প্রিয় ইরাবতী পর্ব ৯
রাজিয়া রহমান
সন্ধ্যা বেলায় আকাশ আজও অন্ধকার হয়ে উঠে। ইরা খানিকক্ষণ সাগরের রুমে বসে থাকে। বুকটা কেমন ভার ভার লাগছে।ভাই ভাবীর সম্পর্কটা নিয়ে ইরার চিন্তা হয়।নতুন যে আসবে,সে কি একটা সুস্থ পরিবার পাবে না?
একটা নিরাপদ পরিবেশ পাবে না?
ভাবীর অনেক দোষ আছে ইরা জানে তবুও ইরার মন উপিমাকে দোষী ভাবতে চায় না।
লিনা ইরাকে খুঁজে পাচ্ছে না অনেকক্ষণ ধরে।
শেষে এসে দেখে সাগরের রুমের জানালার সামনে বসে আছে ইরা।
লিনা কাঁধে হাত রাখতেই ক্রার চোখ থেকে দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।
লিনা বিরক্ত হয়ে বলে, “তুই এমন কেনো?জসীমউদ্দিনের একটা কবিতা আছে,ঠিক ওরকম।”
ইরা হেসে বলে, “কোন কবিতা?”
“আমার একুল ভাঙ্গিয়াছে যেবা আমি তার কুল বাধি,
যে গেছে বুকেতে আঘাত হানিয়া তার লাগি আমি কাঁদি;
সে মোরে দিয়েছে বিষ ভরা বান,
আমি দেই তারে বুক ভরা গান;
কাটা পেয়ে তারে ফুল করি দান সারাটি জনম ভর,
আপন করিতে কাদিঁয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।
ইরা জীবন অনেক কঠিন। তুই এসব বোকামি করিস না।তোর ভাবী একজন ভীষণ জঘন্য মানুষ। এতো ভালোবাসা কিসের তোর ওনার জন্য? উনি তো তোকে ভালোবাসে না ইরা।”
ইরা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, “একদিন তোকে লুকোনো গল্পটা বলবো। তাহলে বুঝবি সেদিন।
ঝমঝম বৃষ্টি নেমেছে। ইরা চঞ্চল হয়ে উঠে। লিনা ইরার হাত ধরে বললো, “চল ভিজি।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ইরা না করলো না বুকের ভেতরের জ্বলুনি তাতে যদি একটু কমে।ছাদে লাইট থাকায় ভিজতে ভয় লাগছে না।
ছাদে উঠে ইরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।
পাশের ছাদ থেকে একটা ঢিল এসে পড়লো ইরাদের ছাদে। ইরা চমকে উঠে।ইরা পাশের বিল্ডিংয়ের দিকে তাকিয়ে দেখে রাফি দাঁড়িয়ে আছে।
লিনা এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে একটা পলিথিনে মোড়ানো কিছু একটা। লিনা হাতে নিতেই ইরা কেড়ে নেয়।তারপর ছুড়ে ফেলে দেয় বাহিরে।এক মিনিট ও না দাঁড়িয়ে নেমে যায় নিচে।
রাফির রাগ লাগে।এতো অহংকার কিসের!
ভার্সিটিতে পড়ে তার জন্য!
নাকি চামড়া সাদা তার জন্য?
জামা কাপড় পালটে নেয় ইরা, লিনা দুজনেই।ইরা গিয়ে লেবু চা করে আনে।পেঁয়াজ, মরিচ, চানাচুর, সরিষার তেল দিয়ে মুড়ি মাখায়।
শারমিন খায় না।গাল ফুলিয়ে বসে থাকে।ইরা পাত্তা না দিয়ে লিনাকে নিয়ে খেয়ে নেয়।
রাতে সাগর ফিরলে লিনা ভীষণ বিনীত হয়ে সাগরকে অনুরোধ করে ইরাকে যেতে দিতে ওদের বাসায়।সব ফ্রেন্ডরা আসবে।
সাগর এক মুহূর্ত চিন্তা করে। বাসায় উপমা নেই।ইরা যে উপমাকে মিস করে সেটা সাগর জানে।তারচেয়ে বন্ধুদের সাথে সময় কাটালে ভালো লাগবে ভেবে সাগর অনুমতি দেয়।
সকাল বেলায় উপমা ইরাকে নিয়ে বের হয় বাসা থেকে।
নিচে নামতেই ইরা দেখে রাফি দাঁড়িয়ে আছে। দুই চোখ টকটকে লাল।গতরাতে অনেকক্ষণ রাফি দাঁড়িয়ে ছিলো বৃষ্টিতে।ভোররাতে জ্বর এসেছে।
ইরাকে যেতে দেখে ছুটে আসে। স্থান কাল পাত্র সব ভুলে গিয়ে ইরার হাত ধরে টেনে ধরে বললো, “কি হয়েছে তোমার? এতো অহংকার দেখাচ্ছো কেনো আমাকে?”
