ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৬৫
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই
দেয়াল ঘড়িতে ঘন্টার কাঁটা তখন রাত দুইটা ছড়িয়ে পৌনে তিনটার কোঠায় ঠিক ঠিক করছে।
বাড়ির বাচ্চারা সহ আত্মীয়দের অনেকের চোখে হালকা হালকা ঘুম নেমে এসেছে। শিকদার বাড়ির ড্রয়িং রুমের সোফায় চিতপটাং হয়ে যে যেদিকে পারছে ঘুম দিচ্ছে। তন্ময় উঠে পড়েছে অরণ্যের কোলে। রাদিফ, সাদিফ, সমুদ্র, থিরা, তরি, অভ্র, শুভ্র—সকলেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
যদিও এখনো কর্তা, গিন্নি, প্রণয়, প্রেম, প্রীতম সহ অনেকে জেগে আছেন, চা খাচ্ছেন, আড্ডা দিচ্ছেন।
দেবী মেহমান বিধায় তাকে ১ টা বাজার সাথে সাথেই ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছেন অনুস্রী বেগম।
কিন্তু এত বড় ঘরে একা একা দেবীর কিছুতেই ভালো লাগছে না। এই বাড়িতে আসার পর থেকে আবির্ভাবের আর একবারও দেখা মেলেনি। লোকটার যেন কর্পূরের মতো হাওয়া হয়ে গেছে।
দেবী বিছানায় শুয়ে শুয়ে মোবাইল ফোনে রিলস স্ক্রল করছে, আর মাঝে মাঝে একটা দুটো হাই তুলছে।
এভাবে বসে থাকতে থাকতে কখন জানি চোখ লেগে এলো। দেবীর ফোনটা হাত থেকে পড়ে গেলো।
ইলিমিলি ঘুমটা একটু গভীর হতেই অকস্মাত ধড়াম করে দরজা খোলার শব্দে কাঁচা ঘুম ছুটে গেল। দেবী ধরফরিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
দুই হাতে চোখ কচলে সামনে তাকাতেই আতকে উঠলো। আবির্ভাব টলছে এলোমেলো পায়ে। এক পা সামনে আগাতেই দুই পা পিছিয়ে যাচ্ছে।
চুলগুলো উষ্কখুষ্ক, চোখ দুটো লাল। আবির্ভাবের এই বিধ্বস্ত বেহাল অবস্থা দেখে মুখ হা হয়ে গেলো দেবীর। ভাবনা চিন্তা ফেলে দ্রুত বিছানা থেকে নেমে গেল, ছুটে গিয়ে জাপটে ধরল আবির্ভাবকে।
শক্তিশালী মাদকের নেশায় বুদ হয়ে আছে আবির্ভাব। তবুও ভালোবাসার নারী ব্যতীত অন্য নারীর স্পর্শ সহ্য হলো না আবির্ভাবের। ঝাড়া মেরে দেবীকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দুই পা পিছিয়ে গেলো।
নেশা জড়ানো কন্ঠে হুশিয়ারি দিলো—
“ড-ড-ডোন্ট টাচ মি।”
দেবী অবাক হলো না। আবারো কাছে এসে আবির্ভাবকে ঝাপটে ধরল। ঈশৎ ক্রোধ প্রকাশ করে বললো—
“সব সময় জেদ করবেন না আবির্ভাব। আপনি নিজের মধ্যে নেই।”
আবির্ভাব পুনরায় দেবীর হাত ছড়িয়ে দিলো। অস্ফুট কন্ঠে বিরবিরালো—
“একদম ছুঁইও না আমায়। আমাকে ছোঁয়ার অধিকার কারো নেই, কারো না।”
বলে দূরে সরতে নিলেই বিছানার হীরে ধাক্কা খেয়ে ধপাশ করে উল্টে পড়লো।
আবির্ভাবের এই নিত্য অবহেলায় ভীষণ খারাপ লাগলো দেবীর। এই মানুষটা সব সময় এমন করে নেশায় ডুবে থাকে। তবুও একটু স্পর্শ করতে দিচ্ছে না, যাতে মাতাল তালে ঠিক!
দেবী এসব বাধা-নিষেধ শুনলো না। বিছানায় উঠে বসে আবির্ভাবের শার্টের বোতাম খুলতে লাগলো। কঠোর কন্ঠে বিরক্তি প্রকাশ করে বললো—
“একদম গায়ের জোর দেখাবেন না আবির্ভাব। আমি আপনার বিবাহিত স্ত্রী। আপনাকে স্পর্শ করার আমার সব রকম অধিকার রয়েছে।”
একটা বোতাম খুলতেই আবির্ভাব দেবীর হাত চেপে ধরে আটকে দিলো। রাগান্বিত কন্ঠে বললো—
“বললাম না, ছুঁইও না আমায়। আমাকে আমার মতো ছেড়ে দাও। তুমি এখানে শুয়ে পড়ো, আমি কাউচে শুয়ে পড়ছি।”
বলে গায়ের সবটুকু জোর লাগিয়ে উঠে বসলো আবির্ভাব।
দেবী কিছু বলতে নিলে হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দিলো। কঠিন নিষেধাজ্ঞা জারি করে বললো—
“কোনো অবস্থাতেই আমায় ছুঁইও না। আমি এখনো প্রস্তুত নই তোমাকে গ্রহণ করতে। তাই আমি না বলা পর্যন্ত আমায় টাচ কোরো না।”
বলে টলমলে পায়ে কাউচে গিয়ে শুয়ে পড়লো আবির্ভাব। সে বেশি কথা বাড়াতে চায় না।
দেবী ভীষণ অপমানিত বোধ করলো। বিয়ের এতগুলো দিন হয়ে গেছে, সে কী কখনো আবির্ভাবকে কোন কিছু নিয়ে জোড়াজড়ি করেছে? নাকি আবির্ভাবের মতের বিরুদ্ধে কিছু করেছে? তাহলে এই মানুষটা এমন কেন!
সুমিষ্ট আযানের ধ্বনিতে ঘুম ছুটে যায় প্রিয়তার।
পাশ বালিশ জড়িয়ে ধরে ফের চোখ বুজে খুব কাছে পিঠের কোনো মসজিদ থেকে সুস্পষ্ট আযানের ধ্বনি এসে কানে লাগছে।
প্রিয়তা ২ মিনিট চোখ বুজে পরে থাকে। অলসতা তাকে ঘিরে ধরেছে। কিন্তু ফজরের নামাজ আদায়ের তাড়নায় আরামোরা ভেঙে উঠে বসে। পাশ বালিশটা বুকে আঁকড়ে চোখ বন্ধ করে ঝিম মেরে পড়ে থাকে কিছুক্ষণ। অন্ধকারে হাতের তালু কেমন চুলকাচ্ছে, টান টান অনুভূত হচ্ছে।
কয়েক মুহূর্ত পর আলস্য ছেড়ে বিছানার মায়া ত্যাগ করল প্রিয়তা। লম্বা চুল গুলো হাত দিয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ঢিলে খোঁপা করে ঘরের সব লাইট জ্বালিয়ে দিলো। ঘুমের রেশ এখনো কাটেনি পুরোপুরি। তাই দুই হাতে চোখ ঢলে অজু করার উদ্দেশ্যে পিছন ফিরে থাকতেই চোখ চানাবড়া হয়ে গেলো প্রিয়তার। অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইল বিছানার দিকে।
সাদা বিছানার এক সাইডে ২০-২৫ টা শপিং ব্যাগ পড়ে আছে।
ব্যাগগুলো দেখে ভীষণ অবাক হলো প্রিয়তা।
মাথা চুলকে ভাবলো— “এগুলো এখানে এলো কিভাবে? ঘুমানোর সময় তো এসব দেখি নি।”
প্রিয়তা ভাবনা ছেড়ে এগিয়ে গেলো শপিং ব্যাগগুলোর কাছে। বিছানায় বসে একটা ব্যাগের দিকে হাত বাড়াতেই পুনরায় থমকে গেল প্রিয়তা। আচানক নজর পড়লো নিজের হাতের দিকে।
এবার যেন বিস্ময়ের অন্ত রইলো না প্রিয়তার। সে চোখ বড় বড় করে নিজের হাত দুটো চোখের সামনে মেলে ধরলো।
ফর্সা হাতের চামড়ায় অকল্পনীয় সৌন্দর্যে ফুটে উঠেছে টকটকে গাঢ় লাল রঙা মেহেদি।
প্রিয়তা হতবাক চোখে দেখলো নিজের হাতের পরিবর্তন। ঘুমানোর সময় ও তো সাদা ফকফকে ছিল, অথচ এখন হাত দুটোতে এত সুন্দর রঙ এসেছে যা অকল্পনীয়।
কারো কারো মেহেদির রঙ গাঢ় হতে হতে কুচকুচে কালো হয়ে যায়, দেখতে ভালো লাগে না। কিন্তু প্রিয়তার হাতের রঙে যেন রক্ত মেশানো।
প্রিয়তা হাত দুটো নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রাণ নিলো। হালকা অর্গানিক মেহেদির স্মেল আসছে।
“কিন্তু এগুলো পরালো কে?”
কিছু একটা আন্দাজ করে প্রিয়তার শরীরের পশম দাড়িয়ে গেলো। চোখ মুখে খেলে গেল লাজুক হাসি। রক্তিম ঠোঁট দুটো অস্ফুটে উচ্চারণ করলো— “প্রণয় ভাই…”
কিন্তু প্রণয় ভাবতেই প্রিয়তার মুখ মলিন হয়ে যায়। মন খারাপের কালো মেঘে ঢেকে যায় হৃদয় অঙ্গীনা। মন বলে— “আর যেই হোক, প্রণয় নয়। উনি কখনোই আসবেন না।”
আবার মনে হয়— “এই বাড়িতে এত যত্ন নেয়ার, এতো ভালোবাসা দেখানোর কেইবা আছে?”
