উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৪০

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৪০
দিশা মনি

নেহা হতবাক চোখে তাকিয়ে থাকে আহিরের দিকে৷ সে জানে না, এখন কি করবে, কি বলবে। নিয়া একবার নেহা ও একবার আহিরের দিকে তাকাচ্ছে৷ এরইমধ্যে হঠাৎ করে আরাভ চলে আসায় নেহা নিয়াকে বলে,
“যাও, তোমার মামার কাছে যাও।”
নেহা ভদ্র মেয়ের মতো চুপচাপ আরাভের দিকে এগিয়ে যায়। আরাভ নেহাকে এভাবে একজন অচেনা পুরুষের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা অবাক হয়। সে জিজ্ঞেস করে,
“এই লোকটা কে নেহা? তুই কি ওনাকে চিনিস?”
নেহা বলে,

“উনি আমার পরিচিত। তুমি একটা নিয়াকে নিয়ে যাও। ও তখন ডিসকোণ আইসক্রিম খেতে চাইছিল না? ওকে কিনে দাও। আমি ওনার সাথে কিছু কথা বলে আসছি।”
আরাভ ব্যাপারটা নিয়ে বেশি মাথা না ঘামিয়ে নিয়াকে নিয়ে রওনা দেয়। তারা যেতেই নেহা আহিরের দিকে রক্তিম চোখে তাকিয়ে বলে,
“আমার বা আমার মেয়ের দিকে আপনি যদি নিজের পাপী হাত বাড়ানোর চেষ্টা করেন তাহলে এই হাত আর হাতের জায়গায় থাকবে না।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আমাকে ভয় দেখাচ্ছ তুমি? কিসের ভিত্তিতে? কি ক্ষমতা আছে তোমার?”
“একজন নারী, একজন মায়ের ক্ষমতা কত বেশি সেটা আপনি হয়তো জানেন না। তাই আজ থেকে ৫ বছর আগে,,,,যাইহোক, যথেষ্ট ক্ষতি করেছেন আমার। নিজের জীবন দিয়েও সেই ক্ষতিপূরণ করতে পারবেন না। তাই আর ক্ষতি করতে আসবেন না। জাহান্নামেও যায়গা পাবেন না তাহলে।”
বলেই নেহা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে নেয়। আহিরও নিজের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। এমন সময় হঠাৎ করে বিকট শব্দে কেপে ওঠে পুরো এলাকা। নেহা কিছু বুঝে ওঠার আগে দেখতে পায় চারিদিকে ভয়াবহ ধোয়ার কুণ্ডলি। পার্কের আশেপাশে থাকা সমস্ত লোক ছোটাছুটি করতে শুরু করে। নেহা হতবাক চোখে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। তার মাথায় হঠাৎ করে এই চিন্তা আসে যে আরাভ তো একটু আগেই নিয়াকে নিয়ে আইসক্রিম কিনতে গেল। ওরা ঠিক আছে তো?

ভয়ে নেহার বুক কেপে উঠল। সে আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে সামনের দিকে দৌড় দিলো। একটু সামনে যেতেই দেখতে পেল কয়েকটা ছোট বাচ্চা ধোয়ায় শ্বাস নিতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। কিছু সময়ের মাঝে কয়েকজন ছুটে এলো এদিকে। নেহা তাদের সাহায্যে বাচ্চাগুলোকে টেনে তুলল। নেহা জিজ্ঞেস করল,
“ভাই, এখানে কি হয়েছে কিছু জানেন? হঠাৎ করে একটা বিস্ফোরণের শব্দ শুনলাম তারপর এই ধোঁয়া…কিছু বুঝতে পারছি না।”
একটা লোক বলে,
“পাশেই একটি কেমিক্যাল কোম্পানিতে বিশাল ব্লাস্ট হয়েছে৷ সেখান থেকেই বিষাক্ত ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে পুরো এলাকায়।”
কথাটা শুনেই নেহার অন্তরাত্মা কেপে ওঠে। সে বলে,

