উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৪৫

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৪৫
দিশা মনি

আহির চলে যেতেই নেহার দৃষ্টি গেল আহিরার দিকে। আহিরা এককোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল৷ আহিরের পেছন পেছন নাতাশা, মুমিনুল পাটোয়ারী সবাই চলে গেছিল। কিন্তু আহিরা ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল৷ নেহা সুযোগ বুঝে আহিরার কাছে গিয়ে তার হাতটা আলতো করে ধরে বলল,
“তুমি ঠিক আছ তো?”
আহিরা হালকা হেসে বলে,
“আমি একদম ঠিক আছি। আমি ভীষণ খু্শি যে, পাপার সাথে নাতাশা আন্টির এনগেজমেন্ট হয় নি।”
আহিরার কথা শুনে নেহা আরো বেশি অবাক হয়। সে জিজ্ঞেস করে,
“নাতাশা আন্টি মানে? নাতাশা তোমার মা হন না? ওনাকে তুমি আন্টি কেন বলছ?”
আহিরা বলে,

“না, নাতাশা আন্টি কেন আমার মাম্মা হতে যাবে?”
“তাহলে তোমার মাম্মা কে?”
আহিরা এই প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে না পেরে চুপচাপ চেয়ে থাকে নেহার দিকে। নেহা এতে যা বোঝার বুঝে যায়। হালকা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
“তাহলে তোমার মা অন্য কেউ? তুমি তার ব্যাপারে কিছু জানো না?”
আহিরা দুদিকে মাথা নাড়ায়। এতে যেন নেহার মনের সন্দেহ আরো পাকাপোক্ত হয়৷ সে মনে মনে ভাবে,
“তাহলে কি এমন হতে পারে যে আহিরাই আমার সেই হারিয়ে যাওয়া যমজ মেয়ে। কিন্তু এমনটাই যদি হয়ে থাকে তাহলে আহির ওকে নিজের কাছে রেখেছে কেন? কি উদ্দ্যেশ্য ওনার? নাহ, আমাকে সব জানতেই হবে।”
নেহা এবার আহিরাকে জড়িয়ে ধরে আলতো করে। আহিরাকে নিজের বুকের মাঝে রেখে তার মাতৃহৃদয় অনেকটাই নিশ্চিন্ত হয়ে যায় যে এটাই তার সন্তান৷ কিন্তু এটা যে তাকে প্রমাণ করতে হবে। নাহলে সে কিভাবে আহিরের থেকে নিজের মেয়েকে নিজের কাছে ফেরাবে?
নেহা কিছুটা ভেবে আহিরাকে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“তুমি আমার সাথে একটু ঘুরতে যাবে আহিরা?”
আহিরা নেহার মুখ থেকে এমন কথা শুনে অবাক হয়। তবে সাথে খুশিও হয়। কারণ নেহাকে সে অনেক পছন্দ করে। আহিরা বলে,
“আচ্ছা, আন্টি। তুমি যেখানে নিয়ে যাবে আমি সেখানেই যাব।”
নেহা আহিরার হাত শক্ত করে ধরে। এমন সময় নিয়াও সেখানে চলে আসে। নিয়া তার মায়ের পাশে আহিরাকে দেখে অবাক হয়। নেহা নিয়ার উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“তোমার আরাভ মামাকে ডেকে আনো।”
নিয়া তাই করে। আরাভ একটু দূরেই ছিল। নিয়া তাকে নিয়ে আসে। নিয়া আরাভকে নিয়ে আসতেই নেহা আরাভের উদ্দ্যেশ্যে বলে,

“আরাভ ভাই, তোমায় আমার কিছু সাহায্য করতে হবে।”
“কি সাহায্য?”
“আমি আপাতত কিছু সময়ের জন্য একটু বাইরে যাচ্ছি। তুমি একটু নিয়াকে সামলে রেখো।”
“কোথায় যাচ্ছিস তুই?”
“পরে তোমাকে সব বলব। আর হ্যাঁ, পারলে একটু সিসিটিভি ফুটেজটাও ডিলিট করে দিও আর তুমি বাড়িতে চলে যাও।”

“তোর কথা আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”
“আপাতত তোমায় আমি কিছু বুঝাতে পারব না। তুমি শুধু আমার কথা মতো কাজ করো। আমি পরে তোমাকে সবকিছু বলব। অনেক সত্যের উপর থেকে পর্দা ওঠা বাকি আছে এখনো।”
আরাভ আর কিছু বলার সুযোগ পায় না। নেহা আহিরাকে নিয়ে চলে যায়৷ আরাভ অবাক হয়ে ভাবে,
“এই বাচ্চাটা কে? আর নেহা ওকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছে?”
নিয়া বলে,
“ঐ মেয়েটা তো আমার সাথে একই স্কুলে পড়ে। আজ এখানে যেই লোকটার এনগেজমেন্ট হচ্ছে তার মেয়ে ও।”
নিয়ার কথা শুনে আরাভ আরো অবাক হয়ে বলে,
“তাহলে তো নেহা এটা অনেক ঝুঁকির কাজ করছে, নাহ আমায় সিসিটিভি ফুটেজ টা জলদি মুছে দিতে হবে। নাহলে ও সমস্যায় পড়তে পারে।”