ভাবনা চিন্তার দোলাচলে হারিয়ে যায় প্রিয়তা। কয়েক মুহূর্ত পর ভাবনা চিন্তা ছেড়ে বসা থেকে উঠে ওয়াশরুমে চলে যায়।
অজু করে এসে নামাজ আদায় করে নেয়।
মুনাজাত শেষে জায়নামাজ গুছিয়ে রেখে জানালার মুঠামুঠা পর্দাগুলো সরিয়ে দেয়। বাইরে এখনো নিকষ কালো অন্ধকার।
প্রিয়তা ফের বিছানায় এসে বসলো। একে একে শপিং ব্যাগগুলো খুলে দেখলো। প্রথম ৫ টা শপিং ব্যাগে ৫ টা ভিন্ন ভিন্ন ডিজাইনের পাকিস্তানি থ্রি পিস।
পরের ৫ টা ব্যাগে ৫ টা ডিজাইনার শাড়ি। প্রত্যেকটাই অত্যন্ত নিখুঁত ও সুন্দর, দেখেই বোঝা যাচ্ছে কেউ হয়তো খুব যত্ন নিয়ে বেছে বেছে কিনেছে।
পরের ৫ টা ব্যাগে ৫ টা ড্রেসের সাথে ম্যাচিং ৫ জোড়া জুতা। প্রত্যেকটাই প্রিয়তার পায়ের মাপে মাপে।
পরে ৫ টা ব্যাগে সবগুলো ড্রেসের সাথে মেচিং করা ২ ডজন ২ ডজন চুড়ি, ইয়ারিং, পেনডেন্ট, ঝুমকা, ফিঙ্গার রিং, টিপ।
এতোকিছু দেখে প্রিয়তা তো পুরাই সকড। সে কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখবে আর কোনটা ছেড়ে কোনটা পরবে ভেবে কঠিন কনফিউশনে ভুগে মরে যাচ্ছে মেয়েটা। একেকটা জিনিসই তার পছন্দ হয়েছে বলে ভুল হবে— খুব পছন্দ হয়েছে।
প্রিয়তার এবার আর কোনো সন্দেহ নেই এগুলো কার পক্ষ থেকে এসেছে।
প্রিয়তা ভীষণ খুশি হলো। পাকিস্তানি ড্রেসগুলোর মধ্য থেকে একটা হোয়াইট ড্রেস হাতে উঠিয়ে নিলো। সাথে সাথেই কাপড়ের ভাজ থেকে একটা নীল চিরকুট খুলে পড়লো প্রিয়তার চোখের সামনে।
প্রিয়তা কৌতুহল নিয়ে সেটা তুলে দেখলো।
নীল কাগজটার ভাঁজে গুটি গুটি ইংলিশ অক্ষরে লেখা— a small gift for my princess।
কাগজটা প্রিন্ট করা, তাই হাতের লেখা চিনতে পারলো না প্রিয়তা। তাতে কি! প্রিয়তা তো যা বুঝার বুঝে গেছে। কারণ মানুষটা মুখে যতই অস্বীকার করুক, সে তো জানে তাকে এতো ভালোবাসা দেখানোর মানুষ শুধু এই বাড়িতে কেন, এই ত্রিভুবনে আর কেউ নেই।
প্রিয়তা প্রত্যেক জিনিস সযত্নে নিজের আলমারিতে তুলে রাখলো।
সাদা ড্রেসটার দিকে তাকিয়ে একটা বাঁকা হাসি দিয়ে বললো— “ভালো তো, তুমি আমাকে ঠিকই ভালোবাসো চাঁন্দু। শুধু শিকার করতে চাও না। ওকে, কোনো ব্যাপার না। এখন থেকে তোমাকে সব কিছু স্বীকার করানোর গুরুদায়িত্ব আমার। তোমাকে এমন জ্বলাবো, এমন জ্বলাবো যে তুমি বাধ্য হবে।”
প্রিয়তা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে মনে মনে একটা মোক্ষম প্ল্যান কষে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো।
মিনিট কুড়ি পর লম্বা শাওয়ার নিয়ে বের হলো প্রিয়তা। শুভ্র রঙা অঙ্গে জড়ানো শুভ্র ড্রেসটাতে প্রিয়তাকে সত্যি প্রিন্সেস লাগছে।
উজ্জ্বল গৌর বর্ণ শরীরের সাথে সাদা ড্রেসটা মিলে মিশে একাকার। প্রিয়তা টাওয়াল দিয়ে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। ভোর প্রায় হয়ে এসেছে, চারপাশে আলো ফুটছে একটু একটু।
প্রিয়তা বারান্দার রেলিং এ হাত রেখে সামনে দৃষ্টি পাত করতেই সকাল সকাল চমৎকার এক দৃশ্যে তার মন ভালো হয়ে গেল।
প্রিয়তার বারান্দার নিচে থেকে কিছুটা সামনে শিকদার বাড়ির ৪০০ বছর পুরাতন রক্ত পদ্ম পুকুর। যার কালচে জলে লাফিয়ে লাফিয়ে পড়ছে বাচ্চারা।
বাচ্চাদের আনন্দ উল্লাস, খিলখিলে হাসির প্রানোউচ্ছল ধ্বনি আর পানির কলকল শব্দে মনে হচ্ছে সত্যি আজ ঈদের দিন।
অরণ্য, সমুদ্র, তন্ময়, রাদিফ, সাদিফ সবাইকে পানিতে ঝাঁপাঝাঁপি করতে দেখে উচ্ছ্বাসিত হয় অবনী। মামাদের সাথে পানিতে নামার বায়না ধরে বসে।
অভিরাজের হাত ঝাকিয়ে বলে— “বাইয়া আমিও যাবো।” বলে হামাগুড়ি দিয়ে যেতে নিলে।
খপ করে অবনীর ছোট্ট ছোট্ট দুই হাত ঝাঁপটে ধরলো অভিরাজ। ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে বললো— “একদম নলবি না। ওকানে পড়লে একদম ডুবে যাবি। ওটা শুনেছি অনেক গভীর।”
অবনী নাছোড়বান্দা। নাক মুখ ফুলিয়ে বলে— “না, আমি যাবো। ছাড়ো আমায় মামুুুুউউ।” বলে তন্ময়কে ডাক দিলো অবনী।
তন্ময় অরণ্যের সাথে মাঝ পুকুরে সাঁতারের রেস করছে।
অরণ্য তন্ময় মুখের উপর একটা বিরাট অফার ছুঁড়ে দিয়ে বলে— “পার্টনার, আজ যদি আমাকে হারাতে পারিস তবে আমার গার্লফ্রেন্ড নম্বর ৫৭৫কে তোকে গিফট করবো যাহ।”
তন্ময় ভ্রু বাঁকিয়ে বললো— “ভেবে বলছো?”
অরণ্য বাঁকা হেসে জবাব দিলো— “হান্ডেট পার্সেন্ট। অরণ্য শিকদার কখনো ফাঁকা আওয়াজ দেয় না।”
তন্ময়ও বাঁকা হেসে দুই ভাই হাত মিলালো। যার অর্থ ডিল ডান। শুরু হলো আবার তাদের প্রতিযোগিতা। পানির শব্দে তন্ময় শুনতেই পেলো না অবনীর ডাক।
অবনীর এবার কান্না পাচ্ছে।
অভিরাজ অবনীর গাল দুটো ধরে শিশুসুলভ ভঙ্গিতে বললো— “কাঁদিস না লচ্চগুল্লা। বল, তোর কী চাই?”
অবনী জল জলে চোখে তাকিয়ে একটা লাল পদ্মের দিকে ইশারা করলো। অভিরাজ মিষ্টি হাসলো।
একটু এগিয়ে পারের দিক থেকে একটা লাল পদ্ম তুলে অবনীর হাতে দিলো। সাথে সাথেই খিলখিল করে হেসে উঠলো অবনী। অভিরাজও খুশি হলো।
শিকদার বাড়ির পদ্ম পুর ২০ ফিট গভীর। তাই খুব সাবধানে ঝাঁপাঝাঁপি করছে সবাই। পানির কলরবে চার পাশ তুমুল শব্দে মুখরিত হচ্ছে, যা হয়তো বা বাড়ির সামনে থেকেও শোনা যাচ্ছে।
প্রেম আর প্রীথমও এসে যুগ দিলো সবার সাথে।
প্রেম চিৎকার দিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বললো— “একটু আস্তে ঝাঁপাও ভাই তোমরা। এইবার বাড়িতে বাঘ সিংহ সহ আরো অনেকেই আছে। একবার চলে এলে চাপকে পিঠের ছাল তুলে নেবে।”
সবাই শুনলো কিন্তু নিজেদের আনন্দ দমাতে পারলো না।
ওতপর প্রেমের কথাই সত্যি হলো। আরো দুই এক মিনিট যাওয়ার পূর্বে বিরাট এক হুংকারে সবার আত্মাকেঁপে উঠলো— “কী হচ্ছে এখানে?”
যারা পুকুরের মাঝে ছিলো, সবাই এক নিশ্বাসে সাঁতার কেটে পাড়ে আসলো। ভয়ে সকলের হৃৎপিণ্ড লাফাচ্ছে।
“তোমরা জানো না এই পুকুরটা কত গভীর? কত বিষাক্ত সাপ খুপের বাস এখানে? তার পরও লাফাকাফি করছো?”
সকলেই মাথা নিচু করে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলো। বড় দাদানের ক্রুদ্ধানিত মুখের দিকে তাকানোর সাহস হচ্ছে না কারো।
প্রণয়ের কণ্ঠ শুনেই অরণ্য ও তন্ময় তৎক্ষণাৎ পানির নিচে ডুব দিয়েছিল। তাই আস্তে করে তারা চুপি চুপি পাড়ে উঠে কেটে পড়লো।
প্রণয় সন্তুষ্ট কণ্ঠে সবাইকে বিশাল জুড়ে ধমকে উঠে বললো— “কি ব্যাপার? এখনো সং-এর মতো দাঁড়িয়ে আছো কেনো? লিভ।”
সকলে তাই শুনে ভদ্র বাচ্চাদের মতো বিনা বাক্যে চুপচাপ উঠে বাড়ির ভিতরে চলে গেলো।
আজকে প্রণয়কে একদম অন্য রকম স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। হাতে ঘড়ি, গায়ে শুভ্র রঙা পাঞ্জাবি, দেখলেই মন প্রাণ জুড়িয়ে যায়। প্রিয়তারও তাই হলো। সে মনযোগ দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অসম্ভব সুন্দর এই পুরুষটাকে দেখতে চাইলো। কিন্তু বিধিবাম, প্রণয় তার ভাবনায় এক বালতি ঠান্ডা পানি ঢেলে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলো।
হতাশ হলো প্রিয়তা। নিচের ঠোঁট দিয়ে উপরে ফু দিয়ে বললো— “বাহ বাহ, কী ঝাল পুলার! তোমাকে থার্ড ডিগ্রি দিয়ে যদি আমি সোজা করতে না পেরেছি তবে আমার নামও তনয়া শিকদার প্রিয়তা নয়, হুউহ।” বলে মুখ বাঁকিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলো প্রিয়তা।
হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে সযত্নে ভেজা চুলগুলো শুকিয়ে নিলো। চুলের মাঝ বরাবর শিঁতি করে লম্বা চুলগুলো উন্মুক্ত ছেড়ে রাখলো পিঠের উপর। সমুদ্রনীল চোখে চিকন কাজলের রেখা টানলো।
ঠোঁটে মানানসই পিঙ্ক লিপস্টিক দিয়ে কপালে ছোট্ট একটা পাথরের টিপ পরলো।
ড্রেসিং টেবিলের নিচের ড্রয়ার খুলে বিরাট একটা ঝুমকার বক্স বের করলো। সেটা ঘেঁটে ঘুঁটে জামার সাথে ম্যাচিং এক জোড়া বড় বড় ঝুমকা বের করে কানে পরে নিলো।
ড্রেসের সাথে পাওয়া ম্যাচিং চুড়ি থেকে এক মুঠো ভর্তি সাদা রংয়ের চুড়ি দুই হাতে সমান ভাবে পরে নিলো।
ফাইনালি সব সাজগোজ শেষ করে সাদা ওড়নাটা কাঁধের এক সাইডে ফেলে রাখলো প্রিয়তা। এবার পুর্ণ মনোযোগ তাকালো ড্রেসিং টেবিলের আয়নায়।
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো নিজের প্রতিবিম্ব। খুঁত খুঁজে বার করার চেষ্টা করলো। কিন্তু আশ্চর্য! চোখ, মুখ, নাক, ঠোঁট, ত্বক— সব কিছুই যেন অধিক মাত্রার পারফেক্ট। কোনো খুঁতই নজরে আসলো না প্রিয়তার।
প্রিয়তা হতবাক হয়ে বললো— “সব যদি ঠিকঠাক থাকে, তাহলে শিকদার বাড়ির বড় ছেলে কেনো আমার প্রেমে পড়লো না? বেটার কি চোখ নষ্ট, নাকি রুচি খারাপ? নাকি আমি ছোট বলে আমায় তখন পাত্তা দিতে চায়নি?”
