অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৭৯
নুসাইবা ইভানা
নয়না সবকিছু প্যাকিং করে নিলো। তারপর নিচে এসে ফ্রিজ থেকে আইসক্রিম নিয়ে সোফায় বসে আইসক্রিম খেতে খেতে গান শুনছিল।
এমন সময় মেহনূর এসে নয়নার পাশে বসল। “গতকাল তোমাকে কী বলেছিলাম, মনে আছে?”
“আমার ব্রেন খুবই দুর্বল এসব ক্ষেত্রে। সে কোনো অপ্রয়োজনীয় কথা কিছুতেই মনে রাখতে চায় না।”
“বলেছিলাম, এক বিছানায় শুয়েও মানুষের মধ্যে থাকে শত মাইলের দূরত্ব। তোমার কী মনে হয়, রেজা তোমাকে ভালোবাসে?”
“ভালোবাসা কী জিনিস, আপু? খায়, নাকি মাথায় দেয়?”
“দেখো নয়না, শরীর পেলেও মানুষের মন পাওয়া যায় না।”
“মন দিয়ে আমি কী করব! মন তো দেখাও যায় না। শরীরটা আমার সঙ্গে সব সময় থাকলেই হয়। মনটা চাইলে আপনিও রাখতে পারেন, আপু। ওসব মন-টন আমার ধরকার নেই। আস্ত মানুষটাই তো আমার।”
“তুমি কি জানো, তুমি প্রচণ্ড রকম বেয়াদব একটা মেয়ে?”
“এই মুহূর্তে জানলাম। আইসক্রিম খাবেন, আপু? এটার টেস্ট অনেক জোস। মুখে দিলেই স্বাদের ব্লাস্ট হচ্ছে।”
“এত অহংকার কীসের তোমার? রেজা ছাড়া তোমার জীবনে আর কোনো অ্যাচিভমেন্ট আছে?”
“এখন অবধি নেই। তবে খুব তাড়াতাড়ি আসবে, সে আমার কোল আলো করে।”
“চরম অসভ্য একটা মেয়ে তুমি।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“কী যে বলেন, ননদী! ননদের সঙ্গে মজা করব না, তবে কার সঙ্গে করব?” “কানে কানে একটা কথা বলি, শোনো। ওই বেডার দেহের প্রতিটি লোমকূপে আমার নাম লেখা। এবার ভালোভাবে ওনার স্পর্শের স্ট্যাম্প লাগাতে সিলেট নিয়ে যাচ্ছি। ইনশাআল্লাহ, ফিরে এসে আপনাকে ফুপি হওয়ার সুসংবাদ দেব।”
মেহনূর রেগে উঠে যাবে, এমন সময় মিতা বেগম এসে বললেন, “তোরা গল্প করছিস? ভালোই হয়েছে। নিজেদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুললে একসঙ্গে থাকতে সুবিধা হবে ভবিষ্যতে।”
“আমি তো চলে যাব, আম্মি। তোমাদের পরিবারে আমি তো স্থায়ী না।”
“স্থায়ী না, কিন্তু হতে কতক্ষণ?”
নয়না চুপচাপ বসে আছে। মেহনূর আর মিতা বেগম কথা বলছে।
মিতা বেগম সার্ভেন্ট ডেকে বললেন, “মিষ্টি নিয়ে আয় তো। সুখবর দেওয়ার আগে মিষ্টিমুখ করতে হবে তো।”
সার্ভেন্টের হাত থেকে মিষ্টির প্লেট নিয়ে প্রথমে মেহনূরকে খাওয়ালেন, তারপর নয়নাকে। হাসিমুখে বললেন, “জাহিন তোকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেছে।”
নয়না শুনে খুশি হলো, আবার বিরক্তও হলো। মেহনূরের মতো মেয়ের সঙ্গে সারাজীবন একসঙ্গে থাকতে হবে!
নয়না মিতা বেগমকে জড়িয়ে ধরে বলল, “খুব তাড়াতাড়ি একটা বিয়ে খাব। তাও দেবরের বিয়ে। সেই মজা হবে। আম্মু, আমি এখন রুমে যাই।”
“যা, গিয়ে একটু রেস্ট নে।”
নয়না রুমে আসছিল, পথে জাহিন উচ্চস্বরে বলল, “আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন, চৌধুরী বাড়ির বড় বৌ?”
নয়না থমকে দাঁড়াল। খানিক চুপ থেকে বলল, “ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন, ভাইয়া?”
