অন্তঃদহন পর্ব ৩৮
DRM Shohag
সৌম্য’র চোখজোড়া কখন যে ঝাপসা হয়েছে সে বুঝতেই পারেনি। তার বোন এতো ক’ষ্ট চেপে রাখতো, অথচ তাকে কখনো মুখ ফুটে বলেনি আর নাতো কখনো বিন্দুমাত্র বুঝতে দিয়েছে। নিরব দৃষ্টিতে শুধু চেয়ে রইল সন্ধ্যার পানে।
সন্ধ্যাদের স্পেস দিতে ইরার হাত ধরে বাইরে বেরিয়ে গেল।
আসমানী নওয়ান চোখে পানি নিয়ে আবার-ও তৃপ্তির হাসি হাসলেন। এরপর তার রুমে চলে যায়। সাইফুদ্দীন নওয়ান তার পিছনের রুমে চলে যায়।
আকাশ ঢোক গিলছে বারবার। তার সন্ধ্যামালতী তাকে তার মতো করে, এক সেকেন্ড-ও ভুলে না গিয়ে, প্রতিটি দিন তাকে মনে করে শুধু তাকেই ভালোবেসেছে। তার ভালোবাসা, তার সন্ধ্যামালতী শুধু তাকে নিয়ে ভাবে। আকাশ এতো শান্তি কোথায় রাখবে? বাবা অশান্তির কারণ হয়ে যেমন এসেছে, তেমনি তার সন্ধ্যামালতী তার জীবনে অফুরান মায়া, ভালোবাসা শান্তি এনে ভরিয়ে দিয়েছে।
আকাশ সন্ধ্যাকে কোলে তুলে নিল। সন্ধ্যা কিছু বলল না। কান্নাভেজা চোখে আকাশের দিকে চেয়ে রইল। আকাশের দৃষ্টি সামনে। সে বড় বড় পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে ঘরে গিয়ে সন্ধ্যাকে বেডের উপর বসিয়ে দিয়ে দরজা আটকে দেয়। এরপর এগিয়ে এসে ডান পা ভাঁজ করে সন্ধ্যার সামনে বসে। সন্ধ্যা আকাশের দিকে চেয়ে আছে।
আকাশ হঠাৎ-ই সন্ধ্যাকে টেনে সর্বশক্তি দিয়ে সন্ধ্যাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয়। সন্ধ্যা চোখ বড় বড় করে তাকায়। মনে হচ্ছে সে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। আকাশ সন্ধ্যার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
– উফ! আমি পা’গ’ল হয়ে যাব। আমার কলিজা আমায় এতো ভালোবাসে কেন!
সন্ধ্যার দেহ জুড়ে অদ্ভুদ এক শিহরণ বয়ে যায়। আকাশের বলা প্রতিটি কথায় কি ভীষণ অনুভূতি লুকিয়ে থাকে! সন্ধ্যা ভেবে পায় না আকাশ কিভাবে এতো অনুভূতি নিয়ে প্রতিটি শব্দ উচ্চারণ করে!
আকাশ সন্ধ্যাকে ছেড়ে দু’হাতে সন্ধ্যার মুখ আগলে নেয়। সন্ধ্যার চোখে চোখ রেখে ভারী গলায় বলে,
– সোনা বউ তুমি আমার। তুমি এতো ভালো কেন বউ?
সন্ধ্যার নিরব দৃষ্টি আকাশের চোখে। আকাশের পকেটে ফোন বাজছে। আকাশ খেয়াল করল তবে ফোন পকেট থেকে বের করল না। সন্ধ্যার দিকে চেয়ে বলে,
– বউ একবার হাসো। আমার ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে। এক্ষুনি যেতে হবে।
সন্ধ্যা প্রশ্নাত্মক চোখে তাকায়। কোথায় যাবে আকাশ? আকাশ সন্ধ্যার নাকের ডগায় টুপ করে একটা চুমু খেয়ে বলে,
– সন্ধ্যার পর তোমাকে নিয়ে বের হব। এখন হাসো বউ।
সন্ধ্যা ঠোঁট টেনে একটু হাসে। আকাশ সাথে সাথে সন্ধ্যার গালে সৃষ্ট টোলটায় শব্দ করে একটা চুমু খায়। সন্ধ্যা কেঁপে ওঠে। মেয়েটি বুঝতে পারেনি। আকাশ সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে হাসলো। এরপর সন্ধ্যাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। দ্রুতপায়ে বাইরে যেতে যেতে বলে,
– সন্ধ্যায় রেডি হয়ে থাকবে সন্ধ্যামালতী, বুঝেছ?
সামনে শিমুর বোর্ড এক্সাম। এইকয়দিনে প্রায়ভেটসহ অনেক পড়া মিস হয়েছে। এজন্য আজ খুব ভোরে শিমুর মা শিমুকে নিয়ে তাদের বাড়ি চলে গিয়েছে। ইরার মায়ের বাড়ি থেকে অনেকেই ইরাকে দেখতে এসেছিল দু’দিন আগে। এরপরের দিন তারা সবাই চলে গিয়েছে, সাথে ইরার মা-ও চলে গিয়েছে। বাবার মৃত্যুর খবর শুনে ইরার মাঝে বিয়ের উৎফুল্লতা আর নেই, সে নিজেই এখন আর অনুষ্ঠান করতে চায়না।
ধরনীর বুকে সন্ধ্যা নেমেছে। সন্ধ্যা নামাজ পরে ঘরে বসেছিল। আসমানী নওয়ান সন্ধ্যাকে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে। যদিও সন্ধ্যা নিজেই পরতে পারে। আসমানী নওয়ান পরিয়ে দিলেও সে কিছু বলল না। খুব সুন্দর করে হিজাব-ও বেঁধে দিয়েছেন।
আকাশ তাকে বলে গিয়েছিল, সে সন্ধ্যাকে নিয়ে বেরবে, এজন্যই তিনি সন্ধ্যাকে রেডি করিয়ে দিলেন। সবশেষে আসমানী নওয়ান সন্ধ্যার থুতনিতে হাত রেখে মৃদুস্বরে বলেন,
– আল্লাহ আমার ছোট বোনরে তার কাছে নিয়ে নিবে বলেই হয়ত, তার আরেক পিস আমাদের কাছে পাঠিয়েছে। তোরে আমার জ্যোৎস্নার কার্বন-কপি লাগে।
সন্ধ্যা মৃদু হাসলো। সৌম্য ভাইয়াও সবসময় তাকে এই কথা বলে৷ কলিং বেল বেজে উঠলে আসমানী নওয়ান সন্ধ্যার হাত ধরে তার রুম থেকে বেরিয়ে আসেন। দরজা খুললে আকাশকে দেখে আসমানী নওয়ান মৃদু হেসে বলে,
– আমার মাইয়ারে সাবধানে রাখবা বুঝছ?
