উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৩৯

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৩৯
দিশা মনি

নেহা নিয়াকে ভাত খাইয়ে দিচ্ছিল। নিয়া ভদ্র মেয়ের মতো চুপচাপ খাচ্ছিল। এমন সময় রিনা তাদের রুমে আসে। রিনাকে দেখে নেহা কিছুটা অবাক হয়। রিনা খুব একটা কিছু না ভেবে নেহার পাশে এসে বসে৷ অতঃপর সামান্য হেসে বলে,
“আপনার ব্যাপারে অনেক কিছু শুনেছি বিপাসা আন্টির মুখে। আপনার সাথে দেখা করার খুব ইচ্ছা ছিল৷ আজ সেই ইচ্ছাটা পূরণ হলো।”
নেহাও বিনয়ী হেসে বলে,

“আমি বড় আম্মুর মুখে শুনেছি আপনি এতদিন কিভাবে ওনাকে আর আরাভ ভাইকে আগলে রেখেছিলেন। এজন্য আপনাকে ধন্যবাদ।”
“আমি মন থেকেই ওনাদের আগলে রেখেছিলাম। কারণ ওনারা আমার আপন ছিলেন। তবে এখন মনে হচ্ছে, এসব অর্থহীন ওনাদের কাছে।”
“কেন এমন মনে হচ্ছে?”
“বাদ দিন সেসব। আপনি আপনার কথা বলুন। আপনার মেয়েটা তো খুব মিষ্টি। ওর চেহারায় অবশ্য আপনার সাথে বেশি একটা মিল নেই। ও নিশ্চয়ই ওর বাবার মতো হয়েছে, তাই না?”
নেহা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। নিয়াও কিছুটা অবাক হয়। “বাবা” এই শব্দটা নিয়াকে কখনো সেভাবে ভাবায় নি। নেহা ছোটবেলাতেই নিয়াকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, তার অভিভাবক শুধুমাত্র নেহা। নিয়া তাই স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নিয়েছিল। বাবার ব্যাপারে কিছু জানতে চায়নি কখনো। তার জন্য তার মায়ের সঙ্গই যথেষ্ট ছিল সবসময়। নেহা নিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আমার মেয়ে আমার মতোই হয়েছে। আপনার বুঝতে ভুল হয়েছে।”
“হতে পারে। ওর বাবাকে দেখলে এই ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারতাম। আচ্ছা, আপনার কাছে ওর বাবার কোন ছবি আছে? থাকলে দেখান তো একটু দেখে বলি, ও নিজের বাবার মতো হয়েছে না আপনার মতো।”
নেহা কিছু বলতে যাবে এমন সময় আরাভ এসে বলে,
“কি হচ্ছে এখানে?”
আরাভের গলা শুনে রিনা নড়েচড়ে ওঠে। আলতো স্বরে বলে,
“আমি একটু তোমার কাজিনের সাথেও গল্প করছিলাম।”
আরাভ এগিয়ে এসে রুক্ষ স্বরে বলে,
“এসব গল্প পরে করা যাবে। নেহা অনেক দূর জার্নি করে এসেছে। ও এখন ভীষণ ক্লান্ত। তুমি নিজের বাসায় যাও রিনা। নেহাকে একটু বিশ্রাম নিতে দাও।”
“কিন্তু আমি তো সেভাবে বিরক্ত করি নি..”

