প্রিয় বেগম সিজন ৩ শেষ পর্ব

প্রিয় বেগম সিজন ৩ শেষ পর্ব
পুষ্পিতা প্রিমা

সোলেমান মাহমুদ নিজ হাতে শোহরাবকে খাইয়ে দিচ্ছেন। শোহরাবও ভীষণ খুশি। নানাভাইয়ের সাথে রাজ্যের গল্প জুড়ে দিয়েছে সে। তার আব্বার গল্প, আম্মার গল্প, ভাইয়ের গল্প। তার গল্পের শেষ নেই। তটিনী শেরতাজ সাহেবকে খাবার বেড়ে দিতে দিতে আঁড়চোখে নানা নাতির কান্ড দেখছে। ভিজে উঠা চোখ আড়ালে মুছে নিল সে। শেরতাজ সাহেব জানতে চাইলেন,

” শেরহাম আজ খাবে না? ”
” ওর জন্য খাবার ঢেকে রাখবো কক্ষে। কখন ফিরবে জানিনা। আজ নাকি ঘাটে মালবাহী জাহাজ এসেছে। সময় লাগবে। ”
” ওহহ। ”
শোহরাব খেয়ে নানাজানের কোল থেকে নেমে এল। শবনম এসে তাকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,
” চলো চলো আমার আব্বার মুখ মুছে দিই। খাওয়া হয়েছে?”
” হা। ”
” মজা করে খেয়েছ?”
” হা খাচি। ”
” ওলে আমাল সোনা। খালামণির সাথে আঙুর খাবে চলো। ”
শোহরাবকে নিয়ে চলে গেল সে। তটিনী সোলেমান মাহমুদকে বললেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” আব্বা আর দুটে ভাত দেই? এই মাংস ভুনাটা খেয়ে দেখুন। এটা মজা হয়েছে। ”
” খেয়েছি। ভালো হয়েছে। তুমি রেঁধেছ?”
” জ্বি। আমি রান্না করতে পারি এখন। ”
সোলেমান মাহমুদ মাথা নাড়লেন। বললেন
” হুমম, রান্না পারা ভালো। ”
তটিনী খুশি হলো। শাহজাহান সাহেবকে বললেন,
” ছোটমামু তোমাকে দেব? ”
” আর কত খাব? পেট ভরে খেয়েছি মা। ”
তটিনী হেসে বলল, ” সত্যিই পেট ভরেছে? ”
” আরেহ হ্যা। ”
” ভাইজান আপনাকে দেব কিছু? ”
সাফায়াত বলল,

” অল্প করে দাও। সিভান মাছ নিচ্ছো না কেন? ”
সিভান বলল, ” আমার মাছ খেতে ভালো লাগে না।”
তটিনী বলল, ” এক্কেবারে ভাইয়ের মতো হয়েছে। মাছ খেতে চায় না। ”
শেরতাজ সাহেব বললেন, ” খেতে না চাইলে দিস না। ও ছোট থেকেই মাছ খেতে পছন্দ করতো না। জোরাজোরি করলে খেত কিন্তু পছন্দ করতো না। ”
তটিনী বলল, ” আচ্ছা খেয়ে নাও। আমি আসছি। ”
সে খুশিমনে রসাইঘরে গেল। শাহানাকে বলল,
” আম্মা জানেন, আব্বা বলেছে আমার রান্না মজা হয়েছে। ”
হামিদা বলল, ” বাহ বরের পর বাপ সুনাম করেছে। আর কি লাগে আমাদের তনী রাণীর। ”
তটিনী বলল,
” সবখানে তোমরা লজ্জা দাও। ধ্যাত। ”

সে কক্ষে চলে এল শেরহামের খাবারের থালা নিয়ে। আজ বেশিরভাগই শেরহামের প্রিয় খাবার। মানুষটা পেটপুরে খেলে তার কি যে শান্তি লাগে। তার হাতের রান্না হলে তো কথায় নেই। শেরহামের অপেক্ষায় কক্ষজুড়ে হাঁটাহাঁটি করলো সে। বের হয়ে শোহরাবের খোঁজে গেল। সে শবনমের পাশে ঘুম। শবনম তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোচ্ছে। তটিনী হাঁটতে হাঁটতে অতিথি কক্ষে চলে এল। লাট্টুকে বলল, ” তুমি চলে এসেছ? ও কখন আসবে? এত রাত অব্ধি কিসের কাজ? ”
” চলে আসতেছে বেগম। কাজ শেষ। আমি গোসলপ যাইতেছি। ”
” আচ্ছা গোসল করে খেয়েদেয়ে নাও। ”