আকাশ সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,
– তোমার মেয়ে আমার কলিজা। তোমার থেকে আমার চিন্তা বেশি।
আসমানী নওয়ানের সামনে এভাবে বলায় সন্ধ্যা ল’জ্জা পায়। আসমানী নওয়ান হেসে সন্ধ্যাকে আকাশের দিকে এগিয়ে দেয়। আকাশ বা হাতে সন্ধ্যাকে টেনে তার সাথে জড়িয়ে নেয়। সন্ধ্যা আরও ল’জ্জা পায়। তার খালাম্মার সামনে আকাশের বলা বেফাঁস কথা, এরকম উদ্ভট কাজে ভীষণ বিব্রতবোধ করে। আকাশের থেকে সরে দাঁড়াতে চাইলেও আকাশ ছাড়লো না। বরং তার মায়ের দিকে চেয়ে বলে,
– মা দরজা লাগাও। আমার বউ তোমাকে দেখে ল’জ্জা পায়।
সন্ধ্যা চোখ বড় বড় করে তাকায়। ডান হাতে আকাশের পিঠে একটা খামচি দিল। আকাশ বুঝতে পেরে হাসলো। আসমানী নওয়ান মেকি মৃদু হেসে দরজা লাগায়৷
আকাশ এখানে আর দাঁড়ালো না। সন্ধ্যার হাত ধরে এগিয়ে গিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ে।
ঢাকা ইউনিভার্সিটির সামনে নেমেছে আকাশ সন্ধ্যাকে নিয়ে। বা হাতে সন্ধ্যার হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। একটু পর পর লোকজনের সাথে বা হাতে হাত মেলায়। কেউ কেউ আকাশকে সালাম দেয়, আকাশ সালামের উত্তর দেয়। সন্ধ্যা সেই তখন থেকে অবাক হয়ে চেয়ে আছে। আকাশকে মনে হচ্ছে ঢাকা শহরের সবাই চেনে, ভাবটা এমন। আকাশ একটু এগিয়ে গিয়ে একজনকে নিজেই সালাম দেয়। ভদ্রলোক সালামের উত্তর নিয়ে আকাশকে জড়িয়ে ধরল। আকাশ নিজেও হেসে তার সাথে কোলাকুলি করে। কিন্তু সন্ধ্যার হাত ছাড়লো না। সন্ধ্যা নিজে থেকে হাত ছাড়াতে চাইলে আকাশ আরও শ’ক্ত করে ধরে। সন্ধ্যা অবাক হয়। আকাশ লোকটির সাথে কোলাকুলি করছে, অথচ তার হাত ছাড়ছে না।
একটু পর আকাশ সোজা হয়ে দাঁড়ায়। সন্ধ্যার পাশে দাঁড়ায়। লোকটি সন্ধ্যাকে দেখে মৃদুহেসে বলে,
– তোমার ওয়াইফকে নিয়ে আসো একদিন।
আকাশ ছোট করে বলে,
– জ্বি চেষ্টা করব।
এরপর লোকটি চলে গেলে আকাশ সন্ধ্যার দিকে তাকায়। সন্ধ্যা আকাশের দিকে প্রশ্নাত্মক চোখে চেয়ে আছে। আকাশ সন্ধ্যার গালে হাত দিয়ে বলে,
– কি বউ?
