মায়াকুমারী পর্ব ৫৩
মেহেরিন আনজারা
মশলা-চায়ের দমে ভেসে উঠেছিল পুরো রান্নাঘর। হাঁড়ির ঢাকনা উঠতে না উঠতেই তীব্র দারুচিনি আর এলাচের ঘ্রাণে নিশুর মাথা যেন ঘুরে যাচ্ছিল। তবুও হাত থামাল না। একদিকে মশলা-চা,আরেকদিকে কড়া লিকারের দুধ-চা- দুটোই ফুটে উঠেছে ছোট ছোট বুদবুদে। ধোঁয়া উঠছে,কাপগুলো সারি করে সাজিয়ে নিলো দ্যুতি। সযত্নে চা ঢালতে ঢালতে নিশু বলল,”দ্যুতি,এটা তোর বড় ভাইয়াকে দিস। আর এই তিন কাপ আমাদের জন্য নিয়ে যা। আমি আসছি একটু পর।”
মাথা নেড়ে ট্রে হাতে নিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল দ্যুতি। ওকে দেখতেই দ্রুত সরে গেল বুশরা। বাকি কাপগুলো ট্রেতে তুলে নিতেই হঠাৎ এগিয়ে এসে এক কাপ তুলে নিলো ধীরাজ। তারপর ফুপা-ফুপির রুমের দিকে পা বাড়াল নিশু। তার চোখে খানিক খুশির রেখা খেলে গেল,যেন সংসারের ছোটখাটো সুখগুলোতেও ওর প্রাণ ভরে যায়। উনাদেরকে দিয়ে ধূসরের রুমের দিকে এগোল। নক করতে গিয়েই খেয়াল করল দরজা ভিড়িয়ে রাখা। হৃদস্পন্দন খানিক জোরালো হলো। নিঃশব্দে এগিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। রুমে নেই ধূসর। ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ ভেসে আসছে। নিশু নিঃশব্দে কাপটা টেবিলের উপর রেখে সজোরে বলল,”তোমার চা দিয়ে গেলাম,খেয়ে নিও।”
হঠাৎ দৃষ্টি আঁটকে গেল টেবিলের উপর রাখা ডায়েরিটির দিকে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
কালো-নীল কভারের সেই ডায়েরি। ধূসরের প্রিয় জিনিসগুলোর একটি। বাইরে থেকে সাধারণ,ভিতরে যেন লুকিয়ে আছে অনেক অজানা রহস্য। কতদিন ধরেই ওটার দিকে তাকিয়ে অস্থির হতো নিশু। আজ যেন সেই নিষিদ্ধ ফল হাতের নাগালে চলে এসেছে। কম্পিত হাতে তুলে নিলো ডায়েরিটা। কলম রাখা ছিল ভিতরে বুকমার্কের মতো। পাতা উল্টাতেই চোখে পড়ল ঝলসানো অক্ষর-
“তোমাকে পাওয়ার মতন ভাগ্য নিয়ে আমার জন্ম না হলেও,তোমাকে ভালোবাসার মতন একখানা নিখুঁত মন নিয়ে আমার জন্ম হয়েছে। সুতরাং পাওয়া না-পাওয়ার হিসেব না করে আমৃত্যু অব্ধি তোমাকে ভালোবেসে যাব।”
মুহূর্তেই শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল নিশুর। মাথার ভিতর প্রশ্নের পাহাড় জমে উঠল,”কে সেই মেয়ে? কার জন্য মানুষটা দেবদাস হয়ে যাচ্ছে?”
