উত্তল তরঙ্গ পর্ব ২৩

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ২৩
দিশা মনি

নেহা আহিরাকে একদম বুকের সাথে আগলে নেয়। আহিরাও এই ঘটনায় হঠাৎ এত ঘাবড়ে যায় যে সে নেহাকে জড়িয়ে ধরে। নেহা দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে আহিরাকে কোলে নিয়ে রাস্তা পার হয়। এরমাঝে আহিরা আচমকা অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে,
“মাম্মা..”
নেহা ফুটপাতের ধারে এসে একদম থেমে যায়। এই অচেনা অজানা মেয়েটির মুখে মা ডাক শুনে তার বুকে হঠাৎ করে এত উথাল-পাতাল তরঙ্গের সৃষ্টি হয়৷ নেহা বুঝতে পারে না, তার এই অনুভূতির কারণ কি। তত্মধ্যে নিয়া ছুটে এসে বলে,

“আম্মু তুমি ঠিক আছো তো? আমি ওকে বলেছিলাম এভাবে রাস্তা পার না হতে কিন্তু ও…”
নেহা আহিরাকে কোল থেকে নামায়। আহিরা তখনো ঘোরের মাঝে ছিল। নেহা আহিরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“তুমি এভাবে রাস্তা পার হচ্ছিলে কেন? তোমার মা-বাবা কোথায়?”
আহিরা নেহার দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমার পাপা তো কোম্পানিতে আর মাম্মা..”
আহিরা আর কিছু বলতে পারে না। নেহা তাকে শাসনের ভঙ্গিতে বলে,
“আর কখনো এভাবে রাস্তা পার হবে না। এটা তোমার জন্য বিপদজনক। আজ যদি আমি সঠিক সময় না আসতাম তাহলে কি হতো বলো তো?”
আহিরার অহংকারী মন হঠাৎ যেন কেমন থমকে যায়। নেহার সামনে সে কিছু বলতেও পারছিল না। এরইমাঝে নিয়া বলে ওঠে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আম্মু ও আজ আমাদের স্কুলে নতুন এসেছে। ওর বাসা ঢাকার বাইরে তো তাই কিছু বুঝতে পারে নি।”
ততক্ষণে রাস্তায় আরো অনেক মানুষ জড়ো হয়ে গেছে। তারা সবটা প্রত্যক্ষ করছে। এরমধ্যে নেহা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় কোম্পানিেফ টিফিন ব্রেক শেষ হবার পথে। তাকে আবার নিয়াকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে কোম্পানিে ফিরতে হবে। তত্মধ্যে স্কুল কতৃপক্ষের কিছু লোকও জটলার কাছে এসেছে। নেহা তাদেরকে দেখে আহিরাকে তাদের কাছে শপে দিয়ে বলে,
“এই নিন, মেয়েটার পরিবারের কেউ আসলে ওকে ওর পরিবারের সাথে পাঠিয়ে দেবেন। আর বলবেন, ওর খেয়াল রাখতে।”

বলেই নেহা চলে যেতে নেয় এমন সময় হঠাৎ করে আহিরা পেছন থেকে নেহার জামা ধরে টান দেয়। নেহা আহিরার দিকে তাকায়। আহিরার চোখে এক গভীর বিস্ময়, ছোট্ট এই মেয়েটার প্রতি নেহা কেন জানি আজ বড্ড বেশি টান অনুভব করছে। তার মনে হচ্ছে, যেন এই মেয়েটা তার অনেক কাছের।
নেহা আহিরার সামনে হাটু গেড়ে বসে। নিয়ার জন্য কেনা একটা চকলেট আহিরার হাতে দিয়ে বলে,
“এটা খাও ভালো লাগবে। তোমার পরিবারের লোক চলে এলে ভালো মেয়ের মতো তাদের সাথে চলে যাবে। আর কখনো এভাবে রাস্তা পার হতে যেও না, কেমন?”
আহিরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো নেহার বলা কথাগুলো শুনতে থাকে। নেহা এরপর নিয়াকে নিয়ে চলে যায়। আহিরা নেহার দেয়া চকলেটটার দিকে তাকিয়ে থাকে। ভীষণ সাধারণ একটা চকলেট। সাধারণত এত কমদামী চকলেট সে খায় না। তবে আজ তার মনে চাইল না চকলেট ছুড়ে ফেলতে।
কিছু সময় পর আহির নিজের গাড়ি নিয়ে উপস্থিত হলো সেখানে। স্কুল কতৃপক্ষের কাছে সব শুনে আহিরাকে জড়িয়ে ধরে সে বলল,

