মায়াকুমারী পর্ব ৫২
মেহেরিন আনজারা
নিশু মুখ তুলল না। ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ল ধ্রুব।
“আয় ঘুমাই। অনেক প্যারা দিয়েছিস।”
ছোট্ট আদুরে বেড়াল ছানার মতো নিশু ধ্রুবর বুকের মধ্যে গুটিশুটি হয়ে চোখ বুজে রইল। মুহূর্তেই যেন পৃথিবীর সব অস্থিরতা দূরে হারিয়ে গেল।
“এখানেই আমার শান্তি মেলে।”
“কী বললি?”
“কিছু না।”
“তুই আমাকে এত সন্দেহ করিস! আল্লাহ কী দিয়ে বানিয়েছে তোকে! একটু বিশ্বাসও নেই আমার উপর!”
চোখ বুজে হতাশ শ্বাস ফেলল ধ্রুব।
“সন্দেহ করি মানেই বিশ্বাস করি না,এমনটা কিন্তু নয়।”
ভিজে বাতাসে তার চুলের খুসখুসে ঘ্রাণ ধ্রুবের নাকে এসে লাগল।
“তাই করিস তুই।”
“সন্দেহ করি,কারণ ভয় হয় তোমাকে যেন হারিয়ে না ফেলি।”
নিশুর গলার ভাঁজে ঠোঁট স্পর্শ করতেই ওমন ছোঁয়া পেতেই পুরো শরীর উষ্ণ হয়ে উঠল নিশুর।
“পাগল একটা।”
“তুমি ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের প্রতি আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। কারণ তুমি আমার কাছে আমার মহারাজা। তোমাকে কারো সঙ্গে দেখলেই আমার সহ্য হয় না। খু’ন করতে ইচ্ছে হয় তাকে। মেয়েরা তার ভালোবাসার মানুষটাকে শেয়ার করতে পারে না।”
হালকা হাসল ধ্রুব। নিশুর শরীর থেকে ভেসে আসা মিষ্টি ঘ্রাণে তার মন ভরে গেল। নিশুর ঘাড়ে মুখ গুঁজতেই শ্বাস আঁটকে ফেলল।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“ভালোবাসো আমাকে?”
অশ্রুসিক্ত নয়নে,ফিসফিস করে বলল নিশু।
“না,তবে একটা ছিদকাঁদুনে প্রেত্নিকে ভালোবাসি।”
“তা কবে থেকে?”
“হঠাৎ একদিন তাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। সেদিন থেকে আজও তাকে ভালোবাসি।”
“দেখেছিলে?”
“না।”
“না দেখেই?”
“হুম।”
“না দেখে কেউ ভালোবাসতে পারে নাকি?”
“আমি পারি।”
নিশু ধ্রুবের বুকের কাছে মাথা রেখে চোখ বুজে ফিসফিস করল,”আমার হৃদয় জানে,রক্তের প্রতিটি প্রবাহ জানে,কত গভীরভাবে তোমায় ভালোবাসি। কেবল তোমার কাছে না,এই ভয়ে,যদি একদিন হারিয়ে যাও।”
ফিসফিস করল ধ্রুব,”কী বললি?”
“তুমি থাকলে নিজেকে এমন সুখী লাগে যেন আমি কোনোদিন অসুখী ছিলাম না।”
বাইরে বৃষ্টি তীব্র হয়ে উঠল,রাস্তার হালকা হেডলাইটের প্রতিফলন ভিজে রাস্তায় নাচছে। দূরের বাগান থেকে পাখির ডাক ভেসে আসছে। বাতাসে রাতের ফুলের সুগন্ধ ধ্রুব ও নিশুর চারপাশে এক মধুর আবরণ তৈরি করেছে। তাদের নিঃশব্দতা আর প্রণয়ের মধ্যে সময় যেন স্থির হয়ে গিয়েছে। হোটেলের কক্ষে,বৃষ্টির ছন্দ আর শহরের আলো মিশে সেই মুহূর্তকে স্বপ্নময় করে তুলেছে এক রোমান্টিক,গভীর ও অনন্তকালীন রাতের আবহ।
বেশ রাত হলো। তখনও বৃষ্টি পড়ছিল হালকা ছন্দে। হোটেলের জানালার কাঁচে ধপধপ শব্দ হচ্ছে। বাইরে রাস্তার আলো ভিজে প্রতিফলিত হচ্ছে,দূরে কোথাও পাখির ডাক ভেসে আসছে। ফ্রেশ হয়ে টি-শার্ট পরে নিলো বুশরা। ধূসর করিডোরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিছু বলার চেষ্টা করলেও থেমে গেল বুশরা। কী বলবে বুঝতে পারছে না,ধীরে ধীরে পেছনে এসে দাঁড়াল। ইতস্তত করে বলল,”ঘুমাবেন না?”
নীরব রইল ধূসর।
“আপনি অসুস্থ। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে আরও অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। চলুন ঘুমাবেন।”
ধূসর নিরুত্তর। ঝড় বইছে মনের মধ্যে। এ ঝড় থামার নয়। কখনো নয়।
“আ..আপনার কষ্ট আমি বুঝি। প্লিজ,চলুন।”
তবু ধূসর শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। চোখ বাইরে,রাত্রি ভেজা শহরের আলো আর বৃষ্টির ছন্দে হারিয়ে যাচ্ছে। কয়েক কদম এগিয়ে রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে হোটেলের নিচের দিকে তাকাল বুশরা।
“প্রথম যেদিন আপনাকে দেখি,সেদিনও বুঝতে পারিনি আপনি আমার এত শখের হয়ে যাবেন। আপনার মন পাওয়ার জন্য অনেক পাগলামি করেছিলাম। কিন্তু কখনো আপনার খারাপ চাইনি।”
“ঘুমাতে যাও।”
“আ.. আপনিও আসুন।”
“যাও!”
শক্ত কণ্ঠস্বরের তার। কেঁপে উঠল বুশরা।
“আ..”
“যাও।”
হতাশ হয়ে ভেতরে ঢুকে বেডের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসে রইল। ধূসর দাঁড়িয়ে রইল একইভাবে,এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বাইরে। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো,শ্বাস আঁটকে যাচ্ছে। ধূসরের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত,বিমর্ষ বুশরার চোখ একসময় লেগে এলো। ধূসর ওইভাবেই দাঁড়িয়ে রইল।
গভীর রাত। বৃষ্টি পড়ছে এখনও অঝোরে। যেন আকাশ নিজেই মন খারাপের গল্প বলছে। হোটেলের জানালা দিয়ে ভিজে রাস্তার আলো ভেসে আসছে। গাড়ির হেডলাইটের লাল-হলকা আলো ভেজা পাথরের ওপর নাচছে। দূরের বাগান থেকে পাখির কুয়াকুয়ি আর বাতাসে ভেসে আসা রাতের ফুলের সুগন্ধ। জেসমিন,অর্কিড আর হালকা লবঙ্গের মিশ্রণ এক মধুর আবরণ তৈরি করেছে কক্ষের চারপাশে। হোটেলের জানালার কাঁচে বৃষ্টির ধপধপ শব্দ ভেসে আসছে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল নিশুর। ধ্রুব গভীর ঘুমে,তার নিঃশ্বাস ধীর। পিটপিট করে তাকাল নিশু। অস্থিরতা ভিতরে ঢুকে পড়ল। আস্তে করে ধ্রুবর বুক থেকে বের হয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরুতেই চমকাল। করিডোরের রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে ধূসর। ঘুমায়নি বোধহয়। অস্বস্তি নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল নিশু। অপরাধবোধে মনটা জর্জরিত হয়ে গেল।
“ঘুমাওনি?”