কিন্তু প্রিয়তা মন সন্তুষ্ট হওয়ার মতো কোনো মানানসই উত্তর খুঁজে পেলো না। যাই হোক, সে আর অযথা ভাবলো না। নিজের ফোনটা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
মিষ্টি সকালে পাখির কিচির মিচির রব, কোকিলের কুহুতান, থেকে থেকে বয়ে চলা ধমকা হাওয়া—সব মিলিয়ে এক নৈসর্গিক পরিবেশ। দক্ষিণের মৃদু বাতাসে দুলে উঠছে তিন তলার ছাদবাগানের ফুল-ফলের গাছগুলো। রেলিং দেয়ালে বসে আছে ঝাঁকে ঝাঁকে কবুতর। প্রিয়তার মন জুড়িয়ে গেল এত সুন্দর দৃশ্যে। সে চপল পায়ে এগিয়ে গেল, চাঁদের মাঝ বরাবর কয়েক মিনিট ঘুরে ঘুরে সকালের সৌন্দর্য উপভোগ করলো। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেল সেই ঘরের সামনে। আজকেও সেই ঘরের দরজা খোলা।
প্রিয়তার মনে পড়ে গেল ৪ বছর আগের সেই রাতের কথা। প্রিয়তা বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই মনে মনে উনিশ-বিশ কিছু একটা ভাবলো। তার মাথায় একটা বিশাল মতলব উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছে। সে চোরের মতো আশেপাশে নজর বুলিয়ে আলতো করে হাত ছুঁয়ালো ঘরের দরজায়। সাথে সাথেই সাবেক আমলের কাঠের দরজা শব্দহীনভাবে খুলে গেল।
প্রিয়তার কলিজাটা ভয়ে কেমন ধুকপুক করছে। এমন বাদরামি করে সে অভ্যস্ত নয়। শুষ্ক ঢোক গিলে চুপি চুপি ঘরের মেঝেতে এক পা রাখতেই আকস্মিক ধড়াম করে কারো প্রশস্ত বুকে বাড়ি খেলো। ভয়ে লাফিয়ে উঠলো প্রিয়তা। ধরা পড়ে গেছে ভেবে আতঙ্কে জমে গেল। চোখ-মুখ খিঁচে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে রইলো। খুব কাছ থেকে নাকে এসে ঠেকলো আতরের মিষ্টি একটা ঘ্রাণ।
প্রণয় চোখ ছোট ছোট করে প্রিয়তার মাথা থেকে পা অবধি দৃষ্টি বুলালো। উন্মুক্ত খোলা চুলের রমণীর এক দর্শনে প্রণয়ের হৃদয় উথালপাথাল শুরু হয়ে গেল। ভীতু হরিণীর রক্তিম ঠোঁট, লালচে গাল, থিরথির করে কাঁপতে থাকা কালো কুচকুচে চোখের পাতা—সবই যেন তাকে ভীষণভাবে দুর্বল করে দিল। হৃদয়হরণীর সৌন্দর্যে মোহাবিষ্ট প্রণয়ের বুকের ভিতরের ছোট্ট হৃদপিণ্ডটা গুনগুন করে উঠলো।
“তোমায় দেখতে দেখতে আমি
যেন অন্ধ হয়ে যাই।
দুনিয়াতে তুমি ছাড়া
কিছু দেখার তো আর নাই।
তোমার ভালোবাসা ছাড়া
কোনো কিছু এ মন চায় না।”
প্রিয়তা বহুক্ষণ একভাবে থাকার পরও আশানুরূপ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখতে পেল না। তখন ধীরে ধীরে সামনে তাকালো। দৃশ্যপটে উদ্ভাসিত হলো কারো প্রসস্থ বুক। ঢোক গিললো প্রিয়তা। ঝট করে চোখ উঠিয়ে উপরে তাকাতেই বুকের ভেতর মুচড় দিয়ে উঠলো। ক্ষণিকের ব্যবধানে মিলিত হলো দুই জোড়া তৃষ্ণার্থ চোখ। যে চোখের পিপাসায় হাজার বছরের বরফজমা পাহাড়ও গলে পানি হয়ে যায়।
অজানা কোনো চুম্বকীয় আকর্ষণে স্থির হয়ে গেল প্রিয়তা। চোখ ফিরাতে পারলো না সেই পুরুষের থেকে। সামান্য সাদা পাঞ্জাবিতেও কাউকে এত সুন্দর লাগতে পারে!
“এতো সেজেছিস কেনো?”
গম্ভীর পুরুষালি কণ্ঠে নির্গত বাক্যে প্রিয়তার ঘোর কেটে গেল। সে দৃষ্টি নত করলো। তথক্ষণাত পুনরায় একই কণ্ঠ ভেসে এলো।
প্রণয় সন্ধিহান কণ্ঠে বললো,
“চোরের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে, পা টিপে টিপে আমার ঘরে ঢুকার পাঁয়তারা করছিলি কেনো? কী মতলব?”
বেকায়দায় ধরা পড়ে হাত কচলাতে লাগলো প্রিয়তা। অস্থির দৃষ্টি ফেলছে এদিক-ওদিক।
এতো সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে! এই যে ঘাবড়ে যাওয়া ভীত চেহারায়ও খুন হয়ে যাচ্ছে প্রণয়।
আজকের দিনে মেয়েটার মনে আঘাত দিতে ইচ্ছে করলো না প্রণয়ের। তাই এই বিষয়ে আর কথা বাড়ালো না।
প্রিয়তাকে মন ভরে কিছুক্ষণ দেখলো। ঠোঁট কামড়ে হেসে বললো,
“সুন্দর লাগছে।”
কেঁপে উঠলো প্রিয়তা। চমকে তাকালো প্রণয়ের দিকে। হঠাৎ করেই লজ্জারা এসে তাকে ঘিরে ধরলো। রক্তিম গাল দুটোতে গোলাপী আভার দেখা মিলল। প্রিয়তা নিজের লজ্জা সামলে প্রণয়ের পা ছুঁয়ে সালাম করলো।
মৃদু হাসলো প্রণয়। সালামের প্রত্যুত্তরে প্রিয়তার মাথায় হাত রেখে দোয়া করলো,
“জীবনে অনেক সুখী হও।”
মুখ কুঁচকালো প্রিয়তা। কেবল দোয়াতে সন্তুষ্ট হলো না সে। প্রণয়ের মুখের সামনে হাত পেতে বললো,
“শুকনো দোয়াতে চিঁড়ে ভিজবে না।”
প্রণয় ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। পাঞ্জাবির পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে পুরো ওয়ালেটটাই প্রিয়তার হাতে তুলে দিল। বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে ফেললো প্রিয়তা। মুখ হা করে তাকিয়ে রইলো নিজের হাতের মুঠোয় থাকা ওয়ালেটটার দিকে।
প্রণয় মুচকি হেসে ওর গাল টেনে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। গালে হাত দিয়ে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে রইলো প্রিয়তা। নিজের মধ্যে কেমন ফিলিংস কাজ করছে তা বোঝানোর মতো নয়। তবে এটা আজ প্রথমবার ঘটলো না। ছোটবেলা থেকেই প্রিয়তার ঈদ সালামী ছিল প্রণয়ের পুরো ওয়ালেট।
প্রিয়তা নিজেকে সামলে প্রণয়ের বিছানার উপর গিয়ে পা তুলে বসলো। ওয়ালেটের ভাঁজ খুলে ভেতরে তাকাতেই বিস্ময়ে তার চোখ গুলগুল হয়ে গেল।
ওয়ালেটের ভেতর চকচকে ৩টা ৫০০ টাকার বান্ডিল, প্রত্যেকটা বান্ডিলেই নতুন নোট। প্রিয়তা টাকাগুলো বের করে দেখলো। ওয়ালেটের এক কোণায় ৫ টাকার দুটো কয়েন পড়ে আছে। প্রিয়তা ওয়ালেটের প্রথম সাইড ওপেন করে দেখলো—ওখানে ৩টা কার্ড আর একটা ড্রাইভিং লাইসেন্স। অপর সাইডে তাকিয়ে দেখলো ছুট্টো একটা পাসপোর্ট সাইজ ফটো, যেটা প্রিয়তা চেনে।
ছবিটা বের করে হাতে নিলো প্রিয়তা। ভীষণ পুরনো একটা ছবি। ১–১.৫ বছরের একটা বাচ্চা নিজের উরুতে হাত রেখে চোখ গুলগুল করে সামনে তাকিয়ে আছে। প্রিয়তার চোখে পানি চিকচিক করছে।
এতো কিছুর পরেও মানতে হবে যে এই মানুষটা তাকে একটুও ভালোবাসেনি?
“আপনি এতো রহস্যময় কেনো, প্রণয় ভাই? আমি কেনো আপনাকে বুঝতে পারি না? আমি কেনো আপনার ভালোবাসার ধরন চিনতে পারি না?”