শেরহাম চলে আসছে শুনে তটিনী কক্ষে ফিরে এল। গামছা পোশাক, পায়জামা এক জায়গায় রাখলো। পোশাকগুলো নেয়ার সময় হঠাৎ তার হাতে পড়লো লাল শাড়িটা। শবনমের বিয়ের দিন সেটি তার পড়া হয়নি। একটা আরামদায়ক পোশাক পড়েছিল সে ভালো করে হাঁটতে পারবে না বলে। এত সুন্দর শাড়ি না পড়তে পারায় তার আফসোস হলো। লাল শাড়ি নিশ্চয়ই নতুন বউয়ের পড়লে ভালো লাগে। শবনমকে দিয়ে দেবে সে। তার অনেক শাড়ি কিন্তু সে শাড়ি পড়ে না। ভালোকরে হাঁটতে না পারলে ওসব পোশাক পড়ে কোনো লাভ আছে বলে তার মনে হয় না। সে শাড়িটা বিছানার উপর রেখে দিল। শেরহাম চলে এসেছে ইতোমধ্যে। দরজা ঠেলে ঢুকে পাঞ্জাবির বোতাম খুলতে খুলতে বলল,

” শোহরাব কোথায়? ”
” খেয়েদেয়ে ঘুম। ”
একটা চকচকে-ভেলভেট ধরণের মোড়ক সে রেখে দিল টেবিলে।
তটিনী সেদিকে চেয়ে তার বোতাম খুলতে সাহায্য করে বলল, ” ওটা কি? ”
শেরহাম তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
” পরে দেখে নিস। তোর চোখ ফুলেছে কেন? ”
” এমনি। খুশির চোটে বেশি কেঁদে ফেলেছি। ”
শেরহাম ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইলো। তটিনী বলল,” আরেহ তেমন কিছু না। যাও গোসল সেড়ে এসো। আমি খাবার দিচ্ছি। ”

শেরহাম সন্দিহান চোখে চেয়ে গোসল সাড়তে চলে গেল। তটিনী বিছানা ঝেড়েঝুড়ে শাড়িটা ভাঁজ করে রেখে দেওয়ার জন্য হাতে নিয়ে যাওয়ার সময় আরশির সম্মুখে থমকে দাঁড়ালো হঠাৎ। আয়নায় ভাবুক হয়ে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে এপাশ ওপাশ করে নিজেকে দেখতে লাগলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। তারপর ভাবনায় বুঁদ হয়ে গেল সে। ভাবতে লাগলো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যেখানে শেষ থেকেই তাদের প্রণয়ের শুরু হয়েছে। কখনো দুঃস্বপ্নেও সে ভাবেনি এই মানুষটার ঘর সংসার করবে সে।
ভাগ্যের কি লীলাখেলা! বউ হয়েছে, সংসার করছে ঠিক কিন্তু আফসোস একটাই তার বউ সাজা হয়নি কভু। ওই একটা অপূর্ণতা রয়ে গেছে তার জীবনে। ছোট অথচ ভাবতে গেলে দীর্ঘশ্বাসটির ওজন ভার। এই আফসোসটিও সে রাখতে চাইনা তার জীবনে। সে সম্পূর্ণ সুখী হয়ে বাঁচতে চাই। তার জীবনে কোনো আফসোসকে সে ঠাঁই পেতে দেবে না।

দপদপ পায়ের শব্দ শোনা যাওয়ায় তার ধ্যান ভাঙলো। দ্রুত চোখ মুছে শাড়িটা লুকিয়ে নিল সে।
শেরহাম ভেজা গামছাটা তাকে দিয়ে খেতে বসলো। বলল, ” তুই খেয়েছিস? ”
তটিনী খেয়েছে কিন্তু তারপরও গামছাটা রশিতে বিলিয়ে দিতে দিতে মজা করে বলল,
” তোমার হাতে খাব বলে খাইনি। ”
” তোর ঢংয়ের শেষ নেই। এদিকে আয়। ”
” একশোবার ঢং দেখাবো। আমার ঢং সইতে না পারলে নিকাহ করেছ কেন? করেছ তো ওইরকম ভাবে জোরজবরদস্তি করে। যাব না ওদিকে। ”
শেরহাম খেতে খেতে থমকালো। তটিনীর তখনই মনে হলো সে ভুল কিছু বলে ফেলেছে। তখনি জিভে কামড় দিয়ে শেরহামের পেছনে গিয়ে কাঁধে থুঁতনি ঠেকিয়ে বলল,