“আমার মেয়ে আর কাজিন ঐদিকে আইসক্রিম কিনতে গেছিল। ওদের কোন খোঁজ পাচ্ছি না।”
“কি বলেন? ওদিকটা তো ধোঁয়ায় পুরো ছেয়ে গেছে৷ পুরো রাস্তায় আমি অনেক মানুষকে পড়ে থাকতে দেখেছি।”
কথাটা শুনে নেহা আর অপেক্ষা না করে ঐদিকে যেতে নেয়। এমন সময় কয়েকজন বলে,
“ঐদিকে যাবেন না বিপদ হতে পারে।”
নেহা কারো কথা না শুনে সেদিকে যেতে থাকে।

আরাভ কোনরকমে নিয়াকে নিয়ে দূরে একটি নিরাপদ স্থানে আসে। এখানে ধোঁয়া নেই তেমন। নিয়া কান্নারত স্বরে বলে,
“আম্মু কোথায় মামা? আমাকে আম্মুর কাছে নিয়ে চলো।”
আরাভ বুঝতে পারে না সে এখন নিয়াকে কিভাবে বোঝাবে। নিয়াকে আইসক্রিম কিনে দিয়ে আসার সময়ই এই ভয়াবহ বিস্ফোরণটি ঘটে। আরাভ নিয়াকে নিয়ে দ্রুত নিরাপদ স্থানে চলে আসে। কারণ সে ছোট বাচ্চা। এই বিষাক্ত ধোয়ায় তার ক্ষতি হবার সম্ভাবনা বেশি। পাশেই কিছু লোক ছুটে এসেছিল উদ্ধার কাজে। আরাভ নিয়াকে তাদেরই একজনের হাতে তুলে দিয়ে বলে,
“মেয়েটাকে একটু দেখে রাখবেন প্লিজ..ওর মাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমাকে ওর মাকে খুঁজতে হবে।”
অতঃপর সে নিয়াকে বলে,

“তুমি এখানেই থাকো নিয়ামনি। আমি তোমার আম্মুকে নিয়ে আসছি।”
বলেই আরাভ দৌঁড় দেয়। নিয়া সেখানেই থাকে। আরাভ দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে পার্কের এড়িয়াতে চলে আসে। কিন্তু নেহা তখন সেখানে ছিল না। আরাভ নেহার নাম ধরে ডাকতে থাকে। কিন্তু কোন সাড়া পায় না।
অন্যদিকে নেহা চলে আসে দোকানপাঠগুলোর কাছে৷ কারণ এখানেই আরাভ আইসক্রিম কিনতে এসেছিল। ভিড়ের মধ্যে তার ফোনটাও কোথায় জানি পড়ে গেছে। তাই যোগাযোগেরও কোন উপায় নেই। সেই স্থানে ধোঁয়া বেশি থাকায় নেহার শ্বাসকষ্ট হতে থাকে। তবুও সে অনেক কষ্টে খুঁজে বেড়াতে থাকে আরাভ ও নিয়াকে। রাস্তায় সে অনেক মানুষকে পড়ে থাকতে দেখে। কয়েকজনকে তুলে সে নিরাপদ স্থানেও পৌঁছে দেয়। ততক্ষণে অনেক উদ্ধারকারী টিমও পৌঁছে গেছিল৷ তারা নেহাকে বলে,

“দ্রুত এই স্থান ত্যাগ করুন নাহলে আপনারও সমস্যা হবে।”
“আমার মেয়ে আর কাজিন এখানে এসেছিল….ওদের খোঁজ না পেয়ে আমি যেতে পারব না।”
কিন্তু এরপর তাদের জোরাজুরিতে নেহাকে পিছু হটতে হয়। সে বাধ্য হয়ে আবার পার্কের কাছাকাছি চলে আসে। হঠাৎ করেই নেহার কানে আসে কেউ ক্ষীণ স্বরে তার নাম ধরে ডাকছে,
“নেহা…হেল্প..”
নেহা পেছন ফিরে তাকায়। রাস্তার পাশেই গাড়িতে বসে ছিল আহির। মনে হয় হঠাৎ ভীষণ পরিমাণ ধোঁয়া গাড়ির ভেতর চলে যাওয়ায় আহির অসুস্থ হয়ে পড়েছে।