“আমি সবসময় ভালো থাকি।”
নয়না সামনে পা বাড়াতেই জাহিন বলল, “শুনুন…”
নয়না সামনের দিকে ঘুরে বলল, “আপনি আমাকে ভাবি ডাকতে পারেন। অথবা আপুও ডাকতে পারেন, ভাইয়া।”
“ভবিষ্যতে দেখা যাবে কী নামে ডাকব।” বাঁ হাত থেকে একটা শপিং ব্যাগ ডান হাতে নিয়ে নয়নার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এটা আপনার জন্য। সিঙ্গাপুর থেকে এনেছি। আপনি এ বাসায় আসার পর আপনাকে কিছু দেওয়া হয়নি তো, তাই।”
“ধন্যবাদ, ভাইয়া। তবে এসবের কোনো দরকার ছিল না।”
“জীবনে কত কিছুই তো আমরা করে থাকি, যার কোনো দরকারই ছিল না। সরি।”
“সরি কেন?”
“এমনি।”
নয়না বলল, “কংগ্র্যাচুলেশনস।”
“ধন্যবাদ।”
নয়না রুমে এসে বেডের ওপর বসে বলল, “আমি যতটা ভেবেছি, ততটা খারাপ না মনে হয়। যাক, বাবা, বিয়ে করলেই বাঁচি। তুষিকে খবরটা দিই।” নয়না নিজের ফোন থেকে তুষির নম্বরে কল করল।
ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই তুষি বলল, “নয়ন, তোর সঙ্গে আমার জরুরি কিছু কথা আছে।”
“রাখ তোর জরুরি কথা। নিশ্চিত নোট দিতে বলবি? তার আগে আমার কথা শোন।”
“না, আমার কথা বেশি ইম্পর্ট্যান্ট, নয়ন।”
“এত ইম্পর্ট্যান্ট? নিশ্চিত নতুন প্রেমে পড়েছিস। জানিস, জিয়ানের ভাইয়ের বিয়ে খুব তাড়াতাড়ি।”
“সত্যি, জাহিনের বিয়ে?”
“হ্যাঁ, সত্যি বিয়ে। অবশেষে ওই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হলাম। আগে জাহিনকে দেখলেই কেমন যেন লাগত। মনে হতো আমার দিকে কেমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিন্তু জানিস, আজ আমার সঙ্গে সুন্দর ব্যবহারও করল। যতটা খারাপ ভেবেছিলাম, ততটা খারাপ না। এবার তোর ইম্পর্ট্যান্ট কথা বল।”
“কেমিস্ট্রি নোট লাগবে। দিতে পারবি?” তুষি জাহিনের কথাটা বলতে চাইছিল, কিন্তু জাহিন বিয়ে করছে, তাই সে-সব কথা আর তুলল না।
“জানতাম, তুই এমন কিছুই বলবি। আমি আজ চলে যাব, তুই বাসা থেকে এসে নিয়ে যাস।”
তুষি তাড়াহুড়ো করে বলল, “আচ্ছা, পরে কথা হবে।” তুষি ফ্লোরে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল। জাহিন বিয়ে করছে। “আমার করা ভুলটা না হয় আড়ালেই থাকুক। এক জীবনে মানুষ তো কত ভুল বয়ে বেড়ায়, কত ভুল নিজের মধ্যেই দাফন করে ফেলে। আমি না হয় এই ভুলটাকে আজ দাফন করে দিলাম। অতীতের ভুল ভবিষ্যতে কোনো খারাপ প্রভাব না ফেলুক। অন্তর, তুমি কোথায় আছো? এভাবে কেন আমাকে একা করে দিয়ে হারিয়ে গেলে! আমি তোমাকে ভালোবাসি। ফিরে এসো আমার কাছে।”
সায়না চেয়ারে বসে আছে। অনিকেত খিচুড়ি রান্না করছে। সায়না ডিরেকশন দিচ্ছে।
অনিকেত সামনের দিকে ঘুরে বলল, “জীবনে রান্না করতে হবে, এটা তো কখনো ভাবিনি। বৌ, তুমি ধন্য, ডাক্তার অনিকেত মাহমুদকে দিয়ে রান্না করানোর জন্য।”
“তো, রান্না না করলে ভবিষ্যতে যখন আমি অসুস্থ হয়ে যাব, তখন কী খাব? আমাদের যখন গুলুমুলু বাবু আসবে, তখন সেবা করবে কে? তাই আপনাকে টুকটাক রান্না, সঙ্গে ঘরের কাজও শিখতে হবে।”
অনিকেত খিচুড়ি দমে দিয়ে সায়নাকে কোলে তুলে নিয়ে এল রুমে। বেডে বসিয়ে দিয়ে বলল, “তুমি এমন ডাকিনী কেন?”
