প্রিয় ইরাবতী পর্ব ১৫

প্রিয় ইরাবতী পর্ব ১৫
রাজিয়া রহমান

মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে বিকেলে।লিনার আরো কয়েকটা ফ্রেন্ডকে লিনা ইনভাইট করেছে।পরদিন ওদের বাসায় একটা পার্টি আছে তাই।
ঝুম বৃষ্টি দেখে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলো বৃষ্টিতে ভিজবে।
লিনা বললো, “আচ্ছা শোন,আমরা সবাই মিলে শাড়ি পরে ভিজবো।”
শায়লার আলমারি ভর্তি শাড়ি পরে আছে।দুপুরের ঘটনার পর শায়লা রাগ করে বের হয়ে গেছে।
লিনা এসবে যদিও অভ্যস্ত। ফিরবে দুই দিন পর।
বন্ধুদের সবাইকে নিয়ে লিনা শাড়ি সিলেক্ট করতে গেলো।ইরা বললো, “তোরা আমার জন্য একটা পছন্দ করে আনিস।”

লিনা ইরার কথা শুনলো না।ইরাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে এলো।
শায়লার ক্লোজেট খুলতেই লিনার বাকি ৬ বান্ধবীর মাথা ভোঁভোঁ করে ঘুরতে লাগলো। এতো কালেকশন!
কি নেই এখানে!
একটা রুম শুধু ক্লোজেট দিয়েই ভর্তি।
সবাই পাগলের মতো একবার এটা একবার ওটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগলো।
ইরা অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে দেখে শেষে একটা রাজকীয় নীল রঙের সিল্ক শাড়ি হাতে নিলো।
নীল রঙটা দেখেই কেমন ঘোর লাগা অনুভূতি হয়।ময়ুরের পেখমের সেই নীল রঙ।
ইরা লিনাকে জিজ্ঞেস করলো, “এটা নিবো?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“নে না,যেটা ইচ্ছে নে।মা কিছুই বলবে না।মা এসব এখন আর পরে না।সব আমার এসব।”
শাড়ি পরে সবাই সিদ্ধান্ত নিলো ছাদে যাবে।
ঝুম বৃষ্টিতে কয়েকটা বন ময়ুর যেনো নেঁচে উঠলো। ইকবাল চিলেকোঠার ঘরের চাবিটা ইশতিয়াকের রুম থেকে না বলেই নিয়ে এসেছে।
এই রুমটা ইশতিয়াকের।
তবে সুন্দরীদের জলকেলি উপভোগ করতে এই জায়গাটা একেবারে পারফেক্ট।
আনন্দে মেতে উঠতে গিয়ে ও ইরার কেমন যেনো অস্বস্তি লাগছে। মনে হচ্ছে কেউ যেনো খুব গভীর পর্যবেক্ষণ করছে ওকে।ইরা দ্রুত সরে এলো।চারদিকে তাকিয়ে দেখে কেউ-ই নেই।
ছাদে থাকা রুমটার দরজা ও বাহিরে থেকে তালা দেওয়া। তাহলে মনের ভেতর এমন খচখচ করছে কেনো?
আধভেজা হয়ে ইরা দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ।

কিছুতেই মনের খচখচানি যাচ্ছে না।
নীলি ইরাকে ডেকে বললো, “কিরে,ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?আয়।”
বৃষ্টিতে শাড়িটি নীলির দেহের সাথে একেবারে আটকে আছে।ইরা সবার দিকে তাকালো।
সবারই একই অবস্থা। পেটের দিকে শাড়ি নেই,বুক অর্ধনগ্ন।
নিজের উপর নিজের রাগ হলো ইরার।
এমন বোকামি কীভাবে করলো সে!
ইরা সিঁড়ি ঘরে দাঁড়িয়ে বললো, “আমার মনে হচ্ছে কেউ যেনো আমাদের দেখছে।প্লিজ সবাই নিচে নেমে আয়।”
রিমি হিহিহি করে হেসে বললো, “বাপরে,তোর তো গোয়েন্দা হওয়া উচিত ছিলো। এখানে কেউ আসবে কোথা থেকে?যত আজগুবি কথা। এরকম ভাব করিস যেনো নিজে একেবারে পর্দাশীল,বোরকা পরে থাকিস সারাক্ষণ।”
“ইরা,তোর সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি।”