” আচ্ছা আচ্ছা এমন আর বলব না। খেয়ে নাও। আমি খাব না। খেয়েছি আগে। ”
শেরহাম ঘাড় ঝাঁকুনি দিয়ে খেতে খেতে বলল, ” শোহরাবকে নিয়ে আয়। ”
তটিনী পেছনে দাঁড়িয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরে গালে গাল ঘষে বলল,
” ও শবনমের সাথে ঘুমোচ্ছে। ওরা দেবে না। তুমি খেয়ে নাও। আমি রসাইঘরে যাচ্ছি। ”
শেরহামের খাওয়া শেষ। সে খেয়ে-দেয়ে অতিথি শালায় চলে গেল তারপর। তটিনী কক্ষে আসামাত্রই তাকে চলে যেতে দেখলো। জানতে চাইলো,
” আবার কোথায় যাচ্ছ? ”
” কাজ আছে। ”

তটিনী বিছানার চাদর ঠিক করতে গিয়ে বিছানার উপর হতে শাড়িটি পুনরায় হাতে তুলে নিল। সেটির গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে আরশির সম্মুখে দাঁড়িয়ে
লাল বেনারসির আঁচলটা মাথায় তুলে ঘোমটা পড়ে আরশিতে নিজেকে বারংবার দেখলো।
তার নিকাহ হয়েছে লাল টকটকে বেনারসির বদৌলতে গায়ের বাসি কাপড় পড়ে। কবুল বলেছে প্রচন্ড ঘৃণাভরে, শেরহাম সুলতানের মৃত্যু কামনা করে, ধ্বংস কামনা করে। ভাঙাচোরা মন নিয়ে যার বর্বরতা, প্রতারণা কবুল করে সে নিকাহ করেছিল, তার জন্যই সে আজ বউ সাজবে। শেরহাম সুলতানকে তো একদম তাক লাগিয়ে দেবে। এই প্রথমবারের মতো বলবে, তোমার ভালোবাসা কবুল।
আনোয়ার আর মানিকের সাথে বাকি কথা শেষ করে শেরহাম কক্ষে আসতেই দেখলো তটিনী একটা লাল শাড়ি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছে। সে তটিনীকে পিছু করে কেদারায় বসে বেশকিছু কাগজপত্র ঠিকঠাক গোছগাছ করতে করতে বলল,
” মোড়কটা খুলে দেখেছিস? ”
তটিনী শাড়ির কুঁচি ধরতে ধরতে বিরক্তিসূচক শব্দ করে বলল,
” না। কি মরা আছে ওতে? ”

কিছুক্ষণ পিনপতন নীরবতা। কেদারা ছেড়ে উঠে মোড়কটা নিয়ে কক্ষের বাইরে ছুঁড়ে মারলো শেরহাম। তটিনী আঁতকে উঠলো। কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই কেদারায় জোরে লাথি বসিয়ে হম্বিতম্বি দেখিয়ে গটগট পায়ে হেঁটে বেরিয়ে গেল। তটিনী স্তব্ধ। শাড়িটা সে এখনো পুরোপুরি পড়তে পারেনি। এলোমেলো শাড়িটা পড়ে কোনোমতে কক্ষের বাইরে বেরিয়ে মোড়কটা নিয়ে এল। তার খেয়ালই ছিল না এটার মধ্যে দামী কিছু থাকতে পারে। সে কেন এত বোকা! হায় আল্লাহ এজন্যই ছুঁড়ে মেরেছে। বেয়াদব লোক। একবার বললেই তো হলো।
বকবক করতে করতে মোড়কটা খুলে ফেললো তটিনী। দেখলো অনেকগুলো পাথরের বসানো ঝুমকো চুড়ি। কি সুন্দর! তটিনীর হেসে ফেললো। কিছুদিন পূর্বে তার হাত খালি থাকায় আম্মা তাকে বকেছিল বেশ। তা শুনে শেরহাম জিজ্ঞেস করেছিলো তার চুড়ি লাগবে কিনা। সে বলেছিল, কয়েকটা হাতকরা মোটা চুড়ি তাকে যেন এনে দেয়। এত দামী চুড়ি কেন আনতে বলেছে? তটিনী সবগুলো তার হাতে পড়ে নিয়ে নাড়াচাড়া করলো। শেরহাম সুলতানের পছন্দ আছে বৈকি। কিন্তু বেয়াদব লোক রাগ দেখিয়ে গেল কোথায়? মাথা নষ্ট করে দেয় লোকটা।
সে শাড়িটা ভালো করে পড়ে চোখে সুরমা টেনে দিল। ব্যস।

