প্রিয় বেগম সিজন ২ পর্ব ১৭
পুষ্পিতা প্রিমা
শাহানার ক্রন্দনে মহলের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠলো। অনুপমা আর হামিদা মিলে তাকে শান্ত করানোর চেষ্টায় রত। মাথায় পাগড়ি প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে কক্ষ হতে হন্তদন্ত পায়ে বেরিয়ে এল শেরহাম। সোজা সদর কক্ষ পার হয়ে আসার সময় সাফায়াত তার পথ আটকে বলল,
‘ ঠিকানা দাও, কোথায় ওকে রাখা হয়েছে। ‘
শেরহাম উত্তর না দিয়ে চলে যাচ্ছিলো। সাফায়াত কাঁধের পোশাক আঁকড়ে ধরে বলল,
‘ আমার উত্তর চাই। ‘
শেরহাম আঁকড়ে ধরা পোশাকের দিকে চোখ নীচু করে তাকিয়ে বলল,
‘ বিয়ের রাতে হাত ভাঙতে চাইছিস? নাকি একেবারে হারাতে? ‘
সকলেই আঁতকে উঠলো। সায়রা এসে সাফায়াতের হাত থেকে পোশাক ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল,
‘ কেন এখন বিবাদে জড়াচ্ছেন? ওদিকে আপু কত বিপদে না আছে। ভাইজান আপনার কারণেই তো আপুকে অপহরণ করা হলো। আপনি কেন ঠিকানা বলছেন না? ‘
শেরহাম দাঁত চিবিয়ে বলল,
‘ পাঁচশোরও অধিক ডাকাত আছে ওখানে। এরা দলবল নিয়ে গেলে তনীকে আস্ত রাখবে ওরা?
সাফায়াত চেঁচিয়ে উঠে বলল,
‘ ওর কিছু হলে তোমার লা**শ ফেলে দেব আমি। অনেক কষ্ট দিয়েছ ওকে। ‘
শেরহাম আবারও পা বাড়ালো কথা কানে না নিয়ে। শেরতাজ সাহেব পথরুদ্ধ করে বললেন,
‘ ঠিকানা দাও। শেহজাদ আর সাফায়াত যাবে। তোমার বিশ্বাস নেই। তুমি নিজেই একটা ভক্ষক তুমি কি রক্ষা করবে তাকে। ‘
শেরহাম বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘ এই বুড়ো। সরে দাঁড়াও। ধাক্কা মেরে অক্কা দিতে দু মিনিট লাগবে না আমার। আমার মায়ার শরীর নয় যে আমি ভাববো তুমি আমার জন্মদাতা। তোমার ছোট ছেলের কথা ভেবে সরে দাঁড়াও। ‘
শেরতাজ সাহেব ওর গালে কষে চড় বসাতে দেরী করলো কিন্তু সে শেরতাজ সাহেবকে ধাক্কা মারতে দেরী করলো না। ভাগ্যিস শেহজাদ এসে ধরেছে!
