উত্তল তরঙ্গ পর্ব ১১
দিশা মনি
নেহা তার মেয়েকে কোলে নিয়ে ফুটপাতের ধারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। এত সময় ধরে অপেক্ষা করায় তার পায়ে কিছুটা ব্যথা অনুভূত হলো৷ বাচ্চাটাও ক্ষুধার জ্বালায় কাঁদছিল৷ এমন সময় হঠাৎ করে নেহার সামনে একটি গাড়ি এসে দাঁড়ায়। নেহা অবাক চোখে গাড়ির দিকে তাকাতেই খেয়াল করে গাড়ি থেকে নেমে আসে দৃঢ়তা। তাকে দেখেই নেহার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। দৃঢ়তাও হাস্যজ্বল মুখে এগিয়ে এসে নেহাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“কেমন আছ তুমি নেহা?”
“আমি আছি কোনরকম। আপনি?”
“আমি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তোমার এই অবস্থা কেন? তোমার গলার স্বর শুনেই আমার মনে হচ্ছিল যে…আর এই বাচ্চাটা কার?”
নেহা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
“আমার মেয়ে ও।”
“তোমার মেয়ে?”
অবাক স্বরে বলে ওঠে দৃঢ়তা। অতঃপর বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“তোমার বিয়ে কবে হলো? আমার তো যতদূর জানা ছিল তোমার সাথে তোমার চাচাতো ভাইয়ের সম্পর্ক ছিল৷ আর বিয়ে যদি হয়েও থাকে তাহলে.. তোমার স্বামী তাহলে কোথায়? তুমি এভাবে ঢাকায় এলে কেন?”
“সেসব অনেক কথা আপু। আমি আপনাকে সব বলব৷ কিন্তু এখন দয়া করে, আপনি আমাকে আর আমার সন্তানকে থাকার মতো একটা আশ্রয় করে দিন। আমাদের কোথাও যাওয়ার যায়গা নেই। আপনার ভরসাতেই আমি আছি এখন আপু। নাহলে এই অচেনা শহরে যে আমি একদিনও টিকে থাকতে পারব না।”
“আচ্ছা, তুমি আমার গাড়িতে উঠে বসো। আমি তোমাকে আপাতত আমার বাসাতে নিয়ে যাচ্ছি। এরপর তোমার জন্য কোন ব্যবস্থা করা যায় কিনা দেখছি।”
নেহা তার মেয়েকে নিয়ে দৃঢ়তার গাড়িতে উঠে বসে। দৃঢ়তা তাকে নিজের সাথে নিয়ে যেতে থাকে। নেহার সাহস ছিল না তার সাথে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা দৃঢ়তাকে বলার৷ কারণ সব জানাজানি হলে তার সমাজে টিকে থাকা কঠিন হবে। তাছাড়া তার সন্তানকেও সে একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ দিতে চায়৷ তাই দৃঢ়তা যখন জিজ্ঞেস করে,
“এখন বলো, তোমার সাথে কি হয়েছে?”