ইরার দুই চোখ ভিজে এলো।
সিঁড়ি ঘরে দাঁড়িয়ে ইরা ওদের উচ্ছ্বাস দেখতে লাগলো।
কিছুক্ষণ পর নেমে এলো নিজের আধভেজা শাড়ি চেঞ্জ করতে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ইরার মনে হলো, “সত্যি কী আমি বেশি বাড়াবাড়ি করি সবকিছু নিয়ে?”
ইশতিয়াক হাসিবুল শেখের রুম থেকে ফিরছিলো। নীল শাড়ি পরে একটা মেয়েকে দুপদাপ পা ফেলে যেতে দেখে ইশতিয়াকের বহু বছর আগের একটা কথা মনে পড়ে গেলো।
এই শাড়িটাই সেদিন শায়লার পরনে ছিলো।
স্পেশাল এডিশনের ডিজাইনার শাড়ি এটা।ইশতিয়াক স্কুল থেকে ফিরেছে।সামনের বছর ইশতিয়াকের এসএসসি।
দুপুরের হাফ টাইমের পর ইশতিয়াকের ক্লাস করতে ইচ্ছে করলো না।ছুটি নিয়েই চলে এলো বাসায়।
ইশতিয়াক বাসায় ফরে দেখে বাসা কেমন শুনশান।যদিও ওদের বাসা সবসময় শুনশানই থাকে।ইকবাল থাকে আলাদা ফ্ল্যাটে ওর দুই বন্ধুর সাথে। হাসিবুল শেখ নিজের রুমেই থাকেন।শায়লা বিজনেসের কাজে বিভিন্ন জায়গায় ছোটাছুটি করে।

তবে বাড়িতে হেল্পিং হ্যান্ডরা আছে ৪-৫ জন।তাদের কাউকেই দেখা যাচ্ছে না।
ইশতিয়াক ফেরার সময় একটা অলকানন্দা ফুলের গাজরা নিয়ে ফিরেছে।মা’কে চুলে ফুল পরলে কি যে সুন্দর লাগে!
ইশতিয়াকের মনে হয় যেনো স্বর্গ থেকে নেমে আসা অপ্সরা।
গাজরা দিতেও ইশতিয়াক শায়লার রুমের দরজায় নক করে।
শায়লা দরজা খুলে ইশতিয়াককে দেখে ভূতের মতো চমকে উঠে। ইশতিয়াক এই মুহূর্তে এখানে!
মা’য়ের এমন বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে ইশতিয়াক চমকে উঠে। পরনের শাড়ি আধখোলা হয়ে আছে,এলোমেলো চুল,ছড়িয়ে আছে পুরো ঠোঁটে লিপস্টিক।
চোখের নিচে লেপ্টে যাওয়া কাজল।
ইশতিয়াক প্রথমে বুঝতে পারলো না।এক পা রুমের ভেতর দিতেই দেখে বিছানায় নগ্ন হয়ে শুয়ে আছে বাবার বন্ধু কামরুল আংকেল।

ইশতিয়াকের পায়ের নিচের মাটি সরে গেলো।
হুট করেই ইশতিয়াকের একটা হিসাব মিলে গেলো।কেনো লিনাকে দেখতে তাদের দুই ভাইয়ের মতো না হয়ে কামরুল আংকেলের মতো লাগে।
শায়লা ভেবেছিলো কাজের মেয়েটা এসেছে, ওকে শায়লা বলেছিলো এক বাটি আইস কিউব দিয়ে যেতে।সেই ভেবেই শায়লা দরজা খুলে ফেলেছে।
ইশতিয়াক হাত থেকে ফুলের গাজরাটা ফেলে দিয়ে ধীর পায়ে নিজের রুমে চলে আসে।
রুম থেকে বের হয় ইশতিয়াক দুই দিন পর।
ততক্ষণে ইশতিয়াকের ভেতরে আগুন তাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে।
শায়লা ইশতিয়াককে দেখলো কিন্তু কিছু বললো না।
ইশতিয়াকের দুই চোখ জ্বালা করছে অতীত ভাবতে গিয়ে। কতো দিন আগের কথা অথচ এখনো সেই ক্ষত তাজা বলে মনে হয় ইশতিয়াকের।