শিকদার বাড়ির ডাইনিং টেবিলে ট্রে ভর্তি বাটি বাটি জর্দা, সেমাই সহ বিভিন্ন স্বাদের মিষ্টান্ন সাজিয়ে রাখা, আর তার পাশে পাশে পিপড়ের মতো ঘুরঘুর করছে থোরি, তন্ময়, অভিরাজ, অবনি।
এই সকল পদের মিষ্টি জাতীয় রান্না প্রিয়তা একা হাতে করেছে।
একটু পরেই বাড়ির পুরুষরা সব ঈদের নামাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়বে, বাড়ির অন্য সকলে গোসল শেষে নতুন জামা পড়ে একে একে এসে ড্রয়িং রুমে হাজির হচ্ছেন।
ভাবি।
প্রিয়তা তখনও রান্নাঘরে কিছু একটা করছিল কিন্তু শ্বেতার ডাকে হাত স্থির হলো, পিছন ফিরে চাইলো শ্বেতার পানে।
সাথে সাথেই মুগ্ধতা ভর করলো প্রিয়তার চোখে।
গর্জিয়াস মেরুন থ্রি পিসের সাথে কোমর ছড়ানো খোলা চুল, ঠোঁটে ডার্ক মারুন লিপস্টিক, কানে বড় বড় ঝুমকা আর হাত ভর্তি মেরুন চুড়ি।
ব্যাস! এতেই যেন পরী লাগছে। এতটাই দৃষ্টিনন্দনীয় যে সেই সৌন্দর্য বিশ্লেষণের ভাষা খুঁজে পেল না প্রিয়তা। কিন্তু এটা বেশ বুঝলো, রূপ মানেই সুখ নয়, ভয়াবহ অসুখ।
কিছু মেয়েদের চরম সর্বনাশের নেপথ্যে একটা জিনিসই থাকে—মাত্রাতিরিক্ত রূপ। আর তাদের মধ্যে একজন শ্বেতা।
শ্বেতা “ভাবি ভাবি” বলে হাস্যজ্জ্বল মুখে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো প্রিয়তাকে। প্রিয়তার দুই গাল টেনে টেনে আদর করে বললো—
“হায় আল্লাহ, তোমার এই রূপে আমি তো ঝলসে যাচ্ছি। তাহলে আমার নাদান ভাইটার কী হবে? হায় মাবুদ, আমার ভাই বুঝি আর আমার রইল না।”
শ্বেতা ভীষণ হেসে হেসে কথা বলছে, কিন্তু এই হাসি দেখেই প্রিয়তার বুকের ভিতর মুচড় দিচ্ছে। এই হাসির ধরন যে তার খুব চেনা।
প্রিয়তা ও হাসার চেষ্টা করলো। শ্বেতার প্রশংসা করে বললো—
“তুমকেও খুব সুন্দর লাগছে ননদিনী। কাশ যদি আমার আরেকটা ভাই থাকতো তাহলে তুমকেও আমার ভাবি বানিয়ে নিতাম।”
“ভাই নাই বলছো কেনো আপু, আমি তো আছি। একদম পিওর সিঙ্গল। তুমি যদি বলো তো এই গুরু দায়িত্ব আমি নিজের কাঁধে তুলে নেবো। বোনের খুশিতে করবো আত্ম বলিদান, তোমার খুশির জন্য এই বান্দর জান ও কুরবান।”
বলে স্টাইল মেরে এসে শ্বেতার পাশে দাঁড়ালো তন্ময়। মুখে লজ্জা লজ্জা ভাব ফুটিয়ে তুলে বললো—
“দেখো তো আপু, আমাদের পাশাপাশি কেমন মানিয়েছে।”
তন্ময়ের এমন বিচিত্র কথায় তাজ্জব বনে গেল শ্বেতা ও প্রিয়তা।
তন্ময় হাতের আঙুল দিয়ে মাথার চুল ব্যাকব্রাশ করে বললো—
“একটু হাইট ইস্যু আছে, কিন্তু ওটা কোন ব্যাপার না। ১-২ বছরের মধ্যেই ফিক্স হয়ে যাবে। তখন আমাদের কেই সেরা কাপল লাগবে। কী বলো সেতু রানী?”
প্রিয়তার মুখ হাঁ করে থাকিয়ে আছে তন্ময়ের দিকে।
“হাঁ বন্ধ করো প্রিয়ো আপু। এতো বড় হাঁ করে বসে থাকলে মুখ দিয়ে মশা, মাছি, বদলে, গন্ডার, জলহস্তী সব একসঙ্গে ঢুকবে।”
তন্ময়ের কথায় ফট করে মুখ বন্ধ করে নিলো প্রিয়তা।
শ্বেতা চোখ সরু করে তন্ময়ের কান টেনে ধরলো। ভ্রু নাচিয়ে বললো—
“বেশি পেকেছো তুমি। এক দুই বছরের মধ্যেই সব ফিক্স হয়ে যাবে, তাই না?”
তন্ময় চিৎকার দিয়ে কান ছাড়িয়ে নিলো—
“আহ লাগছে আপু।”
প্রিয়তা ওর বদমাইশি পাত্তা না দিয়ে ওর হাতে একটা সেমাইয়ের বাটি দিয়ে বললো—
“যা, সবাইকে ডেকে নিয়ে আয়।”
তন্ময় এক চামচ সেমাই মুখে দিয়ে চামচ নাড়িয়ে নাড়িয়ে উপদেশ দেওয়ার ভঙ্গিতে বললো—
“দেখো, এতো ভাব নেওয়ার কিছু নেই গার্লস। আমার গার্লফ্রেন্ড সাদিয়ের চোখ তোমাদের থেকেও বেশি সুন্দর। আমার গার্লফ্রেন্ড মাইশার ঠোঁট আহা, তোমরা তো পাত্তাই পাবে না। আমার গার্লফ্রেন্ড তিশার চুল আহা, যেনো ঘন কালো মেঘ। আমার গার্লফ্রেন্ড আনিকার কণ্ঠস্বর আহা, যেনো চিকন বাঁশি।”
“তাই বুঝি? তাহলে তোকে ধরে সবার সাথে বিয়ে দিয়ে দেই, কী বলিস?”
পরিচিত ভারী কণ্ঠে পিলে চমকে উঠলো তন্ময়। ছোট্ট মুখের রক্ত উড়ে গেল ভয়ে। আতঙ্কিত মুখে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো।
সিঁড়ি বেয়ে নামছে প্রণয়। মাথায় টুপি, গায়ে সাদা পাঞ্জাবি, কাঁধে শাল, হয়তো নামাজে যাবে।
প্রণয়কে দেখে তন্ময়ের সকল কনফিডেন্স জাস্ট উবে গেল। সে ভয়ার্ত চোখে তাকালো প্রিয়তার দিকে। যেন ওই ভীত সন্ত্রস্ত চোখ দুটো বলছে—
“এবারের মতো বাঁচিয়ে নে আপু, এমন পিছন পাকানো আর কখনো করবো না।”
কিন্তু প্রিয়তা অসহ মায়াময় দৃষ্টিকে পাত্তা দিলো না। সে থতকে আছে সাদা টুপি-পাঞ্জাবি পরিহিত পুরুষের পাক-পবিত্র মুখের পানে।
প্রণয় পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো তন্ময়ের সামনে।
ভ্রু নাচিয়ে বললো—
“কী রে, বল, বিয়ে দিয়ে দেই সবগুলোর সাথে?”
অরণ্য এদিকেই আসছিলো, কিন্তু তন্ময়কে কঠিন কেস খেতে দেখে উল্টো দিকে মুখ করে দৌড় দিলো।
তন্ময় আমতা আমতা করতে লাগলো। প্রিয়তা চোখের ইশারায় ওকে কিছু বললো। প্রিয়তার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে ফট করে প্রণয়কে সালাম করলো তন্ময়।
ঢোক গিলে বললো—
“ওগুলো ছেলের নাম নাকি মেয়ের নাম, আমি তাই জানি না বড় দাদান। বিশ্বাস করো, সত্যি বলছি।”
“সত্যি জানিস না?”
তন্ময় তৎক্ষণাৎ উপর নিচ মাথা ঝাকিয়ে বললো—
“সত্যি জানি না।”
“তাহলে যে বললি ওগুলো তোর গার্লফ্রেন্ড?”
“ম-ম মুখ পিছলে বেরিয়ে গেছে।”
প্রণয় আরো কিছু জেরা করার পূর্বে প্রণয়ের সামনে সেমাইয়ের বাটি তুলে ধরলো প্রিয়তা।
হালকা তেজি কণ্ঠে বললো—
“ছোট ভাইকে সালামি না দিয়ে এমন ভাবে জেরা করছেন! মনে হচ্ছে এখনই ওকে রিমান্ডে নিবেন।”
প্রণয় তন্ময়ের দিক থেকে চোখ সরিয়ে প্রিয়তার দিকে তাকালো, তবে প্রিয়তার কথার জবাব দিলো না।
ইতিমধ্যে সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছে পৃথম, প্রেম রাজ, অরণ্য, সমুদ্র, সদামান সিখদার, খালিদ সিখদার, সাজিদ সিখদার, সোহেব সিখদার।
পৃথমরা সবাই এসে একে একে বড় ভাইকে সালাম করলো।
অরণ্য নির্লজ্জের মতো হাত পেতে বললো—
“সালামি না নিয়ে কিন্তু যাবো না দাদান। গত ৪ বছর তোমার কাছ থেকে এক টাকাও সালামি পাই নাই।”
অরণ্যের তালে তাল মেলালো প্রেম রাজ, প্রিথম, সমুদ্র, তন্ময় সবাই।
প্রণয় সবার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকালো—
“এই বুড়ো বয়সে তোরা সালামি চাইছিস? লজ্জা লাগছে না বলতে?”
