উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৩২

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৩২
দিশা মনি

নেহা হতবাক চোখে তাকিয়ে ছিল আহিরের দিকে। আহিরের দৃষ্টিও নেহার দিকে স্থির ছিল। তাদের দুজনকে এভাবে মুখোমুখি হতে দেখে দূর থেকে এই দৃশ্যের সাক্ষী হলো নাতাশা। সেও নিজের মনে এখন নানা সমীকরণ কষছে। আহির সহসা নেহার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে তার কাছ থেকে একপ্রকার ছিনিয়ে নিলো আহিরাকে। অতঃপর আহিরাকে কোলে তুলে নিয়ে বললো,
“তোমার কোথাও লাগে নি তো প্রিন্সেস?”
আহিরা না বোধক মাথা নাড়িয়ে বলে,
“কিছু হবার আগেই এই আন্টিটা আমায় বাঁচিয়ে নিয়েছে। সেদিন রাস্তায় এক্সিডেন্টের হাত থেকেও এই আন্টি আমায় বাঁচিয়েছিল।”

আহির অবাক হয় আহিরার কথা শুনে৷ তার মানে নেহাই সেই মহিলা যার সাথে সে সেদিন রাতে কথা বলেছিল! নেহা নিজের বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে আহিরকে জিজ্ঞেস করে,”ও আপনার মেয়ে?”
নাতাশা এবার ছুটে আসে মঞ্চে। এসেই আহির ও আহিরার পাশে দাঁড়ায়। আহিরার গালে চুমু খেয়ে বলে,
“তোমার কোথাও লাগে নি আহি বেবি? আহারে, আমার মেয়েটা আর একটু হলেই কত বড় দূর্ঘটনার স্বীকার হতো। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ আমার মেয়েকে বাঁচানোর জন্য।”
নাতাশার কথায় আহির কিছুটা অবাক হয় কিন্তু কিছু বলে না। নেহা ভাবে,
“তার মানে..এই মেয়েটা এই আহির আর ওনার বান্ধবীর!”
আহির আহিরাকে কোলে তুলে নিয়ে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ও নিশ্চয়ই অনেক শকের মধ্যে আছে। আমার ওকে এখনই হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে৷ নাতাশা আমার সাথে আয়।”
বলেই সে আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে আহিরাকে নিয়ে রওনা দেয়। নাতাশাও তার পিছন পিছন যেতে থাকে। নেহা তাদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। কিছু সময় পর নিয়া ছুটে আসে নেহার পাশে। এসে বলে,
“আম্মু..তোমার কোথাও ব্যথা লাগে নি তো?”
“না, নিয়ামনি। তুমি একটু এখানে থাকো। আমি একটু বাইরে থেকে আসছি। একজনের সাথে ভীষণ জরুরি কথা আছে।”

বলেই সে নিয়াকে পাশেই একটি সিটে বসিয়ে বাইরে যায়। নিয়া ভদ্রমেয়ের মতো সেখানে বসে থাকে।
আহির বাইরে এসে আহিরাকে গাড়িতে বসিয়ে নাতাশাকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,
“তুই আহিরার পাশে বস, আমি একটু আসছি।”
নাতাশা বিনাবাক্য ব্যয়ে আহিরের কথা মেনে নেয়। আহির আবার সামনের দিকে হাটা নেয়। একটু পরই নেহা ও আহির পুনরায় মুখোমুখি হয়। নেহার দিকে পর্যবেক্ষক চোখে তাকায় আহির। এই নেহার সাথে ৫ বছর আগের নেহার কোন মিল নেই। সেই সহজ-সরল মেয়েটা অনেক বদলে গেছে। তার চোখে যেন আগুন জ্বলছে। নেহা এগিয়ে এসে একদম আহিরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার চোখে চোখ রেখে বলে,
“পাঁচ বছরেও আপনি একটুও বদলান নি তাই না? এখনো সেই আগের মতো জানোয়ারই রয়ে গেছেন। নিজের মেয়েকেও জানোয়ার হবার শিক্ষা দিচ্ছেন।”
আহির রাগী স্বরে বলে,