ধূসর একই স্থির ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল। কণ্ঠে কোনো উষ্ণতা নেই শুধুই স্থিরতার ছাপ।
“অসুস্থ হয়ে পড়বে তো!”
ঘাড় ঘুরিয়ে নিশুর দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠল। চোখজোড়া কেমন টকটকে লাল।
“কী হয়েছে তোমার?চোখ লাল কেন?”
ধূসর নিরুত্তর।
“নেশা করেছ? নাকি শরীর খারাপ করেছে?”
দু’কদম এগিয়ে কপালে হাত রাখল। শরীর গরম।
“তোমার শরীর গরম,এত টেনশন নিও না। বিশ্রাম নাও। যা হয়েছে,একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। মানুষ সবকিছু পায় না। আর বুশরা,নিঃসন্দেহে খুব ভালো মেয়ে। সে তোমাকে সত্যিই খুব ভালোবাসে। আমি বিশ্বাস করি,সে তোমাকে সুখেই রাখবে। আমরা কেউই তোমার খারাপ চাইনি। আর মনে রেখো,আমরা সবসময় মিলেমিশে থাকব।”
নিশুর চোখে চোখ রাখল ধূসর। সেই দৃষ্টি যেন হৃদয় বিদীর্ণ করা ধারালো ছু’রি। নিশুর বুকের ভেতর হঠাৎ কেঁপে উঠল,অন্তর ধুকপুক করে কেঁদে উঠল। ঠোঁট কাঁপতে লাগল,গলা আঁটকে এলো। ধূসর ফিসফিস করে বলল,”একজনকে ভালোবেসে অন্যজনকে বিয়ে করার মতো দুঃখ- বোধহয় পৃথিবীতে আর নেই,ধুতরাফুল।”
চমকে তাকাল নিশু। বুকের ভিতর হু-হু করে ভেঙে পড়ল তার। চোখে অশ্রু জমে উঠল,যেন আর ধরে রাখা যাচ্ছে না।
“বুকের বাঁ পাশে একজনকে রেখে অন্যজনকে বিয়ে করা যে কতটা যন্ত্রণাদায়ক,সেটা কেবল একজন মানুষই জানে। অর্থাৎ যার সাথে হয় কেবল সে-ই। এক জীবনের বোঝা হয়ে বুকের ভিতরে সেই নাম,সেই মুখ চাপা পড়ে থাকে অথচ মুখে হাসি টেনে সংসার চালিয়ে যেতে হয়।”
চোখের জল মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল নিশু। ভেজা ঢোক গিলে বলল,”হ্যাঁ,পৃথিবীতে এমনটাই ঘটে- যাকে আমরা চাই,সে চায় অন্য কাউকে। যাকে ভালোবাসি,সে আমাদের হয় না। আর যে আমাদের হয়ে থাকে,তার সুখের জন্য আমরা শুধু অপেক্ষা করি। অথচ কিছুই করার থাকে না হাতে। কেউ জানেও না,একজন মানুষের ভিতরে কতটা নিঃশব্দ বেদনা গোপন থাকে,কতটা শূন্যতা,কতটা অপরাধবোধ জমে জমে পাহাড় হয়ে ওঠে। আমরা চাই সবকিছু ঠিক হয়ে যাক অথচ ভাগ্যের উপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। কেবল দেখা আর নীরব থাকা- এই একমাত্র উপায়।”
ধূসর নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল। নাক টানলো নিশু।
“পরিস্থিতির চাপে পড়ে অনেকেই বুকের বাঁ পাশে একজনকে রেখে আরেকজনের সাথে সংসার করছে..”
“হ্যাঁ,একটা জীবন্ত লাশ হয়ে।”
অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকাল নিশু অথচ চোখের ভিতর ভাঙন।
“শোনো,এইসব আহামরি কিছু না। বুশরা তোমাকে ভালোবাসে,ওর সঙ্গে সব ঠিক করে নাও। সংসার সামলানোই শেষ কথা।”
“তুই তো তোর ভালোবাসার মানুষকে পেয়েছিস। আমার দুঃখ বোঝার অনুভূতি তোর হয়নি।”
নিশু কষ্ট গিলে নিলো।
“বিয়ে করেছ,এবার মন দিয়ে সংসার করো। ভালোবাসা দিয়ে নয়,দায়িত্ব দিয়েই সংসার টিকে থাকে।”
ধূসরের ঠোঁট কেঁপে উঠল,চোখ ভিজে গেল। কণ্ঠ ফেটে বেরোল,”একজন ভাগ্যে আরেকজনকে মনে রেখে সংসার করা যে কতটা কষ্টের.. তা তুই বুঝবি না,ধুতরাফুল।”
টুপ করে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়তেই বিস্ময়ভরা চোখে তাকাল নিশু। ধূসরের মুখ কঠিন কিন্তু কণ্ঠ স্থির। নিশুর বুক কেঁপে উঠল,গলা আঁটকে গেল। সে বুঝতে পারল ধূসরও কষ্টে আছে কিন্তু সেই ভালোবাসা কোনোদিন প্রকাশ করবে না।
“মৃত্যু অনিবার্য জেনেও জন্ম নিলাম। পাব না জেনেও তাকে চাইলাম।”
নিশুর চোখ ভিজে উঠল। বুকের ভিতরে জমে থাকা ব্যথা হঠাৎ ছড়িয়ে গেল সারা শরীরে।
“পুনর্জন্ম সত্যি না হলেও যদি কখনো হয়,আমি চাই সেই জীবনে তার ভালোবাসার ছায়া হয়ে জন্ম নিতে।”
টুপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল নিশুর চোখ বেয়ে। ভিতরে ভিতরে এক অদ্ভুত শূন্যতা আর বিষণ্ণতা গ্রাস করল তাকে। ভেজা ঢোক গিলে শ্বাস আঁটকে গেল। ধূসরের প্রতিটি শব্দ তার কষ্টকে আরও গভীর করল। সে বুঝল,ধূসরও ভিতরে ভিতরে কাঁদছে অথচ নিঃশব্দে। বাইরে বৃষ্টির শব্দ হঠাৎ তীব্র হয়ে উঠল। রাস্তার ভেজা আলো ফ্লোরে ঝিলমিল প্রতিফলন ফেলে নাচতে লাগল। দূরের বাগান থেকে ভেসে এলো কোনো অচেনা পাখির হাহাকার-ভরা ডাক। হোটেলের স্যাঁতসেঁতে করিডোরে ধূসরের দীর্ঘ ছায়া ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে মিলিয়ে গেল। রাতটা হয়ে উঠল নিঃশব্দ,অটল আর হৃদয়ভাঙা। নিশু তার ব্যথা বুকের ভিতর চাপা দিয়ে রাখল,ঠোঁটে শুকনো দৃঢ়তা টেনে নিলো। আর ধূসর দাঁড়িয়ে রইল নীরবে- ভালোবাসা লুকিয়ে,কেবল অপেক্ষার ভারী নিঃশ্বাস নিয়ে।
সকালবেলা। আইসিইউ-এর নিস্তব্ধ রুমে ধীরে ধীরে প্রাণের স্পর্শ। যন্ত্রের টিকটিক,ভেন্টিলেটরের মৃদু শোঁ-শোঁ আওয়াজ- সব মিলেমিশে যেন এক চাপা সঙ্গীত তৈরি করেছিল। রুমের কোণে বসে আছেন আদনীন ফেরদৌস। চোখ ভেজা,মলিন মুখ। নার্স ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বলল,”আজ ফিজিওথেরাপি শুরু করা হবে। আপনার ছেলের একটু একটু করে শক্তি ফিরবে। আপনাকে পাশে বসতে হবে।”
মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন তিনি।
“আমি থাকব।”
ফিজিওথেরাপিস্ট ধীরে ধীরে অনিকের হাত নড়াতে শুরু করলেন। প্রথমে শুধু আঙুল হালকা নড়াচড়া। অনিক হালকা ফুঁফুঁ করে পাতলা কণ্ঠে বলল,”মা!”
