চেকমেট পর্ব ৫৩

চেকমেট পর্ব ৫৩
সারিকা হোসাইন

উত্তপ্ত মরুভূমিতে হঠাৎ হীম শীতল বর্ষণ ধারা যেমন অবিশ্বাস্য ঠিক তেমনি এই ভয়ানক রাতের আধারে মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে সুফিয়ান চৌধুরীর আবির্ভাব সারফরাজের কাছে কল্পনা ঠেকলো।নিজের চোখ দুটো যেনো ভুল দেখলো।কঠিন হৃদয়ের সারফরাজ এর ইচ্ছে হলো সুফিয়ান চৌধুরী কে জড়িয়ে ধরে এই মুহূর্তে চিৎকার করে কাঁদতে।সারফরাজ করুন চোখে সুফিয়ান চৌধুরীর পানে তাকিয়ে বহু কষ্টে বলে উঠলো
“রূপকথাকে ও আঘাত করেছে কমিশনার সাহেব।অধম আমি কিচ্ছুটি করতে পারিনি।ও রূপকথার শরীরে নয় আমার হৃদপিণ্ডে আঘাত করেছে।সেই আঘাত আমি যে সইতে পারছি না কমিশনার সাহেব!

মেয়ের গায়ে রুদ্ররাজ আঘাত করেছে ভেবেই পায়ের রক্ত মাথায় ছলকে উঠলো সুফিয়ান চৌধুরীর ।তার মন বললো রুদ্রের গায়ের চামড়া তুলে লবন মরিচ ভরতে।এদিকে সুফিয়ান চৌধুরী কে দেখে মোটেও ঘাবড়ালো না রুদ্ররাজ।সে আরো তেজী গলায় বলে উঠলো
“বুড়ো বয়সে বেঘোরে প্রাণ হারাতে এলি কমিশনার?
রুদ্রের মুখে তুই সম্বোধনে সুফিয়ান চৌধুরী তেঁতে উঠলো।চোয়াল শক্ত করে সুফিয়ান চৌধুরী রুদ্রের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“তোর জন্মই আজন্মের পাপ রুদ্ররাজ।নয়তো অমন নিকৃষ্ট পরিবারে কি করে তোর জন্ম হয়?বাপ দাদাই যেখানে হৃদয় হীন কসাই ছিলো সেখানে তুই আর ভালো হবি কি করে?বিধাতা বুঝি মরার জন্যই তোদের সৃষ্টি করেছে?তাই বলে এতোটা ঘৃণিত কোনো মানুষ হয়?অবশ্য তোর কি দোষ?দোষ তোর রক্তের।পঁচা রক্ত বইছে তোর শরীরে।দুর্গন্ধ ওয়ালা কালো রক্ত।থু
বলেই সুফিয়ান চৌধুরী রুদ্রের উদ্দেশ্যে থুথু ছুড়লেন।সুফিয়ান চৌধুরীর কথায় রুদ্রের ক্রোধ আকাশ ছাড়ালো।সে নিজের রাগ ধরে রাখতে না পেরে গুলি করতে চাইলো সুফিয়ান চৌধুরী কে।কিন্তু সেই সুযোগ দিলো না সুফিয়ান চৌধুরী।রুদ্রের হাতে গুলি করে দিলো দক্ষ হাতে।এরপর বলে উঠলো

‘দুদিনের মাস্তান হয়ে আমায় গুলি করবি?এতই সহজ?আরে পাপিষ্ঠ তুই যখন তোর মায়ের পেটে তখন থেকে বন্দুক চালাই আমি।পুলিশ হয়ে তোর মতো জোচ্চোর এর হাতের গুলি খেলে মান সম্মান থাকবে বল?
এদিকে গুলির তোড়ে রুদ্রের হাত থেকে পড়ে গেলো বন্দুক খানা।ব্যাথায় গর্জে উঠলো রুদ্র।রুদ্রের অপর হাতে এখনো রূপকথা বন্দি।রুদ্ররাজ এর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে হাতে শক্ত কামড় বসালো রূপকথা।ব্যাথা সইতে না পেরে রূপকথাকে ঝটকা দিয়ে ফেলে দিলো রুদ্র।অসুস্থ রূপকথা ঘাস যুক্ত উঠানের কোনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আর্তনাদ করে উঠলো।সারফরাজ দৌড়ে গিয়ে রূপকথাকে আগলে নিয়ে ঝাপ্টে ধরলো।রূপকথা সারফরাজ কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেদে উঠলো।সারফরাজ রূপকথার মাথায় চুমু খেয়ে দুর্বল গলায় বলে উঠলো

