দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৮২
তাসফিয়া হাসান তুরফা
নিশীথ দোলনচাঁপাকে ঘিরে বাচ্চার আগমনের আমেজ শেষ হলো বেশ অনেকক্ষণ পরে। এরপর রাতের খাওয়া শেষে সকলে নিজ নিজ গন্তব্যেও চলে গেলো ঠিকি। আয়মান সাহেব ভরা পেটে রুমে এসে মোবাইল নিয়ে বসলেন। বেশ কিছুক্ষণ মোবাইল দেখার পর তার বিরক্ত লাগলো। কি যেন নাই মনে হলো। কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনার পর তার মাথায় এলো, আজকে খাওয়াশেষে পানমশলা খেতে ভুলে গেছেন। যেদিন রাতে ভারি খাবার খাওয়া হয় ওদিন খাওয়া শেষে পানমশলা চিবোতে চিবোতে তিনি ফোন চালান। এটা তার একটা অভ্যাস বলা চলে। কিন্তু আজকে নাতি আসার আগমনের খবরে তিনি এতটাই খুশি যে কোনোকিছুরই খেয়াল নেই তার। সব অভ্যাস এদিক-ওদিক হয়ে গেছে।
আয়মান সাহেবের চোখ বারবার ঘুরেফিরে দোলনচাঁপা নিশীথের দিকে যাচ্ছিলো। এ প্রথম উনি খেয়াল করলেন ওদের দুজনকে একত্রে কতটা মানায়। বিশেষ করে দুজনকে হাসিমুখে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আয়মান সাহেবের মন ভরে গেলো। তিনি অনুভব করলেন, নিজের ইগোর কারণে জীবনের কত সুখ, কত ভালো জিনিসকে তিনি এভাবে উপেক্ষা করে গেছেন। এর মধ্যেই একটা হলো দোলনচাঁপা, আরেকটা তার সহধর্মিণী-আসমা। বিয়ের প্রায় ত্রিশ বছর দুজন একত্রে কাটিয়েছে। আয়মান শুরু থেকেই উদাসীন থাকলেও আসমা কোনোদিন ওর তরফ থেকে সামান্য ত্রুটি রাখেনি। দিনকে দিন নিজের সমস্ত দায়িত্ব পূরণ করে গেছে। শুধু আয়মানের জন্য করেছে এমনটা নয়, বরং আসমা আসার পর থেকে এ বাড়ির সমস্ত দায়িত্ব ও নিজ হাতে সামলে নিয়েছে। অথচ ও নিজে কি করেছে? যে মানুষটা ওর জন্য সব করে গেলো তার দিকে ভালোবাসার নজরে একবার ফিরেও তাকায়নি বলা চলে। আয়মান মনে মনে অনেক অপরাধবোধ অনুভব করে। এমন সময় রুমে আসমা প্রবেশ করে। আয়মান চমকে উঠে চোখ সরিয়ে নিতেই আসমা হেটে ওর কাছে যায়। পানমশলার কৌটো ওর দিকে এগিয়ে বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
—দাদু হওয়ার খুশিতে আজ এটা না খেয়েই চলে এলেন দেখলাম!
আয়মান আজ অবাক হয়না। অন্যদিন হলে হয়তো সামান্য অবাক হতো, তবে একটু আগের করা ওর পর্যবেক্ষণ ওকে ভাবতে বাধ্য করে আসমা সবসময়ই ওর সাথে এই কাজটা করে এসেছে। যখন যেভাবে আয়মানের যা প্রয়োজন তার সবটাই ও সামাল দিয়ে এসেছে। আর সেই মানুষ কে কিনা ও অবহেলা করে এসেছে? তাও এমন মানুষের জন্য যে দিব্যি ওকে ছাড়া ভালো আছে? এমন অকৃতজ্ঞ ও কিভাবে হলো! আয়মান এ প্রথম মন থেকে আসমার দিকে তাকায়। কোন প্রকার বিরক্তি, অবহেলা অথবা আক্রোশ ছাড়া এ চাহনি আসমাকে বেশ ভাবায়। সত্যি বলতে ও অনেকটা বিস্মিত হয়। যে চোখে এত বছর মায়া, ভালোবাসা খুজে ব্যর্থ হয়েছে, পরিশেষে হাল ছেড়েছে, সে চোখে নিজের জন্য হঠাৎ এমন মায়া দেখে ও বিস্ময় চেপে রাখতে পারেনা। ভালোবাসার তালাশে ব্যর্থ হয়ে হৃদয়ের যে সিন্ধুকে ও তালা মেরে রেখেছিলো তার চাবি আয়মান সাহেবের চোখজোড়ায় খুজে পায়! আসমার বুক কাপে! তবে ও নিজেকে দূর্বল দেখাতে চায়না, বিশেষ করে এতবছর যার কাছে অবহেলা ছাড়া কিছুই পায়নি তার কাছে তো নয়ই! নিজের দূর্বলতা ঢাকতে আসমা রুম থেকে চলে যেতে নেয়। তখনি আয়মান পেছন থেকে ডাকে,
—কই যাচ্ছো?