তবে আহিরের এই অবস্থা দেখে নেহার মনে একটুও খারাপ লাগা কাজ করে না। তার মনে পড়ে যায়, ৫ বছর আগে এই লোকটার জন্য তাকে কতটা নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছিল। আজ হয়তো লোকটা সেসবরেই শাস্তি পাচ্ছে।
নেহা আহিরের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে যায় না সে। মনে মনে বলে,
“ওনার মতো একজন রে*পিস্ট এটাই ডিজার্ভ করে। আইন ওনাকে কি শাস্তি দেবে জানি না৷ তবে যদি প্রকৃতি ওনাকে এই শাস্তিটা দেন তাহলে ঠিক আছে। ভোগ করুক উনি ওনার শাস্তি।”
নেহা এবার পার্কের দিকে তাকাতেই দেখতে পায় আরাভ ঢলতে ঢলতে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। নেহা উদ্বিগ্ন হয়ে আরাভের দিকে এগিয়ে যায়। নেহার কাছাকাছি এসেই আরাভ ঢলে পড়ে। নেহা আরাভের পাশে বসে বলে,
“আরাভ ভাই..তুমি ঠিক আছ তো? আর নিয়া কোথায়?”
আরাভ অনেক কষ্টে বলে,

“ওকে আমি নিরাপদ স্থানে রেখে এসেছি…”
এরপর আরাভের নিঃশ্বাস নিতে অনেক কষ্ট হচ্ছিল দীর্ঘ সময় বিষাক্ত ধোঁয়ার সংস্পর্শে থাকায়। নেহার অবস্থাও ধীরে ধীরে খারাপ হচ্ছিল। নেহা আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে আরাভকে ধরে এই স্থান ত্যাগ করতে নেয়। আহির ঝাপসা চোখে সবকিছুই দেখে। তার দম্ভে যেন আঘাত লাগে এই দৃশ্যে। আহির বুঝতে পারে, নেহার মনে তার প্রতি ঘৃণা কতটা বেশি। যে এই পরিস্থিতিতেও সে আহিরকে একটু দয়া দেখাল না। ততক্ষণে আহিরের পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাচ্ছিল। সে আহিরার মুখশ্রী মনে করে। আগে মৃত্যুকে ভয় পেত না আহির। তবে আজ কেন জানি তার মরতে ভীষণ ভয় হচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে তার কিছু হয়ে গেলে তার আহিরার কি হবে? এই মুহুর্তে আহিরের মনে হলো সে যদি নেহাকে আহিরার আসল সত্যটা জানায় তাহলে হয়তো নেহা আহিরাকে অবশ্যই সামলাবে। কারণ নিয়াও তো আহিরের মেয়ে, তাকে যদি নেহা সামলায় তাহলে আহিরাকেও সামলাবে। তাছাড়া, আগেও তো একবার আহিরকে তাদের আরেক সন্তানের কথা জিজ্ঞেস করেছিল নেহা। তাই আহির নিজের সর্বশক্তি দিয়ে আবছা স্বরে বলে,

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৩৯

“নেহা..আহিরা..তোমা..মে..”
আহিরের অবস্থা এতই খারাপ হয়ে গেছিল যে সে শব্দটাও ঠিকভাবে উচ্চারণ করতে পারছিল না। তার আওয়াজও অনেক ধীরে বের হচ্ছিল। যা নেহার কান অব্দি পৌঁছায় না। ততক্ষণে নেহা অনেক দূরে চলে যায়। এদিকে আহির ধীরে ধীরে ঢলে পড়তে থাকে। জ্ঞান হারানোর আগে সে দেখতে পায় নাতাশা এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে। তার গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছে নাতাশা। এরপর আহিরের চোখে নেমে আসে অন্ধকার।

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৪১