“সব ঠিক হয়ে যাবে।সব।কেঁদো না।
সুফিয়ান চৌধুরী উপস্থিত বাকি চার জনের পায়ে একে একে গুলি করে মাটিতে শুইয়ে দিলো।এরপর রুদ্রের সামনে এসে হিসহিস করে বলে উঠলো
“কোথায় কোথায় আঘাত করেছিস আমার মেয়েকে?
বলেই রুদ্রের গালে সপাটে এক ঘুষি মেরে জিজ্ঞেস করলো
“এখানে?
ঘুষির আঘাতে ছিটকে গেলো রুদ্র।সুফিয়ান চৌধুরী পুনরায় রুদ্রের কলার ধরে টেনে ঠোঁটে ঘুষি বসিয়ে বলে উঠলো
“নাকি এখানে?
নিজের নিয়ন্ত্রণ যেনো হারিয়েছেন সুফিয়ান চৌধুরী।যেই মেয়েকে আজ পর্যন্ত একটা ধমক পর্যন্ত দেননি সেই মেয়েকে আঘাত করেছে বাইরের একজন ক্রিমিনাল?কোমরের বেল্ট খুলে দুই ভাজ করে বকলেসে দিয়ে রুদ্রের ভ্রু পেঁচিয়ে কপালে আঘাত করে বলে উঠলেন
“কপালে মেরেছিস রাইট?ও আমার কত আদরের মেয়ে জানিস?

ব্যথায় দাঁত চেপে হুংকার ছেড়ে উঠলো রুদ্র।বেল্টের আঘাতে তার ভ্রু আর কপাল দুই ই কেটে রক্ত ঝরছে।হাত দিয়ে সেই রক্ত মুছে লম্বা চওড়া রুদ্র সুযোগ বুঝে বেল্ট হাতে পেঁচিয়ে ধরে সুফিয়ান চৌধুরী কে হ্যাচকা টানে নিজের কাছে এনে গলা টিপে ধরলো।ওতো লম্বা শক্তিশালী মানুষটার সামনে সহজেই ধরাশায়ী হতে নিলেন সুফিয়ান চৌধুরী।এই দৃশ্য দেখে রূপকথাকে ফেলে উঠে এলো সারফরাজ।তার দুই চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।শরীর আর সায় দিচ্ছে না।বুক আর হাতের ক্ষত থেকে গলগল করে রক্ত ঝরছে।তবুও সেসব তোয়াক্কা না করে সারফরাজ এলোমেলো পায়ে রুদ্রের পেছনে দাঁড়িয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে রুদ্রের পিঠ বরাবর এক ঘুষি বসালো।ঘুষির পাউন্ড প্রায় নয়শত।এক ঘুসিতেই দম আটকে এলো রুদ্রের।তার শরীর দুর্বল হয়ে হাত ঝুলে পড়লো।রুদ্র সুফিয়ান চৌধুরীর গলা ছেড়ে দিয়ে হাটু মুড়ে বসে গেলো উঠানে।সারফরাজ দাঁত চেপে চক্রাকারে ঘুরে সজোড়ে এক লাথি বসালো রুদ্রের।মাথায়।মাথায় আঘাত পেতেই চিৎকার করে মাটিতে শুয়ে গেলো রুদ্র।সারফরাজ যেনো উন্মাদ হয়ে উঠলো।সে লাথির উপর লাথি বসালো রুদ্রের বুকে ,কোমরে,পেটে আর পিঠে।

রুদ্র নড়বার শক্তি টুকু পেলো না।সারফরাজ এর ইচ্ছে হলো ইট দিয়ে রুদ্রের মাথা টা থেতলে দিতে ।কিন্তু এমনটি করলো না সে।সারফরাজ রুদ্রকে টেনে হিচড়ে দাঁড় করালো।এই দৃশ্যে সুফিয়ান রূপকথা দুজনেই অবাক হলো।রূপকথা চিৎকার করে বলে উঠলো
“ওকে মেরে ফেলো সারফরাজ।ও একটা নিকৃষ্ট মানুষ।এই পৃথিবীতে ওর বেঁচে থাকবার কোনো অধিকার নেই ।প্লিজ কিল হীম।
সুফিয়ান চৌধুরী ও অবাক হয়ে বলে উঠলেন

