উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৩৮
দিশা মনি
আহিরের কথা শুনে নাতাশা ভীষণ খুশি হয়ে যায়। তার এতদিনের জমানো ইচ্ছা আজ পূরণ হতে চলেছে। এটা যেন তার কাছে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতো। নাতাশা খুশি হয়ে বলে,
“তার মানে তুই আমায় বিয়ে করবি?”
আহির মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ-বোধক ইশারা করে। তবে তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে মন থেকে এই বিয়েতে রাজি হয়নি। তবে নাতাশার কাছে সেটা কোন বড় ব্যাপার না। নাতাশা আনন্দে আজ আত্মহারা। কিছু সময়ের মধ্যে সে চলে যায় ডাইনিং টেবিলে। সেখানে তখন মুমিনুল পাটোয়ারী খেতে বসেছিলেন। নাতাশা খুশি হয়ে বলে ওঠেন,
“আঙ্কেল, একটা খুশির খবর আছে। আহির অবশেষে আমায় বিয়ে করতে রাজি হয়েছে।”
মুমিনুল পাটোয়ারী খাওয়া থামিয়ে দেন। তার মুখে খুশি এবং অবাক দুই ধরনের অভিব্যক্তি দেখা যায়। তিনি বলে ওঠেন,
“যাক! এতদিনে তাহলে ছেলেটার সুবুদ্ধি হলো। কিন্তু কাল অব্দি তো ও এই বিয়েতে রাজি ছিল না, হঠাৎ এই পরিবর্তন কিভাবে সম্ভব হলো?”
নাতাশা বলে উঠল,
“সেটা যে কারণেই হোক, ও যে রাজি হয়েছে সেটাই অনেক। এবার আপনি বিয়ের সব প্রস্তুতি শুরু করে দিন আঙ্কেল।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কিছু সময় পর আহির চলে আসলো। আহিরকে দেখে মুমিনুল পাটোয়ারী বললেন,
“তুই যে নিজের নতুন জীবন শুরু করতে চাইছিস এটায় আমি খুশি।”
আহির বলে,
“আব্বু, তাহলে তুমি বিয়ের সব আয়োজন শুরু করো।”
“আমি চাই, তোমাদের বিয়ে এখানে না, গাজীপুর শহরে হোক।”
“বেশ, তুমি যা বলবে।”
নাতাশার কাছে অবশ্য কোথায় বিয়ে হবে সেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ না। সে তো নিজের মা-বাবা এবং কিছু বন্ধু-বান্ধবদের সাথে নিজের এই খুশির সংবাদ ভাগ করে নিলো। তার মাকে বিয়ের শপিং এর প্রস্তুতি নিতে বলল।
আহির নাতাশার এত আনন্দ যেন দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। শুধুমাত্র নিজের মেয়ের জেদের জন্যই তাকে এই বিয়েটা করতে হচ্ছে। নাহলে সে কখনোই করত না।
আরাভের সাথে গাজীপুরে তার নতুন বাসায় এলো নেহা৷ তার সাথে নিয়াও এলো। সে তো এখানে এসে ভীষণ খুশি। কিন্তু নেহার মুখ অন্ধকার। আজ ৫ বছর পর আবারো তার মনে হচ্ছে যে, সে জীবনযুদ্ধে হেরে গেছে! আরাভ যেন বুঝল নেহার মনের কথা। তাই তো নেহার কাধে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“চিন্তা করিস না নেহা, এটা তোর হার নয়। বরং এখান থেকেই তোর জয়যাত্রা শুরু হবে। আমার উপর ভরসা রাখ। আমরা সবকিছু আবার নতুন ভাবে শুরু করব।”
বিপাসা চৌধুরী আরাভকে দেখে ছুটে আসেন। তার সাথে রিনাও ছিল। রিনা নেহাকে দেখে যে খুশি হয় নি সেটা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। বিপাসা চৌধুরী নেহাকে দেখে খুশি হয়ে বলেন,
