অন্তঃদহন পর্ব ৪০

অন্তঃদহন পর্ব ৪০
DRM Shohag

পরদিন,
ঘড়ির কাটায় তখন রাত ৮ টা। সন্ধ্যা ডাইনিং টেবিলে বসে নুডুলস্ খাচ্ছে। সন্ধ্যা যেখানে বসে আছে, সেই সোজা একটি রুম, যেখানে সাইফুদ্দীন নওয়ান থাকে। সে ঘর থেকে জিনিস পড়ে যাওয়ার শব্দ হলো। সন্ধ্যা ঘাড় বাঁকিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালো একবার। শেষবার নুডুলস্ মুখে নিয়ে কয়েকঢোক পানি খায়। এরপর চেয়ার থেকে উঠে সাইফুদ্দীন নওয়ানের রুমের দিকে এগিয়ে যায়।

সাইফুদ্দীন নওয়ান টেবিলের কোণা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মেঝেতে পানি ভর্তি জগ পড়ে আছে। সন্ধ্যা অবাক হলো। ঘরে এভাবে পানি ফেলেছে কেন বুঝল না। আসমানী নওয়ান, আকাশ কেউ উনার সাথে কথা বলে না। মানুষটা একদম একা হয়ে গিয়েছে। সন্ধ্যা সেদিন সবাইকে ক্ষমা করে দেয়ার কথা বোঝালেও এরপর আর কাউকে জোর করেনি। সোহা, সাধন, সৃজা, সিজান এদের সবার কথা এখনো ভীষণ মনে পড়ে তার। সাইফুদ্দীন নওয়ানের প্রতি তার অনুভূতি বোঝা যায় না। সন্ধ্যা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উল্টো ঘুরলে পিছন থেকে সাইফুদ্দীন নওয়ানের করুণ কণ্ঠ ভেসে আসে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– সন্ধ্যা আম্মু?
সন্ধ্যার বুক ধ্বক করে উঠল। তাকে এভাবে কেউ কখনো ডাকেনি। এমনকি তার নিজের বাবা-ও ডাকেনি। সাইফুদ্দীন নওয়ান আবার-ও একই সুরে বলেন,
– আমার দু’টো কথা শুনবে আম্মু? প্লিজ!
এবার সন্ধ্যা পিছু ফিরে তাকায়। সাইফুদ্দীন নওয়ানের সাথে চোখাচোখি হয়। ভদ্রলোকের চোখজোড়া পানিতে টইটুম্বুর। সন্ধ্যা বুঝল, লোকটির চোখজোড়া অনুতপ্তের পানিতে ভরা। সন্ধ্যা মলিন মুখে চেয়ে রইল। তার খারাপ লাগে মানুষটার জন্য। প্রিয় মানুষ অবহেলা করলে ভীষণ ক’ষ্ট হয়, তা তো সন্ধ্যা জানে। সাইফুদ্দীন নওয়ান ভাঙা গলায় বলে,

– আমি জানি আমার পা’পের ক্ষমা হয় না। আমি তো তোমার সাথে অন্যায় করেছি। আমাকে তুমি শা’স্তি দিবে আম্মু?
সন্ধ্যা অবাক হয়ে তাকায়। সে কিভাবে শা’স্তি দিবে? সাইফুদ্দীন নওয়ান ঢোক গিলে বলে,
– আসমানী আমায় খুব ভালোবাসে। ও আমায় শা’স্তি দিতে গিয়ে নিজের সুখ ভুলে গিয়েছে আমি জানি।
আমি তোমার সাথে অন্যায় করেছি। তোমার আপন মানুষগুলোকে মে’রে ফেলেছি। তুমি আমাকেও মে’রে ফেল আম্মু। তুমি যত ক’ষ্ট দিয়ে মৃ’ত্যু দিতে চাও, দাও। কিন্তু আমার আসমানীকে ভালো থাকতে দাও। আমাকে আর আমার আসমানীকে একটাবার শান্তির নিঃশ্বাস নিতে দাও।

কথাগুলো বলতে বলতে সাইফুদ্দীন নওয়ানের চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। গলা বেঁধে আসে। সন্ধ্যার চোখজোড়া ভিজে ওঠে। সাইফুদ্দীন নওয়ান এগিয়ে আসতে নিলে পড়ে যেতে নেয়। সাথে সাথে আবার-ও টেবিলের কোণা ধরে নিজেকে সামলে নেয়। প্রচন্ড বুক ব্য’থা করছে। চোখবুজে রইল কিছুক্ষণ। এরপর ধীরে ধীরে হাঁটু মুড়ে মেঝেতে বসে। দু’হাত জমা করে ভাঙা গলায় বলে,

– আমাকে ফিরিয়ে দিওনা আম্মু। আমার ক্ষমা চাওয়ার মুখ নেই, তবুও ক্ষমা চাইছি। আমায় মৃ’ত্যু উপহার দিয়ে আমার শা’স্তিটা একটুখানি কমিয়ে দাও।
সন্ধ্যার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। তার মনে হচ্ছে তার সামনে তার এক বাবা এভাবে বসে আছে। সন্ধ্যা ঢোক গিলল।
সাইফুদ্দীন নওয়ান আবার-ও করুণ কণ্ঠে ডাকে,
– সন্ধ্যা আম্মু আমায়………
আর বলতে পারেনা। হঠাৎ-ই পিছন দিকে হেলে ঠাস করে মেঝেতে পড়ে যায়। সন্ধ্যা বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। দ্রুত ঘরের ভিতরে প্রবেশ করতে চায়, তখন-ই পাশ থেকে আসমানী নওয়ান সন্ধ্যার হাত চেপে ধরে। সন্ধ্যা ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায় আসমানী নওয়ানের দিকে।
আসমানী নওয়ানের দৃষ্টি সাইফুদ্দীন নওয়ানের দিকে। চোখের কোণে জলকণা। সন্ধ্যা আসমানী নওয়ানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ডান হাতে আসমানী নওয়ানকে ঝাঁকায়। আসমানী নওয়ান সন্ধ্যার দিকে তাকায়। নিজেকে সামলে বলে,

– এক পা-ও এগোবি না জান্নাত।
সন্ধ্যা বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। সে ভেবেছিল আসমানী নওয়ান নিজেই এগিয়ে যাবে, অথচ আসমানী নওয়ান নিজেও যাচ্ছে না, তাকেও যেতে দিচ্ছে না। সন্ধ্যা ঘাড় ফিরিয়ে সাইফুদ্দীন নওয়ানের দিকে তাকায়। লোকটি মাটিতে শুয়ে বা হাতে বুক ডলছে একটু পর পর। কেমন ছটফট করছে। ভদ্রলোকের ঝাপসা দৃষ্টিজোড়া তাদের দিকেই। সন্ধ্যা ঢোক গিলল। দৃষ্টি ঘুরিয়ে আসমানী নওয়ানের দিকে তাকায়। সন্ধ্যা তার হাত আসমানী নওয়ানের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিতে চায়।
কিন্তু আসমানী নওয়ান সন্ধ্যার হাত ছাড়লেন না। উল্টে সন্ধ্যার হাত আরও শ’ক্ত করে ধরে। ঢোক গিলে তেজী স্বরে বলে,