“এই জানোয়ার টাকে আবার কোনো সুযোগ দিতে চাইছিস?
সারফরাজ রুদ্রের ভারী দেহ সহ টলতে টলতে বলে উঠলো
“ওকে অনেক সুযোগ দিয়েছি কমিশনার সাহেব।আর কোনো সুযোগ আমার কাছে অবশিষ্ট নেই।আমার মা খুব আশা করছেন ওর হাল ও যেনো আমার মায়ের মতো হয়।পাগল মায়ের আবদার কি করে অপূর্ণ রাখি বলুন?
সুফিয়ান কপাল চুলকে ঘাবড়ে শুধালেন
“ওকে নিয়ে ঢাকা জাবি?
“না স্যার।
“তবে?

কিছুটা উত্তেজিত গলায় শুধালেন সুফিয়ান চৌধুরী সারফরাজ রুদ্রকে টেনে হিচড়ে নিয়ে হাটতে হাটতে বলে উঠলো
“ও আজ থেকে এই বন্দি শালায় বন্দি থাকবে।ঠিক যেমনটি থেকেছে আমার মা।
রুদ্রের শ্রবনিন্দ্রিয়ে কথা খানা প্রবেশ করতেই সে সজাগ হতে চাইলো।কিন্তু বুক পিঠে চূড়ান্ত খিল দিয়েছে ।শ্বাস পর্যন্ত আটকে আটকে আসছে।তবুও নিজেকে শেষ রক্ষা করার জন্য সারফরাজ এর গুলি করা ক্ষততে চেপে ধরে ভাঙা ভাঙা গলায় ককিয়ে বলে উঠলো

“বাঁচতে চাইলে ছেড়ে দে আমায় সারফরাজ।
রুদ্রের হাতের পিস্টনে সারফরাজ এর বুকের ক্ষত থেকে আরো বেশি করে রক্ত ঝরতে লাগলো।ব্যথায় দাঁত চেপে চিৎকার করে উঠলো সারফরাজ।মনে হচ্ছে মৃত্যু যন্ত্রনাও বুঝি এর চাইতে সহজ।সারফরাজ রুদ্রের গলা চেপে ধরলো সহসাই।বরফ নীল চোখ জোড়া কেমন ফ্যাকাসে হয়ে আসছে।শরীর খানাও নির্জীব হতে চাইছে।সারফরাজ রুদ্রের গলা চেপে ধরতেই সারফরাজ এর থুতনিতে ঘুষি বসালো রুদ্ররাজ।সারফরাজ তবুও রুদ্রের গলা ছাড়লো না।সারফরাজ ব্যথায় গুঙিয়ে বলে উঠলো
“আমি মরলে তোকে নিয়েই মরবো রুদ্র।আমার হাত থেকে তোর আজ নিস্তার নেই।তুই যতোই চেষ্টা করিস আজ আর বাঁচতে পারবি না ।

এদিকে শ্বাস নিতে না পেরে রুদ্রের ফর্সা মুখ নীল হয়ে উঠলো।হৃদ গতি এই বুঝি থেমে যায়।রুদ্র কথা বলতে চাইলো।কিন্তু পারলো না।চোখ উল্টে এলো রুদ্রের।সে ছটফট করতে করতে সারফরাজ এর পায়ে কিক করলো।অসহনীয় ব্যথায় রুদ্রের গলা ছেড়ে দিয়ে হাটু ভেঙে বসে গেলো সারফরাজ।গলা উন্মুক্ত হতেই রুদ্র যেনো প্রাণ ফিরে পেলো।কিন্তু তার শরীর অসাড় হয়ে পড়লো।মাথাটা কেমন ঘুরতে লাগলো।বুকে তীব্র ব্যথা।বুক চেপে ধরে মাটিতে মুখ থুবড়ে পরে গেলো রুদ্র।