আদনীন ফেরদৌস অবাক হয়ে পাশে ঝুঁকে বললেন,”হ্যাঁ,বাবা। মা এখানে আছি। সব ঠিক আছে। ভয় পেও না।”
অনিকের চোখ অল্পখানি খোলার সঙ্গে সঙ্গে হাত নাড়ল। নার্সের মুখে অল্প হাসি,চোখে অনাবিল আশা-
“দেখেছেন,সে নিজেই চেষ্টা করছে। ছোট্ট প্রতিক্রিয়াতেই অনেক উন্নতি।”
পরের ধাপে ফিজিওথেরাপিস্ট পায়ের নড়াচড়া করালেন। হালকা চাপ,ধীরে ধীরে। অনিক প্রথমবার নিজের পায়ে চাপ দেওয়ার চেষ্টা করল। হালকা কণ্ঠে বলল,”পানি!”
সঙ্গে সঙ্গে চামচে কয়েক ফোঁটা পানি নিয়ে ঠোঁটে ছোঁয়ালেন তিনি। অনিক গিলে নিলো আর চোখে অল্প জোছনা ঝলমল করল। নিঃশব্দে কাঁদলেন আদনীন ফেরদৌস। চোখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলেন।
“একটু চেষ্টা করো,বাবা। দেখো,তুমি নিজেই কিছু করতে পারবে। আমরা আছি পাশে।”
নার্স কোমলভাবে বলল,”আজ থেকে ধীরে ধীরে খাবার শুরু করা হবে। আপনার ছেলে ধৈর্য ধরে চেষ্টা করছে। এটিই সবচেয়ে বড় অগ্রগতি।”
অনিকের হাত ধরে চোখের জল মুছলেন। ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস নিয়েই চোখ বন্ধ করল অনিক। আইসিইউ-এর যন্ত্রের মধ্যে যেন নতুন সুর- প্রাণের,ভালোবাসার,আশা ও অদৃশ্য শক্তির মিলন। আরও কিছুক্ষণ হালকা ব্যায়াম করিয়ে ফিজিওথেরাপিস্ট চলে গেলেন কিন্তু রুমে অবশিষ্ট প্রতিটি মুহূর্তে সেই ছোট্ট জীবনের লড়াইয়ের আলো ছড়িয়ে রইল।
শরীর কাঁপিয়ে ভীষণ জ্বর এলো ধূসরের। তার পাশে বসে মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে বুশরা। শ্বাস যেন প্রতিবার টেনে আনছে মৃত্যুর ছায়া। হঠাৎই কী হলো,কেন এমন জ্বর এলো- কোনো উত্তর পাচ্ছে না বুশরা। ঠোঁট ফাঁক হয়ে বিড়বিড় করছে কিন্তু কথাগুলো অস্পষ্ট,কেবল নিঃশ্বাসের সঙ্গে ভেসে আসছে করুণ শব্দ। বুশরা কিছুই বুঝতে পারছে না। বুকের ভিতর দুরুদুরু কাঁপছে,যেন সময় থেমে গিয়েছে। কী করবে,কার কাছে দৌঁড়াবে কোনো বোধ নেই। ধ্রুবকে জানাতে পারছে না,সেই সাহসও নেই। নিশু যদি আবার তেড়েফুঁড়ে আসে! গলা শুকিয়ে আসছে তার,ভেজা ঢোক গিলল। হাত কাঁপতে কাঁপতে শরীর মুছিয়ে দিলো ধূসরের।
জ্বর কমে আবার বেড়ে উঠছে,ভোরের আলোয় কাঁপা কাঁপা শরীরটা যেন আরও বেশি ভয়ার্ত দেখাচ্ছে। চোখের জলে কিছু দেখতে পারছে না বুশরা। প্রচণ্ড অসহায়ত্বে বুক ফেটে যাচ্ছে। ধূসরের হাত তুলে নিজের গালে চেপে ধরল। নিভু নিভু চোখে তাকাল ধূসর,দৃষ্টি যেন মৃত্যুর দোরগোড়া থেকে ফিরে আসা এক সান্ত্বনা আর এক অশেষ বেদনা। কাঁপা গলায় বুশরা ফিসফিস করে উঠল,”আপনার কিছু হয়ে গেলে আমি কী নিয়ে বাঁচব! আমি তো নিজের অস্তিত্বটাই হারিয়ে ফেলব। আমার শ্বাস,আমার দিন-রাত,সবকিছু আপনার ভরসায় বাঁধা। আমি যদি আপনাকে হারাই,এই ভিড়ভাট্টার পৃথিবীটা আমার কাছে কবরের মতো নিঃশব্দ হয়ে যাবে। আমি বেঁচে থেকেও মরব ধূসর.. আপনার ছায়া ছাড়া এক পা-ও হাঁটতে পারব না।”
টুপটুপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল দু’চোখ বেয়ে। তার কণ্ঠের সঙ্গে সকালের হাওয়ায় মিলেমিশে কান্নার আর্দ্রতা ভেসে বেড়াল। ঘড়িতে সকাল আটটা। অথচ সময় যেন থমকে দাঁড়িয়ে আছে একজন মানুষের বেঁচে থাকা আর অন্য একজনের ভেঙে পড়া শ্বাসের মাঝখানে। হঠাৎ বমি করল ধূসর। আতঙ্কিত হয়ে থরথর করে কেঁপে উঠল বুশরা। বুকের ভিতরটা হিম হয়ে এলো। তবু একটুও ঘৃণা না করে তাড়াহুড়া করে পরিষ্কার করে দিলো মেঝে,বিছানা। তার বুক চিরে হাহাকার ভেঙে পড়ল,”এত কষ্ট কেন দিচ্ছ উনাকে,আল্লাহ! আমি সহ্য করতে পারছি না।”
অনর্গল চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে গালে। কী করবে বুঝতে না পেরে একসময় কাঁপা পায়ে উঠে দাঁড়াল। রুম থেকে বেরিয়ে ইতস্তত করে পাশের দরজায় দু-তিনবার নক করল। ক্লিক করে দরজা খুলল ধ্রুব। বুশরার ফ্যাকাসে মুখ,অস্থির দৃষ্টি দেখে চমকে উঠল।
“কী হয়েছে?এমন দেখাচ্ছে কেন তোমাকে?”
