একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ৬০
Mousumi Akter
সমুদ্র দেখা শেষে ওরা তীরে এসে নামল। তরীর যন্ত্রণাদায়ক মুখের দিকে তাকিয়ে মৃন্ময় বলল,
” কি হয়েছে বলো আমাকে?”
তরী মাথা নিচু করে আছে। সে ব্যক্তিগত সমস্যা মৃন্ময়কে শেয়ার করতে পারছে না। মৃন্ময় তরীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
” আমি তোমার স্বামী হই, লজ্জা বা ভ’য় পেওনা। বলো আমাকে। ”
তরী পেছন ঘুরে দাঁড়ালো। মৃন্ময় দেখল তরীর পেছনে লাল দাগ হয়ে আছে। বুঝতে বাকি রইলো না সমস্যা। মৃন্ময় বলল,
” ওহ এই ব্যাপার! এটা নরমাল ব্যাপার। এত ঘাবড়াচ্ছো কেন? আর লজ্জা পাচ্ছো কেন? চলো ফার্মেসীর দোকানে।”
মৃন্ময় তরীর হাত ধরে খুঁজে খুঁজে ফার্মেসী বের করল। মৃন্ময় আগে পরে এ ধরণের কিছুই কেনেনি। তাই নিজেই অপ্রস্তুত। কীভাবে দোকানদারকে বলবে সেটা ভেবে পাচ্ছেনা। কিন্তু তরীকে সেটা বুঝতে দিচ্ছেনা। দোকানে গিয়ে দু’টো শুকনো কাশি দিয়ে বলল,
” ভাই শোনেন।”
দোকানদার খুব ব্যস্ততার সাথে বলল,
“কন ভাই।”
মৃন্ময় আশেপাশের লোকজনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সাইডে আসেন।”
“দোকানে বহুত ভীড় ভাই দেখতেছেন না। কি ওষুধ লাগবে নাম কন।”
“এত মানুষের ভীড়ে বলতে পারব না। আপনার সাইডে আসা লাগবে।”
দোকানদার বেশ কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“কেন?”
মৃন্ময় বিড়বিড় করে বলল,
“আমার শরম করে।”
দোকানদার তা শুনে ফেলে বুঝল নিশ্চয়ই ফ্যামিলি প্ল্যানিং এর কিছু লাগবে। অন্য একজনকে নাপা এক্সট্রা দিতে দিতে বলল,
“তাইলে ধৈর্য্য ধরেন।”
মৃন্ময় বেশ উত্তেজিত হয়ে বলল,
“আরে ভাই আমার ইমারজেন্সি, একটু দ্রুত আসেন না।”
“ভাই এত ভীড় দেখতেছেন একটু লেট করেন না। ”
“ভাই ততক্ষণে আমি ম’রে যাবো।”
দোকানদার খানিকটা বিরক্ত হয়েই মৃন্ময়ের কাছে এসে বলল,
“কি ওষুধ ভাই?”
মৃন্ময় দোকানদারের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
“পেটে ব্যাথার।”
দোকানদার বেশ অবাক হয়ে বলল,
“আপনার পেটে ব্যাথা করতেছে এইটার জন্য শরমের কি আছে?..”
মৃন্ময় গলা খাদে নামিয়ে বলল,
“আরে ভাই মেয়েলি ব্যাপার বুঝতেছেন না।”
দোকানদার আরেকদফা কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“এখানে মেয়েলি ব্যাপার কীভাবে এলো?”
“ভাই আমার বউ এর পেটে ব্যাথা।”
দোকানদার ফিক করে হেসে উঠে বড় একটা প্যাকেট নিউজপেপার দিয়ে মুড়িয়ে দিলো। সাথে এক পাতা ওষুধ দিলো।
মৃন্ময় প্যাকেট টা ধরে বলল,
“এইটা কি দিছেন? এত ওষুধ। ”
“এতে যা আছে তাও লাগবে নিয়ে যান।”
” কি আছে?”