সন্ধ্যা মাথা নিচু করে নেয়। আকাশ মৃদু হাসলো। সন্ধ্যার পাশ দিয়ে একটি ছেলে যাচ্ছিল। ছেলেটি যাওয়ার সময় সন্ধ্যার পেটের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়, ব্যাপারটি আকাশের চোখে পড়তেই চোখেমুখে ক্রোধ জমা হয়। বা হাতে সন্ধ্যার কোমর ধরে উঁচু করে ওপাশ থেকে এপাশে আনে। সন্ধ্যা ভ’য় পেয়ে যায়। হঠাৎ কি হলো বুঝল না।
ছেলেটি নিজের কাঙ্ক্ষিত কাজে বাঁধা পেয়ে ভীষণ বিরক্ত হয়ে পিছু ফিরে সন্ধ্যাকে একবার দেখল। এরপর আবার-ও সামনের দিকে এগিয়ে যায়।
আকাশ বা হাতে সন্ধ্যাকে জড়িয়ে রেখে ছেলেটির মাথা থেকে পা পর্যন্ত স্ক্যান করল। চোখমুখ শ’ক্ত। সন্ধ্যা নড়েচড়ে দাঁড়ালে আকাশ ঘাড় বাঁকিয়ে লম্বা শ্বাস টেনে নিজেকে সামলালো। এরপর সন্ধ্যাকে কোলে তুলে নেয়। সন্ধ্যা চোখ বড় বড় করে তাকায়। সন্ধ্যা নড়াচড়া করলে আকাশ মৃদুস্বরে বলে,
– এটা ঢাকা শহর। এখানে অপেনলি আরও অনেক কিছু হয়। আমি যাস্ট আমার বউকে কোলে নিয়েছি।
সন্ধ্যা ল’জ্জায় কুঁকড়ে যায়। আকাশ বড় বড় পা ফেলে তার গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। এরপর সন্ধ্যাকে ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে বসিয়ে দেয়। পকেট থেকে ফোন বের করে সন্ধ্যার কোলের উপর রাখে। দু’হাত সন্ধ্যার গালে রেখে মৃদুস্বরে বলে,
– পাঁচমিনিট অপেক্ষা কর বউ। আমি একটা কাজ করে আসছি।
সন্ধ্যা ডান হাতে আকাশের হাত টেনে ধরে। একটুখানি ভ’য় পায়। চোখেমুখে ভীতি। তাকে একা রেখে কোথায় যাবে? আকাশ তার হাতের উপর রাখা সন্ধ্যার হাত সামান্য উঁচু করে একটা চুমু খায়। এরপর বলে,
– গাড়ি লক করে যাবো। কিচ্ছু হবে না। আর্জেন্ট কাজ। বুঝেছ বউ?
সন্ধ্যা একটু শান্ত হলো। আকাশ তার ফোন অন করে, গ্যালারি থেকে একটি ভিডিও অন করে সন্ধ্যার হাতে ফোন ধরিয়ে দেয়।
ভিডিওতে সন্ধ্যা কান ধরে উঠবস করছে। ভিডিওটি দেখে সন্ধ্যার চোখমুখে বিস্ময় ভর করে। আকাশের সাথে বিয়ের পর একদিন সে আসমানী নওয়ানদের সাথে নাক ফুটা করতে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল। তখন কু’কু’রের ধাওয়া খেয়ে বেচারি আকাশের সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গিয়েছিল। এরপর আসমানী নওয়ানদের খুঁজে পায়নি। আকাশ তার সুযোগ নিয়ে কান ধরে উঠবস করিয়েছিল।
কথাগুলো ভেবে সন্ধ্যা আকাশের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকায়। আকাশ মিটিমিটি হাসছে। সন্ধ্যাকে এভাবে তাকাতে দেখে আকাশের হাসি দীর্ঘ হলো। মুখ এগিয়ে নিয়ে সন্ধ্যার বাম গালে একটা চুমু খেয়ে বলে,
– কান ধরে উঠাবসা করলে কিউট লাগে তোমাকে। আরেকদিন করাবো। রা’গ করে না বউ।
সন্ধ্যা রে’গে তাকায়। ডান হাত বাড়িয়ে আকাশের গলায় খামচি দিতে গেলে আকাশ ডান হাতে সন্ধ্যার হাত ধরে, হাতের উল্টোপিঠে একটা চুমু খায়। সন্ধ্যা শান্ত চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। আকাশ সন্ধ্যার দিকে চেয়ে একটু হেসে বলে,
– আপাতত এসব এনার্জি তুলে রাখো বউ। কাজের সময় এপ্লাই করতে হবে তো!
সন্ধ্যা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। আকাশ মিটিমিটি হাসলো। আর কিছু বলল না। সন্ধ্যার হাত ছেড়ে গাড়ির ড্যাশবোর্ডের উপর থেকে একটি কালো রুমাল নেয়। এরপর সন্ধ্যার দিকে চেয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– আসছি। একটু অপেক্ষা কর।
এরপর আকাশ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গাড়ির দরজা আটকে গাড়ি লক করে দেয়। তার গাড়ি একটি ফাঁকা জায়গায় দাঁড় করানো। এই জায়গার আশেপাশে তেমন মানুষ নেই। আকাশ তীক্ষ্ণ চোখে চারিপাশ পরোখ করল। চোখমুখ শ’ক্ত। ডান হাতে রুমালটি একবার ঝেড়ে মুখ বেঁধে নেয়। এরপর গাড়ির ডিকি খোলে। বা পা তুলে গাড়ির ডিকির ভিতর রাখে। এরপর ডান হাতে একটি মিডিয়াম সাইজের ছু’রি নিয়ে বা পায়ের প্যান্ট সামান্য উপরে তুলে জুতোর কোণায় ছু’রিটি ঢুকিয়ে নিল। এরপর প্যান্ট নামিয়ে গাড়ির ডিকির ভিতর থেকে পা নামিয়ে গাড়ির ডিকি লাগিয়ে দেয়। দু’হাতের কনুই পর্যন্ত গোটানো পাঞ্জাবির হাতা কনুই থেকে আরেকটু উপরে তুলল।