গলা আঁটকে এলো বুশরার।
“আ..আপনার ভাই.. মানে.. উ.. উনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।”
“কী হয়েছে?”
“জ্বর এসেছে,বমিও হয়েছে।”
“ওহ! চল দেখি।”
ওদের রুমে ঢুকতেই ধ্রুব এগিয়ে গিয়ে ধূসরের কপালে হাত রাখল। চোখ কুঁচকে গেল তার।
“সত্যিই তো! অনেক জ্বর.. শরীর ফেটে যাচ্ছে।”
দীর্ঘশ্বাস বুকে চাপল বুশরা।
“আরো আগে জানাওনি কেন?”
আমতাআমতা করে তাকাল বুশরা,গলা শুকিয়ে আসছে। কিছু বলতে পারল না।
“সমস্যা হলে বলবে না! চুপ থেকে কী লাভ!”
চোখ নামিয়ে চুপ করে রইল বুশরা। ধ্রুব আর সময় নষ্ট করল না।
“আমি ঔষধ নিয়ে আসছি। দাঁড়াও। আর হ্যাঁ,নিশুর দিকেও একটু খেয়াল রেখ.. ওরও জ্বর এসেছে।”
কথা শেষ করেই তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে গেল ধ্রুব। বুশরা নিঃশ্বাস আঁটকে ধূসরের দিকে ফিরে তাকাল। রুমের নিভু আলোয় ধূসরের ফ্যাকাসে মুখটায় যেন মৃত্যুর ছায়া ভাসছে। করিডোর নিস্তব্ধ হয়ে গেল হঠাৎ। ঘড়িতে সকাল আটটা বেজে কিছু মিনিট পার। বাইরে সিঙ্গাপুরের শহরটা ধীরে ধীরে জেগে উঠছে অথচ এই রুমের ভেতরে যেন মৃত্যুর ছায়া গাঢ় হয়ে জমে আছে। বুশরা আবার ধূসরের পাশে বসে পড়ল। তার শরীর এখনও জ্বরে কাঁপছে,ঠোঁট শুকিয়ে ফেটে গিয়েছে। কপালে ঘাম জমে বিন্দু বিন্দু হয়ে গড়িয়ে পড়ছে। বুশরা কেঁপে কেঁপে আবারও জলপট্টি চাপিয়ে দিলো কিন্তু অসহায় বুকের ভিতর হাহাকার থামল না। ধূসরের নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে মনে হলো সে কিছু বলতে চাইছে। বুশরা কেঁপে ওঠে,মাথা কাছে নিয়ে গেল। কিছুই বোঝা গেল না,শুধু শ্বাসের শব্দ আর ভাঙা ভাঙা কিছু শব্দ,যেন স্বপ্নের মতো অস্পষ্ট। চোখ বুজে ধূসরের হাত নিজের হাতে নিলো বুশরা।
“আল্লাহ,উনাকে আমার থেকে কেঁড়ে নিও না। আমি বাঁচব না উনাকে ছাড়া। আমি শ্বাস নিতে শিখেছি উনার ভালোবাসার ছায়ায় দাঁড়িয়ে.. উনি যদি চলে যান,এই পৃথিবীটা আমার কাছে কবরের মতো ফাঁকা হয়ে যাবে।”
চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল ধূসরের বুকে। সে নিস্তব্ধ,শুধু শরীরটা কাঁপছে। মিনিট দশেক পর দরজায় নক পড়তেই দ্রুত খুলল। ভেতরে ঢুকল ধ্রুব। হাতে খাবার আর কিছু ঔষধ। মুখে তাঁড়া আর উদ্বেগের ছাপ।
“আগে জ্বরের ওষুধ খাওয়াতে হবে।”
ধীরে ধীরে ধূসরের মাথা তুলে ধরল ধ্রুব। গ্লাসে পানি দিলো বুশরা। কোনোভাবে গিলিয়ে দেওয়া গেল ওষুধ।
“তুমি একটু শক্ত হও। ভয় পেলে হবে না। ডাক্তার দেখাতে হবে যদি জ্বর না কমে। আমি ব্যবস্থা করে রাখছি।”
বুশরা কিছু বলল না। শুধু ধূসরের হাত ধরে কেঁদে যেতে লাগল নিঃশব্দে। মনে হচ্ছিল,এই হাতটাই যদি একবার খুলে যায়,তবে তার পৃথিবী ভেঙে যাবে তাসের ঘরের মতো। ওষুধ খাওয়ানোর পর ধীরে ধীরে ধূসরের শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হতে লাগল। শরীরের কাঁপুনি কিছুটা থেমে এলো। তবু চোখে জ্বলজ্বলে এক অদ্ভুত ক্লান্তি রয়ে গেল। বুশরা কপালে হাত রেখে টের পেল,জ্বরটা একটু কমেছে বটে,তবে এখনও শরীর জ্বলছে। ধ্রুব একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,”মনে হয় ওষুধ কাজ করছে। তবে নিশ্চিন্ত হওয়ার মতো না। আচ্ছা,আরেকটু দেখি তারপর না হয় হসপিটালে নিয়ে যাব। তুমি বরং ওকে স্যুপটুকু খাওয়ানোর চেষ্টা করো। সমস্যা হলে ডেকো কেমন?”