– আমারে তোর মায়ের সাথে গুলাবিনা জান্নাত। তুই আর তোর মা দয়ার সাগর হইলেও, আমি নই। কেউ অন্যায় করলে সে কখনো আমার থেইকা পার পাইব না।
সন্ধ্যা অবাক হয়ে তাকায় আসমানী নওয়ানের দিকে। আসমানী নওয়ান ঝাপসা চোখে সন্ধ্যার দিকে তাকায়। মলিন গলায় বলে,

– ওই মানুষটার জন্য ছয়টা মানুষ পু’ড়ে ম’র’ছে জান্নাত। ওগো না জানি কত পানি পিপাসা লাগছিল, কতভাবেই না ওরা বাঁচতে চাইছিল। একটা বাচ্চাও আছিল। ওদের সবাইকে কত ক’ষ্ট দিয়া মা’র’ছে সাইফুদ্দীন নওয়ান। তুই সব ভুইলা গেলেও আমি ভুলতে পারিনা মা। তুই তোর সাথে করা অন্যায়ের ক্ষমা করলেও ওই বাঁচতে চেয়ে হাহাকার করা মানুষগুলোর হয়ে ক্ষমা করতে পারবি জান্নাত? ওপারে গিয়া ওগো সামনে গিয়া দাঁড়াতে পারবি তো?
কথাগুলো বলে থামে আসমানী নওয়ান। সন্ধ্যার চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি গড়িয়ে পড়ে। তার আজও মনে পড়ে সোহা প্রথমদিন দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরেছিল। সে সামলাতে না পেরে দু’জনেই উল্টে পড়েছিল। তারপর সাধন ভাইয়া সোহাকে মেরেছিল। আরও কত কত স্মৃতি জমা হয়েছে। অথচ ওই মানুষগুলো আর নেই। সন্ধ্যার দমবন্ধ লাগে।
আসমানী নওয়ান ধরা গলায় বলে,

– আমি আমার স্বামীরে ক্ষমা কইরা ওই মানুষগুলোর সামনে দাঁড়াতে পারমু না।
এরপর আবার-ও শ’ক্ত গলায় বলে,
– সাইফুদ্দীন নওয়ান আমার জীবন থেইকা শান্তি কাইড়া নিছে। আমি তারে কোনোদিন ক্ষমা করমু না।
সাইফুদ্দীন নওয়ান আসমানী নওয়ানের কথায় ছটফটিয়ে উঠল। বুক ব্য’থা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। প্রচন্ড পানি পিপাসায় ছটফটায়। অস্ফুটস্বরে ডাকল,
– আসমানী?
ভদ্রলোকের কণ্ঠ বের হলেও তার বেশিদূর গেল না। সাইফুদ্দীন নওয়ান খুব করে বলতে চাইল,

– আমাকে এক গ্লাস পানি দিবা আসমানী?
কিন্তু পারল না বলতে। তার গলা বেঁধে আসছে। বুক ব্য’থায় ছটফটানি বাড়ে। সাইফুদ্দীন নওয়ানের ছটফটানি আসমানী নওয়ান, সন্ধ্যা দু’জনের চোখেই পড়ে। আসমানী নওয়ান ঢোক গিলল। কি করবে সে?
সন্ধ্যা সাইফুদ্দীন নওয়ান ছটফটানো দেখে আসমানী নওয়ানের হাত থেকে আবার-ও নিজের হাত ছাড়িয়ে নিতে চায়। কিন্তু সে ব্যর্থ। আসমানী নওয়ান সন্ধ্যার হাত শ’ক্ত করে ধরে রেখেছে। সন্ধ্যা অসহায় চোখে তাকায়। তার কী করা উচিৎ সে জানেনা। কিন্তু তার সামনে একজন মানুষ ছটফট করছে, সে চুপ করে থাকতে পারছে না। ভীষণ খারাপ লাগছে মেয়েটার। আসমানী নওয়ানকে দেখে অবাক না হয়ে পারেন না। তার খালাম্মা এতো কঠোর কেন, সে বুঝে পায় না। তার খুব বলতে ইচ্ছে করল, – খালাম্মা তুমি কি তোমার স্বামীরে একটু-ও ভালোবাসো না?
কিন্তু মুখ বলতে পারলো না। কথা বলতে পারলেও হয়তো বলতো না।

সাইফুদ্দীন নওয়ান মাটিতে হাত রেখে টেবিলের দিকে যেতে চায়, কিন্তু পারে না। ডান হাত সামান্য উঁচু করে আসামনী নওয়ানের দিকে বাড়িয়ে বহুক’ষ্টে উচ্চারণ করে,
– আসমানী একবার আসবে?
আসমানী নওয়ানের বুকে চিনচিনে ব্য’থা হয়। ঝাপসা চোখজোড়া আরও খানিক ঝাপসা হলো। সন্ধ্যার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে।
সাইফুদ্দীন নওয়ান বেশ কসরত করে ডান হাতে এগিয়ে গিয়ে টেবিলের পা আঁকড়ে ধরে। প্রচন্ড বুক ব্য’থায় বা হাতে বুক চেপে ধরে রাখে। টেবিলের পা-র সাথে মাথা ঠেকিয়ে ঝাপসা চোখে আসমানী নওয়ানের দিকে তাকায়। নিজ স্ত্রীর ভেজা চোখ দেখে ব্য’থাতুর মুখে একটু হাসল। বুক ব্য’থার সাথে পানি তৃষ্ণায় ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। সন্ধ্যার দিকে চেয়ে খুব ক’ষ্টে বেঁধে আসা গলায় বলে,

– সন্ধ্যা আম্মু আমাকে ক্ষমা করে দিও।
সন্ধ্যার কান্না পাচ্ছে। আসমানী নওয়ানের হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলে এবারে-ও ব্যর্থ হয়।
সাইফুদ্দীন নওয়ান দৃষ্টি ফিরিয়ে আসমানী নওয়ানের দিকে তাকায়। ইতোমধ্যে আসমানী নওয়ানের চোখ থেকে পানি গড়িয়েছে। সাইফুদ্দীন নওয়ানের বারবার চোখ বুজে আসে। তবুও নিজ স্ত্রীর পানে চেয়ে রইল।
হাজারো ঝড়, বৃষ্টির পর-ও মাথার উপরে দন্ডায়মান আসমান যেমন মাথার উপর অটল থাকে। তার আসমানী-ও এতোকিছুর পর-ও তার দিকে এক পা বাড়ানোর সাহস করল না। দৃঢ় আসমানের মতো নিজ সত্ত্বায় অটল থাকলো।
সাইফুদ্দীন নওয়ানের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। চোখ বন্ধ করে নেয়। আবার-ও খুব ক’ষ্টে চোখজোড়া মেলে অস্ফুটস্বরে বলে,