আকাশ সামনের দিকে দৃঢ় পায়ে এগিয়ে যায়। কিছুদূর এগিয়ে গেলে ফাঁকা জায়গা থেকে কিছুটা জনবহুল জায়গায় এসে দাঁড়ায়। চারিদিকে নজর বুলায়৷ তখনকার সেই ছেলেকে আর-ও দু’জনের সাথে হেসে হেসে কথা বলতে দেখে দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিল। জ্ব’ল’ন্ত চোখে তাকায়। কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ায়৷ ঘুরে গিয়ে ছেলেটির পিছন বরাবর দাঁড়ায়। চারপাশে আবার-ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ঘোরায়। ছেলে তিনটি রাস্তার সাইডে দাঁড়ানো। আকাশ ফুটপাতের উপর দাঁড়ানো। এগিয়ে গিয়ে একদম ছেলেটির পিছনে দাঁড়ায়। সবাই সবার মতো কাজে ব্যস্ত।
আকাশ হঠাৎ বা হাতে ছেলেটির মুখ চেপে এক সেকেন্ড-ও সময় না গিয়ে অন্ধকারে কোথাও যেন ঝাপ দিল। কেউ কিছুই বুঝল না। ব্যাপারটি একদম চোখের পলকে হয়েছে। সেই ছেলেটির সাথে আরও দু’জন তারা এখনো কথা বলায় ব্যস্ত। তাদের থেকে একটি পিছনে সেই ছেলেটি দাঁড়ানো ছিল। তাদের মনে হলো তাদের ফ্রেন্ড হুট করেই কোনো কাজে জায়গাটি প্রস্থান করেছে।
ছেলেটি অন্ধকারে উপর দিকে তাকালে দেখল দু’জোড়া শ’ক্ত তার দিকে চেয়ে আছে। মুখ দেখতে পায় না। আকাশ ছেলেটির মুখের উপর ডান পায়ের জুতো চেপে রেখেছে। একটু নিচু হয়ে বা পায়ের জুতোর কোণায় রাখা ছু’রি বের করল। এরপর ছেলেটির দিকে চেয়ে বাঁকা হাসলো। ডান পা আরেকটু শ’ক্ত করে ছেলেটির মুখে চেপে রেখে বা হাতের ছ’রি দ্বারা ছেলেটির পুরো হাত সমানে কেচায়।
ছেলেটি মুখ থেকে কোনো শব্দ বের করতে পারলো না। দু’চোখ বড় বড় হয়ে গিয়েছে। অ’স’হনীয় ব্য’থায় শব্দহীন কাতরায়।
আকাশ প্রায় মিনিট দুই ঝড়ের বে’গে ছেলেটির হাত কেচিয়ে ছু’রি খাড়া করে ধরে। ক্রোধান্বিত চোখে চেয়ে ছেলেটির হাতের কাঁধ থেকে একটু নিচে সর্বশক্তি দিয়ে একটি কো’প দেয়। ছেলেটির হাত একদম আলাদা হয়ে যায়। ছেলেটি এবার গলা কাটা মুরগির ন্যায় দাপায়।
আকাশ ছু’রিটি ছেলেটির কাঁধে গেড়ে দেয়। ক্রোধে কপালের র’গ ফুটে উঠেছে। আকাশ শ’ক্ত করে ফিসফিসিয়ে বলে,
– লাস্ট চান্স। পরেরবার সোজা গলা কা’ট’ব।
এরপর ছেলেটির মুখ থেকে পা সরিয়ে আকাশ সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ছেলেটি এতোক্ষণ ছটফটালেও এখন নেতিয়ে পড়েছে। শব্দ করে কিছু বলতে চাইলেও পারছে না। বোধয় অজ্ঞান হওয়ার পথে।
আকাশ র’ক্তমাখা ছু’রি আবার তার জুতোর কোণায় রাখে, এরপর প্যান্ট নামিয়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। দু’হাতের পাঞ্জাবির হাতা নামিয়ে দেয়। এরপর সামনে যেতে নিলে পায়ের কাছে ছেলেটির কা’টা হাত বাঁধলে বিরক্ত হয়ে ডান পায়ে একটি সট দেয়, ফলস্বরূপ হাতটি হালকা চিপা গলির ভিতর থেকে একদম মেইন রাস্তায় গিয়ে পড়ে।
আকাশ এক সেকেন্ড-ও সময় ব্যয় না করে দ্রুত অন্ধকার জায়গাটি থেকে বেরিয়ে আসে। কেউ খেয়াল-ই করল না। কিছুদূর গিয়ে মুখের বাঁধা রুমাল বা হাতে মুখ থেকে নামিয়ে দেয় আকাশ, যা গলায় এসে বেঁধে থাকলো।
ইতোমধ্যে পিছনে কা’টা হাত নিয়ে শোরোগোল শুরু হয়ে গিয়েছে। সকলে যেমন ভ’য় পাচ্ছে, তেমনি একটি ক্ষ’ত বিক্ষ’ত কা’টা হাত দেখে সবাই চিন্তিত হচ্ছে। কেউ বুঝতে পারছে না এটা কার হাত।
আকাশ খুব স্বাভাবিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। অনেকেই আকাশকে সালাম দেয়, আকাশ সালামের উত্তর দেয়। কিছুদূর হেঁটে তার গাড়ির কাছে এসে দাঁড়ায়। গাড়ির দরজা খুলতে গিয়েও থেমে গেল। পানির বোতল নিতে গেলে হাতে র’ক্তের ছিটেফোঁটা সন্ধ্যার চোখে পড়তে পারে। তাই গাড়ির দরজা খুলল না। সন্ধ্যা গাড়ির যে পাশে বসেছে, সেইপাশে এসে দাঁড়ায়। একটু ঝুঁকে মৃদুস্বরে ডাকে,
– সন্ধ্যামালতী?
সন্ধ্যা আকাশের ফোনে রিলস দেখছিল, আকাশের কণ্ঠ পেয়ে সাথে সাথে জানালার দিকে তাকায়৷ সন্ধ্যাকে সাথে সাথে এভাবে নিজের দিকে তাকাতে দেখে আকাশ একটু হাসলো। মৃদুস্বরে বলে,
– একটা পানির বোতল দাও।
সন্ধ্যা সামনে ড্যাশবোর্ডের উপর তাকিয়ে দেখল পানির বোতল নেই। এরপর আকাশের দিকে প্রশ্নাত্মক চোখে তাকালে আকাশ বলে,
– ড্রাইভিং সিটের প্যাক পকেটে পানির বোতল আছে, দাও।
আকাশের কথায় সন্ধ্যা এগিয়ে গিয়ে পিছনের সিট থেকে এক লিটারের একটি পানির বোতল জানালা দিয়ে বের করে দেয়। আকাশ বোতলটির মুখ খুলতে খুলতে দেখল সন্ধ্যা তার দিকে চেয়ে আছে। অতঃপর সন্ধ্যার দিকে চেয়ে মিটিমিটি হেসে বলে,
– ক্ষুধা লেগেছে তোমার? চুমু খাবে বউ?