“আচ্ছা।”
বুশরা কেঁপে মাথা নাড়ল। তার চোখে ভয়ের ছায়া এখনও স্পষ্ট। বেরিয়ে নিজেদের রুমে ঢুকল ধ্রুব। নিশুর হাত-মুখ মুছিয়ে সামান্য কয়েক চামচ স্যুপ খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দিলো। চোখ বুজে শুয়ে রইল নিশু। একটা কথাও বলল না। শুধু দু’চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল। বুক চিরে বারবার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসছে। কিছুক্ষণ পর জ্বর ছাড়ল নিশুর। ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে গেল। নিশুকে রেডি করে গাড়ি ডাকল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল হোটেলের সামনে। ধূসর-নিশু দু’জনকে সতর্কভাবে নিয়ে নামল ওরা দু’জন। শহরের সকালটা তখন পুরোপুরি জেগে উঠেছে। রাস্তার ওপর গাড়ির লাইন,মানুষের ভিড়,ব্যস্ততা। অথচ বুশরার কাছে সবকিছুই অচেনা,কেবল কানে বাজছে ধূসরের ভাঙা শ্বাসের শব্দ। ট্যাক্সির ভেতরে বুশরা তার মাথাটা কোলে নিয়ে বসে রইল।
ধ্রুবও নিশুকে নিয়ে সামনে বসল। কপালে হাত বুলিয়ে দিলো বারবার। প্রতিটি সেকেন্ড বুশরার কাছে মনে হচ্ছিল এক একটি যন্ত্রণার যুগ। বেশ কিছুক্ষণ পর মাউন্ট এলিজাবেথ হসপিটালে পৌঁছাল ওরা। ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল ওরা। নিস্তব্ধ করিডোরের ভেতর প্রতিটি পদক্ষেপে যেন আতঙ্ক জমে থাকল। আসাদ সাহেবের কেবিনের দরজা খুলতেই ভেতরে গম্ভীর পরিবেশ। বেডের উপর আধশোয়া হয়ে বসে আছেন তিনি। পাশেই বিমর্ষ মুখে বসে রয়েছেন দিলরুবা খাতুন। আসাদ সাহেবের গম্ভীর,কড়া মুখ। ওদের উপস্থিতি টের পেতেই চোখ তুললেন। মুহূর্তেই আবার চোখ ফিরিয়ে নিলেন। নিশুর বুক হু-হু করে উঠল। মনে হলো কারও নীরব উপেক্ষা ছু’রি হয়ে বিঁধল হৃদয়ে। ধ্রুব সামলে নিয়ে ভেতরে ঢুকল,সোফায় বসতে বলল ওদের।
দ্যুতির পাশে বসল নিশু। ধ্রুব বেরিয়ে রিসিপশনে গেল। সকাল তখন প্রায় এগারোটা। মাউন্ট এলিজাবেথ হসপিটালের করিডোরে হালকা ভিড়,নার্সদের পদচারণা আর দূরে কোথাও লিফটের টুংটাং শব্দ। তবু এই ব্যস্ততার মাঝেও ধ্রুব যেন সময়ের ভার অনুভব করছিল অন্যভাবে। হাতে বিলের কাগজপত্র,চোখে নিদ্রাহীন ক্লান্তি। কাউন্টারে দাঁড়িয়ে সমস্ত হিসেব মিটিয়ে দিলো। বিল চুকিয়ে নেওয়ার পরপরই টিকেট কাউন্টারের দায়িত্বও শেষ করল। সবার নামের পাশে নিশ্চিত হলো আজকের ঢাকা ফেরার আসন। জানালার ওপাশে তখন সিঙ্গাপুরের সকাল। রোদ্দুর ঝলমলে কিন্তু আকাশে মেঘের হালকা রেখা ছড়ানো। রাস্তা ভরা গাড়ি,মানুষজনের দৌড়ঝাঁপ,চকচকে অট্টালিকায় কাঁচে সূর্যের প্রতিফলন- সবকিছু মিলেমিশে এক ব্যস্ত অথচ সুশৃঙ্খল শহরের ছন্দ তুলে ধরছে। অথচ হসপিটালের কেবিনের ভেতরে বসে থাকা সবার চোখে কেবল ক্লান্তি আর নিঃশব্দ শূন্যতা। লম্বা লম্বা কদম ফেলে কেবিনে ঢুকল ধ্রুব।
“ডিসচার্জ দিয়েছে ডক্টর। দেশে ফিরব সবাই।”
নীরব রইল সবাই। সতর্কভাবে আসাদ সাহেবকে হুইলচেয়ারে বসাল ধ্রুব। এরপর চেয়ার ঠেলে কেবিন থেকে বেরোল। রেডি হয়ে এক এক করে ধ্রুবর পিছু নিলো সবাই এবং নিচে নেমে গাড়িতে উঠে বসল। গাড়ি ছুটে চলল এয়ারপোর্টের দিকে। জানালার বাইরে ছায়াঘেরা গাছপালা,চকচকে মল,ব্যস্ত ফুটপাত- সবকিছু ভেসে উঠছিল কিন্তু গাড়ির ভেতরে নেমে এসেছে নিস্তব্ধতার ভার। চাঙ্গি এয়ারপোর্টে পৌঁছে দীর্ঘ করিডোর পেরোল তারা। নিরাপত্তা আর চেক-ইনের আনুষ্ঠানিকতা সেরে বিমানে উঠতেই শহরের কোলাহল পেছনে রয়ে গেল। ধীরে ধীরে আকাশের দিকে উঠতে থাকল উড়োজাহাজ। নিচে সিঙ্গাপুরের সবুজ-ধূসর শহর ছোট হয়ে আসছিল আর ওপরে ছড়িয়ে ছিল সাদা তুলোর মতো মেঘ। দীর্ঘ চার ঘন্টার বেশি সময় ধরে চলল যাত্রা। দ্যুতি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল; আকাশের অসীমতায় তার চোখে জমল এক অদ্ভুত শূন্যতা। নিশু মাথা হেলিয়ে বসেছিল,ক্লান্ত শরীরে মনের ভার যেন দ্বিগুণ হয়ে উঠেছিল।
দীর্ঘ চার ঘন্টার অধিক যাত্রা শেষে ঘোষণা এলো,ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণের। বিমানের জানালা দিয়ে নিচে ছড়িয়ে থাকা শহরের অসংখ্য আলো দেখা যাচ্ছিল। কোথাও ধূসর,কোথাও ঝাপসা সোনালি রোদে ভেসে থাকা বিল্ডিংয়ের ছায়া। সকাল ১১টার সিঙ্গাপুর তখন অনেক দূরে আর এখন ঢাকার সকাল মিলিয়ে দুপুর ঘনিয়ে এসেছে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামতেই লাগল গরম আর ধুলো মেশানো বাতাসের ধাক্কা। সিঙ্গাপুরের শীতল পরিস্কার শহরের পর এই আবহটা যেন হঠাৎ করে সবাইকে ভিতর থেকে কাঁপিয়ে দিলো। ইমিগ্রেশন পার হয়ে গাড়িতে উঠল সবাই। বনানীর দিকে ছুটতে লাগল গাড়িটি।
চারদিকে যানজট,হর্নের তীব্র শব্দ,ধুলোয় ভরা রাস্তা- এই চেনা বিশৃঙ্খলায় ফিরে আসার অনুভূতি যেন কারো মনকে শান্ত করল না বরং কেবল ভারী করে তুলল। অবশেষে বনানীর বিশাল বিল্ডিংয়ের সামনে এসে থামল গাড়ি। এক এক করে গাড়ি থেকে নেমে বাসায় ঢুকল সবাই। দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি যেন শরীর ভেদ করে মনের গভীরতাকেও আচ্ছন্ন করে রেখেছে। আসাদ সাহেব এবং দিলরুবা খাতুনকে উনাদের রুমে পৌঁছে দিয়ে নিজেদের রুমে ফিরে গেল ধ্রুব,ধূসর,ধীরাজ। নিশু,দ্যুতি আর বুশরা এসে থমকাল তাদের রুমের সামনে। মুহূর্তের জন্য হালকা নীরবতা নেমে এলো। আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে বউ করে নেওয়া অব্ধি ধ্রুবর রুমে যাবে না বলে মনঃস্থির করল নিশু। বুশরা দোনোমোনো করে দাঁড়িয়ে রইল। চোখে-মুখে দ্বিধার ছাপ স্পষ্ট। নিশু বলল,”এখন আমাদের সঙ্গে আয়। পরে যা হবার হবে। পরিবারকে মানাতে হবে আগে।”
নিঃশ্বাস ফেলে মাথা নেড়ে সায় দিলো বুশরা। তারা তিনজন একসাথে রুমে ঢুকল। নিশু বিছানায় বসে পড়ল ক্লান্ত শরীর নিয়ে।
“ভীষণ ক্লান্ত লাগছে,দ্যুতি।”
“গোসল করে নে।”
“হুম,গোসল না নিলে অসহ্য লাগবে আমার।”
“তুই আগে করে নে। আমরা পরে করব।”
“আচ্ছা।”
“করতে পারবি?”