“তোমায় যা বললাম তাই করো। আমি অতিরিক্ত কোন কথা শুনতে চাই না।”
অগত্যা রিনা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আরাভ নিয়ার পাশে বসে বলে,
“কি করছে আমার নিয়ামনি?”
“এই তো, ভাত খাচ্ছি মামা।”
“গুড।”
“আচ্ছা, মামা আমাকে তুমি গাজীপুর শহরটা একটু ঘুরে দেখাবে?”
“হ্যাঁ, দেখাব।”
“ইয়ে..আজই ঘুরতে যাই চলো।”
“ঠিক আছে, আজ বিকেলে তোমাকে আর তোমার আম্মুকে নিয়ে আমি ঘুরতে যাব।”
নেহা সহসা বলে ওঠে,

“তুমি নিয়াকে নিয়েই যাও না আরাভ ভাই, আমার সাথে যাওয়ার কি দরকার?”
“দরকার আছে৷ তোর মন ভালো হবে যদি তুই ঘুরতে যাস। শোন, এই ব্যাপারে আমি আর কিছু শুনতে চাই না। এতদিন তুই নিজের ভালো নিজেই বুঝেছিস তবে এবার আমাদেরও তোর ভালোটা বুঝতে হবে। চিন্তা করিস না, আমি সব পরিস্থিতিতে তোর খেয়াল রাখব। তোকে ভালো রাখার দায়িত্ব এখন আমার।”
নেহা আরাভের কথা শুনে আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে।

বিয়ে উপলক্ষে বর্তমানে সপরিবারে গাজীপুরে চলে এসেছে আহির। আগামী মাসেই নাতাশার সাথে তার বিয়ে। মূলত এনগেজমেন্টটা দুই দিন পর হবে, সেই উপলক্ষ্যেই গাজীপুরে আসা। আহিরা জানে আহির ও নাতাশার বিয়ের ব্যাপারে। তবে এই বিয়েটা নিয়ে সে মোটেই আগ্রহ পাচ্ছে না। তার নাতাশাকে এমনিতেও খুব বেশি পছন্দ না। তাই আহিরা মুখ গোমড়া করে বসে আছে৷
মুমিনুল পাটোয়ারী আহিরাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে তার পাশে এসে বলে,
“তুমি তো এখন নিশ্চয়ই অনেক খুশি, তাই না আহিরা? তুমি নিজের মাম্মা পেতে চলেছ।”
আহিরা বলে,

“না, আমি একটুও খুশি না। নাতাশা আন্টিকে আমি মাম্মা বলে মানতে পারব না।”
“এভাবে বলছ কেন? নাতাশা আন্টি তোমায় কত ভালোবাসে। ”
“আমার নাতাশা আন্টির মতো মাম্মা চাই না, আমার তো ঐ ভালো আন্টিটার মতো..”
আহিরা আরো কিছু বলতে যাবে এমন সময় আহির এসে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
“আহিরা! চুপ করো। কি বলছ এসব তুমি। যাও, নিজের রুমে যাও।”
আহিরা রাগী দৃষ্টিতে আহিরের দিকে তাকিয়ে বলে,
“তুমি এখন খুব পচা হয়ে গেছ। আই হেইট ইউ।”
বলেই আহিরা চলে যায়। আহিরার মুখে কথাটা শুনে আহির বুকের গভীরে তীব্র ব্যথা অনুভব করে। মুমিনুল পাটোয়ারী আহিরের দিকে তাকিয়ে বলেন,

“ও তো বাচ্চা মানুষ তাই বুঝতে না পেরে বলে ফেলেছে। তুই কিছু মনে করিস না, এনগেজমেন্টের প্রস্তুতি নে।”
আহিরের কিছু ভালো লাগছিল না। তাই সে দ্রুত সেভাবেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়ি বের করে ড্রাইভ করতে লাগল। কিছু সময় ড্রাইভ করার পর একটা পার্কের সামনে এসে সে গাড়িটা থামালো।

পার্কে বিভিন্ন বাচ্চারা তাদের মা-বাবার সাথে মজা করছিল। এই দৃশ্য দেখে আহিরের মনেও ভালো লাগা কাজ করতে থাকে। কিন্তু আচমকা সে এমন কিছু দেখে যাতে করে এই ভালো লাগা উধাও হয়ে যায়। নিয়া আরাভ ও নেহার হাত ধরে এই পার্কেই আসে। তাদের হাত ধরে সে খুশিতে উৎফুল্ল ছিল৷ আগ্রহ নিয়ে অনেক কিছু জানতে চাইছিল। নেহাকেও আরাভের পাশে ভীষণ খুশি লাগছিল। তারা যেন এক খুশি পরিবার। এই দৃশ্য দেখে আহির নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়।