মেজাজ খারাপ হলো নিশুর। দাঁতে দাঁত চেপে কলমটা তুলে তার নিচে লিখল,”তাহলে তো তুমি যাকে পেয়েছ তাকে তার হক থেকে বঞ্চিত করবে,জনাব।”
কলম বন্ধ করতে নিতেই ফের চোখ পড়ল আরেকটু নিচে। তাতে লেখা,”চিরকাল এই হৃদয় ছটফট করবে তোমাকে না পাওয়ার যন্ত্রণায়। আর তুমি অন্য কাউকে নিয়ে সুখে থাকবে।”
লাইনটি পড়তেই নিশুর বুকের ভিতর জ্বালা শুরু হলো। হাহাকার ভরে উঠল মনের মধ্যে। দাঁতে দাঁত চেপে কলম খুলে তার নিচ দিয়ে লিখল,”আমার মনে হয় না ছটফট করে,তবে একটা সময় সব ঠিক হয়ে যায়। সংসার,বউ-বাচ্চা- এসবের ভিড়ে সব চাপা পড়ে যায়। তখন সেইসব আর মনে থাকে না।”
এর নিচে লিখল-
“ইতি,
~বিষফুল।”
কলমটা ছুঁড়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল। দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিলো এমনভাবে,যেন নিজের সমস্ত রাগ কাঠের ফাঁক দিয়ে আছড়ে ফেলছে। ওয়াশরুমের কল বন্ধ হতেই এক নিঃশব্দ স্রোত নেমে এলো ঘরে। পানির ফোঁটা গড়িয়ে পড়ল ধূসরের ভেজা কপাল বেয়ে।তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে রুমে ঢুকল। টেবিলের উপর ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চা পড়ে আছে। তার পাশেই ডায়েরি। মুহূর্তেই স্থির হয়ে গেল ধূসর। ডায়েরিটা সে খোলা রাখেনি। বুক ধকধক করে উঠল। অস্থির হাতে এগিয়ে গেল টেবিলের দিকে। পাতায় চোখ পড়তেই তার শিরদাঁড়া বেয়ে একরাশ শীতল স্রোত বয়ে গেল। নিজের লেখা বাক্যের ঠিক নিচে লেখাগুলো দেখতেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। পলক ফেলল না। হৃদয়ের গভীরে এক ঝটকা আঘাত খেল যেন। নিশু আবারও এই দুঃসাহস করল! মেয়েটার জ্বালায় আর পারল না। মেজাজ খারাপ হলো ধূসরের। ‘বিষফুল’ শব্দটি দেখতেই যেন পাথর হয়ে রইল। চোখে রাগ,ক্ষোভ,অভিমানের ঝড়। কিন্তু তার ভিতরে এক চোরা কাঁপুনি। যে কাঁপুনি শুধু ভালোবাসার আঘাতেই জন্মায়। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। চোখের কোণে জল জমলেও মুখে কঠিন রেখা টেনে রাখল।
“তুই সত্যিই বিষফুল! জানিস তো,বিষ কেবলই নষ্ট করে না,পুড়িয়ে দেয়।”
শেষ বিকেলের আলো জানালা দিয়ে ঢুকছিল ঘরে। চায়ের কাপ তখনও টেবিলের উপর পড়ে রইল। ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। রুমে ঢুকল নিশু অনেক আগেই কিন্তু বুকের ভিতরের ধপধপানি যেন থামছিল না। আঙুলের ডগায় এখনও রয়ে গিয়েছে ডায়েরির কাগজের খসখসে ছোঁয়া। ধূসর যে চটবে ঢের জানে সে তবুও দুঃসাহস করা। চোয়াল শক্ত করে রুম থেকে বেরিয়ে ওদের দরজায় নক করল ধূসর। নিশু দ্রুত ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। একপলক তাকিয়ে দ্যুতি উঠে এসে দরজা খুলল।
“কী ভাইয়া?”
“নিশুর বাচ্চা কইরে?”
“কেন?”
“কই ও?”
“ওয়াশরুমে।”
“ওর হাতটা ভেঙ্গে দিবো সামনে পড়লে।”
“কী হয়েছে?”
“দুঃসাহস!”
“মানে!”