দোকানদার হেসে বলল,
” ভাই মেয়েলি ব্যাপার। আপনি বুঝবেন না।”
জীবনে প্রথমবার মৃন্ময় এমন বোকা বনে গেল। মৃন্ময়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তরী মুখ চেপে হেসে ফেলল।
কুয়াকাটায় আরো তিন দিন শেষ হল ওদের। এই তিন দিনে ইচ্ছামত দাপিয়ে বেড়িয়েছে ওরা সবাই। দিন নেই, রাত নেই সমুদ্রে ঘুরাঘুরি করেছে। কুয়াকাটার প্রতিটা কর্ণার ওরা মুগ্ধ হয়ে দেখেছে। অলি গলি কিছুই বাদ রাখেনি। তবে এই তিন দিনের ভেতর তন্ময় আর ছোঁয়াকে খুন একটা দেখা গেল না। ওরা সারাক্ষণ একসাথে আছে, কোথায় যাচ্ছে কাউকে কিছু বলছে না। সারাহ’র কাছে একটু সন্দেহের লাগছে। এভাবে সব সময় ওরা একসাথে থাকছে কেন? আড়ালেই বা থাকছে কেন? হুটহাট হারিয়ে যাচ্ছে কোথায় ওরা? বিগত তিনদিনে ওদের খুব একটা দেখা যায়নি। অবশ্য ওরা কেউ ওদের ডিস্টার্ব ও করেনি। কারণ দীর্ঘদিন পরে দেখা। একান্তে কিছু মুহুর্ত উপভোগ করছে করুক না। যশোরে গেলে তো ওদের বিয়ে। সেই বিয়ে তো শুভকর হবেনা। ছোঁয়ার বাবা কি থেকে কি ঝামেলা করেন তার ঠিক নেই। দেখা গেল জীবনের চরম অশান্তি শুরু হল।
আগামীকাল ভোরে ওরা সবাই যাবে। এদের মাঝে খুব মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে সারাহ। দ্বীপ ভিডিও কলে গার্লফ্রেন্ডকে সমুদ্র দেখাচ্ছে। মৃন্ময় কি সুন্দর একটা বাচ্চাদের হাত ধরার মতো তরীকে নিয়ে ঘুরছে। তন্ময়ের পায়ের উপর মাথা দিয়ে ছোঁয়া সুয়ে আছে। ওদের মাঝে শুধু নিঃসঙ্গ, একাকিত্বতে ভুগছে একা সারাহ। যশোর থেকে এখানে আসার পরে রোশান সিদ্দিকী তার সাথে কথা বলে নি। শুধু না হ্যাঁ এর বাইরে উত্তর দেয়নি। এ’কটা দিন বন্ধুদের সাথে থেকেছে বলে খুব একটা বোধ হয়নি সারাহ’র। কিন্তু আজ সবার প্রিয়জনের সাথে একান্ত মুহুর্তে দেখে ভীষণ মন খারাপ হচ্ছে সারাহ’র। সবাই যখন যার যার প্রিয়জন নিয়ে ব্যস্ত আনমনে হঠাৎ তার প্রিয় পুরুষের জন্য ভীষণ মন খারাপ হচ্ছে। সবার মাঝে রোশান সিদ্দিকী বেশী কেয়ারিং পারসন। আজ এখানে থাকলে সারাহ’র সমস্ত বাচ্চামো সহ্য করত। সারাক্ষণ তাকে পাহারা দিয়ে রাখত।
মানুষটা কোনদিন তার সাথে রাগ করেনি। এবার ই প্রথমবার রাগ দেখিয়েছে। কথা দিয়েছিলো আসবে তাও এলেন না। কতবার সারাহ ভেবেছে হুট করে রোশান স্যার এসে তাকে সারপ্রাইজ দিয়ে দিবে। কিন্তু না আসেন নি। জীবনে প্রথমবার রোশান সিদ্দিকী কে নিয়ে ভাবনা সত্য হলনা। হঠাৎ সারাহ সামনের দিকে তাকাল। মনে হল তার শ্যামসুন্দর পুরুষের মতো একজন হেঁটে আসছে। সারাহ একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। সারাহ জানে এটা তার চোখের ভ্রম তাই সে চোখের পলক ফেলে আবার তাকালো। কিন্তু না এটা ভ্রম নয়, রোশান সিদ্দিকী হেঁটে আসছে। তার দেখায় ভুল নেই। সারাহ তন্ময় চোখে তাকিয়ে রইলো তার প্রিয় পুরুষটির দিমে। ব্লু জিন্স, ব্লু টি-শার্ট পরে হেঁটে আসছে সামনের দিকে। সারাহ’র পেছনে দাঁড়িয়ে আছে মৃন্ময়, তরী,দ্বীপ,তন্ময় -ছোঁয়া। সারাহ পেছনে তাকালো, দেখল ওর বন্ধুরা সবাই সারাহ কে ওরকম অবাক হতে দেখে হাসছে। হাসতে হাসতে বলল,
” সারপ্রাইজ ছাড়া কি জীবন চলে? কেমন লাগল সারপ্রাইজটা। ”
সারাহ বলল,
” তোরা জানতি। তাহলে আমাকে না কেন বললি না।”
“বললে কি সারপ্রাইজ থাকে?”