“হাউ ডেয়ার ইউ..আমার সাথে এভাবে কথা বলার সাহস তোমায় কে দিয়েছে?”
“কেন, কি ভেবেছিলেন আপনি? আপনাকে দেখে আমি ভয়ে জমে যাব? তাহলে আপনি ভুল ভেবেছেন। আমি আর সেই ৫ বছর আগের ভীতু নেহা নই। আমি এখন নিজের জন্য আওয়াজ তুলতে পারি। নিজেকে আমি এমন ভাবে গড়ে তুলেছি যাতে নিজের সাথে হওয়া সকল অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে পারি।”
আহির বাকা হেসে বলে,
“খুব ভয় পাচ্ছি..হু..কি করবে তুমি আমার? সেই অওকাত আছে নাকি?”

“আমার কিসের সামর্থ্য আছে আর কিসের নেই সেটা আপনি খুব শীঘ্রই জানতে পারবেন। আপনার করা প্রতিটা অন্যায়ের শাস্তি আমি আপনাকে পাইয়ে দেবোই। আমি ভুলিনি, ৫ বছর আগে কিভাবে আপনি..আপনি আমায় লাঞ্চিত করেছেন। একটা অবুঝ শিশুসহ আমায় রাস্তায় ফেলে দিয়েছিলেন..জানি না আমার আরো একটা মেয়ের সাথে কি করেছেন আপনি। হয়তো তাকে মেরেই ফেলেছেন।”
নেহার কথা শুনে আহির থমকায়। নেহা বলে,

“কি অন্যায় করেছিলাম আমি? কিসের জন্য আমাকে এত কিছু ভোগ করতে হলো? এর কোন উত্তর আছে আপনার কাছে? জানি, নেই। আর আমি কোন উত্তরের আশা করি না। তবে একজন নারী হিসেবে, একজন মা হিসেবে আমার নারীত্ব এবং আমার সন্তানদের উপর হওয়া অন্যায়ের বদলা আমি অবশ্যই নেব। আজ আমি প্রতিজ্ঞা করছি আপনাকে ফাঁসির মঞ্চে না ঝোলানো পর্যন্ত আমার শান্তি নেই। আইনের মাধ্যমেই আমি আপনার শান্তি নিশ্চায়ন করব।”
আহির বলে,
“ঠিক আছে, দেখি তুমি কি করতে পারো।”
বলেই আহির নিজের গাড়িতে উঠে বসে। নেহা সেখানে দাঁড়িয়ে ফুঁসতে থাকে।

“তুই কেন আহিরাকে নিজের সন্তান বলে পরিচয় দিলি নাতাশা?”
আহিরের প্রশ্ন শুনে চমকে উঠল নাতাশা। আহিরাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসা হয়েছে। ভেতরে ডাক্তার তার চেকআপ করছে। এমন সময় আহির নাতাশাকে প্রশ্নটা করল। নাতাশা বললো,
“এছাড়া যে আমার কাছে আর কোন উপায় ছিল না আহির। যদি ঐ নেহা কোনভাবে জানতে পারত যে, আহিরা ওর মেয়ে তাহলে যদি ও আহিরাকে তোর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিত। তখন তুই কি করতি?”
“ঐ সামান্য মেয়েকে তুই ভয় পেতে পারিস, আমি না। কি ক্ষমতা আছে ওর? ওকে আমার রাস্তা থেকে সরাতে ২ মিনিটও লাগবে না। ৫ বছর আগে তো ওকে ছেড়ে দিয়েছিলাম কিন্তু এবার ও বেশি বাড়াবাড়ি করলে ওকে দুনিয়া থেকেই সরিয়ে দেব।”