সারফরাজ বহু কষ্টে মাটি থেকে উঠে দাঁড়ালো।এরপর রুদ্রের পা ধরে টেনে হিচড়ে নিয়ে যেতে লাগলো পাতাল ঘরের দিকে।অচেতন রুদ্র জানতেও পারলো না তার অবস্থান ওই বন্দি শালাতেই পোক্ত হতে চলেছে।ওই অন্ধকার ঘুটঘুটে কক্ষে একাকী কি করে কাটাবে রুদ্র?
সুফিয়ান চৌধুরীর সহায়তায় রুদ্রকে শিকল দিয়ে বেঁধে শক্ত চৌকিটার উপর শুইয়ে রাখলো সারফরাজ।জগে অল্প পানি আর রূপকথার জন্য রুদ্রের দেয়া বাসী খাবার টেবিলে রেখে বাইরে বেরিয়ে এলো।এরপর লুইসের মৃত দেহের সামনে হুমড়ি খেয়ে গগন কাঁপিয়ে চিৎকার করে ডাকলো সারফরাজ

“লুইস,ওয়েক আপ।হেই লুইস।আমাকে একা ফেলে কোথায় গেলে তুমি?ইয়ং কে কি জবাব দেবো আমি?লুইস!
যেই লুইস সারফরাজ এর এক ডাকে বন্দুক হাতে পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে যেতো সেই লুইস কে হাজার ডেকেও আজ জাগানো যাচ্ছে না।সারফরাজ লুইসের দেহ বুকে নিয়ে অঝোর কাঁদলো।রূপকথা সারফরাজ এর কান্নায় নিজেকে আটকাতে পারলো না।একদিকে অভিরূপের দেহ অন্য পাশে ল্যুইস।রূপকথা আর সুফিয়ান চৌধুরী অভির পাশে বসে ডাকলো

“অভিরূপ,অভি!
সুফিয়ান চৌধুরী পাংশু মুখে অভিরূপের পালস চেক করলেন।পালস রেট খুবই কম।এই মুহূর্তে অভিরূপ কে হসপিটালে এডমিট করতে না পারলে অভিকে বাঁচানো মুশকিল হয়ে যাবে।
সুফিয়ান চৌধুরী নিজের শক্ত হাতে অভিকে কাঁধে তুলে গাড়িতে বসিয়ে সিট বেল্ট বেঁধে দিলেন এরপর বন্ধু সাকলায়েন রেহমান কে কল করলেন।সাকলায়েন রেহমান ন্যাশনাল এয়ার রেসকিউ কমান্ড এর ঊর্ধতন কর্মকর্তা।সুফিয়ান চৌধুরীর জন্য নিজের জান পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত।কারন তাদের বন্ধুত্ব সেই বাল্যকালের।ভদ্রলোক কেবলই ডিউটি থেকে ফিরে আরামে ঘুমিয়েছেন।এমন সময় ফোন আসায় বেশ বিরক্ত হলেন।তবুও জরুরি ফোন ভেবে ফোন হাতে নিতেই সুফিয়ান চৌধুরীর নম্বর দেখে ঘাবড়ে গেলেন।সাকলায়েন ঝটপট ফোন রিসিভ করে ব্যস্ত গলায় শুধালেন

“কিছু হয়েছে?ঠিক আছিস তুই?
সুফিয়ান চৌধুরী ভয়ার্ত কন্ঠে বললেন
“রেসকীউ এয়ার এম্বুলেন্স পাঠা।এই মুহূর্তে ঢাকা যাওয়া জরুরি।কোনো প্রশ্ন করিস না।
সাকলায়েন রেহমান ধরফড়িয়ে বিছানায় উঠে বসলেন।এরপর বলে উঠলেন
“বিষয়টা গোপন নাকি প্রকাশ্যের?
সুফিয়ান কপাল চেপে বলে উঠলেন
“প্রকাশ্যের হলে এই ফজর ওয়াক্তে তোকে কল করতাম গাধা?অবশ্যই ফোর্স রেডি করতাম।খুবই সেনসিটিভ ইস্যু।পাইলট আর উপস্থিত ডক্টর ছাড়া কেউ যাতে কিচ্ছুটি না জানে।
সাকলায়েন তপ্ত শ্বাস ফেলে বলে উঠলেন