– আমার আসমানী ভালো থেকো।
এরপর চোখজোড়া বুঝে নেয়। হঠাৎ-ই টেবিলের পা ছেড়ে দিলে মেঝেতে ঠাস করে পড়ে যায়। ছটফটানি আগের চেয়েও বেড়ে যায়। এক ফোঁটা পানির জন্য ছটফটায়। দম আটকে আসছে। তবু-ও মাথা একটুখানি উঁচু করে আসমানী নওয়ানকে দেখতে চাইল, কিন্তু পারলো না। বিড়বিড় করল,
– আমার প্রাণ, আমার আব্বু আ..কা.শ।
এটুকু বলে ভদ্রলোক একেবারে নিস্তেজ হয়ে গেল যেন। ছটফটানি থেমে গেল।
এ পর্যায়ে আসমানী নওয়ানের বুকটা ধ্বক করে ওঠে। সন্ধ্যার হাত ছেড়ে দেয়। ঢোক গিলে দ্রুতপায়ে এগিয়ে আসতে থাকে আকাশের বাবার দিকে।

সাইফুদ্দীন নওয়ানের চোখে আসমানীর নওয়ানের দু’পা ঝাপসা ঠেকল। চোখজোড়া খুলে নিজ স্ত্রীকে একবার দেখতে চাইলেন, কিন্তু পারলেন না। তার আগেই চোখজোড়া বন্ধ হয়ে যায়।
আসমানী নওয়ান পায়ের গতি বাড়িয়ে সাইফুদ্দীন নওয়ানের পাশে এসে দাঁড়ায়। ভদ্রলোককে নড়চড়বিহীনভাবে নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকতে দেখে ঢোক গিলল আসমানী।
সন্ধ্যা দৌড়ে এসে দাঁড়িয়েছে সাইফুদ্দীন নওয়ানের পাশে। টেবিলের উপর থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে দ্রুত সাইফুদ্দীন নওয়ানের পাশে বসে, ভদ্রলোকের মুখে পানি ছিটিয়ে দেয়। কোনো সাড়া না পেয়ে সন্ধ্যা ভ’য় পায়।
সন্ধ্যা দেখল, আসমানী নওয়ান ধীরে ধীরে তার স্বামীর পাশে বসেছে, যেন কোনো জড়বস্তু। কাঁপা ডান হাত এগিয়ে সাইফুদ্দীন নওয়ানের নাকের কাছে নিয়ে যায়। কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরে স্তব্ধ চোখে তাকায় স্বামীর পানে। দু’চোখ ফেটে বৃষ্টির ন্যায় পানি ঝরতে থাকে।

আসমানী নওয়ান কাঁপা দু’হাত সাইফুদ্দীন নওয়ানের দু’গালে রেখে কেঁদে কেঁদে বলে,
– আকাশের আব্বা, যাইও না তুমি। আমারে রাইখা যাইওনা আকাশের আব্বা। কথা কও আমার সাথে। যাইও না।
কথাগুলো বলতে বলতে সাইফুদ্দীন নওয়ানের বুকে কপাল ঠেকিয়ে দেয়। নিজের দৃঢ়তা ভেঙে ফেলল মুহূর্তেই। ভেতর জমানো সব আবেগ উতলে বেরিয়ে আসতে লাগলো। গত একটাবছর যার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল, সে আজ তার ক্লান্তির অবসান ঘটালো। তার আসমানীর ক’ষ্ট কমিয়ে দিল। আসমানী নওয়ান কেঁদে কেঁদে বলে,

– তুমি নিঃশ্বাস নাও আকাশের আব্বা। তুমি আমারে কইছিলা আমরা একসাথে বাঁচমু, নয়তো একসাথে মরমু। তুমি ফাঁকি দিয়া ক্যান চইলা গেলা আকাশের আব্বা?
ভাঙা ভাঙা স্বরে বলা আসমানী নওয়ানের কথাগুলো শুনে সন্ধ্যার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ আগে-ও সে তার খালাম্মাকে প্রশ্ন করতে চেয়েছিল, সে তার স্বামীকে ভালোবাসে কি-না! অথচ সেই মানুষটা কিছুক্ষণের ব্যবধানে তার স্বামীর জন্য কিভাবে কাঁদছে! সন্ধ্যা ঢোক গিলল।
তখন-ই পাশ ঘেকে আকাশের কণ্ঠ ভেসে আসে,

– কি হয়েছে?
সন্ধ্যা সাথে সাথে ঘাড় ফিরিয়ে মাথা উঁচু করে তাকায়।
আকাশ অফিস থেকে ফিরল মাত্র। তার ঘরের দিকে যেতে গিয়ে তার মা, আর সন্ধ্যাকে এই ঘরে দেখে এগিয়ে আসে।
সন্ধ্যা এদিক ফিরলে আকাশের সাথে চোখাচোখি হয় সন্ধ্যার। আকাশ অবাক হয় সন্ধ্যার চোখে পানি দেখে। অবাক হয়, তার বাবাকে মেঝেতে সটান হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে। সবচেয়ে বেশি অবাক হয়, তার মাকে এভাবে কাঁদতে দেখে। তার জীবনে আজকেই প্রথম, তার মাকে এভাবে কাঁদতে দেখল। আকাশের অবাকের মাত্রা শীর্ষে পৌঁছায়। সে এগিয়ে এসে সন্ধ্যার পাশে দাঁড়ায়। মায়ের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে,
– মা কাঁদছ কেন? কি হয়েছে?

আসমানী নওয়ান মাথা তোলে না। এতোবছর সবরকম পরিস্থিতিতে নিজেকেসহ, প্রত্যেকটি মানুষকে সামলে নেয়া মানুষটা আজ একেবারে ভেঙে পড়েছে যেন। নিজ ভাই, বোন, ছেলেদের কতশত ক’ষ্ট দাঁতে দাঁত চেপে সয়ে নিয়েছে। ছেলের দুঃখের সময় ছেলের পাশে থেকে কতশত সান্ত্বনা দিয়েছে। কিন্তু যেদিন জানলো, তার স্বামী তার আপনজনদের এভাবে ক্ষ’তি করেছে। সেদিন-ই অর্ধেক ভেঙে গিয়েছিল। তবুও ক্ষণে ক্ষণে নিজেকে সামলে নিত। কিন্তু আজ বোধয় পারলেন না। নিজের ভেতর জমানো হাজারো দুঃখ, ক’ষ্ট নিজের ভেতর চেপে রাখতে পারলেন না।
আকাশের দৃষ্টি তার বাবার দিকে পড়ে। কি হয়েছে তার বাবার? তার বাবা বিছানায় না শুয়ে এভাবে মেঝেতে শুয়ে আছে কেন? আকাশ ঢোক গিলল। সন্ধ্যার পাশে হাঁটু মুড়ে বসে মৃদুস্বরে বলে,

– বাবার কি হয়েছে সন্ধ্যামালতী?
সন্ধ্যার চোখে পানি টইটুম্বুর হয়ে আছে। সে আকাশকে কি বলবে? তার নিজেরই ভীষণ কান্না পাচ্ছে। আকাশ বুঝতে পারলে আকাশের কি হবে? আকাশ ঢোক গিলল। সন্ধ্যার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আবার-ও তার বাবার দিকে তাকায়। এরপর উপুড় হয়ে পড়ে কান্নারত তার মায়ের দিকে তাকায়। আকাশ বোধয় কিছু আন্দাজ করতে পারছে। তার গলা শুকিয়ে আসে। মেঝেতে পড়ে থাকা তার বাবার বা হাত, কাঁপা হাতে তুলে পালস্ চেক করে আকাশ। বাবার হাতের ধমনীর স্পন্দন থেমে গিয়েছে বুঝতে পেরে আকাশের বুক কেঁপে ওঠে। আকাশ সাথে সাথে তার বাবার হাত ছেড়ে দেয়। সাইফুদ্দীন নওয়ান এর হাত ঠাস করে পড়ে যায়। মুহূর্তেই আকাশের চোখজোড়া ভরে ওঠে। অস্ফুটস্বরে আওড়ায়,