ইরা হতভম্ব হয়!
এই ছেলেটার সাহস তো কম নয়!
ইরা নিজের রাগ সামলাতে পারে না। ঠাস করে চড় মারে রাফির গালে।
আশেপাশের সবাই তাকিয়ে থাকে।
“আর কখনো আমার হাত ধরা তো পরের কথা, আমার দিকে তাকানোর ও সাহস করনেন না।আপনি কে আমার? কে অধিকার দিয়েছে আমার হাত ধরার?এতো স্পর্ধা কিসের আপনার?”
রাফি হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
ইরা লিনার দিকে তাকিয়ে বললো, “আমার যেতে ইচ্ছে করছে না লিনা।আমি পরে এক সময় যাবো।আজকে থাক।”
ইরা গটগট করে হেঁটে চলে যায়।
লিনা ব্যাপারটা সম্পূর্ণ পর্যবেক্ষণ করে। লিনার মনে হয়, ইরাকে সে যতটা নরম মেয়ে ভাবছে,ইরা আদৌও ততটা নয়।
পরিস্থিতি অনুযায়ী ইরা নিজেকে কঠিন / নমনীয় করে তুলতে পারে।
মা’র সাথে কথা বলতে হবে ভালো করে।
শফিক সারারাত সোফায় শুয়ে কাটিয়ে দিলো।জান্নাত দরজা খুলে রেখেছে যদিও কিছুক্ষণ পর শফিক জিদ করে রুমে যায় নি।সোফায় শুয়ে শুয়ে মশার কামড় খেতে খেতে জান্নাতের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে ফেলেছে।
সকালে জান্নাত উঠে নিত্য দিনের মতো কাজে লেগে গেলো।শফিক কোনো কথা বললো না জান্নাতের সাথে। জান্নাত ও আগ বাড়িয়ে কথা বললো না। রোজকার মতোই জান্নাত রুটি,ভাজি করে টেবিলে রাখলো।
শফিক গিয়ে উপমাকে জিজ্ঞেস করলো, “কি খাবি?”
“আমার আর খাওয়া!আসার পর থেকেই তো এক প্রকার না খেয়েই আছি।”
“কি খাবি বল।”
“নারিকেল তেল নিতে গেলে মা যে আগে মচকা বানাতো,ওটা খেতে ইচ্ছে করছে।”
(নারিকেল তেল বানানোর সময় এই খাবারটা বানায়।আমি জানি না বাংলাদেশের সব অন্ধলে এই খাবার প্রচলিত কি-না কিংবা কোন এলাকায় কি নামে পরিচিত। তবে আমাদের লক্ষ্মীপুরে,নোয়াখালীর এদিকে একে মচকা বলে জানি আমরা।)
শফিক সোজা রান্নাঘরে গেলো।জান্নাত প্রস্তুত ছিলো। শফিক গিয়েই সোজাসুজি বললো, “নারিকেল ভাঙ্গো,উপমার জন্য মচকা বানাও।”
“আমি কখনো এসব করি নি।আমি অনেক কাজ আছে।পারবো না।”
শফিক জান্নাতের চুলের মুঠি চেপে ধরে। অনেক ধৈর্য্য ধরে ছিলো। নরম কথায় কাজ হয় নি যখন তখন শফিক কঠোর হবে।
জান্নাতের থুতনিতে জোরে চাপ দিয়ে বললো, “তুই তো বানাবী,তোর মা ও বানাবে।খা**কির মেয়ে,সাহস কতো তোর!
আমার সাথে বাড়াবাড়ি করছিস!আমি কে তোর কোনো ধারণা আছে?শেষ করে দিবো তোকে আমি।”
জান্নাত অনেক কষ্টে বললো, “আমি তো শেষ হবোই।তবে মনে রেখো,তুমি ও শান্তি পাবে না।তোমাকে ও আমি শেষ করে ছাড়বো।”
“কি করবি তুই?”