“থ্যাংকস গড যে তোমার কিছু হয় নি, প্রিন্সেস। এভাবে আর কখনো রাস্তা পার হয়ো না।”
আহিরা বলে,
“ঐ আন্টিটাও এই কথা বলছিল।”
“কোন আন্টি?”
স্কুলের একজন শিক্ষিকা বলে ওঠে,
“আমাদের স্কুলেরই আরেকজন স্টুডেন্টদের মা আজ আপনার মেয়েকে বাঁচিয়েছে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। আহিরা তারই কথা বলছে।”
আহির বলে,

“কোথায় উনি? উনি জানেনও না যে, উনি আমার কত বড় উপকার করেছেন। ওনাকে যতই ধন্যবাদ জানাই সেটা কম হয়ে যাবে। আমাকে ওনার সাথে যোগাযোগের ঠিকানা দিন প্লিজ। আমি ওনার এই ঋণের প্রতিদান দিতে চাই।”
ঐ শিক্ষিকা তখন আহিরকে নেহার নম্বর দেয়। আহির জিজ্ঞেস করে,
“ওনার নাম কি?”
শিক্ষিকা বলেন,
“ওনার নামটা তো ঠিক আমার মনে নেই..তবে ওনার মেয়ের নাম নিয়া।”
“ওহ আচ্ছা, আপনাকে ধন্যবাদ।”

আহির এরপর আহিরাকে নিয়ে রওনা দেয়। গাড়িতে বসেও আহিরা নেহার কথা ভাবছিল এবং তার দেয়া চকলেটটা শক্ত করে ধরেছিল। আহির আহিরার শরীরে সিটবেল্ট বেধে দেয়ার সময় তার হাতে চকলেটটা দেখে বলে,
“এটা কি প্রিন্সেস? এটা তো খুব কমদামী একটা চকলেট মনে হচ্ছে। এটা ফেলে দাও, আমি তোমাকে অনেক দামী চকলেট কিনে দেব।”
আহিরা রাগী স্বরে বলে,
“নাহ, আমি এই চকলেটটাই খাব। এটা আমাকে ঐ আন্টি দিয়েছে। আমার অন্য চকলেট চাই না।”
আহির আহিরার এমন ব্যবহার দেখে অবাক হয়। কারণ সে সাধারণত এত কমদামী চকলেট খায় না।

নেহা নিয়াকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব আবার কোম্পানির দিকে রওনা দেয়। কিন্তু তার পৌঁছাতে ৩০ মিনিট দেরি হয়ে যায়। কোম্পানিতে পৌঁছে নেহা নিজের কেবিনের দিকে যাচ্ছিল এমন সময় হঠাৎ করে শাহরিয়ার তার পথ আটকে দাঁড়ায়। নেহা অবাক চোখে শাহরিয়ারের দিকে তাকায়। তার চোখে হাজারো প্রশ্ন। শাহরিয়ার নিজের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অতঃপর নেহার চোখের সামনে ঘড়িটা নিয়ে এসে বলে,
“লাঞ্চ টাইম ২ টায় শেষ হওয়ার কথা ছিল এখন বাজে ২ঃ৩২। এর মানে কি দাঁড়ায় মিস নেহা?'”
নেহা সমস্ত ঘটনা শাহরিয়ারকে খুলে বলতে যাবে এমন সময় শাহরিয়ার রাগী স্বরে বলে,

