প্রিয় ইরাবতী পর্ব ৮

প্রিয় ইরাবতী পর্ব ৮
রাজিয়া রহমান

উপমা বাবার বাসায় যখন আসে তখন রাত প্রায় ১০.৩০ বেজে গেছে। সবকিছু হাতের বাহিরে চলে গেছে উপমার।শফিক বাসায় এসে চিৎকার করে বাবা মা’কে বললো, “উপমাকে আমি আর ওই ছোটলোকের সংসার করতে দিবো না।ও এখানেই থাকবে।”
জান্নাত রুমে থেকে শুনতে পেলো।
শফিকের হম্বিতম্বি শুনে জান্নাত মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
যার পকেটে অঢেল ঘুষের টাকা গড়াগড়ি খায় তার পক্ষে এরকম দুই চারটা বোন পোষা ব্যাপার না।কিন্তু জান্নাত এসব মানতে পারবে না।জান্নাতকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করার জন্য শফিকই যথেষ্ট ছিলো, বাড়তি উপমা এখনো গলার ফাঁসের মতো। জান্নাত সিদ্ধান্ত নেয় উপমা এখানে থাকলে সে ও তার মা’য়ের বাসায় চলে যাবে।সেই সুবাদে অসুস্থ মায়ের সেবা করা ও হবে।

শফিক চিৎকার করতে করতে রুমে আসে।জান্নাত ছেলেকে নিয়ে শুয়ে পড়েছে। শফিক রুমে এসে জান্নাতকে ডাকে খাবার দেওয়ার জন্য। জান্নাত শুয়ে থাকে।
সন্ধ্যাবেলার ঘটনা জান্নাত ভোলে নি।
শফিক বারকয়েক ডাকলো।জান্নাতের সাড়াশব্দ পেলো না।
বের হয়ে গিয়ে মা’কে বললো খাবার দিতে।
শফিকের মা উঠে এলেন ভাত বাড়তে।উপমা তরকারি দেখে বিরক্ত হয়ে বললো, “না না,আমি রুই মাছ খাবো না মা।আমার জন্য একটু ভর্তা করে দাও শুঁটকি দিয়ে ঝাল ঝাল করে।”
শাহেদা জিজ্ঞেস করলো, “ভর্তা বাটবে কে?আমি?”
উপমা ভাইয়ের দিকে তাকালো।শফিক আবারও উঠে গেলো জান্নাতকে ডাকতে।
জান্নাত উঠলো না।রেগে গিয়ে শফিক জান্নাতকে টেনে উঠে বসিয়ে দিলো। গর্জে উঠে বললো, “তোরে কয়বার ডাকছি আমি?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কেনো ডাকছেন আমাকে আপনি? কি দরকার?”
“উপমার জন্য ভর্তা বানানো লাগবে।”
“রাতের ১১ টা বাজে এখন,আমি এখন ভর্তা বানাতে পারবো না।সকালে আমাকে উঠতে হবে,শ্রেয়ানের ক্লাস আছে।আমি ঘুমাচ্ছি।”
“খুব সাহস হয়েছে তোর?বেশি উড়তেছস!”
“উড়বোই তো,যার ভাই পুলিশ হওয়ায় তারা অহংকারে মাটিতে পা ফেলে না আমার তো স্বামী পুলিশ, আমার কি পরিমাণ অহংকার হওয়ার কথা ভাবেন?”
শফিকের রাগ উঠছে।শ্রেয়ান হাতড়ে মা’কে খোঁজে।জান্নাত ছেলেকে জড়িয়ে শুয়ে পড়ে। শফিক ছেলের প্রতি দুর্বল। জান্নাত উঠে গেলে শ্রেয়ান ও উঠে যাবে।কাঁচা ঘুম ভাঙলে ও কান্না করবে সারারাত।
বাধ্য হয়ে শফিক উঠে গেলো। কাঁচুমাচু করে বোনকে বললো, “এই বেলা কষ্ট করে খা।তোর ভাবী আসছিলোই কিন্তু বাবু কান্না করছে দেখে আসতে পারে নি।”

