উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৩৭

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৩৭
দিশা মনি

নেহা মুখ তুলে আরাভের দিকে তাকালো। আরাভ তখনো তার মাথায় ছাতা ধরেছিল। আরাভকে দেখেই নেহা বলে উঠল,
“আরাভ ভাই, আপনি?!”
“হ্যাঁ, আমি। এভাবে এখানে বসে কাঁদছিস কেন তুই? বল আমায়।”
নেহা নিজের চোখের জল মুছে বলে,
“কই কাঁদছিলাম না তো।”
“শোন, আমি তোকে সেই ছোটবেলা থেকে চিনি। তাই এভাবে আমার থেকে নিজের কষ্ট লুকাতে পারবি না।”
নেহা প্রসঙ্গ পালটানোর জন্য বলল,

“কিন্তু তুমি এখানে কি করছ?”
“ঢাকায় কিছু জরুরি কাজে এসেছিলাম। আর কাকতালীয় ভাবে আমিও এই পার্কে এসেছিলাম। আর আমাদের দেখা হয়ে গেল।”
“আচ্ছা।”
নেহা চুপ। আরাভ নেহার পাশে বসে ছাতাটা ভালো ভাবে ধরে বলল,
“৫ বছর তো একা লড়েছিস। আর কত? এবার আমাকে তোর হয়ে লড়তে দে। অপরাধীকে যে তার শাস্তিটা পাইয়ে দিতে হবে আমাদের।”
নেহা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“সে যে অনেক শক্তিশালী আরাভ ভাই। এই সমাজে অনেক ক্ষমতা তার। আর আমার কাছে তো, তার বিরুদ্ধে সেরকম কোন প্রমাণ নেই। কিসের ভিত্তিতে আমি তার সাথে লড়াই করব?”
“নিজেকে এত অসহায় ভাববি না। আমি সব পরিস্থিতিতে তোর পাশে আছি। এটা মনে রাখবি।”
নেহা যেন এবার একটু স্বস্তি পায়। কিছু সময় পর আরাভকে নিয়ে সে ফ্লাটে ফেরে। কিন্তু ফ্লাটে ফিরেই অবাক হয়ে যায়। কারণ ফ্লাটের দরজায় তালা মারা। নেহা বলে ওঠে,
“এই তালাটা কে দিল?”
এমন সময় পেছন থেকে ফ্লাটের মালিক মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বলে ওঠেন,
“আমি।”
নেহা আবদুল মান্নানের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আঙ্কেল, আপনি..”

“মাসের ১০ তারিখের মধ্যে ফ্ল্যাটের বেতন পরিশোধ করার ডেট ছিল। অথচ আজ ১৫ তারিখ, ৫ দিন থেকে বেতন পাচ্ছি না। আবার আমি খবর নিয়ে জানলাম আপনাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তো এই অবস্থায় আমি এখানে আপনাকে থাকতে দেব না। দ্রুত আমার ভাড়া পরিশোধ করে এই ফ্ল্যাটটা ছেড়ে দিন।”
“এসব আপনি কি বলছেন আঙ্কেল? এই অবস্থায় আমি নিজের মেয়েকে নিয়ে কোথায় যাব? আর আপনি চিন্তা করবেন না। আপনার টাকা আমি পরিশোধ করে দেব।”
“আমি কিছু শুনতে চাই না। আমার কাছে অনেকেই ফ্ল্যাটটা ভাড়া নিতে চাইছে। আগামী মাসেই আমি নতুন ভাড়াটে তুলব।”