শেহজাদ শেরতাজ সাহেবকে পড়া থেকে আটকে রুক্ষ স্বরে বলল,
‘ সবার কি মাথা খারাপ? এসময় নাটক করছো এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে? ভাইজান তুমি ঠিকানা দাও বাড়াবাড়ি না করে। তুমি নিজেই জানো তনী নিষ্পাপ মেয়ে। ‘
‘ তোকে যেতে হবে না। তোর বউকে পাঠা। তনীকে ফিরিয়ে দেবে ওরা। পারবি? বুকে সে সাহস আছে? ‘
‘ আমার বেগমকে রক্ষা করা যেমন আমার ধর্ম, তোমার বেগমকে রক্ষা করাও তোমার ধর্ম। জীবনে ভালোকাজ তো কিছু করোনি অন্তত যে মেয়েটা তোমাকে তিনবেলা বেড়ে খাওয়াতো তার কথা ভাবো। ‘
শেরহাম বলল,
‘ পথ ছাড়। আমি যা ভালো বুঝি তা-ই করব। এত ফটরফটর না করে পারলে কবর খুঁড়ে রাখ। ‘
সকলেই স্তব্ধ। আঁতকে উঠলো এমন কথায়।
শাহানা হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলল,
‘ তুমি কি করে এমন কথা মুখে আনতে পারো? ওর জীবনে অভিশাপ তুমি । আমি আমার মৃত বাবার সিদ্ধান্তকে ঘেন্না করি। তিনি নিজমুখে আমার মেয়ের ধ্বংস বলে গিয়েছেন। তোমার কখনোই ভালো হবেনা শেরহাম। ও অপরূপা নয় যে আত্মরক্ষা জানে, এমন কোমলপ্রাণ মেয়ের সাথে এত নির্দয় কি করে হতে পারো তুমি? ‘
শবনম কাঁদতে কাঁদতে মাকে শান্ত করায়।
‘ আম্মা এমন করবেন না। ‘
সাফায়াত গর্জে বলল,
‘ সায়রা ছাড়ো আমাকে। আজকেই সবকিছুর ইতি ঘটাবো আমি। কবর আজকে তোমাকে দেব আমি।’
শেরহাম ধারালো তলোয়ারের খাপ পিঠের পেছনে গেঁথে বেরিয়ে গেল হনহনিয়ে। শেহজাদ ডেকে বলল,
‘ কাশিম ওর পথ আটকাও। যতক্ষণ না ঠিকানা দিচ্ছ ততক্ষণ তোমাকে ছাড়বো না আমি। ‘
শেরহাম ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। তলোয়ারের খাপ হতে তলোয়ার বের করতেই শাহজাহান সাহেব এসে শেহজাদের হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে বলে,
‘ কেন ওকে আটকাচ্ছ? ও চেনে ওসব ডাকাতের আস্তানা, ওর চলাফেরা সেখানে। সেখানে তোমরা কিছু করতে পারবে না। কাশিম পথ ছাড়ো। ‘
সৈন্যরা সরে দাঁড়ালো।
শেরহামের হিংস্র কালো ঘোড়াটি হুংকার তুলছে। শূন্যে পা তুলে মাটিতে রাখতেই মাটিসহ কাঁপছে।
শেরহাম পিঠে চড়ে বসতেই ছুটতে ছুটতে একটা পুটলি নিয়ে এল সোহিনী। শেরহামের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘ ভাইজান আপনি যা যা বলেছেন সব দিয়েছি। আপুর কোনো ক্ষতি যেন না হয়। আমার পর যদি কেউ আপনার ভালো চায় সেটা আপু। ‘
শেরহাম পুটলিটা নিয়ে বলে,
‘ অকারণে মহল থেকে বের হবি না। যারা মরতে চায় তাদের বের হতে বলবি। যাহ। ‘