উপমার এক মুহূর্তের জন্য ইরার কথা মনে পড়ে গেলো। ইরা থাকলে উপমা বলার আগেই তৈরি করে রাখতো।এক বেলায় এক রকম ভর্তা করে রাখে মেয়েটা,টেবিলের উপর বালাচাওয়ের একটা বয়াম থাকে যা উপমা কখনো খালি দেখে না।হাফ শেষ হলেও ইরা বানিয়ে ফুল করে রাখে সবসময়।
রুই মাছের গন্ধে উপমার মনে হলো পেটের নাড়িভুড়ি সব বের হয়ে আসবে।
উপমা ছুটে গিয়ে বেসিনে হড়হড় করে বমি করে দিলো।তারপর নিস্তেজ হয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো।
শাহেদা উপমার মাথায় সরিষার তেল আর পানি মিশিয়ে দিলো।উপমা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
সকালে উপমার ঘুম ভাঙে একটু বেলা করে।
ব্রাশ নিয়ে বেসিনে যায় দাঁত মাজতে।বেসিনের সামনে যেতেই উপমার গা গুলিয়ে উঠে।
গতরাতে উপমা এই বেসিনে বমি করেছিলো,এখনো পরিষ্কার করা হয় নি এটা।
উপমা তারস্বরে চেঁচায় ভাইকে ডেকে।
রান্নাঘর থেকে জান্নাত বের হয়ে শান্তস্বরে বললো, “তোমার ভাই অফিসে গেছে।”

“বেসিন এখনো অপরিষ্কার কেনো ভাবী?”
“বমি করেছো তুমি, পরিষ্কার করবে কে?তুমি রাতে পরিষ্কার করে রাখো নি কেনো?এখন ঘুম থেকে দেরি করে উঠে জবাবদিহি চাইছো?”
উপমা চমকায়।আশ্চর্য!
সে পরিষ্কার করবে?
“আমি কেনো পরিষ্কার করতে যাবো ভাবী?আমার ঘেন্না লাগবে।তুমি পরিষ্কার করো।”
“ঘেন্না!কিসের ঘেন্না?সন্তান জন্মাবার পর নিজের এই দুই হাত দিয়েই বাচ্চার হাগুমুতু সব সাফ করতে হবে তখন কী করবে?তখন ঘেন্না লাগবে না?তোমার বমিতে যদি তোমার ঘেন্না লাগে তাহলে আমাদের কী উল্লাসিত হওয়ার কথা? যতো চাইল্ডিশ কথাবার্তা তোমার। তাড়াতাড়ি পরিষ্কার করে নাও।শ্রেয়ান আসলে ও এসব দেখলে অসুস্থ হয়ে যাবে।”
উপমা কি বলবে ভেবে পায় না।
অথচ এতো দিন ধরে তার সবকাজ তো ইরা নির্দ্বিধায় করতো।

উপমার অস্বস্তি লাগে।নাকে ওড়না বেঁধে উপমা হাতে একটা পলিথিন পেঁচিয়ে নেয়।তারপর বেসিন পরিষ্কার করে।
কিন্তু এরপর শুরু হয় উপমার আরেক অশান্তি। উপমার মনে হয় তার হাতে এখনো বমি লেগে আছে।হ্যান্ড ওয়াশ দিয়ে চার পাঁচ দফায় হাত পরিষ্কার করে উপমা।তবুও যেনো গন্ধ পাচ্ছে।
এই গন্ধের জন্য উপমা সকালে নাশতা করতে পারলো না।দুপুরে খাওয়ার সময় ও উপমার অস্বস্তি লাগছে।কিছুই খেতে পারছে না।
রাগ করে ভাবীকে শুনিয়ে শুনিয়ে মা’কে বললো, “আমার জন্য একটু ভর্তা করে দাও মা।শিল পাটায় বেটে দাও।”
শাহেদা মেয়ের আক্কেল দেখে বিরক্ত হয়ে বললেন, “তুই জানিস না আমি এসব পারি না।দিন দিন এমন বেক্কল হচ্ছিস তুই!”

অভিমানে উপমার কান্না আসে।রাগ করে না খেয়ে উঠে যায়।এসব মাছ মাংস কিছুই উপমার কাছে ভালো লাগে না। রুমে গিয়ে উপমা শফিককে কল করে বলে ওর জন্য বাজার থেকে রেডিমেড বালাচাও আনতে।
রাতে ফেরার সময় শফিক উপমার জন্য বালাচাও নিয়ে আসে।
সারাদিনের অনাহারে থাকা উপমার কাছে মনে হয় সে আকাশের চাঁদ পেয়েছে যেনো।খেতে বসে উপমার আশাভঙ্গ হয়ে যায়।
বালাচাওটা কেমন কটু গন্ধ আর লবণ দিয়ে ভরিয়ে রাখা।
হতাশ হয়ে উপমা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে পড়ে।একদিনেই তার মনে হচ্ছে সে যেনো এখানে অযাচিত।
নিজেকে নিজে সাহস দেয়।এক কূল নিজে হারিয়ে যাওয়ার পথে,এক কূলকে আঁকড়ে ধরতে হবে।ভাইকে হাতে রাখতে হবে।