শেরহাম কক্ষে এসে কাগজপত্র গুলো আলমিরায় রেখে ধপাস করে দরজা বন্ধ করতপই তটিনীও ধপাস করে কক্ষের দরজা বন্ধ করে দিল। শেরহাম তেড়ে এসে বলল,
” সর আমার কাজ আছে। ”
তটিনী রেগেমেগে বলল,
” একদম চুপ। কোনো কাজ নেই। আমি কি জানতাম নাকি ওখানে কি আছে। ”
শেরহাম তাকে সরিয়ে দিতে যাবে তখন হাতটা ধরতেই চুড়ির উপর হাত পড়লো। চোখ নামিয়ে হাতের দিকে তাকাতেই তটিনী হাতদুটোতে পড়া চুড়িগুলো নাড়তে নাড়তে বলল,
” আমি কিন্তু পড়েছি। হু। ”
শেরহাম অন্যদিকে চোখ সরিয়ে বলল,

” কাজ আছে বললাম না। পথ ছাড়। ”
তটিনী মুখ গম্ভীর করে চেয়ে রইলো। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে শেরহাম কপাল ভাঁজ করে তাকালো। তটিনী মুখটা দ্বিগুণ গম্ভীর করে বলল,
” তুমি সবসময় আমার সাথে এমন করো। আমি আজকে কত সুন্দর করে সেজেছি। তুমি একবারও ভালো করে তাকাওনি। ”
শেরহাম তাকে আগাগোড়া একপলক দেখে নিয়ে বলল,
” তোকে এতরাতে এমন সং সাজতে কে বলেছে? ”
তটিনী চোখ টলমল করে উঠলো।
” আমি সং সেজেছি? তুমি আমাকে বউ সাজিয়ে নিকাহ করেছ? নিকাহ করেছ তো জোর করে, বদনাম করে। গায়ের ময়লা কাপড় পড়ে তোমাকে কবুল বলেছি। আমার কি আর পাঁচটা মেয়ের মতো বউ সাজতে ইচ্ছে করেনা? সারাক্ষণ খ্যাঁক খ্যাঁক করে। একটু ভালো করে দেখেওনা, কথাও বলে না। ”
তটিনী গলায় কান্না। শেরহাম নরম কন্ঠে বলল,

” শাড়িটা কোথায় পেয়েছিস?”
” বলব না। যাহ যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাহ। ”
বলতে বলতে দরজা খুলে দিল সে। শেরহাম বেরিয়ে গেল। তটিনী দরজা বন্ধ করে চুড়ি গুলো খুলে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেললো তারপর বসে রইলো মেঝেতে শক্ত হয়ে। শেরহাম কিছুক্ষণ পর দরজা ধাক্কা দিয়ে বলল,
” এই তনী, দরজা খোল। ”
তটিনী উত্তর দিল না। শেরহাম ঘনঘন দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে বলল,
” আরেহ আমার কাজ ছিল। আমি কি তোর সাথে মশকরা করছি? আজব! দরজা খোল তনীর বাচ্চা। মাথা গরম করবি না। ”
” তোর গরম মাথা চুলোয় দে বেয়াদব। ”
” বেয়াদবি করবি না। কানের নীচে দেব চড়। দরজা খোল। ”
তটিনী ফোঁপাতে লাগলো। শেরহাম বলল,
” তনীর বাচ্চা তনী, দরজা খুলবি কি খুলবি না বল। নইলে তোর বাপকে ডেকে আনছি। ”
” ডাকো। ”
” তাহলে চৌদ্দ গুষ্ঠিকে ডেকে আনছি। দাঁড়া। ”