ওরা সবাই একসাথে না-বোধক মাথা ঝাকালো।
প্রণয় কথা বাড়ালো না। পাঞ্জাবির পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে তন্ময়, অরণ্য, সমুদ্র সহ আধা-বুড়া বাচ্চার বাপ সব ভাইদের ১০ হাজার ১০ হাজার করে সালামি দিলো।
সালামির গন্ধে পিপড়ের মতো গুটি গুটি পায়ে এসে হাজির হলো পৃথা, প্রেরণা, পরিনিতা, থিরা, থোরি।
ওরাও লাইন ধরে বড় দাদানকে সালাম করলো। প্রণয় ওদেরও সমানভাবে সালামি দিলো। এই একদিন তাদের জন্য বিশ্ব ইনকাম দিবস। এই একদিনে বাপ-ভাইদের কাছ থেকে তারা যা কামায়, সারা বছরে এসকে গ্রুপও ওতো কামায় কিনা সন্দেহ।
প্রণয়কে লুটে নেওয়া শেষ হতেই সাদা টুপি-পাঞ্জাবি পড়ে হাজির হলো শুদ্ধ। যথারীতি সকলে শুদ্ধকেও লুটে নিলো।
সবার শেষে প্রিয়তা এসে সালাম করলো শুদ্ধকে। প্রিয়তার এমন শান্ত কুমল স্নিগ্ধ চেহারা দেখে শুদ্ধের প্রাণ জুড়িয়ে গেলো।
প্রিয়তাও যথারীতি শুদ্ধের কাছে সালামি চাইলো।
কিন্তু এতক্ষণে শুদ্ধের ওয়ালেট পুরো ঘড়ের মাঠ।
শুদ্ধ প্রিয়তার নীল নীল চোখের দিকে তাকিয়ে বুকের ভিতর চাপ অনুভব করলো। এই নারীকে দেখলেই তার বুকে ব্যথা হয়।
শুদ্ধ ঠোঁট কামড়ে বুকের চিনচিনে ব্যথা হজম করে নিল। সকলের সামনে প্রিয়তা কানে কানে বললো—
“আমার তরফের সালামিটা নাহয় তুলা রইলো সুইটহার্ট। কোন এক রাতে একসাথে সব শুধে আসলে পুষিয়ে দেবো।”
বলে বাঁকা হেসে চলে গেলো শুদ্ধ।
কিন্তু বেক্কেল বনে দাঁড়িয়ে রইলো প্রিয়তা। শুদ্ধের কথার আঘা মাথা কিছুই বুঝতে পারলো না।
উপস্থিত সকলে ঠোঁটে চাপা হাসি। প্রণয় কোন বাড়তি প্রতিক্রিয়া দেখালো না, নিজেও বেরিয়ে গেলো। বাড়ির কর্তারা চলে গেলেন নামাজের উদ্দেশ্যে।
শ্বেতা প্রিয়তাকে ধাক্কা দিয়ে বললো—
“হাউ রোমান্টিক ভাবি।”
কিন্তু কিছু বলতে পারলো না প্রিয়তা। শ্বেতা ওর হাত চেপে ধরে বললো—
“চলো ভাবি।”
“কোথায়?”
“ছাদে।”
“কেনো?”
“বাহ রে, এতো সুন্দর করে সেজেছি, ছবি তুলবো না?”
“ছবি?”
“হুম।”
“বাদ দাও।”
“চুপচাপ চলো তো ভাবি।”
বলে প্রিয়তাকে টেনে নিয়ে ছাদের দিকে চলে গেলো শ্বেতা।
কাল মাত্র এলার আর এখুনি লাগেজ প্যাক করছো কেন আবির্ভাব।
আবির্ভাবের পেছন পেছন ছুটতে ছুটতে কথা গুলো বলল দেবী।
আবির্ভাব কোনো এক্সপ্রেশন দিলো না, জাস্ট বলল —
“এই বাড়িতে থাকবো না তাই গুছাচ্ছি।”
অবাক হলো দেবী, বিস্মিত কণ্ঠে সুধালো —
“কেন?”
“এমনি।”
“এভাবে এমনি বললে কিভাবে হবে! তুমি তো বললে আমরা বিয়ের নিমন্ত্রণে এসেছি, এই বাড়ির মেয়েদের বিয়ে মিটলে তার পর যাবো।”
“হ্যা বলেছিলাম, কিন্তু এখন আর এ বাড়িতে থাকতে পারবো না আমি।”
“কেন?”
“এমনি।”
“কি এমনি এমনি করছো আবির্ভাব! হুট করে আমরা কোথায় যাবো?”
“আমার ফ্ল্যাটে।”
“তুমি এভাবে চলে গেলে আন্টি মাইন্ড করবেন না?”
আবির্ভাব লাগেজের চেইন আটকে বলল —
“বায়না করো না দেবী, চলো আমার সাথে। এই বাড়িতে আমি আর থাকতে পারবো না, আমার দমবন্ধ লাগছে।”
দেবী আরো বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল —
“কেন?”
আবির্ভাব জবাব না দিয়ে লাগেজ নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো, পেছন পেছন ছুটলো দেবীও।
ড্রইং রুম পার করে ডাইনিং প্লেসে এসে দাঁড়ালো আবির্ভাব। অনুশ্রী বেগম উনার বউমাদের সাথে কথা বলছেন, তিনি আবির্ভাবকে খেয়াল করলেন না।
“আন্টি।”
আবির্ভাবের কণ্ঠে থামলেন অনুশ্রী বেগম, ঘুরে তাকালেন।
আবির্ভাবকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এসে বললেন —
“নাস্তা খেয়েছিস বাবা? আয় তোকে খেতে দেই।”
আবির্ভাব কিছু বলতে পারলো না। অনুশ্রী বেগম আবির্ভাবের পাশে দেবীকে দেখে বললেন —
“তুমি ও আছো আম্মু? আসো, তোমাদের দুজনকেই খেতে দেই।”
বলে চলে যেতে নিলেন। তবে নড়লো না আবির্ভাব, মাথা নিচু করে জবাব দিলো —
“আমি চলে যাচ্ছি আন্টি।”
আবির্ভাবের আকস্মিক কথায় পুনরায় থমকে দাঁড়ালেন অনুশ্রী বেগম। আবির্ভাব উনার কাছে এসে নতমস্তকে বললো
“আমার খুব জরুরি কাজ পড়ে গেছে আন্টি, নাহলে ঠিক থাকতাম।”
অনুশ্রী বেগম আবির্ভাবের দিকে না তাকিয়ে রোহমানকে ডাকলেন —
“রোহমান! রোহমান!”
ছুটে এলো রোহমান, নিচু কন্ঠে বললো —
“জি বড় আম্মা জান।”
“ওদের লাগেজ গুলো নিয়ে ওদের ঘরে দিয়ে আসো।”
“আচ্ছা আম্মাজান।”
বলে আবির্ভাবের লাগেজ নিয়ে চলে গেলো রোহমান। আবির্ভাব কিছু বলতে চাইলে ও শুনলেন না, অনুশ্রী বেগম ওদের জন্য খাবার আনতে চলে গেলেন।
দেবী মিটি মিটি হেসে আবির্ভাবের পাশে এসে দাঁড়ালো, ফিসফিসিয়ে বললো —
“বেশ হয়েছে।”
আবির্ভাব অসহায় মুখে চেয়ে রইলো। সে সবাইকে কিভাবে বুঝাবে এখানে থাকলে বিরাট অঘটন ঘটে যাবে।
ওই রমণীকে বেশিক্ষণ সামনে দেখলে কিছুতেই সে নিজেকে ধরে রাখতে পারবে না। দেখে ও ভালোবাসতে না পারার অভাবে মরণ হয়ে যাবে।
স্বেতা ও প্রিয়তা হাসতে হাসতে একে অপরের গায়ে গড়িয়ে পড়ছে।
সকালে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা আবহাওয়া কেটে একটু বেলা বাড়ার সাথে সাথেই সোনালী রোদের দেখা মিলেছে। শিকদার বাড়ির বিশাল ছাদে সহস্রাধিক কবুতরের সমাহার।
স্বেতা ও প্রিয়তা নিজেদের মধ্যে হাসি ঠাট্টা করতে করতে ছবি তুলছে। ভিন্ন ভিন্ন পোজে ছবি তুলতে তুলতে এতক্ষনে তারা মোটামুটি হাজার দুই এক ছবি তুলে গ্যালারি ভরিয়ে ফেলেছে।
“ভাবি, সানকিসড একটা ছবি তুলবো।”
প্রিয়তা হেসে স্বেতাকে সেই পোজে ছবি উঠিয়ে দিলো।
স্বেতা কবুতরগুলোর দিকে তাকাতেই একটা অন্যরকম আইডিয়া এলো স্বেতার মাথায়। সে প্রিয়তাকে বললো —
“ভাবি, চলো একটা সিনেমাটিক রিলস বানাই। এই বাড়ির ছাদটা বিশাল বড় আর রয়্যাল একটা ব্যাপার আছে, সেই হবে।”
প্রিয়তা ও হেসে সম্মতি জানালো।
স্বেতা ইনস্টাগ্রাম ওপেন করে ভিডিও স্পিড 2x দিয়ে বললো —
“আমি যখন কবুতরের ঝাঁকের দিকে দৌড়ে যাবো, তখন তুমি নিচ থেকে উপরের দিকে ফোকাস করবে।”
“ঠিক আছে।”
স্বেতা দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। “1… 2… 3… রেডি” বলে খয়েরি উর্নার আঁচল উড়িয়ে কবুতরের ঝাঁকের দিকে ছুটে গেলো।
দৌড়ের সাথে সাথে হালকা বাতাসে স্বেতার কোমর ছাড়ানো চুলগুলো লতানো শরীরের সাথে তাল মিলিয়ে দুলতে লাগলো। একসাথে উড়ে গেলো কবুতরের ঝাঁক। স্বেতা দুই হাত মেলে চোখ বন্ধ করে এগিয়ে গেলো সামনে।
তার এই শ্বাসরুদ্ধকর সৌন্দর্যে, চোখের হাসিতে, মুখের ভাঁশাতে সত্যি কোনো এক পুরুষের হৃদযন্ত্র থমকে গেলো। বুকে ভেতরটা ঝলে উঠলো এই নারীকে না পাওয়ার ব্যর্থতায়।
স্বেতা সিন শেষ করে পেছনে তাকাতেই আচানক তার সর্বাঙ্গে বিদ্যুৎ খেলে গেলো, চোখের কোণা ভর্তি হয়ে গেলো এক মুহূর্তে। অসহ্য যন্ত্রণায় বুকে ভেতরটা খামচে ধরলো কেউ।
আশেপাশে কোথাও কেউ নেই, কেবল স্বেতার থেকে কয়েক হাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে আবির্ভাব। এই মানুষটাকে দেখে স্বেতার ভীষণ কান্না পায়। বুকে ভেতরের নরম মনটা জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যায়।
স্বেতা চোখের পানি আড়াল করতে দ্রুত পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে হঠাৎ তার হাতের কব্জি টেনে ধরলো আবির্ভাব।