নিজের ক্ষতির তোয়াক্কা না করে উপমা চেয়ার থেকে ফ্লোরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়ার অভিনয় করলো।
শফিক ছুটে এসে উপমাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো।জান্নাত এসে পাশে দাঁড়ায়, শফিক পানি আনতে যায়।
উপমার দুই চোখ পিটপিট করছে।
জান্নাতের ভীষণ রাগ হয়।মানুষ এতো নাটকবাজ কীভাবে হয়?
অজ্ঞান হওয়ার অভিনয় করছে এখানে শুয়ে। জান্নাত উপমার পায়ে একটা চিমটি কাটে। উপমা সাথে সাথে মৃদুস্বরে উফ করে উঠে। শফিকের পায়ের আওয়াজ পেয়ে উপমা মটকা মেরে পড়ে থাকে।
উপমার চোখেমুখে পানির ছিঁটা দেয় শফিক।
জান্নাত চলে যায়। খাবার অর্ধেক খেয়ে নাটক দেখতে উঠে এসেছে।উপমা সত্যি ভেবেছিলো প্রথমে। কিন্তু এখন দেখছে একেবারে জাত অভিনেত্রী উপমা।
জান্নাত জানে এবারের ঝড়টা ওর উপর দিয়ে যাবে।নিজেকে শক্ত করে জান্নাত।
লোকে বলে নিচুতে পানি জমে।

কথাটা ভুল না।জান্নাতকে নরম পেয়ে ওরা পেয়ে বসেছিলো।
পানির ছিঁটা দিতেই উপমা চোখ মেলে তাকায়।কাতর গলায় বললো, “আমি মরে যাবো ভাইয়া।আমার শরীর খারাপ লাগছে।”
“কি হয়েছে?”
“খুবই দুর্বল লাগছে।”
“খাবার খাস নি?”
“কি দিয়ে খাবো?আমি তরকারি খেতে পারি না।বাবার বাড়ি আসে মানুষ এই সময়ে আদরে আহ্লাদে থাকার জন্য অথচ আমি আসার পর থেকে এক বেলা পেট ভরে খেতে পারি নি।এজন্যই তো বেশি দুর্বল হয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম।”
শফিক থমথমে সুরে জান্নাতকে ডাকে।

জান্নাত জবাব দেয়,খাবার খাচ্ছে।এখন আসতে পারবে না।শফিক যাতে উঠে যায়।শফিকের মাথায় রক্ত উঠে যায়।জান্নাতের খাওয়া শেষ প্রায়।প্লেটটা টান দিয়ে সরিয়ে শফিক চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, “আমার বোনটা গত রাত থেকে কিছু খেতে পারছে না,তুমি ওর পছন্দ মতো কিছু করে দাও নি কেনো?”
“আমি কেনো করে দিবো?আমি তোমার বোনের মেইড?”
“তুমি বেশি বাড়াবাড়ি করছো জান্নাত।তুমি জানো না এই সময়টা কেমন যায় একটা মেয়ের?”
“আমার থেকে ভালো তোমার কোনো বোন জানে না।বরং তুমি জানো না কিছু। কিংবা বলা যায়,বোনদের বেলায় জানো,স্ত্রীর বেলায় অন্ধ হয়ে যাও।আজ এতো কষ্ট হচ্ছে কেনো তোমার? শ্রেয়ান পেটে থাকতে কতো দিন তোমাদের হাতেপায়ে ধরে বলেছি এক বেলা একটু আম্মার বাসায় যাইতে দাও।আম্মার হাতের খাবার খাইতে পরান বের হয়ে যায় যেনো।তুমি, তোমার মা কেউ-ই যেতে দাও নাই।তোমার বোন এখন তরকারি দিয়ে ভাত খেতে পারে না কেনো?
আমার বেলায় তোমার মা বোন বলতো নাটক করি তোমার অ্যাটেনশন নেওয়ার জন্য।”

“বাড়তি কথা বলবা না।উপমাকে জিজ্ঞেস করো ও কী খেতে চায়।”
“না জিজ্ঞেস করলে?”
“আমার চাইতে খারাপ কেউ হবে না জান্নাত, কথা বাড়াবে না।”
“তোমার খারাপ রূপ আমার কাছে অজানা নেই।তাই এখন আর ভয় পাচ্ছি না।”
জান্নাত উঠে দাঁড়ায়।শ্রেয়ানকে কোলে নিয়ে রুমে ঢুকে রুমের দরজা ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে দেয়।
শফিক হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে।জান্নাতের এত্তো সাহস!