“প্লিজ আঙ্কেল, এমন করবেন না।”
“দূর হয়ে যাও এখান থেকে।”
আরাভ এবার রাগী স্বরে বলে,
“আপনি ওর সাথে এমন ব্যবহার করতে পারেন না। ও বলছে তো, যে কোনভাবে ব্যবস্থা করে ফেলবে। তাহলে আপনি কেন ওকে সুযোগ দিতে চাইছেন না।”
“শোন, এটা আমার ফ্ল্যাট, এখানে আমি কোন আশ্রম গড়ে তুলি নি যে বিনা পয়সার থাকার সুযোগ দেব। আর ফ্ল্যাটটা কেনার সময়ই আমি শর্ত দিয়েছিলাম যে, প্রতি মাসের ভাড়া প্রতি মাসে পরিশোধ করতে হবে। তাই এখন আর কিছু শুনতে চাই না।”
নেহা তখন বলে,

“আঙ্কেল, ভেতরে আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আছে। সেগুলো অন্তত আনতে দিন।”
“আগে টাকা পরিশোধ করো, তারপর।”
বলেই তিনি স্থানত্যাগ করেন৷ আরাভ তার পিছু নিয়ে কিছু শক্ত কথা শোনাতে চায় কিন্তু নেহা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
“শুধু শুধু এভাবে ঝামেলা করে কোন লাভ হবে না।”
“কিন্তু নেহা..এই লোকটা এটা কিভাবে করতে পারে। দেশে কি কোন আইন-কানুন নেই? এভাবে কি মানুষকে জিম্মি করা যায়?”

“এই ফ্ল্যাটটা ভাড়া নেয়ার সময়ই এই এগ্রিমেন্টে সাইন করেছিলাম যে প্রতি মাসের বেতন সঠিক সময় পরিশোধ করতে হবে আর ফ্ল্যাটের বেতন দেয়ার নুন্যতম সামর্থ্য থাকতে হবে। যেহেতু এখন আমি বেতন পরিশোধ করতে পারছি না আবার আমার চাকরিও নেই তাই ওনার বিরুদ্ধে আইনত কোন ব্যবস্থা নেয়া যাবে না।”
“তাহলে এখন তুই কি করবি? নিয়াকে নিয়ে কোথায় যাবি?”
নেহা চিন্তায় পড়ে। দৃঢ়তাও তার ছেলে তাজিব ও তার শাশুড়ীকে নিয়ে তার স্বামীর কাছে ঘুরতে গেছে। এই সময় তাদের ফোন করে দুশ্চিন্তায় ফেলতে চায় না নেহা। এমনিতেই তারা নেহার জন্য অনেক করেছে। নেহা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,

“দেখি কি ব্যবস্থা করা যায়।”
“এসব দেখাদেখির কিছু নেই। এই অবস্থায় তোকে আমি একা ফেলে যাব না। তুই আমার সাথে গাজীপুরে ফিরে চল।”
“এটা কিভাবে হয় আরাভ ভাই?”
“কেন, তুই কি আমাকে আপন ভাবিস না? ৫ বছর আগে করা ভুলের জন্য আর কত শাস্তি পেতে হবে আমায়?”
নেহা কিছু বলতে যাবে এমন সময় হঠাৎ করে নিয়া ছুটে আসে। সে এসেই হাসিমুখে বলে ওঠে,
“আম্মু, আমি এসে গেছি৷ আরে মামা..তুমিও এসেছ।”

আরাভ নিয়াকে কোলে তুলে নিয়ে বলে,
“হ্যাঁ, নিয়ামনি। আমি এসেছি। আর এবার আমি তোমাকে আর তোমার আম্মুকে সাথে নিয়ে গাজীপুরে যাব। তুমি যাবে তো?”
নিয়া খুশি হয়ে বলে,
“হ্যাঁ, যাব।”
নেহা আর কিছু বলতে পারে না। আরাভ নেহার হাতটা আলতো করে ধরে বলে,
“চল, এখন। আর কোন আপত্তি করতে পারবি না।”
অগত্যা নেহাকে যেতে হয়।