“তুই এসেছিস নেহা! আরাভ আমায় বলেছে, এখন থেকে তুই আমাদের সাথেই থাকবি। আমি যে কত খুশি সেটা তোকে বলে বোঝাতে পারব না।”
নেহা কি বলবে বুঝতে পারে না। সে শুধু আরাভের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকায়। আরাভ বিপাসা চৌধুরীকে বলেন,
“এখন থেকে নেহা আর ওর মেয়ে আমাদের সাথেই থাকবে আম্মু। ওর সাথে যত কথা বলার পরে বলো। ও অনেক ক্লান্ত,এখন একটু বিশ্রাম নিতে হবে।”
“আচ্ছা৷ নেহা, তুই ভেতরে যা। তোর মেয়েকেও নিয়ে যা। আমি দুপুরের রান্নার ব্যবস্থা করছি। রিনা এসো আমার সাথে।”
রিনা মূলত বিপাসা চৌধুরীকে কিছুদিন থেকে রান্নাবান্নায় সাহায্য করছে। আরাভ ব্যাপারটা ভালো ভাবে নিচ্ছে না। তাই সে বলে,
“আম্মু, ওনাকে শুধু শুধু বিরক্ত করা ঠিক হচ্ছে না। ওনার নিজেরও তো কাজ থাকতে পারে। ওনাকে কেন তুমি রান্নায় সাহায্য করতে বলছ?”
রিনা আরাভের চোখে চোখ রেখে বলে,
“আমায় আন্টি মোটেই জোর করছেন না। আমি নিজের ইচ্ছাতেই ওনাকে সাহায্য করছি। এতে আপনার কি সমস্যা? আমি সেই মেয়েদের মতো নই, যে নিজের আপনজনদের বিপদে একা ফেলে পালিয়ে যাই। আমি যাদের আপন মনে করি, সব বিপদে তাদের পাশে থাকি।”
কথাটা যে নেহাকে উদ্দ্যেশ্য করে বলা তা নেহা বুঝল। সে আর না দাঁড়িয়ে নিয়াকে কোলে নিয়ে ভেতরে গেল। আরাভ রিনাকে রাগী স্বরে বলল,
“হাউ ডেয়ার ইউ? তুমি কি বলতে চাইছ আমরা বুঝি নি ভেবেছ? বাইরের লোক বাইরের হয়েই থেকো।”
বলেই আরাভ ত্রস্ত পায়ে স্থান ত্যাগ করল। আরাভ যেতেই রিনা কাদো কাদো স্বরে বিপাসা চৌধুরীর উদ্দ্যেশ্যে বলল,
“দেখছেন আন্টি, আপনার ছেলে আমাকে কিভাবে বললো।”
“দেখো রিনা কিছু মনে করো না, তুমি আকারে ইঙ্গিতে কি বলেছ সেটা আমিও বুঝেছি। নেহাকে নিয়ে এমন কথা আমি বা আরাভ কেউ বরদাস্ত করবো না। এরপর যদি এমন কিছু বলো, তাহলে আমিও ছেড়ে কথা বলব না।”
বলেই তিনি স্থানত্যাগ করেন। রিনা রাগে ফুসে উঠে বলে,
“এই এক বাচ্চার মায়ের জন্য এই মা-ছেলের এত দরদ কেন? আমার মতো একটা কুমারী মেয়ে ফেলে কি এখন এই এক বাচ্চার মাকে বাড়ির বউ করবে?”
নাতাশা বিয়ের শপিং করতে এসেছিল। তার সাথে তার মা নূর বেগমও ছিলেন। নূর বেগমকে ভীষণ নাখোশ দেখাচ্ছিল। নাতাশা ভীষণ আনন্দের সহিত বিয়ের কেনাকাটা করলেও নূর বেগম এককোণায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। নাতাশা এগিয়ে এসে তার মাকে বলে,
“এভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছ কেন মা? এসে একটু আমায় শপিং এ সাহায্য করো।”
“আমি এখনো এই বিয়ের সিদ্ধান্ত মানতে পারছি না। কিসের কমতি আছে তোর যে, তোকে একটা এক বাচ্চার বাবাকে বিয়ে করতে হবে? এত সুন্দর দেখতে তুই, এত উজ্জ্বল ক্যারিয়ার তোর, তবুও কেন তুই ঐ আরাভের জন্য এত পাগল?”
