উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৪৭

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৪৭
দিশা মনি

আহির বসে আছে নিজের কক্ষে। রাগে পুরো কাপছে সে। সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না, ঐ নেহার এত সাহস যে তাকে এসে হুমকি দিয়ে যায়। আহির নিজের দুহাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলে,
“আমার মেয়েকে কিছুতেই আমার থেকে আলাদা করতে পারবে না নেহা। সে ও যতোই চেষ্টা করুক না কেন।”
আহিরের ভাবনার মাঝেই পাশের রুম থেকে সে আহিরার আহাজারি শুনতে পেল। মেয়েটাকে সে পাশের রুমে বন্দি করে রেখেছে। আহিরা চিল্লিয়ে বলে চলেছে,

“আমাকে আমার মাম্মার কাছে যেতে দাও। আমি এখানে থাকব না।”
আহিরের গা জ্বালিয়ে দিচ্ছে আহিরার এই আর্তনাদ। তার জেদ আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে যেন আহিরার এই আচরণ। আহির ক্ষেপে গিয়ে উঠতে যাবে এমন সময় মুমিনুল পাটোয়ারী সেখানে চলে আসলেন। তিনি এসেই বললেন,
“মানে কি এসবের আহির? তুমি আহিরাকে এভাবে রুমে আটকে রেখেছ কেন?”
আহিরের মাথা গরম। তাই সে নিজেকে ঠিক রাখতে না পেরে মুমিনুল পাটোয়ারীর সামনেও চিৎকার করে বলল,
“তুমি শুধু আমার পাগলামিটাই দেখছ। আর আহিরা কিভাবে অযথা জেদ করছে সেটা দেখছ না?”
“আমি সবটাই দেখেছি। আমার যা বোঝার সেটাও আমি বুঝে নিয়েছি।”
“কি বুঝেছ তুমি,?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আমি এটাই বুঝেছি যে, তখন যেই মেয়েটি এসেছিল সে-ই আহিরা জন্মদাত্রী মা। আমি নিজেও একজন বাবা আহির। আমি আমার ছেলে মৃদুলকে হারিয়েছি। তাই সন্তান হারানোর বেদনা আমি বুঝি। ঐ মেয়ের চোখেও আমি সন্তানের জন্য আকুল বেদনা দেখেছি, আহিরাও শুধু শুধু এভাবে কান্না করছে না। এটাকে নারীর টান বলে।”
আহির বলে ওঠে,
“তুমি ভুল বুঝছ আব্বু।”
“আমি জানি না,কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল। এতদিন ধরে তো আমি তোমার বলা কথা গুলোকেই সত্য ভেবে এসেছিলাম। কিন্তু আজ কোথাও গিয়ে আমার মনে হচ্ছে, তুমি হয়তো আমায় সমস্ত সত্য জানাও নি। হয়তো বাস্তবতা ভিন্ন।”

আহির কিছু বলতে পারে না। মুমিনুল পাটোয়ারী দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন,
“তাহলে আমি যা ভেবেছি তাই ঠিক? তুমি আমাকে এতদিন মিথ্যা বলে গেছ। তাহলে সত্যটা কি?”
আহির নিশ্চুপ থাকে। মুমিনুল পাটোয়ারী আবারো বলেন,
“তুমি যদি আমাকে সত্যটা জানাতে না চাও তাহলে জানিও না। আমি জোর করব না তোমায়। তবে যদি আমাকে সত্যি নিজের বাবার স্থান দিয়ে থাকো, তাহলে তোমায় একটা পরামর্শ দেব, যদি সুযোগ থাকে তাহলে সবকিছু ঠিক করে নিও। এভাবে একটা মায়ের কাছ থেকে একটা মেয়েকে আলাদা করে রেখো না।”
আহির বলে ওঠে,
“ঐ মেয়েটা..ঐ নেহার জন্য তোমার ছেলে..আমার বন্ধু মৃদুল মারা গেছে। তবুও তুমি আমায় বলবে সব ঠিক করে নিতে?”