সোহিনীর মন খারাপ হয়ে আসে। শেরহামের তেজস্বী ঘোড়াটি টগবগিয়ে ছুটে চলে ধুলো উড়িয়ে। শেরহামের সৈন্যরা অতিথিশালায় থেকে যায়। শেরহামের পেছন পেছন শেহজাদও বেরিয়ে যায় সাফায়াতকে নিয়ে। বেশকিছুদূর যাওয়ার পর পথ হারিয়ে অন্য পথে ছুটে চলে তারা। পরাগ পাহাড়ে রাখা হয়নি তটিনীকে। রাখা হয়েছে জংলাহাঁটার একটা ডাকাত আস্তানায়। সেটি এক ভয়ংকর নিষিদ্ধ জায়গা। জনমানবের জন্য ভীতিকর, চারপাশে গা ছমছম করা ভুতুড়ে পরিবেশ। পরাগ পাহাড়ের সেই পথ দিয়ে যেতে যেতে পার হতে হয় একটা ছোটখাটো মরা নদী। সেই নদীর পানির রঙ কালো। নদীটাকে অভিশপ্তও ধরা হয়। ডাকাতদের নৌকা চলে বেশি।
শেরহাম সেই পথেই ছুটে চললো।
পাহাড়ি এলাকার চারদিকে সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে। দূরের পাহাড়ি জঙ্গল থেকে ভেসে আসে শিয়ালের আর্তনাদ, বিভিন্ন প্রাণীর হাঁকডাক। বনের নিজস্ব প্রাণশূন্য থমথমে শব্দকে নাড়িয়ে দিয়ে সরু পথ অনুসরণ করে চাঁদের নীলাভ আলোয় কুয়াশাজড়ানো অভয়ারণ্যের মধ্যে দিয়ে মরা নদীর সামনে গিয়ে পৌঁছালো শেরহাম । তার ঘোড়াটিকে নিরাপদ স্থানে বেঁধে মরা নদীটি পার হওয়ার জন্য উপায় খুঁজতে লাগলো সে। দূরে মশাল হাতে দাঁড়িয়ে আছে এমন কয়েকজনকে একটা নৌকায় চড়ে আসতে দেখলো সে। নিজের হাতের মশালটি ফেলে দিয়ে আড়ালে দাঁড়িয়ে রইলো নৌকাটি ঘাটে পৌঁছার অপেক্ষায়।
নৌকাটি ঘাটে পৌঁছালো তখনি দপদপ শব্দে নৌকা হতে নেমে দলসহ কিসের উদ্দেশ্যে যেন হেঁটে যেতে যেতে চোখের আড়াল হলো ডাকাতগুলো। তারা আড়াল হতেই সে আড়াল হতে বের হয়ে নৌকাটিতে লাফ দিয়ে উঠে বসলো। ডাকাত মাঝিটা তার উপর হামলে পড়লো। নখের আঁচড় কাটলো গালে। অনেক কষ্টে শেরহাম তাকে ফেলে গলা চেপে ধরলো। ডাকাতটি খঞ্জর বের করার সাথে সাথে শেরহাম তার মুখে ঘুষি মারলো বার কয়েক। তারপর খঞ্জরটি কেড়ে নিয়ে পেটের মধ্যে দু তিনবার গেঁথে দিল। ডাকাতটি তারপরও ক্ষান্ত হলো না। পেট চেপে ধরে শেরহামকে নৌকা থেকে ফেলে দেয়ার জন্য লাথি বসালো। শেরহাম নৌকা থেকে পড়তে গিয়েও পড়লো না। ডাকাতটা ঢলে পড়লো ধীরেধীরে। শেরহাম তার গায়ের কালো মুখোশ খুলে নিয়ে লাথি মেরে নদীতে ফেলে দেয়। মুখোশ পড়ে নিয়ে দ্রুতগতিতে বৈঠা চালিয়ে নদী পার হলো। নৌকা ঘাটে বেঁধে জংলাহাঁটার ডাকাত আস্তানার দিকে পা বাড়ায় সে। সামনে পাতাবিহীন গাছ দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা। পথেপথে মশাল জ্বালানো। সে একটি মশাল তুলে নিয়ে হাঁটা ধরে। আস্তানায় পৌঁছাতেই দেখতে পায় বাদামী ইট সংলগ্ন প্রকান্ড ভয়ংকরী বাসভবন। ডাকাতের দলবল দেখতে পেল সে।