“মা! এই ব্যাপারে আমি আর কিছু শুনতো চাই না। তুমি জানো না, আরাভকে আমি কতো ভালোবাসি..ওকে পাওয়ার জন্য আমি কত অপেক্ষা করেছি।”
“আমি সবটাই জানি কিন্তু..”
“কোন কিন্তু নয়।”
“আরাভ যদি কোনদিন তোর সব সত্য জানতে পারে তাহলে কি হবে?”
“কোন সত্যের কথা বলছ তুমি?”
“এটাই যে, মৃদুলের মৃত্যুর জন্য..”
“মা! আর একটা শব্দও বলবে না।”
নাতাশার গলা শুকিয়ে যায়। চোখ বন্ধ করে সে মনে করে আজ থেকে ১৫ বছর আগের সেই ঘটনা।
ফ্ল্যাশব্যাক
মৃদুল, আরাভ ও নাতাশা তখন সবে ফাস্ট ইয়ার এক্সাম দিয়েছে। কিছুদিন পর রেজাল্ট দিলো। মৃদুল দুটো সাবজেক্টে ফেইল করেছে। এমনিতেই নেহার প্রত্যাখ্যানের জন্য তার মন খারাপ ছিল তার উপর এই রেজাল্ট। আহিরও তখন নিজের মাকে নিয়ে ব্যস্ত ছিল জন্য মৃদুলকে সময় দিতে পারত না। মৃদুল তাই নাতাশার কাছে এসে তার দুঃখের কথা বলছিল। সেই সময় নাতাশা আবার একটু অন্য কাজে জড়িত ছিল। নাতাশা ডাক্তার হওয়ার আগে তাদের পারিবারিক অবস্থা বেশি ভালো ছিল না। তার বাবা একজন সাধারণ মুদি দোকানি ছিল আর মা গৃহিনী। ঐ আয়ে তাদের সংসার কোনমতে চলত। কিন্তু নাতাশা অনেক লোভী ছিল। সে অনেক আভিজাত্যপূর্ণ জীবন চাইত। এজন্য সে গোপনে কিছু ড্রাগ স্মাগলারের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল সেই বয়সেই। এমনকি স্কুল কলেজের অনেক স্টুডেন্টকে সে ড্রাগ সাপ্লাই দিত যারা বিভিন্ন হতাশায় নিমগ্ন ছিল। নাতাশা জানত, মৃদুল ভীষণ ধনী পরিবারের ছেলে। তাই মৃদুলের এই মানসিক অবস্থার সুযোগ নিয়ে চড়া দামে তার কাছে ড্রাগ বিক্রি করে। সে মৃদুলকে বলে,
“এটা খেয়ে দেখ, তোর সব দুঃখ ভুলতে পারবি।”
“সত্যি বলছিস নাতাশা? এটা খেলে আমি আর কোন দুঃখ বোধ করব না?”
‘উহু।’
উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৩৭
মৃদুল নাতাশাকে ভরসা করে ড্রাগ নিতে শুরু করে। কিছুদিনের মাঝেই সে এতোটা আসক্ত হয়ে পড়ে যে নাতাশা তাকে একপ্রকার নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। তার কাছ থেকে অনেক টাকা হাতিয়ে নেয়। কিন্তু এভাবে চলতে চলতে একদিন মৃদুলের কাছে অনেক বেশি টাকা চেয়ে বসে। মৃদুল সেই টাকার ব্যবস্থা করতে না পারায় তাকে ড্রাগও দেয় না। যার ফলে মৃদুল মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে নিজেকে শেষ করে দেয় ড্রাগের নেশায়।