ইরা মনমরা হয়ে বসে আছে সারাদিন। সকালে লিনা এসেছিলো ক্লাসে যাওয়ার জন্য। ইরার যেতে ইচ্ছে করে নি।ইরা যাবে না বলায় লিনাও থেকে গেলো।লিনা থেকে যাওয়ায় ইরা ঝামেলায় পড়ে গেলো। লিনাকে কি খাওয়াবে?
নিজেরা সবসময় যেমন খায় লিনাকে তো সেসব দেওয়া যায় না।
কি করবে ভাবতে ভাবতে ইরা শুঁটকি ভুনা,শিং মাছের পাতলা ঝোল,ডিমের কষা রান্না করে নিলো।
ইরার বুকের ভেতর কেমন শূন্য শূন্য লাগছে।ভাবী চলে গেলো গতরাতে।
সাগর সেই মুহূর্তে মা বোনকে বলে দিয়েছে উপমার নামটাও সাগর শুনতে চায় না এই বাড়িতে। এই বাড়িতে উপমা নামে কেউ ছিলো না কোনোদিন।
সকালে নাশতা খেয়ে সাগর চলে গেলো অফিসে।যেনো কিছুই হয় নি।স্বাভাবিক কথাবার্তা। অথচ ইরার বুকের ভেতর জ্বলেপুড়ে যায়। মানুষ কীভাবে মানুষকে এভাবে ভুলে যেতে পারে?
বারান্দায় কয়েকটা বুলবুলি পাখি আসে রোজ,একদিন না আসলে ইরার কেমন দুঃখ দুঃখ লাগে।পৃথিবী বড় বিষন্ন মনে হয়।

অথচ মানুষ কেমন নিশ্চিন্তে মানুষকে ভুলে যায়।
কে জানে তাদের মন নাকি পাথর বুকের ভেতর।
শুঁটকি উপমার ভীষণ প্রিয়। কে জানে খেতে পারছে কিনা ঠিক করে ওই বাড়িতে!
পারবে নিশ্চয়!
ওখানে তো সবাই উপমার নিজের লোক।
দুপুরে খেতে বসে লিনা ভীষণ চমৎকৃত হয় এই খাবারগুলো সচরাচর লিনাদের বাসায় হয় না।
ইরার হাতের রান্না খেয়ে লিনা আরেক দফা মুগ্ধ হয়।
ইরার হাত ধরে লিনা বলে, “তোর হাত সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে দেওয়া উচিত ইরা।কুটু মিয়াকে জানিস?মনে হচ্ছে কুটু মিয়া তোর ছাত্র ছিলো।”

“বাজে বকিস না।তুই সবসময় রিচ ফুডে অভ্যস্ত বলে এসব সাধারণ খাবার তোর কাছে অমৃত লাগছে।আমরা যেহেতু সবসময় খাই তাই আমাদের এতো আহামরি টাইপ লাগে না।”
শারমিন কিছু বললো না। ইরার রান্না ভীষণ ভালো সেটা সবাই এক বাক্যে স্বীকার করবে।তিনি ইরার সাথে রেগে আছেন বলেই কিছু বলেন নি।উল্টো খাবার অসমাপ্ত রেখে উঠে গেলেন।
ইরার কেমন বুক কেঁপে উঠে।
মা হয়ে মেয়ের সাথে এমন করছেন শুধুমাত্র টাকার জন্য!
ইরার সম্মানের চাইতেও টাকা বেশি জরুরি হয়ে গেছে!

প্রিয় ইরাবতী পর্ব ৭

লিনা বললো, “আগামীকাল আমার ভাইয়ারা সব বাবা মা দেশে আসছে।বাবা একটা পার্টির ব্যবস্থা করেছেন।তোর কিন্তু যেতেই হবে।কোনো কথা শুনবো না এবার। কোনো অযুহাত না।”
“আমাদের বাসার অবস্থা ভালো না লিনা।আমি পারবো না।”
“পারবি,তোকে পারতে হবে।তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।”
ইরা উত্তর দেয় না।

প্রিয় ইরাবতী পর্ব ৯