এতগুলো দিন পর আবারো সেই মানুষটার তীব্র প্রতিক্ষিত স্পর্শে দুনিয়া দুলে উঠলো স্বেতার। এই মানুষটা যা করেছে তার পর স্বেতার উচিত আবির্ভাবকে নিজের হাতে খুন করা, মুখ দেখতে না চাওয়া, ঘৃণায় চোখ ফিরিয়ে নেওয়া। কিন্তু এগুলোর একটা ও করতে পারছে না শ্বেতা।
স্নিজের মৃত্যু কামনা সহজ কিন্তু এই মানুষটার অনিষ্ট কামনা করা অসম্ভব।
স্বেতা হাত মুচড়াতে শুরু করলো, কঠিন কিছু বাক্য শুনাতে চাইলো কিন্তু আফসোস, ওরকম রূঢ় বাক্য তার কণ্ঠ দিয়ে বের হলো না।
দুর্বল নিভে যাওয়া কণ্ঠে বললো —
“প্লিজ ছাড়ুন আবির্ভাব, আমাকে যেতে দিন।”
আবির্ভাব ছাড়লো না। স্বেতা বেশি চাপা চাপি করতে গেলে —
“মাই লাভ…”
আবির্ভাবের কণ্ঠে উচ্চারিত একটা ছোট বাক্যে একদম স্থির হয়ে গেলো স্বেতা।
এতক্ষণ ধরে আটকে রাখা নোনা পানি জোয়ার এবার কঠোর ছাপিয়ে উপচে পড়তে লাগলো।
স্বেতা নিজেকে একটু সামলে নেওয়ার পূর্বেই তার অবস্থা বদলে গেলো। আচমকা, অপ্রত্যাশিত কাণ্ডে হতভম্ব হয়ে গেলো স্বেতা। মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এলো —
“আবির্ভাব…”
আবির্ভাব পরিনামের পরোয়া করলো না।
ছোট্টো মখমলে শরীরটা যতটা শক্ত করে বুকে সাথে চেপে ধরা যায়, ততটাই শক্ত করে মিশিয়ে নিলো। অনেকগুলো মাস পর স্বেতার পুনরায় ঠাঁই হলো সেই চেনা নীড়ে।
সেই উষ্ণ বুকে, যে বুকে যাওয়ার ঠাই পাওয়ার তাড়নায় সে তড়পে তড়পে মরেছে প্রতিটা মিনিটে, প্রতিটা সেকেন্ডে।
কিন্তু অন্যের জিনিস লুকিয়ে ভোগ করাকে চুরি বলে, আর স্বেতা কোনোদিনও অন্যের জিনিসে ভাগ বসাতে চায় না। তাই আবারো ছটফট করে উঠলো আবির্ভাবের বন্ধন হতে মুক্ত হতে।
কিন্তু আবির্ভাব তো ছাড়লোই না, উল্টো স্বেতাকে বুকে চেপে হুহু করে কেঁদে উঠলো। কান্নার মৃদু ছন্দে দুলে উঠলো শরীর। নিঃশেষ চোখের পানি গাল বেয়ে ফুটায় ফুটায় গড়িয়ে পড়তে লাগলো স্বেতার গায়ে।
স্বেতা ছটফট করতে করতে একসময় নিজেও আবির্ভাবকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে উঠলো। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না মেয়েটা। দুই হাতে আবির্ভাবের পিঠ খামচে ধরে বুকে মুখ গুজলো। সশব্দ কান্নার স্রোতে ভিজে উঠতে লাগলো আবির্ভাবের বুক গলা।
দুজনের কারো মুখেই কোনো শব্দ নেই। কেবল নিঃশব্দ অশ্রু বিসর্জন। নিদারুণ তৃষ্ণার্ত বক্ষের পিপাসা নিবারণ। কিন্তু সত্যিই তাই হয় — এই পিপাসা মিটবার নয়।
প্রিয়তা ফোন কথা বলা শেষ করে স্বেতার কাছে এসে বললো —
“সরি ননদিনি।”
তখন আসলে বলতেই সামনের উক্ত দৃশ্যে স্থব্ধ হয়ে যায় প্রিয়তা। অন্যতমার ফোন আসায় তখন অন্যদিকে চলে গেছিলো কিন্তু এসে প্রিয়তা দৃষ্টি নামিয়ে নিলো, কিছু না বলে ছাদের অন্য পাশে যেতে আনমনে বিড়বিড়ালো —
“নিষিদ্ধ আসক্তি, নিষিদ্ধ মায়া, নিষিদ্ধ টান।”
নিষিদ্ধ প্রেমের তীব্রতা বোধ হয় স্বীকৃত প্রেমের তীব্রতার কয়েক গুণ। নিষিদ্ধ প্রেম বুকে ভেতর বিষ বৃক্ষ রূপ করে, যে বৃক্ষের ফুল থেকে পাতা, কাণ্ড থেকে লতা — সব নিষিদ্ধ যন্ত্রণার বিষে পরিপূর্ণ। তবুও ব্যক্তি তা পান না করে থাকতে পারেন না।
কিছুক্ষণ কান্না করে আবির্ভাবকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে দিল শ্বেতা। আবির্ভাবের দিকে আর এক মুহূর্তও না তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে ছাদ থেকে নেমে গেলো।
আবির্ভাবের কলিজা ঠান্ডা হয়নি একটুও, বরং প্রতীক্ষিত নারীর পরশে তা জ্বলে উঠেছে। জীবনে প্রথমবারের মতো আবির্ভাব অনুভব করল, সত্যি এই অভিশপ্ত জীবনের ভার সে আর বইতে পারছে না। আত্মহত্যা ছাড়া আর কোন গতি নেই।
মন যাকে চায় তাকে ছোঁয়া বারণ, আর তাকে ছুঁতে না পারলে আত্মার মরন।
জীবন বোধহয় তার জন্য নয়।
সূর্য হেলে পড়ছে পশ্চিম আকাশে। শেষ বিকেলের অন্তিম কমলা রঙা আভা এসে প্রতিফলিত হচ্ছে শিখদার বাড়ির উত্তরের বারান্দায়।
সেই অপূরূপ সৌন্দর্যের মধ্যমণি হয়ে বসে আছে এক সুন্দরী যুবতী, যার সর্ব অঙ্গ রূপে ঝলসে যাচ্ছে।
গায়ে হালকা গোলাপি রঙের প্রিন্টেড পাকিস্তানি থ্রি পিস।
অতিরিক্ত লম্বা চুলগুলো কেটে পুনরায় হাঁটু অবধি করে ছেড়ে রাখা।
মুখে হালকা মেকআপ আর হাত ভর্তি হালকা গোলাপি রঙের রেশমি চুড়ি—ব্যাস, এতেই যেন রাজকুমারী।
প্রিয়তা সুন্দরভাবে সেজেগুজে বসে দোলনায় দুল খাচ্ছে, বা হাতে ফোন। নীলাভ চোখ দুটি মোবাইল স্ক্রিনে নিবদ্ধ।
হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্বারা ক্রমাগত ফোন স্ক্রিন ঠেলে দিচ্ছে উপরের দিকে। ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে হুট করে প্রিয়তার হাত থেমে যায়। চোখ আটকে যায় একটা নিউজের ওপর, যেখানে লেখা—
“গত ১৬ দিন আগে ভয়াবহ কাণ্ড ঘটে যায় কানাডার ফরেস্টেড হ্যাভেন উপত্যকায়।
মিশন এএসআর করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ৩০০’র বেশি কানাডিয়ান সেনা। প্রাণ হারিয়েছেন দেশের গৌরব বিশিষ্ট ক্রাইম ব্রাঞ্চ অফিসার অভিনাশ শর্মার।
সেই বরফ ঢাকা উপত্যকায় রাতের অন্ধকারে চলে গণহত্যা। সন্ত্রাসে মিশন চালালেও ধরা যায়নি এএসআর সহ তার টিম মেম্বারদেরকে। সবকিছু কঠোর পর্যবেক্ষণে রেখেও শেষ মুহূর্তে কী থেকে কী হয়ে যায়, তার কিছুই বোঝা যায়নি।
জানা যায়, মিশনে যাওয়ার পূর্বে অফিসার অভিনাশ এএসআর’র পরিচয় সম্পর্কে বড় কোনো তথ্য পেয়েছিলেন। যার নেপথ্যে তাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে এএসআর।
আরও জানা যায়, এএসআর কোনো ইউরোপিয়ান নয়, তিনি একজন খাঁটি এশিয়ান।
ওই ফ্রস্টেড হ্যাভেন উপত্যকায় অনেক কিছু ক্যাপচার করার মাধ্যমে নিশ্চিত হয় সরকার।
সরকার আরও অনুমান করে, এএসআর বর্তমানে হয়তো এশিয়ান কোনো কান্ট্রি—যেমন ইন্ডিয়া, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, ভূটান, চিন, শ্রীলঙ্কা সহ আরও কিছু কান্ট্রিতে থাকতে পারে। তাই এখন গোটা বিশ্বের নজর এশিয়া উপমহাদেশ।”
— তন্ময় কলিং
লেখাটা ওঠতেই ভাইব্রেট মোডে থাকা প্রিয়তার ফোনটা ভো ভো শব্দে কেঁপে ওঠে।
লেখাটার ওপর থেকে মনোযোগ সরে যায় প্রিয়তার। স্ক্রিনের উপরে তাকিয়ে দেখে তন্ময় ফোন করছে।
একই বাড়িতে বসে ফোন করছে দেখে মুখ বিকৃত করল প্রিয়তা।
ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরল।
ওপাশ থেকে তন্ময়ের অস্পষ্ট ভাঙা ভাঙা কথা ভেসে এলো—
“প্রিয় আপুুউউ, নিচে আসো। বড় আম্মু রা তোমাকে ডাকছেন।”
“কীইই?”
প্রিয়তা কথাগুলো সঠিক বুঝল না। তন্ময় হয়তো গাল লোড করে ফেলেছে কিছু একটা দিয়ে, তাই কথা বোঝা যাচ্ছে না।
তন্ময় পিঠা চিবোতে চিবোতে আগের মতো বলল—
“আরে, বড় আম্মু রা তোমাকে নিচে ডাকছে।”
প্রিয়তা এবার চরম বিরক্তি নিয়ে বলল—
“দেখ ভাই, ঈদের একটা দিন শুধু শুধু মার খাস না। যা বলবি, সাফ সাফ বল।”
তন্ময় দ্রুত পিঠাগুলো চিবিয়ে পানি দিয়ে গিলে নিল। বড় একটা ঢেঁকুর তুলে বলল—
“আরে আপু, বড় আম্মু রা বলছে কী জানি দরকার, নিচে আসতে। বাড়ির সবাই আছে, মহল বেশ গম্ভীর। মনে হয় ভিতর ভিতর বিরাট কোনো খিচুড়ি পাকাচ্ছে সবাই।”
তন্ময়ের কথায় অটোমেটিক ভ্রু বেঁকে গেল প্রিয়তার। তবে ব্যাপারটা আমলে নিল না, ভাইকে ঝাড়ি মেরে বলল—
“তুই কোন দেশের জমিদার হে, যে নিজে এসে কথাটা বলতে পারছিস না? ফোন করে বলতে হচ্ছে? এত সুখ পাস কই?”