দৃঢ়তা তখন মিথ্যা বলে,
“আমার স্বামী..উনি আমাকে আর আমার মেয়েকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন। আমার বাপের বাড়িতেও আমাকে আশ্রয় দেয় নি। আর সেজন্যই আমি এভাবে বেরিয়ে এসেছি এই ঢাকা শহরে। আমি তোমার উপর বোঝা হয়েও থাকতে চাই না। আমাকে যেকোন ধরনের একটা কাজের ব্যবস্থা করে দাও। যেকোনো ছোট কাজ হলেও করব সমস্যা নেই।”
“উফ, তুমি এত ভেবো না নেহা। তুমি আমার ছোট বোনের মতো। তোমার সব দায়িত্ব আমি নিলাম। আমার স্বামী ইউভান চৌধুরী একজন নেভি অফিসার, আমার নিজেরও একটা পাঁচ বছর বয়সী ছেলে আছে। তুমি চিন্তা করো না, তোমাকে সামলাতে পারবো আমি। তুমি আমার কাছে ছোট বোন এর মতো৷ যতদিন ইচ্ছা আমার কাছে থাকো। আর তুমি এত মেধাবী ছাত্রী ছিলে তাহলে ছোটখাটো চাকরি কেন করবে? তোমাকে অনেক সুন্দর একটা ক্যারিয়ারের ব্যবস্থা আমি করে দিতে পারবো। দেখবে, যারা তোমায় তাড়িয়ে দিয়েছে তারা এক সময় ভীষণ ভীষণ আফসোস করবে।”
নেহা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। এত বড় শহরে এখন যেন সে নতুন একটা ভরসার স্তম্ভ খুঁজে পেয়ে গেল।
আহির নিজের মেয়েকে কোলে নিয়ে দোলনায় বসে আছে। বাচ্চাটা তার কোলে কত সুন্দর করে ঘুমিয়ে আছে। হঠাৎ করে নাতাশা সেখানে চলে আসে। সে বুঝতে পারে, আহিরের কাছাকাছি আসতে চাইলে এখন তাকে আগে আহিরের মেয়ে জয় করতে হবে। এজন্য নাতাশা আহিরের কাছে এসে বলল,
“তোর মেয়ে তো ঘুমিয়ে পড়েছে আহির। ওকে আমার কোলে দে, আমি ওকে বিছানায় শুইয়ে আছি।”
“না, থাক। অনেক কষ্টে ঘুমিয়েছে। এভাবেই থাকুক ও আমার কোলে।”
“কিন্তু এভাবে থাকতে তো তোর নিশ্চয়ই কষ্ট হচ্ছে।”
“নিজের মেয়ের জন্য এটুকু আমি করতেই পারি..জানিস নাতাশা..আমি কখনো ভাবতে পারি নি যে, আম্মুর পরে আর কখনো কোন নারীকে আমি ভালোবাসতে পারব কিন্তু আমার মেয়ে..ও আমার এই ধারণাই বদলে দিয়েছে।”
নাতাশার কথাটা শুনে খারাপ লাগে। কারণ সে আহিরের জীবনের প্রিয় নারী হতে চেয়েছিল অথচ..
নাতাশা হঠাৎ কিছু ভেবে বলে,
“ওহ, তোর মায়ের কথা শুনে মনে পড়লো। এখনো তো ঐ আজমাইন চৌধুরীর উপর আসল প্রতিশোধটাই নেয়া হলো না।”
কথাটা শুনেই আহিরের চোখ যেন প্রতিশোধের নেশায় জ্বলে ওঠে।
আজমাইন চৌধুরী নিজের কক্ষে বসে ছিলেন চুপচাপ। হঠাৎ করে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তিনি। নেহা চলে যাবার পর থেকেই তার এই অবস্থা। যতই তিনি নেহাকে বলুন, তার কাছে নেহা মৃত কিন্তু নিজের মন থেকে নেহাকে মুছতে পারছেন না। নেহা, তার ভাইয়ের শেষ চিহ্ন যাকে তিনি নিজের মেয়ে মতো মানুষ করেছেন তাকে এত দিন ফিরে পেয়ে আবার দূরে পাঠিয়ে তিনি নিজেও মানসিকভাবে ভঙ্গুর হয়ে গেছেন। এরমধ্যে সমাজের লোকের নানান বাজে কথা। এতদিন ধরে তার তিল তিল করে গড়ে তোলা সব সম্মান যেন এক মুহূর্তে ধুলায় মিশে গেছে। তিনি লজ্জায় কারো দিকে চোখ তুলেও তাকাতে পারছেন না। বাড়ির মধ্যেও বিপাসা চৌধুরী ঘ্যানঘ্যান করে চলেছেন। সব মিলিয়ে তিনি বড্ড অসহায় হয়ে পড়েছেন। এরকম মুহুর্তে হঠাৎ তার মনে হয়, কি এমন পাপ করেছেন যার জন্য আজ তাকে এই দিন দেখতে হলো।
তার ভাবনার মাঝেই হঠাৎ করে ফোন বেজে ওঠে। আজমাইন চৌধুরী দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ফোনটা রিসিভ করেই বলেন,
“হ্যালো, কে বলছেন?”