“লোকেশন পাঠা।
সুফিয়ান চৌধুরী কল কেটে দিয়ে ঝটপট লোকেশন সেন্ড করলেন।এরপর সারফরাজ এর কাছে এসে বলে উঠলেন
“ও মরে গেছে সারফরাজ।হাজার ডাকলেও ওর উঠার শক্তি আজ নেই।
লুইস বেঁচে নেই এই কথা সারফরাজ এর কর্ণকুহরে বজ্রপাতের ন্যয় আলোড়ন সৃষ্টি করলো।যেই মানুষটা সব সময় ঢাল হয়ে সারফরাজ এর সামনে দাঁড়িয়েছে আজ তাকে ছাড়া কিভাবে চলবে?সারফরাজ উদ্ভ্রান্তের ন্যয় বলে উঠলো
“আমার সমস্ত প্রোপার্টি ব্যঙ্ক ব্যালেন্স, পাওয়ার সব দিয়ে দেবো।বিনিময়ে ওকে বাঁচানোর ব্যবস্থা করে দিন স্যার।ও আমার ভাইয়ের মতো।
রূপকথা সারফরাজ কে আগলে নিলো।সুফিয়ান চৌধুরী ব্যাতিত গলায় বললেন
“টাকা, ক্ষমতা,সম্পপ্তি কি আর জীবন বাঁচাতে পারে রে সারফরাজ?ওসব ও দুনিয়াবী কারবার।উপর ওয়ালার কাছে এ সবকিছুই নিছক।মূল্য হীন।

তবে যে সারফরাজ এতো টাকা এতো নাম কামাই করলো এসব কোন কাজে?কোটি কোটি টাকা থেকেই তবে কি লাভ হলো?সামান্য একটা জীবন বাঁচাতে কোটি টাকাও মূল্য হীন?
লুইসের নিথর দেহের পানে করুন নজরে তাকালো সারফরাজ ।এরপর মাথা নিচু করে কেঁদে কেঁদে বলে উঠলো
“আমার জন্য মরে গেলে তুমি লুইস।আমি তোমাকে বাঁচাতে পারিনি।আমায় ক্ষমা করো।

হেলিকপ্টার এর লাইট এর আলোয় চারপাশ ফকফকে হলো।হয়তো কোথায় নামবে তার জায়গা নির্বাচন করছে।সুবহান চৌধুরীর হাভেলির পাশেই বিশাল বড় ফাঁকা মাঠ।সেখানেই থামলো হেলিকপ্টার।এরপর ভেতর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এলো দুজন রেসকিউ কর্মী।তারা প্রথমে লুইস এর নিথর দেহ টা তুলে নিয়ে গেলো।এরপর অভিরূপ কে।সুফিয়ান চৌধুরী টেনে সারফরাজ কে মাটি থেকে তুলে হেলিকপ্টার এ তুলে দিলেন।সঙ্গে দিলেন রূপকথাকে।নিজে গেলেন না।এখানে তার কাজ আছে।আপাতত এসপি আবির মাহতাবের হাতে সব বুঝিয়ে তারপর যেতে হবে।হাভেলি নতুন করে আবার রক্তাক্ত হয়েছে।অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকা মানুষ গুলোকে এরেস্ট করিয়ে হাভেলি থেকে রক্তের নিশানা মুছিয়ে তবেই ফিরতে হবে।এজন্য অপেক্ষা ভোরের আলো ফুটবার।

সুফিয়ান চৌধুরীর থেকে বিদায় নিয়ে হেলিকপ্টার আকাশে উড়লো।মিনিট পয়তাল্লিশ বাদে ঢাকার নামকরা বড় একটা হসপিটালের হ্যালিপ্যাডে এসে থামলো তা।যেনো আগে থেকেই সব জোগাড় করা।হেলিকপ্টার এর দরজা খুলতেই দুজন পুলিশ দৌড়ে এসে ডক্টর আর নার্সদের আদেশ দিলেন
“গুলি খাওয়া পেশেন্ট রয়েছে।তাদের দ্রুত অপারেশন এর ব্যবস্থা করুন।ইতোমধ্যে সারফরাজ নিজেও জ্ঞান হারানোর অবস্থায় চলে গিয়েছে।নাওয়া খাওয়া হীন রূপকথার প্রাণ ও যায় যায় অবস্থা।সুফিয়ান চৌধুরী ফোনে সব জানিয়েছেন ডিউটিরত ওসি কে।ওসি সেই মোতাবেক সব কিছু গুছিয়ে রেখেছেন।
তিনটি স্ট্রেচারে তিন জনকে তুলা হলো।সারফরাজ রূপকথার হাত চেপে ধরলো।নার্স প্রথমে লুইস কে নিয়ে গেলো।সারফরাজ নিজের সব টুকু দিয়ে আওয়াজ করে বলে উঠলো