তন্ময় ততোক্ষণে পুনরায় দুই গাল ফুলিয়ে পাহাড় বানিয়ে ফেলেছে। তাই অস্পষ্ট ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে কিছু বলল। কিন্তু সেসব শুনল না প্রিয়তা, খট করে ফোন কেটে দিল। বেশি না ভেবে ব্যালকনি থেকে বেরিয়ে বাইরে চলে গেল।
শিখদার বাড়ির ড্রয়িং রুম বেশ গম্ভীর। কারো মুখেই কোনো রা নেই, সকলে মুখে কুলুপ এটে বসে আছে।
উপস্থিত রয়েছেন বাড়ির বড় থেকে ছোট সকল সদস্য, কেবল উপস্থিত নেই দুজন।
ড্রয়িং রুম ডাবল সিটার সোফায় থমথমে মুখে বসে আছেন—
সাদম শিখদার, খালিদ শিখদার, সাজিদ শিখদার, সাহেব শিখদার।
তাদের সামনের ডাবল সিটার সোফায় চুপচাপ বসে আছে—
প্রীতম, প্রেম, রাজ, অরণ্য, সমুদ্র, তন্ময়।
সকলেই লক্ষী ছানা হয়ে বসে আছে, কেউ কোনো বাদরামি করছে না। কেবল অরণ্য আর তন্ময় টুকটুকে মুখ চালাচ্ছে, আর সকলের দিকে একবার একবার চোখ ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে।
প্রীতমের পাশের সিঙ্গেল সোফায় বসেছে অপরদিকে—
মেহজাবিন চৌধুরী, উনার পাশে উনার স্বামী ফারহান চৌধুরী।
ড্রয়িং রুমের একদিকে থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছেন—
অনুশ্রী বেগম, তনুশ্রী বেগম, অনন্যা বেগম, অর্থি বেগম সহ পরিণীতা, প্রেরণা, ঊষা, ইনায়া, থিরা, থোরি, দেবী।
সকলেই যেন কারো প্রত্যাশায় অপেক্ষারত।
প্রিয়তা নিচে এসে সকলে একসাথে এক জায়গায় দেখে খানিকটা আশ্চর্য হলো। তবে সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য হলো ফুপাকে দেখে।
প্রিয়তাকে আসতে দেখে সকলে যেন আরো অপার প্রস্তুত হয়ে পড়লেন। তবে তা মুখে প্রকাশ করলেন না।
নিজেদের সিদ্ধান্তে তাঁরা অনড়। তাও বুকের কোথাও যেন কষ্টে ছিড়ে যাচ্ছে সকলের।
প্রিয়তাকে দেখে হাসি ফুটল মেহজাবিন চৌধুরীর মুখে। তিনি প্রসন্ন হেসে বসা থেকে উঠে পড়লেন, প্রিয়তার হাত ধরে টেনে এনে নিজের আশনে জায়গায় থুতনিতে হাত রেখে হেসে বললেন—
“মাশাআল্লাহ।”
আচমকা এহেন কাণ্ডে অবাক হয়ে গেল প্রিয়তা, অদ্ভুত চোখে তাকালো মেহজাবিন চৌধুরীর দিকে।
প্রিয়তাকে আরো অবাক করে দিলেন অনুশ্রী বেগম। নিজের হাতের লাল ওড়নাটা এনে প্রিয়তার মাথায় পরিয়ে দিলেন আচমকা।
মেহজাবিন চৌধুরীর উদ্দেশ্যে বললেন—
“আংটি পরানোর সময় মেয়ের মাথায় লাল কাপড় পরাতে হয় আপা।”
“জানি ভাবি।”
প্রিয়তা তো হতবাক। সে চমকে তাকালো অনুশ্রী বেগমের দিকে। সব যেন তার দশ হাত মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। সে শুধু প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকাচ্ছে সবার দিকে।
সাজিদা শিখদার নিজের স্থান ছেড়ে প্রিয়তার পাশে এসে বসলেন। মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন—
“আমার মেয়ে আব্বুর কাছে কিছু চেয়েছে, আর আব্বু সেটা দেয়নি। তা কি কখনো হয়েছে মা?”
বাবার কথার আগা মাথা কিছুই বুঝল না প্রিয়তা, অবুঝ চোখে তাকালো সাজিদ শিখদারের দিকে।
সাজিদ শিখদার আর কিছু বললেন না। মেহজাবিন চৌধুরীকে ইশারা করলেন।
মেহজাবিন চৌধুরী হাত বাড়িয়ে দিলেন স্বামীর দিকে। ফারহান চৌধুরী হাসিমুখে স্ত্রীর দিকে একটা ছোট্ট নীল বক্স এগিয়ে দিলেন।
উপস্থিত সকলে যেন নীরব দর্শক।
অনুশ্রী বেগম এসে প্রিয়তার হাতটা টেনে নিজের হাতে নিলেন। আস্তে করে প্রিয়তার বা হাতের অনামিকা থেকে খুলে নিলেন প্রণয়ের নীরব ভালোবাসার চিহ্ন, সেই পিঙ্ক ডায়মন্ড রিংটা।
যেটা হারিয়ে গেছে বলে পাগল হয়ে যাচ্ছিল প্রিয়তা। পরে স্বেতার কাছে খুঁজে পেয়েছে।
রিংটা খুলে নিতেই চোখে পানি চলে আসে প্রিয়তার। আর্তনাদ করে বাধা দিতে নিলেই এবার তার হাত টেনে ধরলেন মেহজাবিন চৌধুরী।
চোখের পলকেই হাতের অনামিকায় পরিয়ে দেন ছোট্ট একটা ডায়মন্ড রিং।
এহেন কাণ্ডে হতবম্ব হয়ে যায় প্রিয়তা। বিস্ফোরিত চোখে তাকায় মেহজাবিন চৌধুরীর দিকে।
মেহজাবিন চৌধুরী প্রিয়তার হাতে চুমু খেয়ে বললেন—
“তুই জানিস না মা, এটা আমার কত দিনের স্বপ্ন। তুই জানিস না মা, আমি কতগুলো বছর অপেক্ষা করেছি শুধু এই দিনটার জন্য।”
প্রিয়তা তাজ্জব বনে তাকিয়ে রইল। যা কিছু হচ্ছে সব যেন তার মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে।
মেহজাবিন চৌধুরীর চোখে সুখের অশ্রু।
এবার আবার প্রিয়তার মাথায় হাত রাখলেন সাজিদ শিখদার। স্নেহমাখা কণ্ঠে বললেন—
“আমার মা বিয়ে করতে চেয়েছে, কিন্তু আমার মেয়ের জন্য তো আর আমি যে সে পাত্র নির্বাচন করতে পারি না। আর যে কেউ তো আমার মেয়ের উপযুক্তও নয়।”
এতক্ষণে সব বুঝতে পারল প্রিয়তা। কিন্তু এসব যেন তার বিশ্বাস হচ্ছে না। এগুলো কী বলছে সবাই, ভয়ে একপ্রকার রক্ত হিম হয়ে যায় প্রিয়তার।
অনন্যা বেগম চোখ মুছে সবার হাতে হাতে মিষ্টির প্লেট তুলে দেন।
সকলেই হাসছে, কিন্তু এই হাসিটা হয়তো কারো জন্যই সুখের নয়, এই হাসির আড়ালে লুকায়িত তাদের পাহাড় সমবেদনা।
প্রিয়তার হাতের জ্বলে জ্বলে হীরের আংটিটা দেখে কলিজা মুচড় দিয়ে ওঠে অনুশ্রী বেগমের, অজানা আশঙ্কায় মাতৃহৃদয় কেঁপে ওঠে।
মন বলে, “এবার আমার ছেলে টা বাঁচবে কীভাবে, আল্লাহ, আমার ছেলে টাকে সহ্যশক্তি দিও, সব জেনে শুনে মা হয়ে ছেলের সাথে কত বড় অন্যায় করলাম, আমার ছেলেটার বাঁচার উদ্দেশ্য কেড়ে নিলাম, কিন্তু আমি আর কি করতাম মাবুদ?”
প্রিয়তা ঘোর কাটাতে পারছে না।
“আব্বু, আমার বিয়ে ঠিক করেছেন, তাও শুদ্ধ ভাইয়ের সাথে, শুদ্ধ ভাই।”
রাগে দুঃখে প্রিয়তার কান্না পেয়ে যায়, চোখ চিকচিক করে উঠে, পানিতে প্রণয়ের প্রতি আকাশ সমঅভিমান তার সীমা ছাড়িয়ে যায়।
সে চোখ মুছে সবাইকে মানা করে দিতে উদ্যত হয়।
“আব্বু, আমি…”
বলে থেমে যায় প্রিয়তা, কিছু একটা ভেবে।
মানা করতে গিয়েও করে না, চুপ হয়ে যায়।
সাদমান শিখদার হয়তো এটারই অপেক্ষা করছিলেন, প্রিয়তা যদি একবার মানা করে দেয়, তবে বাকিটা উনি সামলে নেবেন।
“এই বিয়েটা যেকোনো ভাবেই হোক বানচাল করে দেবেন।”
প্রিয়তাকে থেমে যেতে দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়েন সাদমান শিখদার।
“কিছু বলবি মা, বল, আমায় নির্ভয়ে বল।”
সকলেই একত্রে তাকান প্রিয়তার দিকে।
কিন্তু কিছু বলে না প্রিয়তা, মাথা নুইয়ে নেয়।
সাজিদ শিখদার আদুরে কণ্ঠে সুধান, “বল মা, কিছু বলবি, কোনো সমস্যা?”
প্রিয়তা দুই পাশে মাথা নাড়ায়, যার অর্থ কোনো সমস্যা নেই।
নিরাশ হন সাদমান শিখদার।
সাজিদ শিখদার হেসে উঠে মেহজাবিন চৌধুরীকে বললেন, “তাহলে আপা, প্রেরণার বিয়ের পর সামনের মাসে একটা দিন দেখি।”
“না, ওর বিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যেই হবে।”
আচমকা এহেন কথায় সকলেই আশ্চর্য হয়ে যান, একত্রে তাকান প্রীতমের দিকে।
প্রীতম এতক্ষণ নীরব ছিল, নিরবে দেখেছে সব। এবার মুখ খুলে বলল, “ওর বিয়ে প্রেরণার সাথেই হবে, এক সাথে, এক আসরে।”
প্রীতমের তারাহুরোয় ভ্রু কুঁচকান সাদমান শিখদার, কঠিন কণ্ঠে বলেন, “কেন এত তারাহুরোর, কী আছে? প্রেরণার বিয়ে আগে হোক, তার পর হবে খন ধীরে সুস্থে।”
সাজিদ শিখদারও সম্মতি জানিয়ে বললেন, “হ্যাঁ, তাই তো বাবা, এত তারাহুরো কী আছে?”