জান্নাত নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, “তোমার নামে মামলা করবো।যেই চাকরির বাহাদুরি দেখাও সবাই মিলে সেই চাকরিটাই হয়তো থাকবে না।তুমি ভেবো না আমি ফাঁকা আওয়াজ দিচ্ছি।
আমি আরো আগে থেকেই একটু একটু করে প্রমাণ জোগাড় করে রেখেছি।আমার উপর করা অত্যাচার, তোমার ঘুষ নেওয়ার প্রমাণ, ছবি,ভিডিও সবকিছু জমিয়েছি।
ভেবো না আমার কাছে রেখেছি সব।একটা করে কপি আমার নিরাপদ জায়গায় পাঠিয়ে রেখেছি পেনড্রাইভে।আমি মরবো আক্ষেপ নেই তবে তোমাদের পুরো ফ্যামিলিকে শিক্ষা দিয়ে যাবো।”
শফিক হতভম্ব হয়ে যায়। জান্নাত ফোন থেকে এমন ভিডিও বের করে শফিককে দেখায়।
স্পষ্ট ভিডিওতে দেখা যায় নিজের বাসার ড্রয়িং রুমে বসা শফিক ইউনিফর্ম পরেই কথা বলছে এক জনের সাথে। স্পষ্ট সব শোনা যাচ্ছে সবকিছু। শফিক ২ লাখ টাকা ঘুষ চায় তা না হলে রিপোর্ট জমা দিয়ে দিবে।
শফিক জান্নাতের দিকে তাকায়। জান্নাত মুচকি হেসে বললো, “এক বছর ধরে একটু একটু করে সব জমিয়েছি।আমার শরীরের প্রতিটি লোমকূপে তোমার করা আঘাতের দাগ আছে।আমার হারানোর কিছু নেই আর।আফসোস থাকবে আমার ছেলের জন্য। ও বাবা মাহারা হয়ে যাবে।
তাই ভালো চাও তো আমার সাথে মানুষের মতো ব্যবহার করো,নিজে ভালো থাকো আমাকে ও ভালো থাকতে দাও।”
শফিকের ধারণা ও ছিলো না জান্নাত কখনো এসব বলবে বা এসব করবে!
জান্নাত এতো দূর পর্যন্ত চলে গেছে!
কিছুক্ষণ পর জান্নাত বললো, “উপমাকে কাল পরশু ওর শ্বশুর বাড়িতে পাঠিয়ে দাও।এতো দিন তো জানোয়ার ছিলে,এবার একটু মানুষ হওয়ার চেষ্টা করো।নিজের মাথার কুবুদ্ধিগুলোকে দূরে সরিয়ে একটু সুবুদ্ধি আসতে দাও।একবার ভেবে দেখো,তোমার বোন তো কোনো কিছুই তো খেতে পারে না,ওর ননদ,শাশুড়ী যদি খারাপই হতো তাহলে প্রেগন্যান্সির এতো দিন পর্যন্ত ও ওখানে কিভাবে থাকছে?এই যে ওর পাটায় বাটা ভর্তা লাগে তিন বেলা,এসব কি তোমার বোন কখনো নিজে করে খায়? নিজের বিবেককে প্রশ্ন করো।
নিশ্চয় উপমা করে না।তাহলে কে করে? ওর শাশুড়ী বা ননদ।
ওরা যদি খারাপ হতো তাহলে কি এসব করতো তোমার বোনের জন্য?
যদি ভেবে থাকো উপমা আর সাগরের ছাড়াছাড়ি করে ফেলবে তবে এখনো বোকার স্বর্গে বাস করছো।তোমার মতো একটা জানোয়ারের ঘর আমি কেনো করছি বলো তো?
শুধুমাত্র আমার একটা ছেলে আছে।আমার কাছে তুমি খারাপ স্বামী হলেও ওর কাছে তো ওর ভালো বাবা।ওর জীবন এলোমেলো হয়ে যাবে।
উপমার সন্তানের জীবন ও এলোমেলো হয়ে যাবে।আর তুমি কী ভাবো এরপর আবার উপমাকে বিয়ে দিলে সেখানে ও এতো শান্তি পাবে?সাগরের মতো স্বামী পাবে?ইরার মতো ননদ পাবে?একটা কথা ভালো করে জেনে রাখো,তুমি যেমন তোমার দুই বোন ও তোমার মতোই।
প্রিয় ইরাবতী পর্ব ৮
তোমার চাইতে ভালো কে জানবে আর তুমি কেমন?”
শফিকের এখনো ঘোর কাটছে না।জান্নাত কেমন আত্মবিশ্বাসের সাথে কথা বলছে!
তবে যা বলছে উপমার ব্যাপারে ভুল বলে নি।।