“হুম।”
“একটু সাবধানে করিস। কিছু লাগলে ডাকিস।”
মাথা নেড়ে সায় দিয়ে ধীরে ধীরে ওয়াশরুমের দিকে এগোল নিশু। ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করার আগেই দ্যুতি লাগেজ থেকে একটি মেক্সি ও পেটিকোট বের করে দিয়ে এলো। ওয়াশরুমের ভেতর জলের শব্দ ভেসে এলো। নিশু ঠাণ্ডা জলে মুখ ভিজিয়ে দিচ্ছে,ক্লান্ত শরীরটাকে ধীরে ধীরে সতেজ করার চেষ্টা করছে। লাগেজ খুলে দ্যুতি জামাকাপড়গুলো একে একে ওয়ারড্রবে গুছিয়ে রাখল। যেগুলো ধোয়ার দরকার,সেগুলো আলাদা করে বিনে রাখল। প্রতিটি কাজে যেন এক অদ্ভুত যান্ত্রিকতা,কোনো প্রাণ নেই। বিছানায় বসে আছে বুশরা। মুখ মলিন,চোখ-দুটো লালচে। চারপাশের সমস্ত ব্যস্ততা,জামাকাপড় গুছানো কিংবা নিশুর গোসলের শব্দ- সবই যেন তার কাছে দূরবর্তী। বুকের ভিতরে জমে থাকা অসহায়তা আর কান্নার স্রোত তাকে শুষে নিচ্ছে। তার চোখ যেন বলছে,এই ঘরে আছি বটে কিন্তু আমার ভিতরে সবকিছু আজও হাসপাতালের সেই নিঃশ্বাসভরা রাতেই আঁটকে আছে। কিছুক্ষণ পর ওয়াশরুম থেকে বেরোল নিশু। ভেজা চুল এলোমেলো হয়ে কাঁধে লেগে আছে,গায়ে মেক্সি। মুখটা ধোয়া জলে কিছুটা সতেজ দেখালেও চোখের ক্লান্তি ঢাকতে পারল না।
“কেমন লাগছে এখন?”
“ভালো,একটু হালকা।”
“সমস্যা হয়নি তো?”
“না।”
হাত বাড়িয়ে টাওয়াল নিয়ে চুলগুলো মুছে দিতে লাগল দ্যুতি। লম্বা চুল হওয়ায় মুছতে কষ্ট হচ্ছিল নিশুর তাই চুলের পানি নিতে পারেনি ঠিকমতো। চুল মুছে টাওয়াল পেঁচিয়ে দিলো মাথায়। ওড়না নিয়ে শরীর ঢেকে নিলো নিশু। ওদের দিকে একপলক তাকিয়ে মাথা নুয়ে রইল বুশরা। নিশু তার দিকে তাকিয়ে মৃদু গলায় বলল,”তুই এভাবে চুপ করে বসে আছিস কেন?”
“সবকিছু যেন খুব ভারী লাগছে.. বুকের ভিতরটা হাঁপাচ্ছে।”
নিশু দু’কদম এগিয়ে বুশরার কাঁধে হাত রাখল।
“কোনো ভয় নেই,আমরা একসাথে আছি।”
বাইরে দুপুরের আলোয় বনানীর রাস্তা গমগম করছে। গাড়ির হর্ন,মানুষের হাঁকডাক,দূরে কোথাও ভাজা পেঁয়াজের গন্ধ ভেসে আসছে। অথচ ঘরের ভেতর নিস্তব্ধতা জমে আছে অদ্ভুত ভারে। হঠাৎ নিশু কণ্ঠ নরম করে বলল,”আজকের দিনটা কেমন যেন অন্যরকম হয়ে রইল। হাসপাতালে কাটানো সেই মুহূর্তগুলো.. তারপর যাত্রা.. সবকিছু এখনও মাথার ভিতরে ঘুরছে।”
বুশরা বলল,”আমিও ভুলতে পারছি না। মনে হয়,প্রতিটা শ্বাসের ভিতর এখনও হাসপাতালের গন্ধ লেগে আছে।”
দ্যুতি জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। বাইরে তাকিয়ে দেখল রোদের ঝলক গাড়ির ধাতব বডিতে পড়ে চকচক করছে। দূরে মানুষের হট্টগোল অথচ তার ভিতরে কেবল নিঃসঙ্গতার দীর্ঘ প্রতিধ্বনি। দৃষ্টি সরিয়ে বলল,”সব ঠিক হয়ে যাবে.. সময় লাগবে,তবে সব ঠিক হবে।”
কথাগুলো যেন তিনজনের বুকের গভীরে গিয়ে বেজে উঠল। তারা কেউ আর কিছু বলল না। শুধু জানালার ফাঁক দিয়ে ভেসে আসা দুপুরের আলোয় তাদের চোখের ভিতরে এক ফোঁটা নিঃশব্দ অশ্রু চকচক করে উঠল। নীরবতা ভেঙে নিশু বলল,”এই তোরা দু’জন গোসল করতে যা।”
দ্যুতি বলল,”বুশরা,তুই আগে যা।”
“না,তুই যা। গোসল করতে আমার একটু সময় লাগবে।”
দ্যুতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওয়ারড্রব থেকে টি-শার্ট আর প্লাজু বের করে দু’হাতের ভাঁজে জামাকাপড় চেপে ধরে দ্রুত এগিয়ে গেল ওয়াশরুমের দিকে। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ হওয়ার শব্দ মিলিয়ে গেল। সঙ্গে মিলিয়ে গেল তার পায়ের তাড়াহুড়োর ছন্দও। ঘরে তখন শুধু নিশু আর বুশরা। নিশু আধখোলা চোখে ছাঁদের দিকে তাকিয়ে রইল। বুশরা চুপচাপ চোখ বুজে রইল। চারপাশের নিস্তব্ধতায় জলের টুপটাপ শব্দ ভেসে আসছিল ওয়াশরুম থেকে। যেন গোসলের জলে ভিজে যাচ্ছে তাদের ভিতরেরও অব্যক্ত ক্লান্তি। কিছুক্ষণ পর ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ হলো। দ্যুতি ভেজা চুল মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলো। গায়ে পিংক কালারের টি-শার্ট আর কালো প্লাজু,মুখটা ধোয়া জলে হালকা উজ্জ্বল হলেও চোখের ভিতর জমে থাকা ক্লান্তি ঢাকা গেল না।