প্রীতম কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না, কঠোর কণ্ঠে বলে, “কারণ আমি চাই আমার বোনের বিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যেই হোক, তাই প্রেরণার সাথেই হবে, এখানে আপনাদের কোনো আপত্তি আছে?”
মেহজাবিন চৌধুরী সম্মতি জানিয়ে বললেন, “না বাবা, আমার কোনো আপত্তি নেই, আসলেই তো শুভ কাজ ফেলে রাখা উচিত নয়, একসাথে দুটো বিয়ে হয়ে গেলে এর থেকে ভালো আর কী হতে পারে।”
সাজিদ শিখদার আর মানা করলেন না, তবে সাদমান সিকদার একটু ক্ষেপে গিয়ে বললেন, “তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছো, প্রীতম।”
প্রীতম কেবল বিদ্রুপ করে হাসে, কিছু বলে না।
ফারহান চৌধুরী বললেন, “তাহলে তো বেশি সময় নেই, প্রেরণার বিয়ের তো আর মাত্র চার দিন বাকি, কাল থেকেই তো শপিং শুরু হওয়ার কথা ছিল, তাহলে কাল থেকে প্রিয়তা আর শুদ্ধের জন্যও শপিং শুরু করে দেবো।”
মেহজাবিন চৌধুরী মাথা দুলান, সকলে উচ্ছ্বসিত হওয়ার চেষ্টা করেন।
কিন্তু মনে মনে ছটফটিয়ে ওঠল প্রিয়তা, অশান্ত চোখে আসে পাশে তাকালো, এসব গসিপ শুনতে সে ইন্টারেস্টেড নয়।
মেহজাবিন চৌধুরী সবার মুখে মিষ্টি তুলে দিয়ে খুশি হয়ে বললেন, “তাহলে কথা ফাইনাল, ১৫ তারিখ বিয়ে।”
তন্ময় আর অরণ্য দুজন চেপে বসলো একে অপরের দিকে। অরণ্য একটা গোলাপ জামুন মুখে ঢুকিয়ে বলল, “বুঝতে পারছিস তো পার্টনার, বাড়িতে পরিদের মেলা বসতে চলেছে।”
“অর্ধেক তোর, অর্ধেক আমার।”
“আরে ছোটগুলো তোর, বড়গুলো আমার।”
“ওকে, ডিল ফাইনাল।”
“তাহলে প্রত্যেকটা অকেশন এর জন্য আলাদা আলাদা আউটফিট লাগবে।”
“কাল আমরা বেছে বেছে শপিং করবো।”
সমুদ্র এদের এসব আজব কথোপকথন শুনে দাঁত খিচিয়ে বলল, “তোরা কি আসে পাশে মেয়ে ছাড়া কিছু দেখতে পাস না?”
অরণ্য ভ্রু বাঁকিয়ে বলল, “তো ছেলে দেখবো নাকি?”
তন্ময় বাঁকা হেসে বলল, “আমাদের ছেলেদের প্রতি কোনো ইন্টারেস্ট নেই।”
সমুদ্র ওদের দুজনেরই কান টেনে ধরে বলল, “তোদের কপালে সেজো ভাবির আপডেট ভার্সন জুটবে, দেখিস।”
শিখদার বাড়ির বড়রা সকলে সকলে সব কথা বার্তা ফাইনাল করে নিলেন।
সাজিদ শিখদার আর মেহজাবিন চৌধুরীর ঠোঁটে অদ্ভুত প্রশান্তিময় হাসি।
সন্ধ্যা গড়িয়ে যাচ্ছে প্রায়, প্রিয়তা অস্থির নয়ন জুড়া এখনো কাউকে খুঁজছে অনবরত।
মাথা ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে হঠাৎ সিঁড়ির পানে চোখ পড়লো প্রিয়তার। সাথে সাথেই দু একটা হার্টবিট মিস করল বেচারি।
হাতে হেলমেট নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসছে চার পুরুষ, চার জনেরই সেম আউটফিট।
স্কিন টাইট ব্ল্যাক টি-শার্ট এর সাথে স্কিন টাইট ব্ল্যাক লেদার জ্যাকেট, হাতে কব্জিতে কালো রুমাল বাঁধা।
প্রিয়তা চোখ ফেরাতে পারছে না সেই দ্বিতীয় পুরুষটার দিক থেকে, তবে সেই নিষ্ঠুর পুরুষ একবারের জন্যও দেখছে না প্রিয়তাকে।
প্রণয়, শুদ্ধ, সাদাফ, আবির্ভাব নিচে এসে সবাইকে এক সাথে দেখে অবাক হলো খানিকটা, তবে বেশি না ভেবে বেরিয়ে যেতে নিলেই পেছন থেকে শুদ্ধকে ডেকে উঠলেন মেহজাবিন চৌধুরী।
“কোথায় যাচ্ছো, মাই সান?”
মায়ের কণ্ঠে থমকে দাঁড়াল শুদ্ধ, পেছন ঘুরে প্রতিউত্তর করলো,
“বাইক রাইডে যাচ্ছি, মম।”
“যাচ্ছো, যাও, কিন্তু সাবধানে যাবে।”
“ঠিক আছে, মম।”
বলে আবার যেতে ধরলো শুদ্ধ। আবার ডেকে উঠলেন মেহজাবিন চৌধুরী।
“দাঁড়াও।”
আবার দাঁড়িয়ে পড়লো শুদ্ধ। মেহজাবিন চৌধুরী হাতের ইশারায় ডেকে বললেন, “এদিকে আসো, ওদের দেরি হচ্ছে।”
তবে এতে প্রণয়, সাদাফ, বা আবির্ভাব কেউই বিরক্তি প্রকাশ করছে না।
শুদ্ধ ঘুরে এবার সরাসরি মেয়ের দিকে তাকালো, সাথে সাথেই শুদ্ধের হার্ট যেন বিট করা বন্ধ করে দিলো।
কন্ঠ নালিতে এসে থমকে দাঁড়ালো নিঃশ্বাস, চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেলো শুদ্ধ।
বাড়ি ভর্তি মানুষের সামনে বোকার মতো হাঁ করে তাকিয়ে রইলো প্রিয়তার দিকে।
সকলেই ঠোঁট চেপে হাসলেন। মেহাজাবিন চৌধুরী শ্বেতাকে ইশারা করলেন।
শ্বেতা এগিয়ে এসে ভাইয়ের হাত ধরে নিয়ে গেলো প্রিয়তার কাছে।
মেহজাবিন চৌধুরী প্রণয়, সদাফ, আবির্ভাবকে ও ডাকলেন। ওরা ও গেলো।
অনুশ্রী বেগম সবার হাতে মিষ্টির প্লেট তুলে দিলেন।
প্রণয় একবার মিষ্টির প্লেটের দিকে তাকিয়ে আরেকবার প্রশ্ন চোখে তাকালো অনুশ্রী বেগমের দিকে।
কিন্তু ছেলের চোখে চোখ অনুশ্রী বেগম।
শুদ্ধ যেন এখনো ঘোরের মধ্যে আছে। শ্বেতা তাকে নিয়ে প্রিয়তার পাশে বসিয়ে দিলো।
বলতেই হবে, মানিয়েছে, ভীষণ সুন্দর, একদম চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার মতো।
প্রণয় শুধু একবার শান্ত চোখে তাকালো দুজনের দিকে।
মেহজাবিন চৌধুরী হঠাৎ বলে উঠলেন, “চার দিন পর তোর বিয়ে, শুদ্ধ।”
মেহজাবিন চৌধুরীর কন্ঠ হতে উক্ত শব্দ গুচ্ছ কানে পৌঁছানো মাত্রই স্তব্ধ হয়ে গেলো শুদ্ধ।
শুধুমাত্র একটা কথায় আশ পাশে ছড়িয়ে পড়লো পিন পরম নীরবতা।
প্রিয়তা সাথে সাথেই ফট করে চোখ তুলে তাকালো প্রণয়ের চোখের দিকে।
তবে প্রিয়তার ভাবনা অনুযায়ী কোনো রিয়্যাকশনই দেখালো না প্রণয়। ভীষণ স্বাভাবিক ভাবে মিষ্টির একটুক ভেঙে মুখে দিলো।
প্লেটটা নিচের টেবিলে রেখে বলে, “সরি গাইস, বেশি খেতে পারবো না, ডায়েটে আছি।”
কয়েকজোড়া ব্যর্থ করুণ দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত প্রণয়ের দিকে।
সকলেই হয়তো প্রণয়ের চোখে ব্যথা দেখতে চাইলো, কিন্তু মহা-আশ্চর্যজনক তেমন কিছুই দেখা গেলো না।
শুদ্ধর হঠাৎ করেই কেমন লজ্জা লাগতে শুরু করলো।
লজ্জায় গাল, মুখ রক্তিম হয়ে উঠছে। ছেলেটার বুকের ভেতরটা যেন সুখের জোয়ারে প্লাবিত হচ্ছে, এমন শব্দ সে শুনতে পাবে তা কি কখনো আশা করেছিল?
শুদ্ধ তৃপ্ত চোখে তাকালো প্রিয়তার দিকে।
প্রিয়তা কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে মৃদু আওয়াজে ডাক দিলো, “Sweetheart।”
আচমকা চমকে উঠলো প্রিয়তা।
শুদ্ধ সকলের অলক্ষে সন্তর্পণে চেপে ধরলো প্রিয়তার কোমল হাতের গোছা।
প্রিয়তা হতবম্ব।
ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৬৪ (২)
শুদ্ধ পুনরায় প্রিয়তার কানে কানে ফিসফিসিয়ে বললো, “মাত্র চার দিন, সুইটহার্ট, এরপর পাক্কা তোমার সালামি দিয়ে দেব।”
চোখ বন্ধ করে ফেলল প্রণয়, হাত মুষ্টিবদ্ধ করে চুপচাপ বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে।
প্রণয়কে এভাবে চলে যেতে দেখে ভয় কেঁপে উঠলো আবির্ভাব।
শুদ্ধকে টেনে তুলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো।