উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৪২

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৪২
দিশা মনি

নেহা তখনো হাসপাতালের বেডে শুয়ে ছিল। ডাক্তাররা তার চিকিৎসা চলমান রাখলেও কোন আশা দিতে পারছিলেন না। আরাভ নিয়াকে আকড়ে বসে ছিল বাইরে।
আচমকা আহিরের আগমন ঘটলো সেখানে। সে বর্তমানে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিয়ে ফিরছিল। হঠাৎ করেই নেহার কেবিনের সামনে এসে তার পা থেমে গেল। থাই গ্লাসে চোখ যেতেই তার নজরে এলো নেহার মলিন মুখশ্রী। নেহার দিকে তাকাতেই তার নিজের বুকে কেমন জানি ব্যথা অনুভূতি হলো। আগে তো কখনোই নেহার প্রতি করা অন্যায়গুলোর জন্য তার অনুশোচনা হয় নি। বরং তার মনে হয়েছিল, নেহার সাথে সেটাই হয়েছে যা সে ডিজার্ভ করে। কিন্তু আজ কেন জানি তেমনটা হচ্ছে না। বরং আজ নেহার জন্য বুক কাপছে আহিরের। একটু করে অনুশোচনা কি জমছে তার মনে?

আচমকা একজন ডাক্তার এগিয়ে এসে নেহার কক্ষে প্রবেশ কর‍তে নিলো। আহির ডাক্তারকে থামিয়ে দিলো৷ অতঃপর তাকে জিজ্ঞেস করল,
“নেহা চৌধুরী..ওনার কি অবস্থা এখন?”
“অবস্থা ভালো না, ওনার শ্বাসনালীর অবস্থা ভীষণ বাজে। আমাদের পক্ষে যতটুকু করা সম্ভব আমরা করছি। এখন দেখা যাক, ওনাকে সুস্থ করতে পারি নাকি৷ সবটাই সৃষ্টিকর্তার হাতে।”
আহির আচমকা হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়। নিজের ফোন বের করে কাউকে একটা ফোন করে। অতঃপর বলে,
“আমি একজন ভালো চিকিৎসকের ব্যবস্থা করছি৷ যত টাকা লাগে আমি দেব। তবুও যেন ওনার কিছু না হয়। আপনারা নিজের সর্বোচ্চ এফোর্ট দিয়ে ওনাকে বাঁচান।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বলেই আহির ঘুমন্ত নেহার দিকে একপলক তাকিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ায়। একটু সামনে এগোতেই সে আরাভের কোলে ক্রন্দনরত নিয়াকে দেখতে পায়। এই মাসুম বাচ্চাটাকেই তো আজ থেকে ৫ বছর আগে নেহার সাথে রাস্তায় ফেলে দিয়েছিল সে। বাচ্চাটার কি দোষ ছিল?
আহিরের মনে ধীরে ধীরে যেন অনুশোচনার বীজ দানা বাধছে। নিজের প্রতিশোধের আগুনে যতটা বেপরোয়া হয়েছিল সে এবার হয়তো ঠিক ততটাই দগ্ধ হবার পালা। আহির আর বেশি সময় দাঁড়ালো না। তার খুব ইচ্ছা করছিল ছোট্ট নিয়ার কাছে গিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেবার। কিন্তু সেই অধিকার যে সে অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছে। তাই দীর্ঘ শ্বাসকে সঙ্গে নিয়ে আহির সামনে এগোতে লাগল।
একটু দূরে যেতেই নাতাশা এসে আহিরের দুই বাহু আগলে ধরল। আহির এতে খানিক বিরক্ত হলো বটে। তবে বেশি কিছু বলল না। শুধু নিজের হাতটা নীরবে সরিয়ে নিলো। নাতাশা আহিরকে বলল,

“তুই এই অবস্থায় একা একা উঠে আসতে গেলি কেন আহির? আমি তো ছিলাম তোকে আনার জন্য।”
আহির বললো,
“আমি এতটাই দূর্বল হয়ে পড়ি নি যে আমাকে সামলানোর জন্য তোর সাহায্য লাগবে।”
নাতাশা আহিরের সামনে কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলো। মনে মনে বলল,
“যত জেদ দেখানোর এখনই দেখিয়ে নে আহির। একবার শুধু বিয়েটা হয়ে যেতে দে। তারপর দেখ, তোকে কিভাবে আমি নিজের ইশারায় নাচাই।”

টানা ২৪ ঘন্টা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে বিশেষ চিকিৎসকের চিকিৎসায় নেহা এখন অনেকটাই ঝুঁকিমুক্ত। ডাক্তার সাহেব এগিয়ে এসে আরাভকে বলল,
“পেশেন্টের অবস্থা এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। আশা করি, খুব শীঘ্রই উনি আবার সম্পূর্ণ সুস্থ হবেন।”
আরাভ ভীষণ খুশি হয়ে ডাক্তারকে ধন্যবাদ দেয়। বিপাসা চৌধুরী বলেন,
“যাক, আল্লাহ এই যাত্রায় আমাদের বাঁচিয়েছেন। বাচ্চা মেয়েটাকে অন্তত মাতৃহারা করেন নি।”
ডাক্তার তাদের কিছু ওষুধের প্রেসকিপশন আর কিছু পরামর্শ দিয়ে এগিয়ে আসেন। একটু দূর আসার পরেই ডাক্তারের ফোন বেজে ওঠে। তিনি ফোনটা রিসিভ করেন। বিপরীত দিক থেকে আহির উদ্বিগ্ন স্বরে বলে,
“নেহা চৌধুরী এখন সুস্থ হয়ে গেছেন তো? ওনার আর কোন ঝুঁকি নেই তো?”
“জ্বি, সবটাই আপনার জন্য। আপনি যদি এভাবে একজন সুদক্ষ চিকিৎসক ম্যানেজ না কর‍তেন আর ওনার চিকিৎসার জন্য এত টাকা…”