সায়না অনিকেতের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “আপনি এমন আলাভোলা ক্যাবলাকান্ত, তাই।”
“তবে যাহোক, তুমি কিন্তু রসগোল্লার মতো সুইট।”
সায়না অনিকেতের গালে চুমু দিয়ে বলল, “তুমি তো রসমালাই। পুরাই মাখন।”
“লজ্জা নেই কেন তোমার! কই, চুমু খাব আমি, তা না, তুমি চুমু খাচ্ছ, আবার কমপ্লিমেন্টও দিচ্ছ! কী বেহায়া বৌ গো তুমি।”
সায়না অনিকেতের ঠোঁটে চুমু দিয়ে বলল, “তোমার মতো লজ্জা পেতে থাকলে এতদিনে বাসরও হতো না। বাচ্চা তো বহু দূরের কথা। আর তাছাড়া, তুমি আমার। আমার জিনিসকে চুমু খাব, আদর দেব, কমপ্লিমেন্ট দেব। এতে আবার কীসের লজ্জা গো?”
অনিকেত “খিচুড়ি” বলে এক দৌঁড়ে কিচেনের দিকে গেল।
সায়না বেডে বসে হাসছে। “এই লোকটা এত কিউট কেন! দেখলেই পাঁচ-দশটা চুমু খেতে ইচ্ছে করে। ইশ, কী যে ইনোসেন্ট।”
নীলাঞ্জনা ডাক্তারের চেম্বারে বসে আছে। ডাক্তার বললেন, “আপনাকে কতবার বলব, টেনশন কম করবেন। ঠিকমতো খাবার খাবেন। বাচ্চার ওজন একদম কম। আর বেশি সময় নেই হাতে। এই মেডিসিনগুলো ঠিকমতো খাবেন। আর হ্যাঁ, পুষ্টিকর খাবার খাবেন। একদম টেনশন নেবেন না। এতে বাচ্চার সমস্যা হবে।”
নীলাঞ্জনা চেম্বার থেকে বের হয়ে গাড়িতে এসে বসল। এত মাস সে একা আসে ডাক্তার দেখাতে। তার দেখাশোনা, খোঁজখবর যতটুকু রাখার, জাহানারা বেগম রাখেন। কিন্তু তার নিজের জন্মদাত্রী মা একবারও তার ভালো-মন্দ খোঁজ নেন না! নীলাঞ্জনা জিয়ানকে ধন্যবাদ লিখে টেক্সট পাঠাল। সেদিনের পর থেকে লাবিব তাকে কোনো রকম ডিস্টার্ব করেনি।
“জিয়ানের মনে কি আমার জন্য কোথাও একটু জায়গা রয়ে গেছে?” পরক্ষণেই বলল, “না, তা তো সম্ভব না। জিয়ান এমনিতেই হাম্বল পার্সন। সেই হিসেবে হয়তো আমার মতো অসহায়কে সাহায্য করেছে। আমার বোনটা কত ভাগ্যবতী, এমন একজন হ্যাসবেন্ড পেয়েছে। অথচ এই ভাগ্য আমি নিজের হাতে ঠেলে ফেলে দিয়েছিলাম।” নিজের পেটের ওপর হাত রেখে বলল, “তুই ছাড়া তোর মায়ের তো আর কেউ নেই। একমাত্র তুই, তোর মায়ের বেঁচে থাকার সম্বল। নয়তো এতদিনে তোর মা হয়তো মাটির নিচে থাকত। আমি বাঁচতে চাই, তোর জন্য। তোর কোমল স্পর্শ পেতে অধীর আগ্রহে ব্যাকুল হয়ে আছি। তুই আমার পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আলো।”
মান্নাত অনেক চেষ্টা করেও জাহিনের নজর থেকে পালাতে পারেনি। কোনোভাবে আর কারো সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারেনি। এখানে পরিচিত ছিল রিতু। তাকেও পায়নি। রিতুর ভাই অন্তর ছিল শেষ ভরসা। সেও ফোন ধরেনি। এয়ারপোর্টে এসেছে জাহিনের তিনজন গার্ডের সঙ্গে। অনেক আকুতি-মিনতি করেও তাদের হাত থেকে মুক্তি পায়নি। নিরুপায় হয়ে উঠে বসল প্লেনে। হয়তো এ জনমে আর কোনোদিন এদেশে আসা হবে না মান্নাতের।
অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৭৮
এভাবেই তার বাবা-মায়ের খুনিরা মুক্ত বাতাসে ঘুরে বেড়াবে। প্রভাবশালীদের ক্ষমতার কাছে তাদের মতো মানুষ একদম তুচ্ছ। আল্লাহ তায়ালার কাছে বিচার দেওয়া ছাড়া আর কোনো কিছুই যেন করার নেই। চোখ থেকে অশ্রু ঝরে গড়িয়ে ভিজে যাচ্ছে ওড়না। ইচ্ছে করছে এখানে বসে চিৎকার করে কাঁদতে, বলতে, “আমার বাবা-মায়ের মৃত্যুর বিচার চাই।” অথচ সে বড্ড অসহায়।