“আমি কোন এক্সকিউজ শুনতে চাই না।”
“আমি ইচ্ছা করে দেরি করি নি আমি তো..”
“ইচ্ছাকৃত হোক বা অনিচ্ছাকৃত দেরি তো আপনি করেছেন। আর এই ভুলের শাস্তি আপনাকে পেতে হবে। শাহরিয়ার কায়সারের ডিকশনারিতে ভুল বলে কোন শব্দ নেই আর না আছে ভুলের ক্ষমা।”
নেহা বুঝতে পারে আজ আর কোন কিছু বলেই লাভ হবে না। শাহরিয়ার বলে ওঠে,
“আপনাকে আমি ফায়ার করছি। আজ থেকে আপনি আর ইনফিনিক্সের কর্মচারী নন।”
নেহার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে যায়। সে অনুনয় করে বলে,
“স্যার, প্লিজ..আমার কথাটা শুনুন..আমার এই জবটার…”
শাহরিয়ার ধাক্কা মেরে নেহাকে দূরে সরিয়ে বলে,

“নাও গেইট আউট ফ্রম মাই কোম্পানি। আমি আমার কোম্পানিতে আপনার ছায়াও আর দেখতে চাই না।”
নেহা হঠাৎ এই ধাক্কা সামলাতে না পেরে ফ্লোরে পড়ে যায়। তার কনুই ছিলে যায়। নেহা অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ায়। শাহরিয়ার ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে চলে যেতে নেয়। এমন সময় নেহা পেছন থেকে বলে ওঠে,
“আপনার মতো অমানুষের কোম্পানিতে জব করার কোন ইচ্ছাও নেই৷ কি ভেবেছেন আপনি? টাকা আছে জন্য মানুষকে মানুষই ভাববেন না, তাদের সাথে জানোয়ারের মতো ব্যবহার করবেন?”
শাহরিয়ার রাগী ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে বলল,

“কি বললে তুমি..হাউ ডেয়ার ইউ?”
“এতদিন সাহস দেখাতে পারি নি। কিন্তু আজ জবটাই নেই তখন আরেকটু সাহস দেখাই..”
বলেই সে শাহরিয়ারের মুখের উপর পাশে থাকা একটি পানির বোতল থেকে পানি ছুড়ে মারে। শাহরিয়ার রক্তিম রোখে তাকায়। নেহা বলে,
“আপনার এই চাহনিতে আমার আর কোন ভয় নেই মিস্টার শাহরিয়ার। আপনি, আপনার এই অহংকার, এই অহেতুক রাগ এসব আমি আর বরদাস্ত করতে চাই না। হতে পারে আপনার অনেক টাকা আছে কিন্তু মনুষ্যত্ব বলে কিছু আপনার মাঝে নেই। আর আপনার মতো অমানুষকে বস হিসেবে মেনে নেওয়াও আমার জন্য কষ্টকর ছিল। আমি তো এটাই বুঝতে পারছি না যে শামিম স্যারের মতো এত ভালো একজন মানুষের আপনার মতো এত জঘন্য একটা সন্তান হলো কিভাবে? আপনি সত্যিই শামিম স্যারের ছেলে তো নাকি..”
শাহরিয়ারের ধৈর্যের বাধ ভেঙে যায়। সে নেহার গায়ে হাত তুলতে যাবে এমন সময় নেহা তার হাত ধরে থামিয়ে দিয়ে বলে,

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ২২

“এই ভুল দ্বিতীয়বার করবেন না। আমি কোন অবলা নারী নই যে আপনার এইসব কিছু মেনে নেব। আমি নিজের অধিকারের জন্য লড়তে পারি।”
বলেই নেহা শাহরিয়ারের হাতটা ছিটকে ফেলে মাথা উঁচু করে অফিস থেকে বেরিয়ে আসে।।

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ২৪