– বাবা?
সন্ধ্যা ভেজা চোখে তাকায় আকাশের দিকে। আকাশের কাঁধে হাত রাখে আকাশ সাথে সাথে সন্ধ্যার দিকে তাকায়। ঢোক গিলে বলে,
– সন্ধ্যামালতী, বাবা নিঃশ্বাস নিচ্ছে না কেন? বাবাকে নিঃশ্বাস নিতে বলো।
কি বাচ্চামো কথা! সন্ধ্যার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। আকাশ আবার-ও তার বাবার দিকে তাকায়। একটু ঝুঁকে তার বাবার মাথায় হাত রেখে ভাঙা গলায় বলে,

– বাবা ওঠো। বাবা ওঠো না! আমার একটাই বাবা। তুমি চলে গেলে আমার বাবা হারিয়ে যাবে। বাবা?
কথাগুলো বলতে বলতে আকাশের চোখ থেকে টুপ করে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। আসমানী নওয়ান মাথা তুলে ছেলের দিকে তাকায়। ভাঙা গলায় বলে,
– আকাশ তোমার আব্বারে আমি অনেক ডাকছি। সে তো ওঠেনা আকাশ। একটু উঠতে কও। আমার খুব ক’ষ্ট হইতাছে। আমি কি করমু?

আকাশ ভেজা চোখে তার মায়ের দিকে তাকায়। আসমানী নওয়ান আবার-ও তার স্বামীর গাল ধরে ঝাঁকায় আর বলে,
– আকাশের আব্বা খালি একটাবার কথা কও। এই দেখ আমি আইছি তোমার কাছে। তুমি চইলা গেলে আমি কারে আকাশের আব্বা কইয়া ডাকমু কও? যাইওনা আকাশের আব্বা।
কথাগুলো বলতে বলতে আবার-ও কাঁদতে থাকে। সন্ধ্যা মা, ছেলের এমন দৃশ্য দেখে মুখ চেপে কাঁদে। আকাশ কেমন নিরব, স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। তার বাবার মাথায় রাখা হাত, বাবার চুলের ভাঝে আলতো করে বুলায় আর করুণ সুরে বলে,

– বাবা একবার ওঠো। এই দেখ, আমি আর মা তোমার সাথে কথা বলতে এসেছি। বাবা?
আকাশ কতক্ষণ তার বাবাকে ডাকে। কোনো সাড়া নেই। ভীষণ ক’ষ্ট হচ্ছে। তার বাবা সত্যিই হারিয়ে গেল! সে আর কাউকে বাবা বলে ডাকতে পারবেনা। বাবাকে তো অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু দিনশেষে ভাবতো, তার বাবা নিঃশ্বাস নিচ্ছে কিন্তু আজ থেকে ভাবতে হবে, তার বাবার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কথাটা ভাবতেই আকাশের দম আটকে আসলো। আকাশের চোখজোড়া থেকে আরও কয়েকফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে থাকা বাবার পানে চেয়ে আকাশ বিড়বিড় করে,

– বাবা তুমি সত্যিই আমাকে একা করে চলে গেলে? ‘আমি সব ঠিক করে দিব’ বলা আমার বাবা তুমি আমাকে রেখে কি করে চলে যেতে পারলে? তুমি আমার ভালো বাবা হয়ে কেন থেকে গেলে না বাবা? কেন আমার থেকে বাবা ডাক কেড়ে নিলে বলো? তুমি জানো? আমি আমার বাবার প্রাণ। বাবা আমায় খুব ভালোবাসে। চলে এসো না বাবা! আমি আর তোমাকে জে’লে দিতে চাইবো না। আর তোমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিব না। বাবা???
আকাশকে তার দু’হাত বাবার বুকে রেখে বাচ্চাদের মতো প্রলাপ করতে দেখে সন্ধ্যার চোখ থেকে টুপটুপ করে পানি গড়িয়ে পড়ে। সন্ধ্যা আকাশের মুখ তার দিকে ফিরিয়ে নেয়। আকাশ ভেজা চোখে তাকায় সন্ধ্যার দিকে। সন্ধ্যা ইশারায় বোঝায়,

– আর কাঁদবেন না। ওনার এই পর্যন্ত-ই হায়াত ছিল।
আকাশ ঢোক গিলল। ঘাড় ফিরিয়ে তার সামনে কান্নারত মায়ের দিকে একবার তাকালো। এরপর সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। একটু একটু করে পা ফেলে বাইরের দিকে যেতে নেয়। কিছুদূর গিয়ে মাথা ঘুরে উঠলে দাঁড়িয়ে যায়।
সন্ধ্যা দৌড়ে আকাশের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। আকাশের গায়ে হাত দিয়ে আকাশকে ডাকে। আকাশ তাকালো না। দুর্বল পায়ে হেঁটে ঘরের বাইরে বেরিয়ে যায়। এগিয়ে গিয়ে সোফা ঘেঁষে মেঝেতে বসে আকাশ। নির্জীব হয়ে চেয়ে রইল মেঝের দিকে।

সন্ধ্যা আকাশের দিকে এগিয়ে যেতে গিয়ে পিছু ফিরে আসমানী নওয়ানের দিকে তাকায়৷ আসমানী নওয়ান সেই তখন থেকে এভাবে কাঁদছে। সন্ধ্যা দ্রুপায়ে এগিয়ে এসে গ্লাস থেকে হাতে পানি নিয়ে আসমানী নওয়ানের মাথায় পানি দিয়ে আলতো হাতে থা’প্প’ড় দেয় মাথায়। ভদ্রমহিলাকে সাইফুদ্দীন নওয়ানের বুক থেকে তুলতে চাইলেন, কিন্তু পারলেন না। সন্ধ্যার ভীষণ অসহায় লাগছে। বারবার চোখ ভিজে যাচ্ছে। এই মানুষটা সবসময় তাকে কত বুঝের কথা বলেছে অথচ কিভাবে ভেঙে পড়েছে। সন্ধ্যা দু’হাতে চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো। এরপর একপ্রকার দৌড়ে গিয়ে আকাশের পাশে দাঁড়ায়। হাতে গ্লাস। আকাশকে পানি খাওয়াবে। সে নিচু হওয়ার আগেই আকাশ হঠাৎ-ই তার দু’হাতে সন্ধ্যার দু’পা জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে ওঠে। ভাঙা গলায় শব্দ করে বলতে থাকে,