সন্ধ্যা চোখ বড় বড় করে তাকায়। আকাশ ভ্রু নাচায়। সন্ধ্যা দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয়। আকাশ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গাড়ির পিছনদিকে যেতে যেতে বলে,
– এসে খাওয়াচ্ছি। আর একটু অপেক্ষা কর সন্ধ্যামালতী।
আকাশ গাড়ির পিছনে এসে দাঁড়ায়। গাড়ির ডিকির উপর পানির বোতল রেখে দু’হাতে পাঞ্জাবির হাতা কনুই পর্যন্ত গোটালো। পানির বোতল নিয়ে দু’হাত ধুয়ে নেয়। পাঞ্জাবির যেখানে যেখানে ছোট্ট ছোট্ট লাল র’ক্ত কণা ছিল, তা মুছে নিল। বা পায়ের প্যান্ট একটু উঁচু করে জুতোর কোণা থেকে ছু’রি বের করে।
গাড়ির ডিকি খুলে ছু’রিটি ভেতরে রাখে। তখন-ই পিছন থেকে সৌম্য গম্ভীর গলায় বলে,
– ওই ছেলের হাতের এই অবস্থা আপনি করেছেন, তাইনা?
সৌম্য’র গলা শুনে আকাশ অবাক হয়। ভ্রু কুঁচকে পিছু ফিরে তাকায়। সৌম্যকে দেখল, কিন্তু কিছু বলল না।
আকাশ আবার-ও ঘাড় ঘুরিয়ে ডিকির ভেতর থেকে একজোড়া সাদা জুতো নামালো মাটিতে। পায়ের কালো জুতো খুলে সাদা জুতোজোড়া পরে ডিকির ভেতর কালো জুতোজোড়া রেখে গাড়ির ডিকি লাগিয়ে দেয়।
এরপর আবার-ও হাতদু’টো ধুয়ে নেয়। উল্টো ঘুরে সৌম্য’র দিকে এগিয়ে এসে বলে,
– কি যেন বলছিলে?
সৌম্য তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আকাশের দিকে। আজ বিকালের দিকে তার একবার বায়ানের সাথে দেখা হয়েছিল। টুকটাক কথা বলার সময় আকাশের ব্যাপারে কেমন উদ্ভট কথা শুনেছে। যদিও বায়ান পরবর্তীতে তা এড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু সৌম্য’র ব্যাপারটা ভালো লাগলো না। আর এখানে এসে আকাশের হাতে ছু’রি টা সে দেখল। সবমিলিয়ে আকাশকে সৌম্য’র সুবিধার লাগছে না। আকাশ সৌম্য’র দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে পানি খায়। সৌম্য ভাবনা রেখে বলে,
– একদম মিথ্যে বলবেন না। কি করেন আপনি?
আকাশ কয়েক ঢোক পানি খেয়ে কৌতুক স্বরে বলে,
– করি তো খু’ন। তুমি হতে চাও?
সৌম্য আকাশের হেয়ালি কথায় বিরক্ত হলো। রে’গে বলে,
– আপনি ওইদিকে গিয়েছিলেন আমি দেখেছি। তাছাড়া বায়ান আমাকে অনেক কিছু বলে দিয়েছে।
আকাশ ভ্রু কুঁচকে বলে,
– কি বলে দিয়েছে?
সৌম্য উত্তর দেয়,
– আজকের নিউজে যে দু’জনের বডি টুকরো টুকরো করা হয়েছে, এর সাথে আপনার কানেকশন আছে।
আকাশ বিরক্ত হলো। এই বায়ানকে সাথে নিয়েছিল কোন দুঃখে? বে’য়া’দ’ব টাকে সামনে পাইলে আগে চারটা লাগাবে। আকাশ আশেপাশে তাকালো। জায়গাটি আগের চেয়েও নির্জন হয়েছে। অতঃপর সৌম্য’র দিকে একটু এগিয়ে এসে গম্ভীর গলায় বলে,
– শুধু কানেকশন নেই। ওগুলো আমি-ই করেছি। আমার পার্সোনাল কাজ মানুষকে দিয়ে করিয়ে নেয়াতে ইন্টারেস্ট পাইনা। বুঝলে?
সৌম্য বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। তার শরীর শিউরে উঠল। আজকের নিউজে ওই বডিদু’টো দেখে তার নিজেরই কেমন গুলিয়ে আসছিল। তার সন্দেহ হচ্ছিল, কিন্তু আকাশকে এতোটা-ও খারাপ মনে হয়নি। সৌম্য অবাক হয়ে বলে,
– আপনি কি পা’গ’ল?
আকাশ একটু পিছিয়ে দাঁড়ায়। হেসে বলে,
– তোমার বোনের।
সৌম্য’র চোখেমুখে এখনো বিস্ময়। অবাক হয়ে বলে,
– আপনি মানুষ খু’ন করেন? কোনো সুস্থ মানুষ এভাবে খু’ন করে না।
আকাশ বিরক্ত হয়ে বলে,
– তো আমাকে সুস্থ ভাবতে কে বলেছে?
সৌম্য তব্দা খেয়ে বলে,
– এ যাবৎ কতগুলো খু’ন করেছেন আপনি?