দলে দলে গোল গোল হয়ে ভবনের চারপাশে বসে তাস খেলছে অনেকে। কেউ কেউ মদের আসরে বসে একসাথে বসে মদ গিলছে। কালো মুখোশসমেত পোশাক পড়ে থাকায় তাদের একজন ভেবে কেউ তাকে সন্দেহ দেখলো না। মুখটা পুরোপুরি খুললো না, আধখোলা রেখে দিল সে।
নিজেদের কাজে মগ্ন সবাই। শেরহাম চারপাশ পর্যবেক্ষণ করতে করতে দলে মিশে গিয়ে মদের আসরের দিকে এগিয়ে গেল। মদ খেয়ে মাতালের মতো ঢুলছে সবাই মিলে। বিশ্রী রকমের গালাগালও করছে। সেই দলে মিশে গিয়ে বাসভবনের ভেতর প্রবেশ করতেই দেখলো বড়সড় রাজাসনে বসে আছে ডাকাত দলের সর্দার আর চন্দ্রলাল। শেরহামের হাতের মুঠি শক্ত হয়ে এল। একজন ডাকাতের সাথে ধাক্কা লাগতেই ডাকাতটি মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়ে শেরহামকে গালি দিয়ে ধাক্কা মারবে ঠিক তখনি শেরহাম হাতের ঘুষি বসালো। অমনি টাল সামলাতে না পেরে ছিটকে পড়লো ডাকাতটি। ডাকাত সৈন্যরা এসে ঘিরে ধরলো শেরহামকে। শেরহাম সামনের দুজনের মুখ বরাবর লাথি বসিয়ে রাজাসনের দিকে এগিয়ে গিয়ে একলাফে চন্দ্রলালকে ধরে গলায় তলোয়ার ধরে অপরহাতে মুখোশ টেনে খুলে বলল,
‘ অস্ত্র ফেল সকলে। ওকে কোথায় রেখেছিস সোজা নিয়ে চল। নয়ত গলায় এখনি ত**লোয়ার চালাবো।’
চন্দ্রলাল হতভম্ব। এত এত পাহাড়া টপকে কি করে এত নিকটে চলে এল শেরহাম? সকলেই অস্ত্র নীচে নামিয়ে রাখলো। চন্দ্রলাল সেই কক্ষের দিকে পা বাড়ালো। গলার কাছেই তলোয়ার। এই শেরহাম সুলতান সব পারে। সে বলল,
‘ তুই এটা ভালো করছিস না শেরহাম সুলতান। ‘
‘ মেয়েঘটিত ব্যাপারে জড়িয়েছিস কেন শয়তান?’
আর উপায়ান্তর না দেখে চন্দ্রলাল তাকে কক্ষের দিকে নিয়ে যায়। কক্ষের তালা খুলে দিতেই চাবিটা রেখে দেয় শেরহাম। তারপর চন্দ্রলালের বুকের একপাশে তলোয়ার দিয়ে হামলা করে ছুুুঁড়ে ফেলে কামরায় প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দেয়। একটা ছোটখাটো ঝালি ফটক দিয়ে আলো ঢুকছে কামরাটিতে। একপাশে মশাল জ্বলছে। আধো অন্ধকারাচ্ছন্ন কামরার এককোণে খড়ের উপর শায়িত নারীদেহটি দেখে দ্রুতবেগে ছুটে গেল সে। মুখটার দিকে তাকালো পূর্ণ দৃষ্টি মেলে। আধশোয়া হয়ে ঝুঁকে পড়ে মুখ ধরে ডাকাডাকি করলো,
‘ তনী! এই তনী। ওঠ। এই তনীর বাচ্চা। ‘
প্রিয় বেগম সিজন ২ পর্ব ১৬
তটিনী ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে নির্জীব হয়ে শুয়ে পড়েছিল। চোখ লেগে গিয়েছে। চোখ মেলে মুখের সামনে হঠাৎই শেরহামকে দেখে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলো সে।
আকস্মিক দুহাতে টেনে গলা জড়িয়ে নিজের সাথে চেপে ধরলো। হু হু করে কেঁদে উঠতেই শেরহাম তার পিঠের নীচে হাত গলিয়ে শরীরটা তুলে নিয়ে গালে,গলায় অজস্র চুম্বন করে মুখ ডুবিয়ে রেখে বলে,
‘ চল পালাই। ‘