দেখছি। ‘
অপরূপা চুপ করে রইলো। এই দানবের মতো লোকটির আতঙ্কে এমনিতেই সে চুপসে আছে। তন্মধ্যে রাত।
ভাগ্য তাকে আবারও কোথায় নিয়ে গিয়ে ছুঁড়ে ফেলবে জানা নেই। তবে সে ভয় পাবে না এবার। চোখের জল মুছে শক্ত করে নিজেকে। সাহস পুষে ভেতরে। আল্লাহকে স্মরণে রাখে।
তারমধ্যে হইহই করে ছুটে এল ঘোড়ার গাড়ির গাড়ি। একটা নয় দুটো নয়। পরপর অনেক।
কামীল তাদের থামিয়ে দিয়ে বলল,

সুলতান মহলের অতিথি আমরা। থামুন। সাহায্য চাই।
ঘোড়ার গাড়িগুলো থেমে গেল। কামীল তাদের সাথে কথা বলতে গেল। অনেকক্ষণ কথা বললো। তারপর অপরূপাকে বলল,
গাড়িতে উঠে বসুন। ওরা সুন্দরপপুরে যাচ্ছে। যেখানে যাচ্ছে সেখানে আপনার থাকার ব্যবস্থা করে দেবে তারা।
অপরূপা বলল, নাহ। আমি চিনিনা জানিনা। কি করে ওদের সাথে যাব?
আর কিছুক্ষণ থাকলে শেরহাম সুলতানের লোক এসে ঘিরে ফেলবে। আপনার পালানোর পথ থাকবে না। এবার আপনার সিদ্ধান্ত।

ঘোড়ার গাড়িতে থাকা কয়েকটা যুবতী মহিলা খিকখিক করে হাসিতে ফেটে পড়ে বলল,
এসো এসো। তাড়াতাড়ি এসো।
অপরূপা দুরুদুরু বুকে উঠে গেল। যুবতীগুলো গায়ে সেলোয়ার-কামিজ আর হিজাব পড়া। ঘোড়া ছুটে চলতেই তারা গল্পে মজে গেল। অপরূপাকে পাত্তাও দিল না।
দুপাশে বনজঙ্গল, পাহাড় পর্বত, দূরের ছাউনির ঘর, ধূ ধূ বিল, পথ পান্তর পেরিয়ে এক নতুন দেশে পা রাখলো ঘোড়ার গাড়ি। অপরূপা নব্য চন্দ্রের আলোক ছটায় প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের মুগ্ধতায় ডুবে গেল। চারপাশটা কি সুন্দর! কি অপূর্ব!

প্রিয় বেগম পর্ব ২৪

ঘোড়া ক্ষণিকের জন্য থামলো। ঘোড়াকে পানি খাইয়ে পুনরায় তীব্র বেগে ছোটার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো গাড়ি চালক। হঠাৎ উল্কাবেগে পাশ দিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে টগবগিয়ে ছুটে গেল কালো চাদরে মোড়ানো এক তেজস্বী অশ্বারোহী। বাতাসের কম্পনে অপরূপার নাসিকারন্ধ্র ভেদ করে গেল সেই পরিচিত আতরের সুগন্ধি।

প্রিয় বেগম পর্ব ২৬