আকাশ হাতের বোতল ছুড়ে ফেলে সৌম্য’র দিকে চেয়ে ভাবলেশহীনভাবে বলে,
– গোনা হয়নি। কপালে এমন গোয়েন্দা শা’লা জুটবে জানলে অবশ্যই গুনে রাখতাম। সো স্যরি!
সৌম্য বাকরুদ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে। আকাশ ভ্রু কুঁচকে বলে,
– ইরার কাছে যাও। জায়গা ভালো না।
কথাটা বলে উল্টো ঘুরে গাড়ির দিকে যায়। ড্রাইভিং সিটে এসে বসলে দেখল সন্ধ্যা তার ফোনে ডুবে আছে। আকাশ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। এই বউটা তার ফোনে এতো মনোযোগ দিয়ে কি দেখছে? একটু এগিয়ে গিয়ে দেখল সন্ধ্যা গ্যালারিতে থাকা তার ছবিগুলো খুব মনোযোগ সহকারে জুম করে করে দেখছে। আকাশ মিটিমিটি হেসে বলে,
– ছেলেটা খুব সুন্দর, তাইনা সন্ধ্যামালতী?
আকাশের কণ্ঠ পেয়ে সন্ধ্যা ঝাঁকি দিয়ে ওঠে। থতমত খেয়ে তাকায় আকাশের দিকে। ভীষণ ল’জ্জা পায়। মাথা নিচু করে আকাশের ফোনের আলো অফ করে দেয় দ্রুত। আকাশ হেসে গাড়ি স্টার্ট দেয়।
সৌম্য ইরাকে নিয়ে বিকালে বেরিয়েছে। ইরার আবদার রাখতেই ঘুরতে বেরিয়েছিল।
ইরার সাথে তার এক ফ্রেন্ড এর দেখা হয়েছিল, তাই সে তার সাথে গল্পে মেতেছিল। সৌম্য এই মেয়েকে চিনলেও ইরা ছাড়া আর কারো সাথে তার তেমন ভালো সম্পর্ক নেই। ইরার সাথে বন্ধুত্বটা ইরার জন্যই হয়েছিল। ইরা সবসময় নিজে থেকেই তার দিকে কয়েকশো ধাপ এগিয়ে আসতো। কারণটা অবশ্যই ইরার ভালোবাসা ছিল। সৌম্য বুঝত। আর তারপর কি ভ’য়া’ন’ক কাজ করে ফেলেছিল অজান্তেই মেয়েটিকে ভালোবেসে।
সৌম্য আকাশের ব্যাপার নিয়ে ডিস্টার্ব। আকাশের কাছে খু’ন করাটা যেন পান্তাভাত। সৌম্য কিছুতেই হজম করতে পারছে না। আজকের নিউজে দেখানো লোকদু’টো যে রে’পি’স্ট। এটা নিউজের সাথেই বলেছে। কিন্তু আকাশ ওদের এভাবে মা’র’লো কেন?
এসব ভাবতে ভাবতে সৌম্য ইরার পাশে এসে দাঁড়ায়। ইরা সৌম্যকে দেখে তার ফ্রেন্ডকে বিদায় দিয়ে দেয়। এরপর দু’হাতে সৌম্য’র হাত ধরে হেসে বলে,
– জানিস, আয়েশার দু’টো বাচ্চা হয়ে গিয়েছে।
সৌম্য ছোট করে বলল,
– ওহ।
ইরা অবাক হলো না। সৌম্য তো এমনি। ইরা সৌম্য’র হাত ধরে ভার্সিটির গেইটের দিকে এগিয়ে যায়। হাঁটতে হাঁটতে তারা কার্জন হলের এখানে আসে। এর মাঝে ইরা কতশত কথা বলে ফেলেছে। সৌম্য শুধু হু, হা করেছে। ইরা আশেপাশে তাকালো। এতোগুলো মাস পর আসলেও আজও স্মৃতির পাতা জ্বলজ্বল করে। তার সৌম্য’র জন্য কত দুঃখ মিশে আছে এই জায়গায়, একমাত্র সেই জানে। ইরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সৌম্য’র হাত ধরে এদিক-ওদিক নাড়িয়ে বলে,
– সৌম্য এক কাজ করি চল। এইখানে সব মামার কাছে যত বাদাম আছে, সবার থেকে সবগুলো বাতাম কিনে এই কার্জন হলে যত স্টুডেন্ট আছে। ওদের সবাইকে দু’টো করে হলেও বাদাম দিই। তোর আর আমার এক হওয়া উপলক্ষ্যে। ভালো হবে না সৌম্য?
সৌম্য’কে চুপ দেখে ইরা বাচ্চাদের মতো জেদ ধরল,
– সবাইকে আমি দিব। সৌম্য রাজি হয়ে যা প্লিজ!
সৌম্য’র বাহু ঝাঁকিয়ে বলে,
– এ্যাই সৌম্য?
সৌম্য হঠাৎ-ই চেঁচিয়ে ওঠে,
– কি প্রবলেম তোর ইরা? এসব বাচ্চামি কেন করিস তুই? মে’জা’জ খারাপ হয়ে আছে এমনিতেই। তার মধ্যে তোর এসব বাচ্চামি না করলে চলে না?
ইরা বিস্ময় চোখে তাকায়। আশেপাশের অনেকে তাকিয়েছে সৌম্য আর ইরার দিকে। ইরার যেমন অপমানিত বোধ হলো, তেমনি ক’ষ্ট হলো। নাহ, একটু নয়, অনেক বেশি। ওই যে আগে যেমন সৌম্য’র অবহেলা তাকে ক’ষ্ট দিত। ইরা তার এই প্রিয় জায়গায় এসে কেঁদে বুক ভাসাতো নয়তো একা একাই কতশত অভিমান বিলিয়ে দিত তার এই প্রিয় জায়গা জুড়ে। আজ আবার-ও একই জায়গায় সৌম্য এরকম ব্যবহারে ইরার কি যে ক’ষ্ট হলো!