আহিরাকে নিয়ে একটি হাসপাতালে এসে উপস্থিত হয়েছে নেহা। উদ্দ্যেশ্য তার এবং আহিরার ডিএনএ স্যাম্পল কালেক্ট করা। আহিরা নেহাকে বলে,
“আন্টি তুমি তো আমায় বলেছিলে আমায় নিয়ে ঘুরতে যাবে। তাহলে এই হাসপাতালে কেন এসেছি আমরা?”
নেহা আহিরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“সবকিছু তুমি পরে জানতে পারবে। এখন আপাতত আমার কথা শুনে চলো। চলবে তো?”
আহিরা না করতে পারে না। একটু পরই তাদের ডাক পড়ে। আহিরা একদম বাধ্য মেয়ের মতো নেহার কথা শুনে। তাদের দুজনের ডিএনএ স্যাম্পল নিয়ে নেয়া হয়। আহিরা এতে ভীষণ অবাক হয়। সে বুঝতে পারছিল না এসব কি হচ্ছে। তবে নেহা আহিরাকে আশ্বাস দিয়ে বলে,
“চিন্তা করো না, এখন আমি যা বলছি তা মনযোগ দিয়ে এখান থেকে ফিরে তুমি তোমার বাবাকে বলবে…”
এরপর সে আহিরাকে কিছু একটা শিখিয়ে দেয়। আহিরা নেহার কথা মেনে নেয়। নেহা আহিরার কপালে হালকা চুমু খেয়ে বলে,

“গুড গার্ল।”
আহিরা বলে,
“জানো আন্টি, আমি কারো কথা শুনি না। নিজের যা ভালো মনে হয় তাই করি। তবে কেন জানি তোমার কথা খুব শুনতে মন চাচ্ছে। আমার খুব ইচ্ছা করছে গুড গার্ল হবার!”
“সবসময় এভাবেই গুড গার্ল হয়ে থাকবে।”
বলেই হাসে নেহা।

আহির কমিউনিটি সেন্টারে ফিরে এসে আহিরাকে না পেয়ে পুরো তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে দিয়েছে। তার রাগ আরো বেড়ে যায় যখন সে জানতে পারে কিছু কারণে সিসিটিভি ফুটেজও কাজ করছে না। আহির বর্তমানে কমিউনিটি সেন্টারের মালিকের সাথে রাগারাগি করে বলছে,
“আমার মেয়েকে যদি আমি খুঁজে না পাই তাহলে আপনাদের সবাইকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেব।”
তার চোখে ক্রোধ এবং অসহায়ত্ব প্রকাশিত হচ্ছিল। এমন সময় হঠাৎ করে আহিরা সেখানে এসে উপস্থিত হয়ে বলে,
“পাপা!”
আহিরাকে দেখেই আহির যেন নিজের হারানো প্রাণ ফিরে পায়। দ্রুত গিয়ে আহিরাকে কোলে তুলে নিয়ে অসংখ্য চুমু খেয়ে বলে,
“তুমি কোথায় চলে গেছিলে মাই প্রিন্সেস? জানো পাপা কত চিন্তা করছিল।”
আহিরা বলে,

“আমি তো পাশেই একটু ঘুরতে চলে গেছিলাম। তোমরা সবাই তো আমাকে একা ছেড়েই চলে গেছিলে ”
“আর কখনো এভাবে একা কোথাও যাবে না। আর পাপা সরি তোমায় এভাবে একা রেখে যাওয়ার জন্য। এখন চলো আমরা বাসায় ফিরবো।”
“নাতাশা আন্টির সাথে তুমি এনগেজমেন্ট করবে না তো?”
আহির থেমে যায়। এনগেজমেন্টটা আজ হয় নি৷ আহির নিজেই ক্যান্সেল করেছে। নাতাশা পুরো ভেঙে পড়েছে। মুমিনুল পাটোয়ারীও ভীষণ রাগারাগি করছে। তবে আহিরের মনে এখন অন্য চিন্তা কাজ করছে। তাই সে আহিরার উদ্দ্যেশ্যে বলে,

“না, নাতাশা আন্টিকে তো তোমার মা হিসেবে পছন্দ ছিল না। তাই এই এনগেজমেন্ট আমি করবো না।”
আহিরা খুশি হয়ে বলে,
“তাহলে আমার আসল মাম্মাকে আমার কাছে এনে দাও।”
আহিরের মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। সে মনে মনে ভাবে,
“তাকে তোমার কাছে ফেরাতে গেলে যে আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলব আহিরা। আর পরিস্থিতি এমন যে, আমাদের এক হওয়াও কখনো সম্ভব না। ভাগ্য তাহলে কি ইঙ্গিত করছে।”
নেহা দূর থেকে আহিরাকে দেখছিল। আর মনে মনে ভাবে,
“সত্যটা সামনে আসলে আমার মেয়েকে আমি নিজের কাছে ফেরাবোই। কেউ আমাকে আটকাতে পারবে না।”
এক সপ্তাহ পর,

নেহা হাসপাতালে এসে উপস্থিত হয়। তার হাতে ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট। যাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, আহিরা নেহারই মেয়ে। নেহার চোখে জল চলে আসে। সে নিজের চোখের জল মুছে বলে,

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৪৪

” এতগুলো দিন আমার মেয়ে আমার সামনে এসেছে অথচ আমি তাকে চিনতেই পারিনি৷ ঐ আহির তো আমার পুরো জীবনটা লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে উপরন্তু আমার এক মেয়েকেও আমার থেকে দূরে রেখেছে। ওকে আমি কখনোই ক্ষমা করব না। এবার আমি নিজের মেয়েকে নিজের কাছে ফেরাবোই। কেউ আমাকে আটকাতে পারবে না। এই দুনিয়ার কোন শক্তি আর আমাদের মা-মেয়েকে আলাদা রাখতে পারবে না।”
বলেই নেহা রওনা দেয়। এখন তার গন্তব্য আহিরের বাড়ি। সেখানে পৌঁছেই নেহা নিজের মেয়েকে নিজের করে নেবে।

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৪৬