আহিরের চোখ রাগে লাল হয়ে গেছিল। নেহার দেওয়া হুমকি তার রাগ বৃদ্ধি করছিল। নাতাশা আহিরকে শান্ত করতে তার কাধে হাত রেখে বলে,
“দেখ, মাথা ঠান্ডা কর। রাগের মাথায় নেয়া সিদ্ধান্ত ভুল হয়। তুই ভাব, আহিরা সব জেনে গেলে কি হতো। ওর উপর তো এটা খারাপ প্রভাব ফেলত।”
“এটা তুই ঠিকই বলেছিস। তবে ঐ নেহা যদি কোনভাবে আমার আর আমার মেয়ের মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়াতে চায় তাহলে এর ফল ভালো হবে না।”
“আমিও তো এটাই চাই আহির, যেই তুই নেহাকে ওর স্থানটা বুঝিয়ে দিস। ওর বড় আব্বুর জন্য তোর আম্মুর জীবনটা নরক হয়ে গেছে, আবার মৃদুলের মৃত্যুর কারণও ঐ নেহা। এখন যদি ও আহিরাকেও তোর থেকে কেড়ে নিতে চায় তাহলে এবার ওকে সবথেকে বড় শাস্তিটা তোকেই দিতে হবে।”

নেহা নিয়াকে নিয়ে বাড়িতে ফেরে। আহিরের সাথে হওয়া কথাগুলোই তার মনে বারবার ভাসছিল৷ নেহা হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলে,
“একটা লোক কতটা অমানুষ হলে এত অন্যায় করার পরেও তার মাঝে বিন্দুমাত্র অনুশোচনাও থাকে না! এতকিছুর পরেও অতীতের জন্য তো ওনার কোন অনুশোচনা নেই তার উপর এখনও উনি একের পর এক অন্যায় করে চলেছে। নাহ, ওনাকে শাস্তির মুখোমুখি হতেই হবে। নিজের কৃতকর্মের শাস্তি পেতেই হবে ওনাকে।”

রাতের দিকে আহির ইনফিনিক্স গ্রুপের সাথে নিজের সই করা ডিলগুলো চেইক করছিল। এমন সময় তার নজরে আসে একটা ফাইল। যেখানে নেহার সাক্ষর করা ছিল প্রজেক্টের ম্যানেজার হিসেবে৷ এটা দেখেই আহিরের মনে পড়ে সেদিন প্রেজেন্টেশনের কথা। আহিরের মুখে বাকা হাসি ফুটে ওঠে,
“তাহলে ঐ মেয়েটা তুমিই ছিলে..নিজেকে তো খুব সাহসী হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করো তুমি। কিন্তু তুমি যে কতোটা ভীতু সেটা আমি বুঝে গেছি। ঠিক আছে, আমার সাথে খেলতে চাও তো এবার খেলা হবে সামনা। দেখি কে কাকে শাস্তি দেয়।”

শাহরিয়ার কায়সার নিজের অফিসে বসে ফাইল ঘাটছিল। এমন সময় খালেক হাসান তার সামনে এসে বলে,
“এই নতুন ডিলটা ফাইনাল করার জন্য নেহাকে আপনাকে কোম্পানিতে ফেরাতেই হবে। এটাই চাইছেন পাটোয়ারী গ্রুপের সিইও।”
শাহরিয়ার যারপরনাই বিরক্ত হয়। এটা তার ইগোর ব্যাপার৷ কিন্তু ডিলটা না হলেও কোম্পানির অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। তাই সে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৩১

“ঐ নেহাকে কোম্পানিতে ফেরানোর জন্য যা করার প্রয়োজন তাই করো। আমি চাই, আগামী সপ্তাহের মধ্যেই যেন ও এই কোম্পানিতে ফিরে আসে। নাহলে তোমাকেও চাকরি থেকে বরখাস্ত করে দেব আমি।”
খালেক হাসান ঢোক গেলেন।

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৩৩