সৌম্য ইরার সাথে এভাবে কথা বলে নিজেই হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছে। আকাশের কথা, কাজ তাকে ভীষণ ডিস্টার্ব করছিল। ফলস্বরূপ হঠাৎ মাথা কাজ করছিল না। ইরাকে ভুলভাল বলে দিয়েছে। সৌম্য ঢোক গিলল। এখন ইরাকে কি বলবে সে?
ইরার চোখের কোণে পানি জমতে শুরু করেছে। ইরা মাথা নিচু করে নিল। তার কেন যেন অনেক কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিছুক্ষণের মাঝেই চোখ থেকে টুপ করে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। ঢোক গিলে বলে,
– স্যরি সৌম্য!
সৌম্য’র বুকে চিনচিন ব্য’থা করে উঠল। ইরার দিকে এগিয়ে এসে অপরাধীর ন্যায় বলতে নেয়,
– ইরাবতী আমি…….
ইরা মাথা উঁচু করে সৌম্য’র দিকে তাকায়। ভেজা চোখে চেয়ে মলিন হেসে বলে,
– আমি ২৬ বছরের মেয়ে হয়ে ১৬ বছরের মেয়ের মতো বাচ্চামি করে তোকে আবার-ও বিরক্ত করেছি। আর কখনো হবেনা।
কথাটা শুনে সৌম্য বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। তার মনে পড়ল, একবছর আগে ইরার বলা কথাটি।
– ২৫ বছরের মেয়ে হয়ে ১৫ বছরের মেয়ের মতো পা’গ’লা’মি করে তোকে অনেক বিরক্ত করেছি।
সৌম্য দ্রুত ইরার দু’হাত তার দু’হাতের মাঝে নিয়ে বিচলিত কণ্ঠে বলে,
– ইরাবতী এভাবে বলিস না। আমার ক’ষ্ট হয়। আমি ওভাবে বলতে চাইনি।
ইরা মাথা নিচু করে নেয়। ভাঙা গলায় বলে,
– আমার হয় না। বাড়ি যাবো সৌম্য।
সৌম্য অসহায় কণ্ঠে বলে,
– খালি পায়ে হাঁটবি বলেছিলি যে? আর বাদাম……
ইরা বলে ওঠে,
– আমার পা ব্য’থা করছে। বাড়ি যাবো।
সৌম্য ঢোক গিলল। ইরাবতী অভিমান করুক, সে ভাঙাবে। কিন্তু ইরাবতী যে আবার-ও তার জন্য ক’ষ্ট পাচ্ছে, এটা মানবে কি করে?
ইরা সৌম্য’র হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে উল্টো ঘুরে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। সৌম্য অসহায় চোখে তাকায়। ইরার পিছু পিছু দ্রুতপায়ে এগিয়ে গিয়ে পিছন থেকে ইরাকে জড়িয়ে ধরে।
সৌম্য এমন মানুষ, যে মানুষের সামনে নিজে থেকে ইরার হাতটা-ও ধরেনা। কিন্তু এখন তো ইরা ক’ষ্ট পাচ্ছে। তাই সব ভুলে বসেছে।
ইরা সৌম্য’র হাত ছাড়াতে চায় আর ভাঙা গলায় বলে,
– ছাড় আমায়। আমি বাড়ি যাব।
সৌম্য একটু ঝুঁকে ইরার কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে অসহায় কণ্ঠে বলে,
– আমার ইরাবতীর চোখের পানির কত ক্ষমতা, দেখ? ইতোমধ্যেই আমার বুক ব্য’থা শুরু হয়ে গিয়েছে।
ইরা নাক টানলো। সৌম্য বলে,
– স্যরি! রা’গ কর রাগিনী। ক’ষ্ট, কান্না এসব বিদায় দে।
ইরা অভিমানী কণ্ঠে বলে,
– পারবো না। তোর বুক ব্য’থা-ই বাড়াবো আমি।
সৌম্য মৃদুস্বরে বলে,
– আচ্ছা বাড়া। কিন্তু কাছে থেকে। দূরত্ব মানবো না।
আকাশ কিছুদূর গিয়ে একটি জনবহুল জায়গায় গাড়ি সাইড করে। সন্ধ্যাকে নিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। পিছনের সিট থেকে বেশ একটি বড় পলিথিন নেয়, যার মধ্যে অনেকগুলো রুটি-কলা। ডানহাতে পলিথিন টি নিয়ে বা হাতে সন্ধ্যার হাত ধরে ঢাকা ইউনিভার্সিটির মেইন গেইট দিয়ে ভেতর প্রবেশ করে। সন্ধ্যা আশেপাশে দেখছে। লেখা দেখে বুঝেছে এটা ঢাকা ইউনিভার্সিটি। আকাশ মৃদুস্বরে বলে,
– তোমার হাসবেন্ড, ভাই এই ইউনিভার্সিটিতে পড়েছে। চিন্তা কর না বউ,, তোমাকে-ও এই ইউনিভার্সিটিতে পড়াবো আমি।
সন্ধ্যা একটু হাসলো। আকাশ হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যার দিকে একটু চেপে ফিসফিসিয়ে বলে,
– আর আমাদের বাচ্চাকেও।