“বুশরা,যা গোসল কর।”
বুশরা নিঃশব্দে মাথা নেড়ে দাঁড়াল। পা টেনে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল ওয়াশরুমের দিকে। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করার মুহূর্তে এক অদ্ভুত শূন্যতা ভেসে উঠল তার চোখে। ভেতরে ঢুকেই কল ঘুরালো। বরফশীতল জলে হাত রাখতেই বুক কেঁপে উঠল। হঠাৎ অঝোরে নেমে এলো কান্না। টপটপ করে গড়িয়ে পড়তে লাগল চোখের জল। যেন গোসলের জলে মিশে যাচ্ছে বুকের সমস্ত চাপা যন্ত্রণা। পানি ঝরে পড়ছিল মাথা থেকে,কান্নার শব্দে দম আঁটকে আসছিল গলা কিন্তু তবুও বুশরা থামল না। যেন একবারে সব ভিতরের যন্ত্রণা জলের সঙ্গে ধুয়ে ফেলতে চাইছে। নিজেকে সামলে গোসল করতে লাগল। দ্যুতির দিকে তাকাল নিশু।
“অযু করেছিস?”
“হ্যাঁ। আয়,নামাজ সেরে নিই।”
জায়নামাজ বের করে বিছিয়ে নিলো।
“বুশরা বের হোক,তারপর একসঙ্গে আদায় করব।”
অপেক্ষা করতে লাগল দু’জন। বেশ কিছুক্ষণ পর ওয়াশরুম থেকে বেরোল বুশরা। মুখে এখনও পানির ফোঁটা লেগে আছে। নিশু আর দ্যুতি নীরবে বসে আছে। নিশু মৃদু গলায় বলল,”নামাজ পড়বি আয়।”
বুশরা ইতস্তত করল। বুকের ভিতর লাজ-অস্বস্তির ঢেউ বয়ে গেল। নিশু হাত বাড়িয়ে একখানি নিকাব দিলো।
“এটা পর।”
দ্বিধাগ্রস্ত চোখে তাকাল বুশরা। তারপর আস্তে করে নিলো নিকাবটা। মাথায় চাপাতে গিয়েই কেমন যেন অদ্ভুত আবেগ দোলা দিলো ভিতরে। দ্যুতি এগিয়ে এসে ঠিক করে দিলো নিকাব। তিনজন একসাথে দাঁড়াল। বুশরাকে মাঝখানে রেখে দু’পাশে নিশু আর দ্যুতি। নামাজের কাতারে দাঁড়িয়ে পড়তেই বুশরার বুক কেঁপে উঠল। মুসলিম হলেও নিয়মিত নামাজ আদায় করতো না,তবে কালেভদ্রে পড়তো। তার মা’ও নিয়মিত নামাজ আদায় করেন। অথচ আজ এই নিস্তব্ধ দুপুরে হঠাৎ করে তার মধ্যে এক নতুন অনুভূতি জেগে উঠল। ওরা যেভাবে শুরু করল,সে-ও সেভাবেই করল। প্রতিটি রুকু,প্রতিটি সিজদাহ,প্রতিটি দোয়া- তার কাছে যেন অচেনা অথচ শান্তির আবহে ভরা। একসময় মনে হলো,বুকের ভিতর জমে থাকা ভারী কষ্টটা নামাজের প্রতিটি সিজদাহর সঙ্গে গলে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে নামাজ শেষ হলো। শেষ মোনাজাতে তিনজন একসাথে হাত তুলল আকাশের দিকে। চোখের ভিতর জমে থাকা অশ্রু নেমে এলো নিঃশব্দে। শেষ করে উঠে দাঁড়াল তারা। বুকের ভিতর এক অদ্ভুত প্রশান্তি,নিঃশ্বাসে ভেসে এলো নীরব সান্ত্বনা। নামাজ শেষে এক মুহূর্ত নীরবতা ভর করে ছিল ঘরে। তারপর নিশু যেন নতুন করে দৃঢ়তা পেল কণ্ঠে। দায়িত্বশীল এক রমণীর মতো বলল,”চল,খাবি।”
নিকাব খুলে দ্যুতি গায়ে আলতো করে ওড়না পেঁচিয়ে নিলো। তার দেখাদেখি বুশরাও কাঁধে ওড়না তুলে নিলো। নিশু হাত বাড়িয়ে দিলো বুশরার দিকে। অনিচ্ছুক ভঙ্গিতে নয় বরং এক ধরণের মমতার টানেই বুশরা তার হাত ধরল। নিশু ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামল। ডাইনিং স্পেসে পৌঁছে বলল,”তোরা বস,আমি বেড়ে দিই।”
তাদের বসে পড়তে বলেই একে একে প্লেটে খাবার তুলে দিতে লাগল। তখনই খেতে বসতে এলো সবাই- ধ্রুব,ধূসর,ধীরাজ- শুধু দু’জন ছাড়া। আসাদ সাহেব আর দিলরুবা খাতুন। নিশুর মুখ হঠাৎই মলিন হয়ে উঠল।
“আব্বু আর ফুপি কই,রিনা আপা?”
“ঘরে।”
“খাবে না?”