– সন্ধ্যামালতী আমি জানি আমার বাবা খুব খারাপ। তোমার সাথে সবার সাথে অনেক অন্যায় করেছে। কিন্তু আমার বাবার হয়ে আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। আমার বাবাকে তুমি ক্ষমা করে দাও সন্ধ্যামালতী। আমি তোমার সব কথা শুনব। তোমার পায়ে পড়ি আমি। আমার বাবাকে ক্ষমা কর সন্ধ্যামালতী।
আকাশের করা কাজ সাথে আকাশের কথাগুলো শুনে সন্ধ্যা বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। হাতের গ্লাস ছুড়ে ফেলে জোর করে আকাশের থেকে নিজের পা ছাড়িয়ে নিয়ে আকাশের সামনে বসে পড়ে। আকাশ কান্নামাখা চোখে তাকায় সন্ধ্যার দিকে। আবার-ও বলতে নেয়,

– সন্ধ্যামালতী আমা…..
সন্ধ্যা ডান হাতে আকাশের মুখ চেপে ধরে। বা হাতে বোঝায়, – আমি অনেক আগেই আপনার বাবাকে ক্ষমা করে দিয়েছি।
এরপর দু’হাতে আকাশের ভেজা গাল মুছে দেয়। ওদিকে সন্ধ্যার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। সন্ধ্যা খুব ক’ষ্টে কান্না গিলে আকাশকে বোঝায়,
– আর কাঁদবেন না।
কথাটা বলে দু’হাতে আকাশের গলা জড়িয়ে ধরে। আকাশ মাথা নিচু করে সন্ধ্যার কাঁধে মুখ গুঁজে রাখে। চোখ বুজে নেয়। আবার-ও কয়েক ফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়ে আকাশের। বিড়বিড় করে,
– বাবাকে আর কোথাও পাওয়া যাবে না তাইনা সন্ধ্যামালতী?
সন্ধ্যা চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি গড়িয়ে পড়ে।

সন্ধ্যার মনে পড়ে,, সোহা, সাধনের কথা। যে দু’জন মানুষ তার আর সৌম্য ভাইয়ার অন্ধকার জীবনে এক উজ্জ্বল প্রদীপ হয়ে এসেছিল। তাকে আর সৌম্য ভাইয়ার দুঃখের দিনে হাসাতে এসেছিল। সন্ধ্যার একটুখানি জ্বর হয়েছিল বলে, সোহা তার মাথায় কত যত্ন করে হাত বুলিয়ে দিয়েছিল। সাধন ভাইয়া ঔষধ এনে দিয়েছিল। তার আর সৌম্য ভাইয়ার ভালো থাকার সঙ্গ দিতে এসেছিল, আর সেই অপরাধে তারা পু’ড়ে কয়লা হয়ে গিয়েছে। সন্ধ্যা কি করে ভুলবে তাদের?

আর এদিকে সাইফুদ্দীন নওয়ান আজকেই প্রথম, আজকেই শেষবার কি আদরমাখা ডাক ডাকলেন ‘সন্ধ্যা আম্মু’ বলে। সন্ধ্যা এটা-ও ভুলতে পারবে না। মানুষটা কি ক’ষ্ট পুষে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করল।
সন্ধ্যা আর কিছু ভাবতে চায় না। সে শুধু চায়, সবাই ভালো থাকুক। তার আর সৌম্য ভাইয়ার দু’দিনের পরিচয়ের দু’টো ভাইবোন যেন খুব ভালো থাকে। আকাশের বাবা-ও ভালো থাকুক।
কথাগুলো ভেবে সন্ধ্যার চোখ বেয়ে নোনাজল গড়ায়। আকাশকে জড়িয়ে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলে।

সময় বহমান। সে কারো দুঃখে থেমে থাকার নয়। চোখের পলকে পেরিয়েছে দু’মাস।
সৌম্য অফিস থেকে মাত্র ফিরেছে। হাতের ছোট ব্যাগ সোফার উপর রেখে দেয়। আশেপাশে তাকালে ইরাকে দেখল না। গরম পড়েছে বেশ। সৌম্য শার্টের দু’টো বোতাম খুলে জগ থেকে পানি গ্লাসে ঢালে। ভরা গ্লাসটি নিয়ে সোফায় বসে পানি খেতে খেতে দেখল ইরা ঘর থেকে বেরিয়েছে। তাকে দেখে ইরা পায়ের গতি বাড়ালো। সৌম্য এক নিঃশ্বাসে গ্লাসের পানি খেয়ে গ্লাসটি টেবিলের উপর রাখল। ইরা সৌম্য’র সামনে এসে বলে,
– আমাকে ডাকিস নি কেন?
সৌম্য মৃদুস্বরে বলে,

– এমনিই। ভেবেছি কাজ করছিস।
কথাটা বলে পকেট থেকে ফোন বের করে গ্যালারি থেকে একটি পিক বের করে। ডান হাত ইরার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
– এখানে আয়।
ইরা এগিয়ে এসে সৌম্য’র ডান পাশে বসল। সৌম্য তার ডান হাত ইরার কোমর জড়িয়ে নেয়। বা হাতে ফোন এগিয়ে দিয়ে বলে,
– দেখ তো ইরাবতী। তোর পছন্দ হয়েছে?
ইরা সৌম্য’র হাত থেকে ফোন নিয়ে দেখল, একটি বাড়ির পিক। বাড়িটি খুব সুন্দর। একতলা ছাদের বাড়ি। পুরো বাড়ি সাদা রঙ করা। কিন্তু আশেপাশের পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছে এটা একটা গ্রাম। ইরা সৌম্য’র দিকে প্রশ্নাত্মক চোখে তাকালে দেখল সৌম্য তার দিকেই চেয়ে আছে। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। ইরা অবাক হয়ে বলে,
– এটা কার বাড়ি?
সৌম্য মৃদু হেসে বলে,
– আগে বল, পছন্দ হয়েছে কি-না!
ইরা মাথা নেড়ে বলে,
– ভীষণ সুন্দর! কিন্তু এটা কার……
সৌম্য উত্তর করে,

– এটা আমাদের বাড়ি ইরাবতী। তোর আর আমার।
ইরা সৌম্য’র কথায় অবাক হয়। সৌম্য আবার-ও বলে,
– গত দেড় মাস আগে আমাদের বগুড়ার মিলনের পাড়া গ্রামে এই জায়গা কিনেছিলাম। আজ বাড়িটা একদম কমপ্লিট হলো। আজ রাতেই গ্রামের উদ্দেশ্যে বের হব। তুই সব দ্রুত গুছিয়ে নে। এখন থেকে আমরা ওখানেই থাকবো।
ইরা বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায় সৌম্য’র দিকে। বলে,
– গ্রামে থাকবি। কিন্তু এখানে যে তোর চাকরি আছে। ভুলে গেলি?
সৌম্য ইরাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। শার্টের বোতাম একে একে খুলতে খুলতে বলে,
– চাকরি ছেড়ে দিয়েছি ইরাবতী।
সৌম্য’র কথাটা ইরার মাথার উপর বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো পড়ল। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বিস্ময় কণ্ঠে বলে,
– মানে? কি বলছিস?

সৌম্য শার্টের বোতামগুলো সব খুলে ছেড়ে রাখে। ইরার দিকে একটু এগিয়ে এসে বলে,
– ভ’য় পাচ্ছিস আমি চাকরি ছেড়ে দেয়ায়?
ইরা নিশ্চুপ। অবাক হয়ে দেখছে সৌম্য’কে। সৌম্য ডান হাত বাড়িয়ে ইরার ছোট ছোট কয়েকটা চুল ইরার কানের পিঠে গুঁজে দেয়। এরপর ইরার চোখে চোখ রেখে বলে,
– আমার ইরাবতীকে ক’ষ্ট করতে দিব না আমি। নিশ্চিন্তে থাক ইরাবতী। তাছাড়া আমার ইরাবতীর ভালোবাসার প্রখরতা কতখানি তা আমি জানি। ইরাবতী তার বেকার সৌম্যকে নিয়ে মাথা উঁচু করে খুব সুখী হয়ে বাঁচবে, আমি এটাও জানি।
ইরার চোখজোড়া ভরে ওঠে। মৃদুস্বরে বলে,
– তুই কি আমার উপর রা’গ করে চাকরি ছেড়ে দিলি সৌম্য? আমি তোকে চাকরি ছাড়তে বলিনি। এখন তোকে সবাই বেকার বলবে।
সৌম্য মৃদুস্বরে বলে,

– আমাকে কেউ বেকার বললে,, ‘তোর বর বেকার’ এটা ভেবে তোর কি খারাপ লাগবে?
ইরা মাথা বলে,
– একটুও খারাপ লাগবেনা।
সৌম্য মৃদু হেসে বলে,
– এজন্য যারা আমাকে বেকার বলবে, তাদের কথা-ও আমার একটুও গায়ে লাগবে না ইরাবতী।
ইরা সৌম্য’র মুখের দিকে চেয়ে রইল। সৌম্য ঘরের দিকে যেতে যেতে ইরাকে তাড়া দিয়ে বলে,
– দ্রুত গুছিয়ে নে ইরাবতী। এখান থেকে আকাশ ভাইয়াদের বাড়ি যাবো। তারপর ওখান থেকে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিব।

রাত তখন ৮ টার ঘরে।
ল্যাপটপে একটি ভিডিও চলছে। যেখানে আকাশের বাবার মৃত্যুর আগে করুণ সুরে বলা কিছু কথা, ছটফটানো আর তারপর নিস্তেজ হয়ে যাওয়া।
ভিডিওটি দেখে আকাশ চোখ বুজে নিল। তাদের প্রতিটি ঘরে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো আছে। যে কারণে এই ভিডিওটি আকাশ পেয়েছে। বিড়বিড় করে বলে,
– তুমি কেমন আছো বাবা?
সৌম্য আকাশের ঘরের দরজা ঠেলে দেখল আকাশ চোখ বুজে রেখেছে। আকাশের বাবা মা’রা যাওয়ার পর থেকে আকাশ কেমন যেন নিরব হয়ে গিয়েছে। সৌম্য’র খারাপ লাগে। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
– আকাশ ভাইয়া আসব?
সৌম্য’র কণ্ঠ পেয়ে আকাশ চোখ মেলে তাকায়। বলে,
– এসো।

এরপর আকাশ সোজা হয়ে বসে। কোলের উপর থেকে ল্যাপটপ বিছানার উপর রেখে দেয়। সৌম্য এগিয়ে এসে আকাশের সামনে বরাবর বেডের উপর বসে। আকাশের পরনে একটি সাদা রঙের টি-শার্ট। আকাশ ডান হাতে তার টি-শার্ট একটু টেনে সামনে আনে। সৌম্য’র দিকে চেয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে,
– কোথাও যাচ্ছো না-কি?
সৌম্য গলা ঝেড়ে বলে,

– আপনাকে তো বলেছিলাম, আমার গ্রামে একটা বাড়ি বানাচ্ছি আমি। বাড়ি কমপ্লিট। তাই আজকে যাচ্ছি।
আকাশ মাথা নেড়ে বলে,
– আচ্ছা সাবধানে যেও। আবার কবে আসবে?
সৌম্য একটু চুপ থেকে বলে,
– আমি একেবারে যাচ্ছি ভাইয়া।
আকাশ ভ্রু কুঁচকে বলে,
– বুঝলাম না। একেবারে গেলে তোমার চাকরি কে করবে?
– চাকরি ছেড়ে দিয়েছি।

আকাশ বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। ব্যাপারটা তার ঠিক হজম হচ্ছে না। মানুষ চাকরি পায় না, আর এ চাকরি পেয়ে, সেই চাকরি আবার ছেড়ে দিয়ে কি সুন্দর করে বলছে, ‘চাকরি ছেড়ে দিয়েছি।’
আকাশ ভ্রু কুঁচকে বলে,
– এটা কেন করলে?
সৌম্য মৃদুস্বরে বলে,
– ইরাবতীকে সময় দিতে পারছিলাম না তাই।
আকাশ অবাক হয়ে বলে,
– তুমি কি পা’গ’ল?
সৌম্য একটু হেসে বলে,
– আমার বড় ভাইয়ের মুখে শুনেছিলাম, ভালোবেসে পা’গ’ল উপাধি না পেলে, সেই ভালোবাসার মূল্য কম হয়।
আকাশ কিছু বলতে গিয়েও হেসে ফেলল। অতঃপর বলে,

– ভালো ভালো। চালিয়ে যাও।
সৌম্য মৃদুস্বরে আবদার করে বলে,
– কয়েকদিন পর পর-ই বোনুকে আমার বাড়ি নিয়ে যাবেন আকাশ ভাইয়া?
আকাশ বেড থেকে নেমে দু’হাত প্যান্টের পকেটে রেখে হতাশ হয়ে বলে,
– আমার বউটাকে যা ভাইপা’গ’ল বানিয়েছ! ভাবছি, দু’দিনের মাথায়-ই না আবার আমাকে আমার বউকে নিয়ে তার ভাইয়ের বাড়ি দৌড় দেয়া লাগে!
সৌম্য আকাশের কথা শুনে একটু হাসলো। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো। বাইরে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে,
– নিয়ে যাবেন বোনুকে। একটাই বউ আপনার।
আকাশ ভ্রু কুঁচকে বলে,

– এমনভাবে বলছ, যেন তোমার দশ বারোটা বউ!
সৌম্য দাঁড়িয়ে গেল। এগিয়ে এসে আকাশের সামনে দাঁড়ায়। আকাশের কথার উত্তর দিল না। তবে মলিন মুখে আকাশের দিকে তাকালো। আকাশ ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে। সে তো মন খারাপ করার মতো কিছু বলেনি, তাহলে এই ছেলের কি হলো? মৃদুস্বরে বলে,
– কিছু বলবে?
সৌম্য হঠাৎ-ই আকাশকে জড়িয়ে ধরল। আকাশ তব্দা খেয়ে যায়। এতোটা আশা করেনি। সৌম্য বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আকাশকে জড়িয়ে রেখেই বলে,

– বোনুকে গ্রামে রেখে আমি এই শহরে প্রথম এসেছিলাম আমার স্বপ্ন পূরণ করতে। আর তারপর গ্রামে ফিরে গিয়ে দেখেছিলাম, বোনু তার কণ্ঠস্বর হারিয়ে ফেলেছে।
আর আজ ইরাবতীর স্বপ্ন পূরণের জন্য নতুন জীবন শুরু করতে গ্রামে যাচ্ছি। আমি শহরে ফিরে এসে আমার বোনুকে, যেমন রেখে যাচ্ছি তেমন-ই দেখতে চাই। আপনি আমার বোনুকে একটুও ক’ষ্ট দিবেন না আকাশ ভাইয়া। আপনার কাছে আমি আর কিছুই চাইনা। আপনি শুধু আমার বোনুকে ভালো রাখবেন।
কথাগুলো বলতে বলতে সৌম্য’র গলা ধরে আসে। আকাশের চোখেমুখে বিস্ময়। ঢোক গিলল। সে সত্যিই সৌম্য’র মতো ভাই দেখেনি। সে নিজেও বোধয় হাজার বছর সাধনা করলেও সৌম্য’র মতো এতো পার্ফেক্ট ভাই হতে পারবেনা। আকাশ ডান হাত সৌম্য’র পিঠে রেখে মৃদুস্বরে বলে,
– বিলিভ মি সৌম্য, আমি সন্ধ্যামালতীর জন্য নিজের জান কু’র’বান করতে, এক সেকেন্ড-ও ভাববো না।
সৌম্য একটু হাসলো। আকাশকে ছেড়ে ঝাপসা চোখজোড়া ডলে স্বাভাবিক করে নেয়।

সৌম্য ভাইয়া চলে যাবে শুনে, সেই তখন থেকে সন্ধ্যার চোখ শুধু ভিজে যাচ্ছে। গত একবছর এমন কোনো দিন নেই, সে সৌম্যকে দেখেনি। একদিন হলেও জড়িয়ে ধরেনি, এমন হয়নি।
গত দুইমাস তার সৌম্য ভাইয়া নিয়ম করে এই বাসায় দু’বার করে আসতো। তার সাথে দেখা করে যেত। এখন একেবারে গ্রামে চলে গেলে কতদিন পর পর দেখা হবে ভাবলেই সন্ধ্যার কান্না পাচ্ছে। এখান থেকে তাদের গ্রামে যেতে অনকে সময় লাগে। চাইলেই তো আর যাওয়া-আসা করতে পারবে না। তার আর নিয়ম করে সৌম্য ভাইয়ার সাথে দেখাও হবেনা।

সন্ধ্যাকে এভাবে কাঁদতে দেখে ইরার ভীষণ খারাপ লাগছে। ইরা সন্ধ্যার পাশ থেকে উঠে দোতলায় উঠতে গেলে দেখল, সৌম্য নিচে নামছে। তাই ইরা দাঁড়িয়ে গেল। সৌম্য নিচে নেমে এলে ইরা মৃদুস্বরে বলে,
– সৌম্য তুই এই শহর ছেড়ে যাস না। সন্ধ্যা খুব কাঁদছে। আমার নিজেকে অনেক স্বার্থপর লাগছে। তাছাড়া সন্ধ্যা তো আমার-ই বোন। আমার খারাপ লাগছে ওর জন্য।
সৌম্য দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ইরার গালে হাত দিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– বোনুকে বাঁচাতে গিয়ে তোকে মৃ’ত্যু’শয্যায় পাঠিয়েছিলাম। এবার নাহয় বোনুর থেকে একটুখানি দূরত্ব বাড়িয়ে আমার ইরাবতীকে একটি সুখের সংসার উপহার দিলাম।
ইরার চোখের কোণে পানি জমে। মলিন গলায় বলে,
– আমার মনে হচ্ছে, আমি তোর আর সন্ধ্যার মাঝে দূরত্ব……..
সৌম্য মাঝখান থেকে বলে,

– বাড়বেনা দূরত্ব। মিলিয়ে নিস। আপাতত গ্রামীণ বউ হওয়ার হিসাব কষে নে। আমি বোনুর সাথে কথা বলছি।
কথাটা বলে সৌম্য ইরাকে পাশ কাটিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। সন্ধ্যা তার ফোনে লিখেছিল,
– সৌম্য ভাইয়া, তুমি এই বাড়িতে না থাকলেও এই শহর ছেড়ে যেও না।
লেখাটি সৌম্য’কে দেখাতে চেয়েছিল সন্ধ্যা। কিন্তু ইরাকে বলা সৌম্য’র কথা শুনে সন্ধ্যা দ্রুত লেখাটি কেটে দেয়। সৌম্যদের থেকে দূরে সরে দাঁড়ায়। তার মনে হচ্ছে, সে তার সৌম্য ভাইয়াকে ভালোবাসতে গিয়ে তার সৌম্য ভাইয়ার ভালোবাসা ইরা আপুর কথাই ভাবছে না। সন্ধ্যার নিজের কাছেই কেমন যেন ছোট লাগছে। পিছন থেকে সৌম্য ডাকে,

– বোনু?
ভাইয়ের কণ্ঠ পেয়ে সন্ধ্যা দ্রুত উল্টো ঘুরে দাঁড়ায়। একটু-ও সময় ন’ষ্ট না করে সৌম্যকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ওঠে। সৌম্য সন্ধ্যাকে জড়িয়ে ধরে। তার খারাপ লাগছে। মৃদুস্বরে বলে,
– বোনু, আমি তোকে দেখতে আসবো তো! কাঁদিস না। তাহলে আমি আর যেতে পারবো না।
সন্ধ্যা সাথে সাথে মাথা তুলে তাকায় ভাইয়ের দিকে। সন্ধ্যার আবার-ও মনে হলো, সে ভাইয়া আর ইরা আপুর মাঝে বাঁধা হচ্ছে। সন্ধ্যা দ্রুত তার দু’হাতে চোখের পানি মুছে নেয়। ইশারায় বোঝায়,
– আর কাঁদব না। তোমরা যাও। তুমি কিন্তু কয়েকদিন পর পর-ই আমাকে দেখতে আসবে সৌম্য ভাইয়া।
সৌম্য সন্ধ্যার কপালে চুমু খেয়ে মৃদুস্বরে বলে,

– আসব বোনু। তুই সব কাজ ঠিকমতো করবি, মন দিয়ে পড়বি। আর একদম কাঁদবিনা। মনে থাকবে?
সন্ধ্যার আবার-ও চোখ ভিজে যায়। তবে নিজেকে সামলে মাথা নেড়ে বোঝায়, সে সব শুনবে।
এরপর সৌম্য আসমানী নওয়ানের কাছে গেলে আসমানী নওয়ান মৃদু হাসলেন। এবার আর তিনি মন খারাপ করেনি। বরং সৌম্য’র কাজে বেশ অবাক হয়েছে, খুশি-ও হয়েছে। তার দুই ছেলে যেন তার মেয়েদের এভাবেই সারাজীবন ভালোবাসে, এটাই চায় তিনি। সৌম্য’র গালে হাত রেখে মৃদু হেসে বলে,
– আমার ইরাকে ভালো রাইখো আব্বা।
সৌম্য আসমানী নওয়ানকে জড়িয়ে ধরে বলে,
– নিজের খেয়াল রাখবেন মা।
আসমানী নওয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তার ছেলে, মেয়েদের জন্যই সে বাঁচে এখন। প্রিয় মানুষটা তো আর নেই। হারিয়ে গেছে। কথাটা ভেবে চোখের কোণ ভিজল।