রোশান সিদ্দিকী সারাহ’র কাছাকাছি আসতে একে একে ওরা সবাই পেছন থেকে টাটা জানিয়ে বিদায় নিলো।
রোশান সিদ্দিকী সারাহ’র সামনে এসে প্যান্টের দুই প্যাকেটে হাত গুঁজে দাঁড়ালো। ঠোঁটের কোণে সুখের হাসি। সারাহ’র চোখ জোড়ায় পানি ছল ছল করছে। ছলছল চোখে বলল,
” আপনি কি সত্যিই এসেছেন? ”
রোশান সিদ্দিকী সারাহ’র গালে হাত দিয়ে বলল,
” না আসিনি।”
সারাহ বলল,
“না আসলে আমার গালে আপনার স্পর্শ আমি অনুভব করতে পারতাম না।”
রোশান সিদ্দিকী ফিসফিসিয়ে বলল,
” হয়তো সত্যি এসেছি। ”
সারাহ অভিমানি কণ্ঠে বলল,
“আমি যে এতবার জিজ্ঞাসা করলাম আপনি কি আসবেন? আপনি তো আসতে রাজি হলেন না। একবারও তো বললেন না আপনি আসছেন। ”
“আসতে চাইছিলাম না কিন্তু হঠাৎ মনে হল আসি।”
” তাহলে আমাকে বললেন না কেন? কত মন খারাপ করেছি জানেন? ”
রোশান সিদ্দিকী একটু ঝুকে বলল,
” না জানিনা তো।”
সারাহ অভিমানি কণ্ঠে গাল ফুলিয়ে বলল,
“আপনি অনেক নিষ্ঠুর। আপনি অনেক অনেক কষ্ট দিচ্ছেন আমাকে। আপনার জন্য অনেক কষ্ট পেয়েছি আমি। ”
রোশান সিদ্দিকী বেশ অবাক চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
“তুমি সত্যি সত্যি আমার জন্য কষ্ট পেয়েছো?”
” হ্যাঁ আপনার জন্য কষ্ট পেয়েছি। একটা কথা বলতে না পেরে আমার ছটফট লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো আমি কষ্টে ম’রে যাবো।”
রোশান সিদ্দিকী কিঞ্চিৎ হেসে জানাল,
” সব কষ্ট নিবারণ করার জন্য তো চলে এসেছি। ”
সারাহ আবার ও গাল ফুলিয়ে প্রশ্ন করল,
“আপনি কেন রাগ করেছিলেন আগে বলুন।”
” সব বলব, তবে এখন নয়।”
সারাহ এবের কেদে ফেলে বলল,
” দেখুন আমি যা করি না কেন, আমাকে ছেড়ে যাবেন না আপনি। ”
রোশান সিদ্দিকী সারাহ’র হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
” তোমার প্রতি আমি কতটা দূর্বল তুমি নিজেও জানোনা। জানলে অকারণ এসব ভাবতে না। একটা কথা মাথায় রেখো আমি যা করি তোমার ভালোর জন্য।”
সারাহ হু হু শব্দে কেঁদে উঠে বলল,
” আমি আর কোনদিন বন্ধুদের সাথে ঘুরতে আসব না। ওদের সাথে কথা ও বলব না। তাও আমাকে ছেড়ে যাবেন না প্লিজ!”
রোশান সিদ্দিকী আবার ও মৃদু হেসে বলল,
“আমি টেনশনে তোমার বন্ধুদেরও ভুল বুঝেছিলাম। এজন্য সারাজীবন নিজেকে অপরাধী ভাবব। কেউ একজন তোমার আর তার ক্লোজ ছবি পাঠিয়েছে আমাকে। ছেলেটির মুখ ঢেকে রাখা। আমি ভেবেছিলাম তোমার বন্ধুদের কারো সাথে তোলা ছবি কীনা! পরে ভাবলাম ছবিটা এডিট হতে পারে। ”
হঠাৎ সারাহ’র মুখ টেনশনে কালো হয়ে গেল। রোশান সিদ্দিকী সারাহ’র মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
” আগে যদি তুমি এক বাচ্চার মা ও হয়ে থাকো, রোশান সিদ্দিকী তার সারাহ সিদ্দিকী’কে ছাড়বে না। প্লিজ কুল!” বলেই রোশান সিদ্দিকী সারাহ’র আঙুলের ভাজে আঙুল রাখল। বেশ শক্তভাবে চেপে ধরল সারাহ’র হাত। নিমিষেই কেঁপে উঠল সারাহ’র আত্মা। প্রিয় পুরুষের হাতের স্পর্শ যেন পৃথিবীর সমস্ত ভাল লাগাকে হার মানায়। ভাল লাগায় দুলে উঠল সারাহ’র হৃদয়। যেন কত শতাব্দি পরে তার শ্যামসুন্দর পুরুষের হাতের স্পর্শ পেয়েছে। এই স্পর্শ যেন স্বর্গীয় অনুভূতির সমান। সেতারার সুরেলা সুরের ন্যায় সমস্ত শরীরে বাজতে থাকে। রোশান সিদ্দিকী সারাহ’র মাথাটা নিজের কাধের ওপর রাখল। সারাহ’র কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল,
” তুমি আমি আর সমুদ্র এর চেয়ে সুন্দর মুহুর্ত আর কি হতে পারে? তবে তোমার প্রতি আমার প্রেম এই মহাসমুদ্রের চেয়ে গভীর সারাহ।”
একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ৫৯
কেটে গেল সাতদিন। বেলকনিতে বসে কফি খাচ্ছে রোশান -সারাহ। এমন সময় রোশান সিদ্দিকী’র মা তার ফোনে ফোন দিয়ে জানান, ওশান বিয়ে করে এনেছে একা একা। বাড়িতে মেয়ে পক্ষের লোকজন ঘেরা করেছে। অনেক ঝামেলা হচ্ছে। রোশান যেন বাড়িতে যায় দ্রুত।