“ওকে কাটবেন না।ও আমার ভাই।এমনিতেই অনেক কষ্টে ওর প্রাণ গেছে।ওকে আর কষ্ট দিবেন না প্লিজ।
ওসি ওমর হায়দার সারফরাজ কে আশ্বস্ত করলো
“আপনি উত্তেজিত হবেন না।উনাকে পোস্ট মর্টেম করা হবে না।স্যার আমাকে সব বুঝিয়ে দিয়েছে।আপনি রিল্যাক্স থাকুন প্লিজ।
নার্স সারফরাজ কে নিয়ে যেতে পা বাড়ালো।রূপকথার কেমন ভয় হলো।সেই ছয় বছর বয়সে সারফরাজ তাকে যেভাবে ছেড়ে গিয়েছিল সেরকম ভয়।রুপকথা সারফরাজ এর হাত শক্ত করে চেপে ধরলো।নার্স দুজন কে দুদিকে নিয়ে যেতে লাগলো।বাড়তে থাকলো দূরত্ব।এক সময় দুর্বল দুই হাত ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলো।রূপকথা ফুঁপিয়ে কেঁদে বলে উঠলো
“এবারও কি হারিয়ে যাবে সারফরাজ?
সারফরাজ বোধ হয় শুনলো।সে গলা বাড়িয়ে বলে উঠলো
“অপেক্ষা করবে আমার জন্য রূপকথা।আমি খুব শীঘ্রই ঠিক ফিরে আসবো।

শক্ত হৃদয়ের ইয়ং হসপিটাল রেফ্রিজারেটর এর সামনে দাঁড়িয়ে ছোট বাচ্চার ন্যয় কেঁদে উঠলো।লুইসের রক্ত হীন ফ্যাকাসে সাদা মুখ তাকে পীড়া দিলো।হৃদয় মুসড়িয়ে তুললো।ইয়ং কোনো কথা বলতে পারলো।ইয়ংয়ের চোখে ভেসে উঠলো এক সাথে কাটানো দীর্ঘ বছরের স্মৃতিIএবছরই নিজের প্রেমিকা এরিকার সাথে তার বিয়ে হবার কথা ছিলো।ইয়ং এরিকা কে এই খবর কিভাবে পৌঁছাবে?ইয়ং কম্পিত হাত বাড়িয়ে লুইসের বরফ শীতল দেহে হাত বুলালো।এরপর সিক্ত গলায় বলে উঠলো
“রেস্ট ইন পিচ ডিয়ার।মে গড সেন্ড ইউ টু হ্যাভেন।কজ ইউ আর অ্যা হলি সোল।
অভিরূপ সারফরাজ দুজনেরই অস্ত্রোপচার চলছে।আমজাদ হায়দার খবর পাওয়া মাত্র নেলি আর সেলিনাক আর অভিরূপ এর মা বোন কে নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন।নিস্তব্ধ হসপিটাল মুহূর্তেই রোনাজারিতে পরিণত হলো।বোকা নেলি সকলের সামনে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলো

“অভিরূপ বাঁচবে তো?
অভিরূপ এর বোন স্তব্ধ হয়ে রইলো।অভিরূপ এর মা সমানে হাত তুলে উপর ওয়ালা কে ডেকে চলেছেন।
রেখা নিজেও হসপিটালে উপস্থিত।সঙ্গে এসেছে কুলসুম।অনুপস্থিত মায়া চৌধুরী।এতো শোক তিনি সইতে পারবেন না।তাই সোহানার কাছে তাকে রাখা হয়েছে।আপাতত এই কদিন সোহানাই তার দেখভাল করবেন।রূপকথাকে স্যালাইন দিয়ে ফেলে রাখা হয়েছে।দুর্বলতা ছাড়া আর কোনো সমস্যা নেই তার।রেখা সেলিনা মিলে নেলিকে সামলে রাখতে পারছে না।নেলি পারলে ওটি রুমের দরজা ভেঙে ঢুকে যায়।নেলির চিৎকার চেঁচামেচি তে একজন নার্স
দৌড়ে এসে নরম কন্ঠে অনুরোধ জানালো
“প্লিজ ম্যাম কাঁদবেন না।অন্য রোগীদের প্রবলেম হবে ।তাছাড়া ওটিতে ডক্টরস আছেন।উনাদের প্রবলেম হবে।
নেলি মেনে নিলো।সে মুখ চেপে ধরে কাঁদতে লাগলো।