ডাক্তার নিজের কথা শেষ করার আগেই আহির বলে,
“এসব কথা যেন গোপন থাকে। এটা আমার অনুরোধ।”
“আচ্ছা।”
আহির ফোনটা রেখে দেয়। নেহা সুস্থ হচ্ছে এটা শুনে সে কিছুটা স্বাভাবিক হয়। তার মনের বোঝাটা কিছুটা কমে। এমন সময় আহিরা এসে আহিরের পাশে দাঁড়ায়। আহির আহিরার দিকে তাকিয়ে বলে,
“প্রিন্সেস তুমি..?”
আহিরা আহিরের পাশেই সোফায় বসে বলে,
“তুমি তো এখন আমায় একদম ভুলে গেছ পাপা।”
“পাপা কি তার প্রিন্সেসকে ভুলতে পারে?”
“তাহলে আমাকে এখন একটা গল্প শোনাও..আমি একটা গল্প শুনতে চাই।”
আহির তখন আহিরার পাশে বসে বলতে শুরু করে,

“অনেক বছর আগের কথা, এক দেশে ছিল এক রাজকন্যা। সে ছিল রাজার অনেক আদরের, তার জীবন ছিল অনেক আনন্দের। তারপর হঠাৎ একদিন এক রাক্ষস এলো তার জীবনে। সেই রাক্ষস রাজকন্যাকে তুলে নিয়ে গেলো রাজপ্রাসাদ থেকে। তুলে নিয়ে গিয়ে তার উপর অনেক অত্যাচার করল৷ এরপর রাজকন্যার যখন ফুলের মতো টুকটুকে দুটো বাচ্চা হলো তখন সে একটা বাচ্চাকে নিজের কাছে রেখে আরেকটা বাচ্চাকে রাজকন্যার সাথে রাস্তায় ফেলে এলো। রাজকন্যা অনেক কষ্টে তার বাচ্চাকে মানুষ করল। সবাই তাকে অনেক অপমান করল, অনেক কষ্ট দিল। তবুও সে দমে গেলো না।”
আহিরা সরল মনে বলল,

“আর রাজকন্যার আরেক বাচ্চার কি হলো?”
“সেই বাচ্চাটাকে রাক্ষস নিজের কাছে রেখে বড় করল।”
আহিরার মনটা হঠাৎ করে ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। সে বলল,
“রাক্ষস এটা ঠিক করে নি, তার উচিৎ ছিল বাচ্চাটাকে তার মার কাছে পাঠানো। মাকে ছাড়া একটা বাচ্চা কখনো ভালো থাকে না। যেমন আমি ভালো নেই।”
আহিরের বুকে চাপা ক্ষতটা যেন আরো বাড়ে। অনুশোচনার আগুনে এবার ভালোই দগ্ধ হতে থাকে সে। অনেক কষ্টে বলে,

“তোমার কি মনে হয় প্রিন্সেস? রাজকন্যার কি উচিৎ কখনো সেই রাক্ষসকে ক্ষমা করা?”
আহিরা বলে,
“মোটেই না। ঐ মনস্টার ক্ষমার অযোগ্য। রাজকন্যার উচিৎ তাকে তার পাপের শাস্তি দিয়ে তার বাচ্চাকে নিজের কাছে নিয়ে যাওয়া। তাহলে সবাই ভালো থাকবে।”
আহির আচমকা আহিরাকে জড়িয়ে ধরে। সে নিজের মনে বলে,

“হয়তো আমি ভুল করেছি কিন্তু তার পেছনে কারণ ছিল৷ এখন নিজের অতীতের জন্য যতোই আফসোস করি না কেন, নিজের মেয়েকে আমি হারাতে পারবো না। আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন আমার আহিরা। সত্যটা জানতে পারলে ও কখনো আমায় ক্ষমা করবে না। এমনিতেই ওর হৃদয়ে আমার জন্য তেমন অনুভূতি নেই তার উপর যদি সব জানে তাহলে..নাহ, এটা আমি হতে দেব না। ভাগ্য কখনো আমায় সুখী হতে দেয়নি। এবার আমি আমার মেয়েকে নিজের থেকে দূরে যেতে দেব না। তার জন্য যা করা দরকার তাই করবো। যদি আরো অন্যায় করতে হয় তো করব। আজীবন নেহার থেকে ওর মেয়ের পরিচয় লুকিয়ে রাখব আমি। আহিরা শুধু আমার মেয়ে ছিল আর আমার মেয়েই থাকবে।”

নেহা আধো আধো চোখ মেলে তাকায়। নিজের চোখ খুলতেই সে আরাভ ও নিয়ার কান্নারত মুখশ্রী দেখতে পায়। অক্সিজেন মাস্কটা সরিয়ে আলতো স্বরে বলে,
“তোমরা চিন্তা করো না, আমি একদম ঠিক হয়ে গেছি।”
নিয়া নেহার কপালে চুমু খেয়ে বলে,

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৪১

“আম্মু তুমি ঠিক হয়ে গেছ..আমি না অনেক ভয় পেয়ে গেছিলাম।”
আরাভ বলে,
“এবার তোদের আমাকে আরো বেশি করে আগলে রাখতে হবে।”

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৪৩