আরাভকে চেনে সে। আরাভের প্রতি ঈর্ষা বোধ হয় আহিরের। সে মনে মনে বলে,
“এই ছেলেটা আমার কাছ থেকে সবসময় সবকিছু কেড়েই নিলো! আমিও আজমাইন চৌধুরীর ছেলে কিন্তু কখনোই বাবার ভালোবাসা পাইনি যা এই আরাভ পেয়েছে, আমার নিজের সন্তানও আমাকে ভালোবাসে না সেখানে আমার আরেক সন্তানের ভালোবাসা পাচ্ছে এই আরাভ, নেহা যাকে আমি শাস্তি দিতে চেয়েছিলাম সেও কিনা আরাভের সাথে ভালো আছে। নাহ,এটা হতে পারে না। আমি এটা হতে দেব না। ওদের সুখ আমি সহ্য করতে পারছি না। আবারো প্রতিশোধের নেশা চেপে বসছে আমার মাথায়।”
আচমকা আহির দেখে আরাভ নিয়াকে কোলে নিয়ে দোলনায় বসিয়ে দোল দিচ্ছে। আহির এই দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে বলে,

“আহিরাকে আমি এত ভালোবাসলেও ও আমাকে কখনো বিন্দুমাত্র ভালোবাসে নি আর আমারই আরেক মেয়ে কিনা এই আরাভকে নিজের অভিভাবকের স্থান দিয়ে দিচ্ছে। ওর সাথে এত খুশি। এটা তো আমি হতে দিতে পারি না। এবার আমি তাই করবো যা আমার করা প্রয়োজন। আহিরাকে তো আমি আগেই নিজের করে নিয়েছিলাম এবার নেহার কাছ থেকে আমার আরেক মেয়েকেও আমি ছিনিয়ে নেব। তার জন্য আমাকে যা করতে হয় আমি করবো।”
আহিরের চোখে যেন আগুনের স্ফুলিঙ্গের দেখা মেলে। এরমধ্যে নেহা চুপচাপ পার্কের ব্রেঞ্চে বসে ছিল। আচমকা তারও চোখ যায় আহিরের দিকে। আহিরকে দেখেই নেহা ভয় পেয়ে যায়। সে বলে ওঠে,

“আবারো এই লোকটা! ইনি কি কখনোই আমার পিছু ছাড়বেন না।”
নেহা উঠে দাঁড়ায়। দোলনায় দুলতে থাকা নিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমার মেয়েকে আমার এনার থেকে দূরে সরাতে হবে।”
বলেই সে হাটা ধরে। দোলনার কাছে গিয়ে নিয়াকে কোলে তুলে নেয়। নেহার আচমকা এমন কাণ্ড দেখে আরাভ বলে,
“কি হয়েছে নেহা?”
“আমাদের এখান থেকে যেতে হবে।”
“এক্ষুনি তো এলাম। এত তাড়াতাড়ি কেন যাব?”

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৩৮

“প্লিজ আরাভ ভাই, এখান থেকে যাওয়াটা খুব বেশি প্রয়োজন। তর্ক করো না।”
বলেই সে নিয়াকে নিয়ে হাটা ধরে। আরাভ বিস্ময়ে থ হয়ে যায়। নেহা নিয়াকে নিয়ে সামনেই যাচ্ছিল এমন সময় আহির হঠাৎ করে নেহার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে,
“স্টপ, আই হ্যাভ টু টক উইদ ইউ!”
“কি বলবেন আপনি? কি বলার আছে?”
“তোমার মেয়ে কি জানে, আমার আসল পরিচয়? ওকে বলেছ? ব্যাপার না, আমিই বলছি।”

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৪০