সারফরাজ এর গুলি শ্যালো থাকায় খুব অল্প সময়েই তা বের করতে সক্ষম হলো ডক্টর।সারফরাজ এর ক্ষত সেলাই করে তাকে অবজারভেশন কেবিনে রাখা হলো।কিন্তু অভিরূপ এর গুলি ডিপ লজড।অপারেশন এ ঝুঁকি রয়েছে।তিন ঘন্টা কেটে গিয়েছে ডক্টর এখনো অপারেশন শেষ করেনি।এদিকে নার্স দৌড়ে চলেছে রক্তের ক্রসম্যাচ নিয়ে।
দুপুরের পর পর ইমারজেন্সি ফ্লাইটে ঢাকা এলেন সুফিয়ান চৌধুরী।এসেই হসপিটালে ঢুকলেন।সারফরাজ বা অভিরূপ কারোর জ্ঞান ফেরেনি এখনো।কিন্তু রিস্ক কেটে গিয়েছে।সফল হয়েছে অভির ওপারেশন ।এদিকে প্রসেস চলছে লুইসের দেহ ক্যালিফোর্নিয়া পাঠানোর।একমাত্র পরিবারই এই লাশের হকদার।

রূপকথার শরীরের দুর্বলতা একটু কাটতেই সে স্যালাইনের সুই খোলে উঠে বসলো।মাথাটা চক্কর দিলো তবুও উঠে দাঁড়ালো রূপকথা।এরপর বাইরে বেরিয়ে এলো।ডিউটি নার্স বোঝানোর চেষ্টা করলো তার শরীর যথেষ্ট দুর্বল তবুও সে মানলো না।এলোমেলো পায়ে রূপকথা করিডোরে বেরিয়ে এলো।মেয়েকে দেখে সুফিয়ান রেখা দুজনেই দৌড়ে এলো।রূপকথা কাঁদতে কাঁদতে সুফিয়ান কে জড়িয়ে বলে উঠলো

“সারফরাজ বেঁচে আছে তো তাইনা বাবা?ও আমার এই হাত ছেড়ে আবার চলে গিয়েছে।যেমনটি বারো বছর আগে গেছিলো।এবার যদি আবার চলে যায়?সারফরাজ কোথায় আছে বলো বাবা।ও বেঁচে আছে তো নাকি?
বলেই চিৎকার করে উঠলো রূপকথা।সুফিয়ান মেয়ের মেন্টাল কন্ডিশন বুঝে রূপকথাকে বুকে চেপে ধরলেন।ক্রমাগত থরথর করে কাঁপছে রূপকথা।সুফিয়ান চৌধুরী ডক্টর এর চেম্বারে গিয়ে মেয়ের সমস্ত ট্রমা ডক্টর এর সাথে আলাপ করলেন।ভদ্রলোক খুব বিনয়ী।রূপকথার ভয়, কষ্ট দুঃখ সব বুঝলেন তিনি।তিনি একজন নার্স কে ডেকে বলে উঠলেন
“সারফরাজ এর পাশের বেডে রূপকথাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখুন।সে হাইপার হয়ে গিয়েছে।জ্বরের প্রোপার চিকিৎসা, ঠিক মতো খাবার, ঘুম কোনো টা না হবার কারনে তার মস্তিষ্ক বিক্ষিপ্ত হয়ে রয়েছে।পেশেন্ট এর জন্য এই সিচুয়েশন খুবই মারাত্মক।কুইক তাকে রেস্টে পাঠান।

চেকমেট পর্ব ৫২

নার্স আদেশ পেতেই দৌড়ে গিয়ে সারফরাজ এর পাশের বেডে সব রেডি করলো।এরপর সুফিয়ান চৌধুরী বুঝিয়ে শুনিয়ে রূপকথাকে শুইয়ে দিলেন।চেতনা হীন সারফরাজ এর পানে তাকিয়ে চোখের জল ছেড়ে দিলো রূপকথা।সুযোগ বুঝে ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে দিলেন নার্স।মুহূর্তেই ব্রেন শান্ত হয়ে শরীর তুলোর মতো ভাসতে লাগলো।সারফরাজ এর হাতটা অল্প ছুঁয়ে নিভু নিভু চোখে জড়িয়ে যাওয়া গলায় রূপকথা বলে উঠলো
“তোমাকে আর কোত্থাও যেতে দেবো না সারফরাজ।এই যে শক্ত করে ধরে রাখলাম।তোমাকে আমার থেকে দূরে নিয়ে যায় কার সাধ্যি?

চেকমেট পর্ব ৫৪