উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৪৩

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৪৩
দিশা মনি

নেহা এখন সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছে। আরাভ বর্তমানে নেহার খেয়াল রাখছে। নিয়াও নিজের মায়ের পাশে বসে থাকছে সবসময়। তার মনের মাঝে একটা ভয় কাজ করে, নিজের মাকে ঐ অবস্থায় দেখার পর থেকেই। নিয়া নেহাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলে,
“তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না তো আম্মু? তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না।”
নেহা নিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“আম্মু তার নেহাকে ছেড়ে কোথাও যাব? আমি আমার মেয়েকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারি?”
মায়ের কথায় কিছুটা স্বস্তি পায় নিয়া। এরমধ্যে আরাভ হঠাৎ করে তাদের রুমে এসে বলে,

“নেহা, তোকে একটা ভালো খবর দেয়ার আছে।”
নেহা আরাভকে জিজ্ঞেস করে,
“কি ভালো খবর?”
আরাভ নিজের আনন্দ প্রকাশ করে বলে,
“আসলে..আমি তো ঢাকা শহরে গিয়ে অনেক চাকরি খুঁজেছি কিন্তু এতে বিশেষ কিছু লাভ হয় নি। আমার বয়স হয়ে যাওয়ায় আর তেমন কোন অভিজ্ঞতা না থাকায় ভালো কোন চাকরি পাই নি। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, নিজে যদি ছোটো-খাটো একটা কিছু করা যায়। তো আমার এক বন্ধু আছে, ও ডেকোরেশনের কাজ করে একটা বড় কমিউনিটি সেন্টারে। ওর সাথে আমি যোগাযোগ করেছিলাম। তুই তো জানিস, আগে থেকে কোথাও কোন অনুষ্ঠান হলে সেসব পরিচালনা করার আমার অভিজ্ঞতা আছে। তো আমার সেই বন্ধু আমাকে সেখানে ম্যানেজিং এর কাজ দিয়েছে। সামনেই একটা বড় এনগেজমেন্ট সেরেমনির দায়িত্ব পড়েছে আমার কাঁধে। কাজটা ভালো ভাবে করতে পারলে একটা বড় এমাউন্টের পেমেন্ট পাবো।”
নেহা খুশি হয়ে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“এটা তো অনেক ভালো খবর।”
নিয়া বলে,
“মামা, ওখানে কি অনেক বড় অনুষ্ঠান হবে? তাহলে তো অনেক মানুষ আসবে আর অনেক মজাও হবে। আমিও ওখানে যেতে চাই।”
নেহাকে নিয়াকে বাধা দিয়ে বলে,
“তুমি ওখানে গিয়ে কি করবে? তোমার মামা তো ওখানে নিজের কাজে যাচ্ছে। তুমি গিয়ে শুধু শুধু ওনাকে বিরক্ত করবে।”
আরাভ নেহার কথায় প্রতিবাদ করে বলে,
“এভাবে বলছিস কেন ওকে? আমার নিয়ামনিকে ছাড়া কি আমি যেতে পারি? আর শুধু নিয়া কেন তুইও যাবি আমার সাথে।”
নেহা আমতাআমতা করে বলে,

“আমি? আমি শুধুশুধু ওখানে গিয়ে কি করবো।”
“আমি কোন কথা শুনব না। তুই এমনিতেই এত বড় একটা অসুস্থতার মধ্যে দিয়ে গেছিস, এখন আমি চাই তুই একটু স্বাভাবিক জীবন কাটা। ওখানে গেলে তোর ভালো লাগবে।”
নেহা আর আপত্তি করতে পারে না। নিয়াও খুব খুশি হয়। আরাভ নেহার দিকে তাকিয়ে বলে,
“তোকে আর তোর মেয়েকে একটা স্বাভাবিক জীবন আমায় দিতেই হবে। সেটা যেকোন ভাবেই হোক।”
এরমধ্যে হঠাৎ রিনা সেখানে এসে বলে,
“আরাভ ভাই, আমাকেও নিন না আপনাদের সাথে। আমিও যাই।”
আরাভ ভ্রু কুঁচকে বলে,
“তুমি ওখানে গিয়ে কি করবে?”

“কেন? আপনার কাজিন ও তার মেয়ে যদি যেতে পারে তাহলে আমি কেন পারবো না?”
আরাভ আর কিছু বলতে যাবে এমন সময় বিপাসা চৌধুরী এসে বলেন,
“মেয়েটা যখন যেতে চাইছে তখন ওকেও নিয়ে যা। হাতেহাতে তোকে সাহায্য করে দিতে পারবে।”
আরাভ নিজের মায়ের কথা আর ফেলতে পারে না। অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজি হয়ে যায়। এদিকে রিনা বিজয়ী হাসি হেসে বলে,
“তোমাকে আর ঐ নেহাকে আমি কিছুতেই একান্তে সময় কাটাতে দেব না। এই পাঁচ বছর ধরে তোমাকে পাওয়ার জন্য আমি কতই না সাধনা করেছি। কত পাত্রপক্ষকে ফিরিয়ে দিয়েছি। বিনিময়ে তোমাকে যদি নিজের করে না পাই তাহলে আমার জীবনটাই বৃথা। তাই এবার আমাকে নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করতেই হবে।”