শাহরিয়ার কায়সার অফিসে বসে বসে ফোন করে আবদুল মান্নানকে। আবদুল মান্নান ফোনটা রিসিভ করতেই শাহরিয়ার বলে ওঠে,
“কাজটা হয়ে গেছে তো?”
“জ্বি, মিস্টার কায়সার। আপনি যেমন বলেছিলেন আমি ঠিক তেমনটাই করেছি। ঐ নেহাকে ফ্ল্যাট থেকে বের করে দিয়েছি।”
শাহরিয়ারের মুখে বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে। সে প্রসন্ন সুরে বলে,
“আপনি অনেক ভালো কাজ করেছেন। চিন্তা করবেন না। আপনার একাউন্টে টাকা পৌঁছে যাবে।”
আবদুল মান্নান খুশি হয়ে যান।
শাহরিয়ার কায়সার বলে ওঠে,
“খুব ইগো না তোমার? এবার দেখি কি করো, চাকরিও নেই, বাসাও নেই। এবার রাস্তায় বসে বসে ভিক্ষা করো। এছাড়া আর কি করবে তুমি নেহা? ভালো অফার দিয়েছিলাম শুনলে না। এবার দেখি, তোমার এই অহংকার কোথায় যায়।”
শাহরিয়ারের চোখে যেন আগুন জ্বলে ওঠে।

আহিরা বাড়িতে ফিরেছে থেকে খাওয়া দাওয়া সব বন্ধ করে দিয়েছে। সকাল থেকে এখনো অব্দি সে কিছু খায় নি। আহির অনেক চেষ্টা করেও আহিরাকে কিছু খাওয়াতে পারে নি। তার একটাই কথা।
“কেন তুমি আমাকে ঐ আন্টির সাথে কথা বলতে দিলে না? ঐ আন্টির সাথে কথা না বলা পর্যন্ত আমি কিছু খাবো না।”
আহির আহিরার পাশে বসে বলে,
“তুমি কেন ঐ আন্টির সাথে দেখা করতে চাইছ আহিরা? ওনাকে তো তুমি ঠিকভাবে চেনোও না।”
আহিরা বলে ওঠে,

“কারণ ঐ আন্টির কাছ থেকে আমি মাম্মা মাম্মা ফিলিংস পাই পাপা। আমি ছোটবেলা থেকে দেখছি, আমার সব ফ্রেন্ডের মাম্মা আছে শুধু আমার মাম্মা নেই। জানো, ঐ নিয়াকে ঐ আন্টি কত ভালোবাসে, আমাকেও দুইবার বিপদের হাত থেকে বাচিয়েছে সে। মাম্মারা বুঝি এমনই হয়, তাইনা? তাহলে আমার কোন মাম্মা নেই কেন পাপা?”
আহির থমকে যায় নিজের মেয়ের প্রশ্নে। কি জবাব দেবে এবার সে? আহিরা আহিরকে চুপ দেখে বলে,
“কি হলো চুপ করে আছ কেন তুমি? আমাকে জবাব দাও। হয় আমাকে ঐ আন্টিকে এনে দাও নাহলে আমার মাম্মাকে এনে দাও। আমি আর কিছু শুনতে চাই না।”

আহির চুপচাপ আহিরার রুম থেকে বেরিয়ে যায়। বাইরে আসতেই নাতাশাকে দেখতে পায়। সে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনছিল। আহিরকে দেখতেই সে বলে,
“দেখলি তো আহির, আমি যেই ভয়টা পাচ্ছিলাম সেটাই এবার সত্য হলো। ঐ নেহা সত্যিই তোর মেয়েকে তোর কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাইছে। এবার কি করবি তুই?”
আহির হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলে,

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৩৬

“এটা কখনো হবে না।”
বলেই সে আবার রুমে প্রবেশ করে আহিরাকে বলে,
“তোমার মাম্মা চাই তাই তো, আমি তোমাকে মাম্মা এনে দেব।”
আহিরা অবাক হয়। সাথে নাতাশাও। রুমের বাইরে এসেই আহির নাতাশাকে বলে,
“বিয়ের শপিং করে নে!”

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৩৮