আসমা এবার আরও অবাক হয়। জীবনে যে মানুষটা জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করলোনা ও কই যাচ্ছে কি করছে আজ সে কিনা আগ বাড়িয়ে এ প্রশ্ন করছে! ও পেছন ফিরে বললো,
—এমনি বাইরে যাই। নিশীথ দোলার সাথে কথা বলে আসি ভাবছি!
—এ সময় ওদের ডিস্টার্ব করোনা। এমন বিশেষ মুহূর্ত জীবনে বারবার আসেনা। আজ প্রথমবার জানতে পেরেছে ওরা মা-বাবা হবে। এ অনুভূতি তোমার আমার কাছে পুরানো হলেও ওদের কাছে ভীষণ নতুন, ভীষণ স্পেশাল। আজ ওদের একাই থাকতে দাও!
আসমা ভেবে দেখলো আয়মান সাহেব কথাটা ভুল বলছেন না। ওর মনে পড়ে যায় প্রথমবার মা হওয়ার কথা, নিশান পেটে আসার সময়ের কথা! কতটাই না খুশি হয়েছিলো ও! আয়মান সাহেবকেও বিয়ের পর এতটা খুশি হতে ওই সময়ই প্রথম দেখেছিলো আসমা! এতটা ভালো লেগেছিল ওর নিজেরও। সত্যি বলতে বিয়ের পুরোটা সময় আয়মান ওকে যতই অগ্রাহ্য করুক না কেন প্রেগন্যান্সির সময়টায় ঠিকি যত্ন করেছে। এটা আসমা চাইলেও অস্বীকার করতে পারবেনা। এ সময় স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক ভালো হওয়া উচিত। আসমাও ভেবেছিলো ভালো হবে, কিন্তু নিশানের জন্মের পর ও দেখলো আয়মান নিজের পুরোটা সময় নিশানকে নিয়েই ব্যস্ত পার করলো। আসমার মনের আশায় এক বালতি জল ঢেলে ও নিশানের পেছনেই সব ভালোবাসা, যত্ন আহ্লাদ ঢেলে দিলো। ফলশ্রুতিতে আয়মানের ভালোবাসায় পুনরায় পিছিয়ে রইলো আসমা। যাই হোক, এবার আয়মান সাহেবের কথায় ও পুরোপুরি একমত হলো। নিশীথ দোলাকে আজকের রাতে অবশ্যই একা থাকতে দেওয়া উচিত। এতক্ষণ তো দুজন সবার সাথে ছিল, মাত্রই একা হয়েছে। এখন আসমার যাওয়াটা শোভা দেয়না! ফলে ও থেমে গেলো। রুমের দরজা লাগিয়ে এসে বিছানায় বসলো চুপচাপ। খানিক বাদে হঠাৎ আয়মান বললো,
—তোমার ভীষণ অভিমান আমার উপর, তাইনা আসমা?
আসমা বেগম বেশ চমকালেন। তবু নিজেকে সামলে নিয়ে শুধু বললেন,
—অভিমান তো মানুষ তার উপর করে যার কাছে ওর মান-অভিমানের দাম আছে। আমার মান-অভিমানের আবার আপনার কাছে কোন দাম আছে নাকি?
আয়মান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
—আগে হয়তো তেমন একটা ছিলোনা। তবে…
আয়মান সাহেব থামলেন। আসমা মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনলো। আয়মান দৃঢ় গলায় বললেন,
—তবে এখন দাম আছে। আমি স্বীকার করতে চাই কিংবা না চাই আমার জীবনে তোমার অবদান কখনোই অস্বীকার করা সম্ভব নয়। তুমি অবশ্যই আমার কাছে দামী!
আসমা শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো আয়মান সাহেবের দিকে। এ কথাগুলো ও কতই না শুনতে চেয়েছিল এক কালে অথচ কখনো শুনেনাই। আজ যে বয়সে এসে ও ভালোবাসার ইচ্ছে খুইয়েছে সে সময় এসে ওর নসীবে এটা জুটলো! জীবন অদ্ভুত। তার চেয়েও অদ্ভুত হলো মানুষের মন। এ বয়সে এসে আয়মানের এ কথার জবাবে আসমার কি বলা উচিত ও ঠিক বুঝে উঠতে পারলোনা।
দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৮১
মন বলছে, যার ভালোবাসার জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করেছে তার ডাকে সাড়া দিতে। কিন্তু মস্তিষ্ক নিজের আত্মসম্মান বোধ হারাতে নারাজ। মস্তিষ্ক বলছে যে কোনোদিন ওর অবদানের মূল্য দেয়নি, শেষ বয়সে এসে তাকেও অবহেলা করে বুঝানো উচিত। মন-মস্তিষ্কের অদৃশ্য দ্বন্ডে আসমাকে বড়ই উদবিগ্ন দেখালো! অপরদিকে ওর জবাবের আশায় আয়মান সাহেবের উত্তেজনায় শ্বাসরোধ হবার জোগাড়!