সৌম্য ইরার হাত ধরে বাসে উঠে। ইরা সৌম্য’র সামনে। ধীরে ধীরে বাসের পিছন দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। রাত হলেও বাসের লাইট দেওয়া। একটি সিটে বসা, সৌম্য’র বয়সী এক লোক ইরার কোমরের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলে, সৌম্য খপ করে লোকটির হাত ধরে। লোকটি থতমত খেয়ে তাকায় সৌম্য’র দিকে। সৌম্য লোকটির হাত মুচড়ে ধরে রেখে, লোকটির দিকে চেয়ে ঠাণ্ডা গলায় বলে,
– এটা আমার বউ ভাই। আপনার বউ হয়ত বাড়িতে।
কথাটা বলে সৌম্য বাসের কন্ডাকটরের উদ্দেশ্যে বলে,
– ভাইজান এই ভদ্রলোকের বউপিপাসা পেয়েছে। এর বউয়ের জন্য-ও একটা টিকিট কাটুন। নয়তো একে বউয়ের কাছে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করুন।
লোকটি হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলো। মনে হচ্ছে তার হাত ভেঙে যাবে। সাথে সবার মধ্যে এভাবে বলায় লোকটি প্রচন্ড ল’জ্জা-ও পেল।
ইরা এগিয়ে এসে সৌম্য’র হাত টেনে বলে,

– সৌম্য ছেড়ে দে। এদিকে আয়।
সৌম্য লোকটির হাত ঝাড়া দিয়ে ছেড়ে দেয়। ফোঁস করে শ্বাস ফেলে ইরাকে নিয়ে গিয়ে সিটে বসে। ঠাণ্ডা মে’জা’জ টা পুরো গরম করে দিয়েছে। ইরা মৃদুস্বরে বলে,
– ঝামেলা করছিলি কেন? ওই লোকটা যদি খারাপ হয়?
সৌম্য ইরার দিকে তাকালো। বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। এর মধ্যে বাস-ও ছেড়ে দিয়েছে। ইরা সৌম্যকে নিজের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে বলে,
– কি?
সৌম্য মৃদু হেসে বলে,

– তুই অনেক সুন্দর ইরাবতী।
ইরা কি বলবে বুঝল না। সে বলল একটা। সৌম্য বলছে আরেকটা। ইরা ঘাড় ফিরিয়ে বাসের জানালার দিকে তাকালো। ঠান্ডা বাতাসে এসে মুখে ধাক্কা খায়। লাইফে ফার্স্ট টাইম বাসে চড়ল সে। তাও আবার তার ভালোবাসার মানুষটার সাথে। ইরার মুখে হাসি ফুটল। বাসের লাইট ইতোমধ্যে অফ করে দিয়েছে।
ইরা ঘাড় ঘুরিয়ে সৌম্য’র দিকে তাকালো। অন্ধকারে তেমন দেখতে পেল না। ডান হাতে সৌম্য’র ডান হাত জড়িয়ে ধরে, সৌম্য’র বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– আমি তোকে অনেক ভালোবাসি সৌম্য।
সৌম্য মৃদু হেসে হিজাবের উপরেই ইরার মাথায় একটা চুমু খায়। ইরা যদিও বুঝল না, তবে তার মুখে হাসি লেপ্টে।

ঘড়ির কাটায় তখন রাত ১২ টা। সৌম্য বেরিয়ে যাওয়ার পর পর আকাশ অফিস গিয়েছিল। সন্ধ্যার জন্যই দ্রুত ফিরেছে।
দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলে দেখল সন্ধ্যা বিছানার এক কোণায় বসে আছে। দু’হাঁটু ভাঁজ করে, হাঁটুতে মুখ গুঁজে রেখেছে। আকাশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখল সন্ধ্যাকে। বুঝল বোধয়। আর সময় ন’ষ্ট না করে এগিয়ে গিয়ে সন্ধ্যাকে টেনে সোজা করে বসালো। দেখল, সন্ধ্যা কেঁদেকেটে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছে।
আকাশ বিস্ময় দৃষ্টিতে চেয়ে রইল সন্ধ্যার দিকে। সন্ধ্যা চোখ খুলে আকাশকে দেখে আবার-ও চোখ বুজে নিয়েছে।
আকাশ মনে মনে ভাবছে, সন্ধ্যার চোখের একফোঁটা পানি তার জন্য হলে, আজ সে খুশিতে লুঙ্গি, প্লাজু, স্কার্ট সব ডান্স দিত। কিন্তু আফসোস, এই সব চোখের পানি শুধু তার বউয়ের ভাইয়ের জন্য। আকাশ হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে সন্ধ্যাকে জড়িয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ে। সন্ধ্যা প্রথম অবাক হলেও পরে কিছু বলল না। চোখ বুজেই রইল।

আকাশ সন্ধ্যাকে জড়িয়ে রেখে মাথা উঁচু করে সন্ধ্যার দিকে চেয়ে আছে। কি বলা যায়, সেটাই ভাবছে। বন্ধ চোখের পাতা বেয়ে এখন-ও জল গড়াচ্ছে। আকাশ কিছু একটা ভেবে, সন্ধ্যার ডান গালে চুমু খায়, এরপর বাম গালে, এরপর কপালে, এরপর থুতনিতে, এরপর নাকের ডগায়। এভাবে সন্ধ্যার সারা মুখে একটানা চুমু খেতে থাকে। দুই মিনিট, তিন মিনিট, পাঁচ মিনিট, এভাবে পুরো দশ মিনিট পেরিয়ে যাওয়ার পর-ও আকাশকে থামতে না দেখে সন্ধ্যা বিরক্ত চোখে তাকায় আকাশের দিকে। মনে হচ্ছে সন্ধ্যা কোনো ছোট বাচ্চা।
আকাশ সন্ধ্যার দৃষ্টি পাত্তা দিল না। সে সন্ধ্যার মুখে চুমু আঁকতে ব্যস্ত।

সন্ধ্যা না পেরে তার ডান হাত আকাশের ঠোঁটে চেপে ধরে। আকাশ সন্ধ্যার হাত তার ঠোঁট থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আবার-ও সন্ধ্যার মুখে একটানা চুমু খায়। সন্ধ্যা এবার রে’গে বা হাতে আকাশের দাঁড়ি মুঠো করে টেনে ধরে। আকাশ মুখ কুঁচকে মৃদু আর্তনাদ করে ওঠে,
– আহ! লাগছে। ছাড়ো বউ!

অন্তঃদহন পর্ব ৩৯

সন্ধ্যা আরও জোরে টেনে ধরল। রে’গে তাকায় আকাশের দিকে। কখন থেকে তাকে বিরক্ত করছে। সে তার ভাইয়ার জন্য কান্না করছে, কোথায় এই লোকটা এসে তাকে দু’টো সান্ত্বনার কথা বলবে। তা না করে তার মুখে চুমু খেতে খেতে তার মুখটা ভর্তা বানিয়ে ফেলল।

অন্তঃদহন পর্ব ৪১