ইশতিয়াক ইরার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেখতে পেলো শায়লা আসছে।ইশতিয়াককে শায়লা খেয়াল করে নি।ইরাকে দেখেই শায়লা চমকে উঠে।
ইরার পরনে তার শাড়ি।
শায়লার গা জ্বলে রাগে।এটা তার ডিজাইনার শাড়ি, স্পেশাল এডিশনের।
লিনার ৫ম জন্মদিনে লিনার বায়োলজিক্যাল বাবা এই শাড়ি তাকে গিফট করেছে।
এই শাড়ি নিয়ে শায়লার দুঃখ ও রয়েছে।
শায়লা কড়া গলায় ইরাকে বললো, “এই শাড়ি তুমি কোথায় পেলে?তোমার সাহস হলো কীভাবে এই শাড়িটা পরার?”
ইরা থ’ হয়ে যায় । সে তো লিনাকে বলেই নিয়েছে।

ইরা জবাব দেওয়ার আগেই শায়লা বললো, “এই শাড়ির দাম জানো তুমি? তোমার মতো একটা ফ্যামিলির আধা বছরের খরচ চালানো যাবে।কোন সাহসে তুমি এই শাড়িতে হাত দিলে?”
“সরি আন্টি,আমি আসলে বুঝতে পারি নি।”
নিজেকে যথেষ্ট শক্ত রেখে ইরা কথাগুলো বললো। ভেতরে ভেতরে ইরা মোমের মতো গলে যাচ্ছিলো অপমানে।
শায়লা আরো কিছু বলতে যাবে পেছনে তাকিয়ে দেখে ইশতিয়াক দাঁড়িয়ে আছে। শায়লা আর কিছু না বলে চলে গেলো। ইশতিয়াকের ভীষণ মায়া হলো মেয়েটার জন্য।
বেচারা!
ইরা রুমে গিয়ে দ্রুত চেঞ্জ করে শাড়িটি ওয়াশ করে নিলো।বুকের ভেতর কেমন তোলপাড় করছে ইরার।
এতো অপমান!
এখানে ইরা থাকবে না আর।কিছুতেই না।এটাই এই বাসায় ইরার শেষ আসা।ইরা সিদ্ধান্ত নিলো যত শীঘ্রই সম্ভব চলে যাবে এখান থেকে। আজকে পারলে আজকেই,নয়তো কাল সকালেই।তবে লিনাকে কিছু জানাবে না। জানালে লিনা যেতে দিবে না।

ইরা চলে যেতেই ইকবালের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। এতো ভাব নেয় কেনো এই মেয়ে!
নিজেকে কী ভাবে!
একবার বাগে পেলে ইকবাল সব ভাব বের করে দিতো।
হাতের ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে ইকবাল। এখানে মেয়েগুলোর অনেকগুলো ছবি তুলেছে ইকবাল। শরীরের সাথে ভেজা লেপ্টে যাওয়া শাড়িতে এক একজনকে কেমন মোহনীয় লাগছে।শরীরের প্রতিটি বাঁক স্পষ্ট।
ইকবাল কল্পনা করে ইরাকে এভাবে দেখতে না জানি কেমন মোহনীয় লাগবে!
হতাশ হয় না ইকবাল।সুযোগ আছে অনেক এখনো।তবে ইকবাল দেরি করতে চায় না আর।
সন্ধ্যা বেলায় ইকবাল লিনাকে মেসেজ দিলো ইরাকে একবার ওর রুমে পাঠাতে কোনো বাহানায়।
ইরা বসে বসে একটা উপন্যাস পড়ছে।
বুকের ভেতরের অপমানকে ধামাচাপা দিতেই ইরা উপন্যাসে মন দিলো।
লিনা ডেকে বললো, “আমার কেমন জ্বর জ্বর লাগছে রে।আমাকে একটু থার্মোমিটার এনে দিবি দোস্ত?”

প্রিয় ইরাবতী পর্ব ১৪

“কোথায়?”
“আমার রুম থেকে বের হয়ে দুই রুম পরের রুমটায় দেখবি একটা মেডিসিন বক্স আছে।বক্সটা নিয়ে আয়।”
ইরা কথামতো বের হয় লিনার জন্য মেডিসিন বক্স আনতে।
রুমে ঢুকতেই কেউ একজন ইরার নাকে একটা রুমাল চেপে ধরে।
ইরা জ্ঞান হারায়।

প্রিয় ইরাবতী পর্ব ১৬