সন্ধ্যা শিউরে ওঠে। আকাশ সোজা হয়ে দাঁড়ায়। অনেকেই আকাশকে সালাম দেয়। আকাশ উত্তর দেয়। প্রায় অনেকক্ষণ হাঁটার পর সন্ধ্যা দেখল প্রায় ছয়টি কু’কু’র আকাশ আর তার দিকে দৌড়ে আসছে। সন্ধ্যা ঢোক গিলল। ভীষণ ভ’য় লাগে কু’কু’রকে। আকাশের দিকে চেপে দাঁড়ায়। আকাশ বুঝতে পেরে সন্ধ্যাকে ডানহাতে আগলে নিয়ে বলে,
– কিছু করবে না ওরা। ভ’য় পেয়ো না সন্ধ্যামালতী।
বলতে বলতে কু’কু’রগুলো আকাশের সামনে এসে দাঁড়ায়। কেউ কেউ আকাশের গা ঘেঁষছে। আকাশ সন্ধ্যার হাত ছেড়ে হাঁটু মুড়ে বসল। পলিথিন থেকে সব খাবারগুলো ঢালে ঘাষের উপর। রুটির প্যাকেট ছিঁড়ে দু’টো রুটি দু’টো কু’কু’রের মুখে দিল।
সন্ধ্যা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। তার মনে হচ্ছে এই কু’কু’রগুলো আকাশের বন্ধু। আকাশ মাথা উঁচু করে সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে বলে,
– ওদের খাওয়াবে সন্ধ্যামালতী? ভালো লাগবে।
সন্ধ্যা ঢোক গিলল। তার কু’কু’র ভ’য় লাগে। কিন্তু এই কু’কু’রগুলো কি ভালো! সন্ধ্যা মাথা নেড়ে বোঝায়, সে খাওয়াবে।
আকাশ বলে,
– বসো তাহলে।
সন্ধ্যা আকাশের পাশে বসতে নিলে আকাশ সন্ধ্যাকে তার ডান হাঁটুর উরুর উপরে বসায়। সন্ধ্যা আশেপাশে তাকায়। আকাশ সন্ধ্যার কোমরের ওপাশ দিয়ে হাত রেখে রুটির প্যাকেট ছিঁড়তে ছিঁড়তে গম্ভীর গলায় বলে,
– আমার দিকে তাকাও সন্ধ্যামালতী। হাসবেন্ডের দিকে তাকিয়ে থাকলে আমলনামায় সাওয়াব লেখা হয়, জানোনা? এরপর-ও অন্যদের দিকে তাকালে তোমার চোখদু’টো খুব সুন্দর করে তুলে নিব। কানা, খোড়া বউ হলে-ও আমার কোনো প্রবলেম নেই। কিন্তু বউ মাস্ট লয়াল হওয়া চাই।
শেষ কথাটা আকাশ সন্ধ্যার দিকে চেয়ে হিমশীতল কণ্ঠে বলে। আকাশের কথা শুনে সন্ধ্যা চোখ বড় বড় করে তাকায় আকাশের দিকে।
আকাশ সন্ধ্যার হাতে রুটি ধরিয়ে দিয়ে বলে,
– খাওয়াও। ওরা ক্ষুধার্ত।
সন্ধ্যা মাথা নিচু করে নেয়। একটু ঝুঁকে কাঁপা হাতে কু’কু’রের দিকে রুটি এগিয়ে দিলে কু’কু’রটি খপ করে সন্ধ্যার হাত থেকে রুটি নিয়ে নেয়। আকাশ কু’কু’র গুলোর দিকে চেয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে,
– এটা আমার একমাত্র সোনা বউ। ওকে সম্মান দিবি। সালাম দিবি সালাম।
এরপর আকাশ বা হাতে হাত উঠিয়ে ইশারায় দেখায়, এভাবে সালাম দিবি। আকাশের কথায় কু’কুরগুলো সব তাদের সামনে এক পা উঠিয়ে সত্যি-ই নাড়াতে লাগলো। এটা দেখে সন্ধ্যা কু’কু’রগুলোর দিকে বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। তার কাছে ব্যাপারটি একদম-ই নতুন লাগলো। ভীষণ ভালো লাগলো। আকাশ সন্ধ্যার বিস্ময় মুখ দেখে একটু হাসলো। সন্ধ্যার গাল তার মুখ বরাবর। আকাশ গলার স্বর নিচু করে গুনগুনিয়ে গায়,
শোনোনা, রূপসী,
তুমি যে শ্রেয়সী
কী ভীষণ উদাসি –
প্রিয়সী।
জীবনের গলিতে,
এ গানের কলিতে
চাইছি বলিতে
ভালোবাসি।
ভালোবাসি বলার সময় সন্ধ্যার সাথে আকাশের চোখাচোখি হয়। সন্ধ্যার চোখজোড়া টলমল করে ওঠে। মেয়েটি ইশারায় করে, আর ঠোঁট নাড়ায়,
চোখের জলের-ই আড়ালে
খেলা শুধুই দেখেছিলে
য’ন্ত্র’ণারই আ’গু’ন নীলে
পু’ড়ে’ছি যে বোঝোনি তা
অভিমানে চুপটি করে,
গিয়েছিলাম তাই দূরে সরে
বোঝাতে চেয়েও পারিনি
তাই বোঝাতে লুকানো কথা।
অন্তঃদহন পর্ব ৩৭
এটুকু বলতে গিয়ে সন্ধ্যার চোখ থেকে পানি গড়ি পড়ে। সন্ধ্যার ঠোঁট নাড়ানো কি ভীষণ নিখুঁত! আকাশ প্রতিটি কথা পড়তে পারলো। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সন্ধ্যার দিকে। সন্ধ্যার চোখে চোখ রেখে ঢোক গিলে আওড়ায়,
– আমার ভালোবাসার চোখ থেকে অশ্রু ঝড়িয়ো না মেয়ে। তোমার অশ্রু আমার হৃদয়ে গভীর ক্ষ’ত সৃষ্টি করে, সে খবর কি তোমার কাছে পৌঁছায়না সন্ধ্যামালতী?