নাতাশা একটা পার্লারে এসেছে নিজেকে আরো সুন্দরী ও আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য। সাজগোছ শেষে বারবার নিজেকে আয়নায় দেখছে সে। নাতাশার মা নূর বেগম নাতাশার দিকে বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। নাতাশা নিজের মায়ের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“আমাকে কেমন লাগছে আম্মু? আজ এনগেজমেন্ট সেরেমনিতে সবার দৃষ্টি আমার দিকেই থাকবে তো?”
নূর বেগম দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন,
“সবার দৃষ্টি থেকে কি লাভ? যার জন্য তুই এত কষ্ট করে সাজছিস সে তো তোর দিকে ফিরেও তাকাবে না।”
“আম্মু! এসব বাজে কথা বলো না।”
“আমি যে ভুল কিছু বলছি না সেটা তুইও জানিস।”
“বাদ দাও! বিয়েটা হয়ে যাক। তারপর আহিরকে আমি হাতের মুঠোয় নিয়ে নেব।”
“কিন্তু আহিরের সামনে যদি সব সত্য চলে আসে কখনো? তাহলে কি হবে?”
“কিভাবে সব সত্য ওর সামনে আসবে?”
“তুই কি ভুলে যাচ্ছিস ঐ মেয়েটার কথা…!”
নাতাশা হালকা ঢোক গিলে বলে,

“অতীতের কথা বাদ দাও৷ ঐ মেয়ে এখন অনেক দূরে। ও আর কখনো বাংলাদেশে ফিরবে না।”
“অতীতকে চাইলেই বাদ দেয়া যায় না, নাতাশা। বিশেষ করে সেই অতীত যদি বর্তমানে প্রভাব ফেলার ক্ষমতা রাখে। ঐ মেয়েকে তো তুই সেই সময় টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিলি। তবুও ও কিন্তু তোর সব পাপের সাক্ষী। মৃদুলের মৃত্যু থেকে কিভাবে তুই নেহার বিরুদ্ধে আহিরকে উস্কে দিয়েছিস সবটাই জানে সে। ও যদি কখনো ফিরে আসে তাহলে..”
“তাহলে ওকেও আমি নিজের পথ থেকে সরিয়ে দেব।”
নাতাশার চোখে আগুন জ্বলে ওঠে। পরক্ষণে সে আবার মৃদু হেসে বলে,
“আমার পথের কাঁটা ওপড়াতে যে আমি কতোটা সিদ্ধহস্ত সেটা তুমি খুব ভালো করেই জানো আম্মু। তাই এখন এসব বাজে বকা বন্ধ করো আর চলো আমার সাথে। এনগেজমেন্টের সময় হয়ে যাচ্ছে।”

আরাভ সকাল থেকে কর্মব্যস্ত সময় পার করছে। কমিউনিটি সেন্টারে আজ গাজীপুর শহরের অন্যতম এক বিজনেস টাইকুনের এনগেজমেন্টের আয়োজন চলছে। সেখানেই মনযোগ দিয়ে কাজ করে চলেছে আরাভ। রিনা মাঝেমধ্যে তাকে হাতেনাতে সাহায্য করছে। নেহাও তাকে বারকয়েক সাহায্য করতে চেয়েছিল তবে তার অসুস্থতার জন্য আরাভ তাকে কোন কাজ করতে দেয় নি। অগত্যা নেহা ও নিয়া চুপচাপ বসে আছে। রিনা আরাভের দিকে একটা ফুলের তোড়া বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
“আপনার কাজিন আর তার মেয়ে কি এখানে বসে বসে খেতে এসেছে? একটুও কি বিবেক নেই ওদের? আপনি একা একা এত কাজ করছেন আর ওরা..”

রিনা নিজের কথা শেষ করতে পারে না। তার আগেই আরাভ চেচিয়ে বলে,
“তোমাকে এসব বাজে কথা বলার জন্য নিয়ে আসিনি আমি। তোমাকেও কিছু করতে বলি নি আমি। আমার কাজ আমি করে নেব। তোমার যদি ওদের দেখে হিংসা হয় তাহলে নিজেও বসে বসে খাও। নাও লিভ।”
বলেই আরাভ ফুলের তোড়াটা কেড়ে নিয়ে নিজের কাজে মন দেয়। রিনা অপমানিত বোধ করে দূরে গিয়ে চোখের জল মুছতে থাকে।
এদিকে নিয়া বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হচ্ছিল। তাই সিদ্ধান্ত নিলো চারপাশটা একটু ঘুরে দেখবে। তাই সে নেহাকে বলল,

“আম্মু, আমি একটু চারপাশটা ঘুরে দেখব?”
নেহা বলে,
“আচ্ছা দেখো, তবে বেশি দূরে যেও না।”
মায়ের অনুমতি পেয়ে নিয়া খুশিতে আপ্লুত হয়ে চারপাশটা ঘুরে দেখতে থাকে। এভাবে আনমনে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ করে দৌড়ে আসতে থাকা একটা মেয়ের সাথে ধাক্কা খেয়ে সে পড়ে যায়। দুজনেই ব্যথা পায়। আহিরা দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

“এই মেয়ে দেখে চলতে পারো না।”
নিয়াও উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“আমি তো দেখেই চলছিলাম৷ তুমিই দৌড়ে এসে..”
নিয়া আর কিছু বলবে এমন সময় আহিরা তাকে দেখে অবাক হয়ে বলে,
“তুমি এখানে..মানে আন্টিও..”
তখনই আহির সেখানে উপস্থিত হয়ে বলে,
“কি হয়েছে এখানে?”

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৪২

নিয়াকে দেখে আহির থেমে যায়। ততক্ষণে নেহাও নিয়াকে দেখতে এদিকে আসে। নেহা ও আহির আবারো মুখোমুখি। নেহার চোখে ঘৃণা আর আহিরের চোখে কিছুটা অপরাধবোধ। নিয়া ও আহিরাও অবাক চোখে সবটা পর্যবেক্ষণ করে। ভাগ্য এই চারজনকে আবারো আজ এক যায়গায় এনে দাঁড় করালো!

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৪৪