“জিজ্ঞেস করছি,কিছু কয় নাই।”
কিছুক্ষণ চুপ হয়ে রইল নিশু। তারপর চোখের জল সামলে নিয়ে আবার মন দিলো সবার প্লেটে যত্ন করে খাবার বেড়ে দেওয়ায়। তাকে সাহায্য করল দ্যুতি। এভাবে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দু’জনের হাতের মায়ায় খাবার সাজতে লাগল টেবিলে। দৃশ্যটা বুশরা একদৃষ্টিতে দেখছিল। তার মনে হলো,এ দু’জন যেন একে-অপরের পরিপূরক। নিশু যখন দায়িত্ব নিচ্ছে,দ্যুতি তখন তাকে এগিয়ে দিচ্ছে দৃঢ় সহচরীর মতো। অচেনা এই সম্পর্কের ভিতরে বুশরার মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি ভর করল। মুহূর্তেই তার নিজের বাসার কথা মনে পড়ে গেল। তাদের বাড়িতে ডাইনিং টেবিলে কখনোই ছিল না এই নীরব সৌন্দর্য।
খেতে বসলেই রাজনৈতিক ফোন আসতো একের পর এক- কখনো মন্ত্রী,কখনো দলীয় নেতারা। আর ফোন ধরতে ধরতেই তার বাবার মুখের রাগ,দাদীর বিরক্তি,মায়ের মলিন মুখ,ভাইয়ের টিটকারিমূলক কথা- সব মিলিয়ে খাবারের স্বাদটাই মাটি হয়ে যেত। প্রায়ই সেখানে খাবার মানেই ঝগড়াঝাঁটি কিন্তু এখানে একেবারেই উল্টো। এরা সবাই কেমন নিরিবিলি খাচ্ছে। কারও মুখে কোনো অশান্তি নেই,নেই কোনো তর্ক-বিতর্ক। শুধু খাবারের গন্ধ,প্লেট,চামচের শব্দ আর এক ধরণের অনাবিল শান্তি ভেসে আসছে চারপাশে। বুশরার বুকের ভিতর হঠাৎ এক উপলব্ধি জেগে উঠল,তাই তো বলা হয় খাবার খাওয়াও একটা ইবাদত। হয়তো এভাবেই,শান্তি আর ভালোবাসার ভিতরে। নিশু প্লেটে খাবার বেড়ে সিঁড়িতে এক কদম ফেলতেই দ্যুতি বলল,”কই,যাস?”
“আব্বু খায়নি তো।”
“পরে খেয়ে নিবে। বস,তুই।”
“না রে। আমার গলা দিয়ে নামবে না। আর আব্বুর মনে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। অভিমান করে আছে। সময় মতো না খেলে আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে। তুই সবার খেয়াল রাখ,আমি আসছি।”
নিশু নিঃশব্দে সিঁড়ি বেয়ে আসাদ সাহেবের রুমে চলে গেল। গোসল শেষে নামাজ আদায় করে বিছানায় বসলেন তিনি। প্লেট নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল নিশু।
“গোসল নিয়েছ আব্বু?”
নিশুকে দেখতেই মুখ ফিরিয়ে নিলেন। মলিন হাসল নিশু।
“নামাজ আদায় করেছ?”
নীরব রইলেন তিনি।
“খাওয়া-দাওয়া করবে না?”
নিরুত্তর তিনি।
“অভিমান করলে হবে বলো!”
শ্বাসটুকুও ফেললেন না তিনি।
“অভিমান করলে তোমাকে অনেক কিউট লাগে,আব্বু। ঠিক গাল ফুলিয়ে ছোট্ট বাচ্চারা যেমন করে তেমন। তুমি বরং অভিমান নিয়েই থাকো।”
নাক ফুলে উঠে আসাদ সাহেবের। মৃদু হাসে নিশু। আকস্মিক ভাতের লোকমা মুখে পুরে দিলো। মুহূর্তেই হতভম্ব হয়ে গেলেন তিনি।
“একদম কোনো কথা নয়,তাড়াতাড়ি খাও,অভিমানী ছোট্ট বাচ্চাটা।”
তবু তিনি মুখ ফিরিয়ে স্থির রইলেন।
“আরে,খাও না!”
নিশু ধীরে ধীরে উনার কাঁধে মাথা রাখল।
“আর রাগ করে থেকো না,আব্বু,প্লিজ। প্লিজ। মাফ করে দাও। তোমার পায়ে পড়ি।”
নীরব রইলেন তিনি।
“বান্দা পাহাড় সমান গুনাহ করলেও আল্লাহ মাফ করে দেয়,আর আমিও এক গুনাহগারী পাপী বান্দা মাফ করে দাও।”
আরেকটি লোকমা মুখে পুরে দিলো। বাধ্য হয়ে আস্তে আস্তে চিবুতে লাগলেন তিনি। নিশু ধীরে ধীরে খাইয়ে মুখ মুছে ঔষধ খাইয়ে দিলো। তবে একটি কথাও বললেন না তিনি এবং তাকালেন না পর্যন্ত।
“রেস্ট করো। তোমার জন্য চা পাঠাচ্ছি।”
দরজার আড়াল থেকে দৃশ্যটি দেখছিল বুশরা। চোখে যেন অদ্ভুত উষ্ণতা ভেসে উঠল। কেন জানি,মনে হলো বহুদিন ধরেই এমন শান্তি ও মমতার দৃশ্য সে দেখেনি। ঘরের নিঃশব্দ বাতাসে ভেসে এলো সেই ছোট্ট আনন্দের প্রতিধ্বনি,শুধু খাওয়ার মধ্যেই এত শান্তি,এত মমতা।
“ফুপি,আসো খাবে।”
উনার হাত ধরে টেনে ডাইনিংয়ে নিয়ে গেল। নিশু সুন্দরভাবে প্লেটে ভাত তুলে দিলো। নিজেও ভাত বেড়ে খেতে লাগল। উপর থেকে বুশরা এই দৃশ্যটা দেখছিল। চোখে অদ্ভুত প্রশান্তি। মনে হলো,এ রকম বউ-শ্বাশুড়ির মেলবন্ধন সত্যিই খুবই সৌন্দর্যপূর্ণ- শুধু খাওয়া না বরং আন্তরিকতা আর সম্মানের এক নীরব ছাপ। ভাত খেয়ে হাত ধুয়ে নিশু কিচেনে ঢুকল। চায়ের জন্য সেটিং করল। আসাদ সাহেব বিকেল বেলায় এক মগ মশলা চা খেতে পছন্দ করেন। দ্যুতি ঔষধের বক্সটা টেবিলে রেখে বলল,”নিশু,ঔষধ খেয়ে নে। আমি কিচেনে আছি।”
মায়াকুমারী পর্ব ৫১
কিছুক্ষণ পর কিচেন থেকে বেরিয়ে নিশু ধীরে ধীরে ঔষধ খেয়ে নিলো। বুশরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখল সবকিছু ঠিক যেন ছোটখাটো নিখুঁত মুহূর্তের মতো,যেখানে কেউ হঠাৎ রাগ বা অসন্তোষের ছাপ ফেলছে না। শুধু প্রশান্তি,যত্ন এবং আন্তরিকতার একটি মৃদু ঢেউ। চা হয়ে গেল। নিশু ধীরে ধীরে সবার জন্য কাপে ঢেলে নিলো।