“আমার মৃদুলকে আমি অনেক আগেই চিরতরে হারিয়ে ফেলেছি। এখন আর কোন কিছুর বিনিময়েই ওকে ফিরে পাবো না। শুধু শুধু ঐ মেয়ের প্রতি আমি কেন ক্ষোভ রাখব? আল্লাহ নসিবে যা লিখে রেখেছিলেন তাই হয়েছে।”
আহির একটা বড় ধাক্কা খায়। সে তো এতদিন নেহার প্রতি এতদিন চাপা ক্ষোভ করেছে, আজমাইন চৌধুরীর তার মা’র প্রতি করা অন্যায় ও নেহাকে মৃদুলের মৃত্যুর জন্য দায়ী ভেবে। অথচ আজমাইন চৌধুরীর কৃতকর্মের দায়ের এক কানাও নেই নেহার উপর। অন্যদিকে, যেই মৃদুলের প্রতিশোধ সে নিতে চেয়েছে সেই মৃদুলের বাবাই নেহার প্রতি কোন ক্ষোভ রাখে নি। আহিরের অনুতপ্ত মন যেন আজ আবারো একটা বড় ধাক্কা খেলো। আগে থেকেই নিজের করা কাজগুলো তার মনে বারবার দোলাচল তৈরি করছিল। এখন আবারো সে নিজেকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড়ানো অবস্থায় আবিষ্কার করল। আহির নিজেকে প্রশ্ন করল,

“তাহলে কি আমি সত্যিই নেহার প্রতি অন্যায় করে ফেলেছি? আমি তো ভেবেছিলাম, আমি যা করছি তা আমার প্রতি হওয়া অন্যায়ের শোধ তোলার জন্য। কিন্তু একটা অন্যায়ের শোধ কি কখনো আরেকটা অন্যায় দিয়ে হয়? আমার জন্য নেহাকে এত সাফার করতে হয়েছে,,এসব কিছুর জন্য আমি দায়ী..”
মুমিনুল পাটোয়ারী বলে ওঠেন,

“তোমাদের মধ্যে কি হয়েছে আমি জানি না। তবে আমি এটুকু বলতে পারি, যদি তোমার অন্যায় সেরকম চরম না হয় তাহলে তুমি ঐ মেয়েটির কাছে ক্ষমা চেয়ে সবকিছু ঠিক করে নিতে পারো। কিন্তু যদি তোমার অন্যায় মাত্রা ছাড়িয়ে যায়..তাহলে আমি একজন বাবা হিসেবেও এটা বলব, তুমি ক্ষমা ডিজার্ভ করো না। এই পৃথিবীর বুকে কিছু কিছু অন্যায় এমন থাকে, যার কোন ক্ষমা হয় না। স্বয়ং আল্লাহও সেই অন্যায়কে ক্ষমা করেন না। সেখানে মানুষ হিসেবে আমাদের সেই স্পর্ধা নেই যে, এমন জঘন্য অন্যায়কে ক্ষমা করবো। এসব অন্যায় থেকে মুক্তি পাবার একটাই উপায়, আর তা হচ্ছে উপযুক্ত শাস্তি। আল্লাহ এমনি এমনি কিছু কিছু অন্যায়ের জন্য চরম শাস্তি ঠিক করে দেন নি। এসবের কারণ আছে। যদি একজন পবিত্র আত্মা হিসেবে আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে চাও, তাহলে নিজের কৃতকর্মের উপযুক্ত শাস্তি তোমায় ভোগ করতেই হবে।”

বলেই মুমিনুল পাটোয়ারী চলে যান। আহির সটান দাঁড়িয়ে থাকে। তার মনে এখন দোলাচল চলছিল। তবুও মাঝখানে তার অহংকারী মন জেগে উঠল। আহির বললো,
“আমি কোন অন্যায় করিনি….আমি যা করেছি তার কারণ ছিল। তবে নেহাও আর শাস্তি ডিজার্ভ করে না। আমাকে ওর সাথে কথা বলতে হবে। আমরা চাইলে আবার সবকিছু ঠিক করতে পারি।”