তটিনী শক্ত হয়ে বসে রইলো। শেরহাম শাহানাকে ডেকে নিয়ে এল। শাহানা দরজায় টোকা দিয়ে বলল,
” তনী কি হয়েছে? দরজা বন্ধ করে বসে আছ কেন? ”
তটিনী হতভম্ব। সত্যি সত্যি ডেকে আনলো? শাহানার পিছুপিছু হামিদা, শেরতাজ সাহেব আর শাহজাহান সাহেবও এল। শেরতাজ সাহেব বললেন,
” মেয়েটা তো ভালোই ভালোই কথা বলছিলো কিছুক্ষণ আগে। হঠাৎ কি হলো? ”
হামিদা ছোট্ট করে বলল, ” ওদের বোধহয় ঝগড়া হয়েছে। ”
শাহানা এবার রাগত স্বরে বলল,
” তনী দরজা খুলছো না কেন আজব? ”

সোলেমান মাহমুদও এসে পড়েছেন ইতোমধ্যে। তটিনী বাবার কন্ঠস্বর শুনে দাঁড়িয়ে পড়লো। শাহানা ডাকলো,
” তনী? কথা বলছো না কেন? কি হয়েছে? দরজা খোলো। তুমি কি ছোট বাচ্চা? তনী? ”
শেরহাম মনে মনে হেসে আওড়ালো, ” এবার নে ঠেলা তনীর বাচ্চা। ”
শাহানার চেঁচামেচি বাড়তেই তটিনী কান্না গিলে ছোট করে বলল,
” আপনারা যান। দরজা খুলছি। ”
শাহানা দরজার সামনে থেকে সরে পড়লো। বলল
” আচ্ছা যাচ্ছি। দরজা খোলো। ”
তটিনী দরজার খিল খুলতেই শেরহাম দরজা খুলে ঢুকে পড়লো। শাহানা দু’পাশে মাথা দুলিয়ে বলল,
” আমাকে জ্বালিয়ে মারছে এখনো। ”

শেরহাম দরজা বন্ধ করতেই তটিনী মেঝে থেকে একটা চুড়ি তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারতেই সেটি দেয়ালে বাড়ি খেয়ে শব্দ হতেই শাহানাসহ সকলেই থমকে গিয়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো।
” কি শুরু করেছ তোমরা? তনী কি হচ্ছে কি? ”
শেরহাম চুড়িগুলো সব কুড়িয়ে নিল। তটিনী বসা থেকে উঠে পড়ে কিছু বলতে যাবে তক্ষুণি শেরহাম তটিনীর গাল চেপে ধরে বলল,
” কিছু হয়নি। তোমরা যেতে পারো। সব ঠিক আছে। ”
তটিনী ধস্তাধস্তি করতে করতে একসময় শান্ত হয়ে এল যখন শেরহাম তাকে শক্ত করে জড়িয়ে গালে ঠোঁট চেপে ধরলো। তটিনী তার পিঠে ধুপধাপ দিয়ে ছাড়লো তারপরও। শেরহাম তার হাতে চুড়িগুলো পড়িয়ে দিতে দিতে বলল,
” সুরমা চোখের নীচে নেমে তোকে ভূতের মতো লাগছে তনীর বাচ্চা। ”
তটিনী নাক টেনে বলল, ” লাগুক। ”

শেরহাম চুড়িপড়া শেষে তার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, ” না তুই ভূত না। তুই হলি ভূতের রাণী।”
তটিনী ফোঁপালো পুনরায়। বা-হাত দিয়ে মুখ মুছতেই আচমকা তার শাড়ির কুঁচি খুলে গেল। শাড়িটা ঝপাৎ করে নীচে পড়ে গেল। তটিনী লজ্জায় পড়ে নীচে বসতে যেতেই শেরহাম তাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে হো হো করে ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠলো। শাহানাসহ সকলেই তখনও যায়নি। দাঁড়িয়ে টুকটাক কথা বলছিলো দূরে দাঁড়িয়ে। উনারা হকচকিয়ে গেল শেরহামের হাসির শব্দ শুনে।
একে অপরের দিকে চেয়ে রইলো খানিকক্ষণ। তারপর মাথা নাড়তে নাড়তে চলে গেল।
শেরহাম শাড়িটা তুলে নিয়ে বলল, ” পড়তে না জানলে তোকে শাড়ি পড়তে বলেছে কে? ”
তটিনী বলল, ” আমি পড়তে জানি। ”