“আপনি নিশ্চয়ই এখন বসে বসে ভাবছেন যে কোন কৃতকর্মের ফল আপনাকে পেতে হলো, তাই না?”
“কে আপনি? কি বলছেন এসব?”
“আমি যেই হই না কেন, সেটা আপনার না জানলেও হবে। আমি আপনাকে আপনার কৃতকর্মের কথা মনে করাতে এলাম। মনে আছে, আজ থেকে ২৮ বছর আগের কথা? কিভাবে নিজের স্ত্রী ও সন্তানকে অস্বীকার করেছিলেন আপনি শুধু নিজের স্বার্থের কথা ভেবে? মনে আছে, কিভাবে আপনার জন্য এক নীরিহ বাচ্চা ও তার মাকে সমাজে কত তিরস্কার সহ্য করতে হয়েছে?”
“কি বলছেন..এসব কি যা তা বলছেন..”
“আমি যে ঠিক বলছি সেটা আপনিও ভালোই জানেন। যাইহোক, আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই। কর্মফল তো ভোগ করতেই হয়, আমিও আপনাকে নিজের কর্মফল ভোগ করালাম৷ ২৮ বছর আগে আপনি মিসেস আমিনা বেগমকে যেই কষ্ট দিয়েছেন তাই কষ্ট আজ আপনার প্রিয় ভাইজি ফেরত পেল।”
“তার মানে..তুই সেই অমানুষ যে আমার ভাইজিকে বিয়ে করে..”
“ভুল ভাবছেন আপনি মিস্টার আজমাইন চৌধুরী..আমি আপনার ভাইজিকে বিয়ে করিনি৷ আমি তাকে তুলে এনেছিলাম তারপর বিয়ে না করেই তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করেছি..সে আমার বাচ্চার মা হয়েছে..জারজ বাচ্চার মা। যেই মিথ্যা অপবাদ আপনি আমিনা বেগমকে দিয়েছিলেন সেই অপবাদকে সত্য প্রমাণ করেছি।”
আজমাইন চৌধুরী এসব শুনে বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব করেন। নেহাকে অবিশ্বাস করার জন্য ও নিজের অতীতের কৃতকর্মের জন্য ভীষণ পস্তাতে লাগলেন তিনি। বুকে হাত দিয়ে বললেন,
“আমি জানি না আপনি কে..কিন্তু যদি আপনার আমার উপর রাগ ছিল তাহলে আমাকে কষ্ট দিতে পারতেন..চাইলে আমায় মেরেও ফেলতেন। আমার নিরপরাধ ভাইজিকে কেন এত বড় শাস্তি দিলেন? বেচারি তো কোন দোষ করে নি..আর আমরা সবাই ওকে অবিশ্বাস করলাম..বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলাম..না জানি ও কোথায় আছে কোন অবস্থায় আছে..”
“এটা তো কেবল শুরু মিস্টার আজমাইন চৌধুরী, আপনার শাস্তি এটাই ছিল। এখন যতদিন বেচে থাকবেন আপনি নেহার কথা ভাববেন আর তিলে তিলে মরবেন।”
উত্তল তরঙ্গ পর্ব ১০
আহিরের কথাগুলো যেন আজমাইন চৌধুরীর কানে বাজতে থাকে। তিনি বুকে হাত দিয়ে পড়ে যান। এমন সময় আরাভ রুমে এসে নিজের বাবাকে এই অবস্থায় দেখে ছুটে এসে বলে,
“আব্বু..ওঠো..কি হয়েছে তোমার?”
আজমাইন চৌধুরী অস্ফুটস্বরে বলেন,
“নেহা..ও ভুল করে নি..ওকে ফিরিয়ে আনো. ”