“আর কিছু ঠিক হবে না, আরাভ ভাই। আমার সাথে এতদিন যা যা অন্যায় হয়েছে তার জন্য আমি সিকিভাগও দায়ী নই। বিনা দোষে আমাকে নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে দিনের পর দিন। আমার জীবনে এত কষ্টের কারণ কি বলতে পারো? আমি তো কখনো কারো ক্ষতি করিনি..”
আরাভ বুঝতে পারে না সে নেহাকে কিভাবে সান্ত্বনা দেবে। একটু আগেই নেহা নিজের সাথে ঘটে যাওয়া সব অন্যায়, আহির, আহিরা-নিয়া সবার ব্যাপারে সব শুরু থেকে খুলে বলল আরাভকে। সব শুনে আরাভ যেন স্তব্ধ। আরাভ দেখল নেহা আজ কাঁদছে না। তার চোখ রক্তিম, এই রক্তিম চোখে নিজের প্রতি হওয়া অন্যায়ের বিচারের দাবি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। নেহা বলে উঠল,

“আমি এতদিন চুপ ছিলাম নিজের এক মেয়ে নিয়ার কথা ভেবে। কিন্তু আমার পক্ষে আর চুপ থাকা সম্ভব না। নিয়া যেমন আমার মেয়ে, আহিরাও ঠিক তেমনি আমার মেয়ে। আমি আহিরাকে আমার কাছে আনবোই। তার জন্য যদি আমায় আইনের সাহায্য নিতে হয়, তাই নেবো। আমি জানি, ঐ আহিরের অনেক ক্ষমতা। উনি চাইলে আইনকে কিনে নিতে পারেন। কিন্তু এক মায়ের কাছে সেই ক্ষমতা নস্যি। আমার ও আমার মেয়েদের সাথে হওয়া সব অন্যায়ের জবাব এবার ওনাকে দিতেই হবে।”
আরাভ বলে,

“আমি এই লড়াইয়ে তোর পাশে আছি নেহা।”
নেহা যেন একটু শক্তি পেল।
আজ অনেক বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। থানায় মামলা করে নিজের মেয়ের কাস্টডি পেতে। এতে হয়তো তার অতীতের সব কাহিনি বেরিয়ে আসবে। অনেক প্রমাণ তাকে দেখাতে হবে। তবে কোন কিছুর পরোয়া করে না নেহা।

নেহা আজ বাসা থেকে বেরিয়ে একটু দূরে এসে বাতাস খাচ্ছে। এই শীতল বাতাস তার মনোবলকে আরো দৃঢ় করছে। আচমকা নিজের পেছনে কারো উপস্থিতি অনুধাবন করল নেহা। পেছন ফিরে তাকালো। এক লম্বা পুরুষ অববয় দেখে অবাক হলো। বলল,
“কে আপনি? কি চাই আপনার?”
আহির গম্ভীর স্বরে বলল,

“আমি চাই সবকিছু ঠিক করতে। এসবের জন্য আইন আদালতের তো কোন প্রয়োজন নেই। তোমার নিজের মেয়েকে চাই, আহিরাও ওর মাম্মাকে চায়..তুমি যদি চাও আমরা নিজেদের মাঝে সবকিছু ঠিক করে..”
আহিরের কথা শেষ হবার আগেই নেহা তার গালে ঠাস করে থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। আহির তাজ্জব বনে যায়। নেহা বলে,

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৪৬

“কি ঠিক করার কথা বলছেন আপনি? আপনি কি আমার স্বামী, আপনার সাথে আমার মনোমালিন্য চলছে যে আমাদের মাঝে সব ঠিক হবে? আপনি ভুলে গেলেও আমি কখনো ভুলব না, আপনি একজন রে*পিস্ট, আপনি আমায় রে**প করেছেন। এর কোন ক্ষমা নেই। যদি সবকিছু ঠিক করতে হয় তাহলে আপনাকে নিজের উপযুক্ত শাস্তি তথা যাবজ্জীবন বা মৃত্যুদণ্ড পেতে হবে।”

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৪৮