” বেশ বেশ। তুই পড়তে জানিস। ”
এলোমেলো ভাবে কুঁচি ধরে শাড়িটা পড়িয়ে দিয়ে ঘোমটা টেনে দিয়ে শেরহাম তার বুকের সাথে মিশিয়ে নিল। তটিনী মুখটা তুলে রাখলো। শেরহাম কপাল ভাঁজ করে বলল,
” বউ সেজেছিস? ”
তটিনী নাক অব্দি ঘোমটা টেনে দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
” হ্যা, তোমার জন্য। কবুল বলো। তাড়াতাড়ি বলো।”
” কবুল ”
” আবার বলো। ”
” কবুল। ”
” আবার। ”
” কবুল। ”
তটিনী হেসে উঠলো। শেরহাম ঘোমটা তুলে দিয়ে বলল
” এখানে হাসির কি আছে? ”

তটিনী তার কন্ঠদেশ জড়িয়ে ধরে গালে আরক্ত চুম্বন এঁকে দিতে দিতে বলল,
” তোমাকেও কবুল। তোমার ভালোবাসা কবুল। তোমার ঘাড়ত্যাড়ামি কবুল। ”
শেরহাম হেসে উঠে তার গালের দুপাশে চুম্বন দিতে দিতে বলল, ” তনীর বাচ্চার পাগলামি কবুল। গালিগালাজ কবুল। কামড়াকামড়ি কবুল। ”
দু’জনেই হাসতে লাগলো একসাথে। তটিনী দু’হাতে মুখ ঢেকে হাসতে লাগলো। হাসতে হাসতে শেরহামকে পিছু করে দাঁড়ালো।

শাড়ি গলে আসা শক্ত দু-হাত তাকে বন্দী করে নেয় তখন। তটিনী শিউরে উঠে উদরে একটা শক্ত হাতের অবাধ বিচরণ টের পেয়ে । শেরহাম শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তার কানে চুমু খেতেই তটিনী ফিক করে হেসে উঠে বলে,
” অসভ্য লোক। আমার সুড়সুড়ি লাগছে। ছাড়ো। ”
শেরহাম ছেড়ে দিল। ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইলো। তটিনী ছাড়া পেয়ে পালাতে যাবে শেরহাম পুনরায় তাকে আটকে ফেললো। কাঁধ ও উরুর নীচে দু-হাত দিয়ে আঁকড়ে কোলের কাছে ধারণ করে বলল,
” বউ সেজেছিস, বাসর করবি না? ”
তটিনী তার মুখ চেপে ধরে বলল,
” আল্লাহ, আমি মরে যাব। ছিহ মুখের কি ভাষা। ”
শেরহাম ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগলো। তটিনী মুখ লুকিয়ে বলল,
” ছিহ ছিহ। ”
শেরহাম তাকে বিছানায় ধপাস করে ফেলে দিয়ে বলল,
” তোর ঢং শেষ হলে বলিস। তখন আমি আসবো।”

প্রিয় বেগম সিজন ৩ পর্ব ২৫+২৬

তটিনী হাসতে লাগলো। তারপর ঘরটা আচমকা অন্ধকার হয়ে আসতেই সে ভড়কে গেল। বলল,
” আমার এত অন্ধকারে ভয় লাগে। আলো জ্বালাও। ”
সুনসান কক্ষের পিনপতন নীরবতার মাঝে শেরহামের টুঁ শব্দটুকু শোনা গেল না আর। তটিনী বিরক্ত হয়ে বিছানায় পা দিয়ে ধুপধাপ শব্দ করে বলল, ” আলো দাও বলছি। ”
আচম্বিত তার নরম শরীরটা উষ্ণ স্পর্শের ছোঁয়ায় কেঁপে উঠলো। চাদরের উপর হতে আলগা হয়ে মজবুত দুবাহুর মধ্যে বন্দী হতে লাগলো। মুখের উপর তপ্ত শ্বাস ছড়িয়ে দিতে দিতে গম্ভীর স্বরটা তার কানের কাছে বলে উঠলো,
” এই তো আমি আলো। ”

সমাপ্ত