তপ্ত দৃষ্টি ফেলে চলে গেল ধূসর।
গভীর রাত। নিস্তব্ধতা এত ঘন যে নিঃশ্বাস ফেললেও মনে হয় শব্দ উঠছে। দু’পাশে দু’জন নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে,আর মাঝখানে শুয়ে আছে নিশু। পেটের ব্যথায় হঠাৎই ঘুম ভেঙে গেল। আধো অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে দেখল,ডিম লাইটের মৃদু আলোয় সময় সোয়া তিনটা বাজে প্রায়। ধীরে ধীরে উঠে বসল। মুখে অজান্তেই ভেসে এলো এক লম্বা হাই,চোখে ঘুমের তদ্রভাব এখনও লেগে আছে। খানিকক্ষণ স্থির হয়ে বসে রইল,তারপর বিছানা থেকে নেমে পেটিকোট বদলে ধীরে ধীরে অযু করে নিলো। পানির ছোঁয়ায় শরীর জেগে উঠল,আর মন গাঢ় এক প্রশান্তিতে ভরে গেল। তাহাজ্জুদ আদায় করে রুম থেকে বেরোল নিশু। সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল ধীর পায়ে। অন্ধকারে শুধু শোনা গেল সোনার নুপুরের মৃদু ঝংকার- ঝুন.. ঝুন.. ঝুন..
নিঃশব্দ অন্ধকারে সেই শব্দ যেন এক অদ্ভুত সঙ্গীত হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। পুরো বাড়ি নিশ্চুপ,তবুও নিশুর পদধ্বনি যেন তার অস্তিত্বের ঘোষণা দিচ্ছে। সব অভ্যাস বদলে গেলেও নিশুর এই বদঅভ্যেস বদলায়নি এখনও। সম্ভবত বদলাবেও না। ঘুম ভেঙে গেলে পুরো বাড়ি হেঁটে বেড়ানো যেন তার শ্বাস নেওয়ার মতোই প্রয়োজনীয়। এক রাতও যদি এভাবে না হাঁটে,নিশুর মনে হয় বুকটা চেপে আসছে। চারদেয়ালের ভেতর গাঢ় আঁধার জেগে ওঠে,অস্থিরতা গ্রাস করে ফেলে। আর আশ্চর্যের কথা,দ্যুতিও এখন এই অভ্যাসে জড়িয়ে গিয়েছে। প্রথমে কৌতূহল,পরে অভ্যাস,এখন প্রায় নেশার মতো নিশুর রাতভর হাঁটা দেখে দেখে ও-ও শিখে নিয়েছে।
অন্ধকারে ঝুনঝুন শব্দে ভেসে ওঠে রাতের আখ্যান। আর নিশু,নুপুরের ধ্বনিতে যেন নিজের অজানা এক সঙ্গীত বুনে চলে। লিভিং স্পেসের নিস্তব্ধতায় এসে বসে রইল নিশু। দেয়ালের মধ্যে ফ্রেমে বাঁধানো পেন্সিল স্কেচটির দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। ছবিটায় সে আর দ্যুতি হেসে রয়েছে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে। যেন সেই মুহূর্তের উচ্ছ্বাস চিরকালের জন্য থেমে গিয়েছে ছবির সাদা-কালো রেখার ভিতর। চোখ সরাতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল,ছবিটাই তাকে শূন্যতার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে ধীরে ধীরে রুমে ফিরে এলো। দু’জনের গায়ে আলতো করে পাতলা কাঁথা টেনে দিলো। হঠাৎ চোখে পড়ল দ্যুতির গাল ভেজা,আঠালো হয়ে আছে। আঙুল ছুঁতেই টের পেল,সে কেঁদেছে। নিশু নিঃশব্দে চুলে হাত বুলিয়ে দিলো কয়েকবার। বুকটা হালকা কেঁপে উঠল। অনিকের কথা মনে পড়ল। কেমন আছে সে?খোঁজ নেওয়া হয়নি অবশ্য। বুশরাও কিছু বলেনি। এক অদৃশ্য গ্লানি ভর করল মনে। নিশু আবারও দাঁড়াল নামাজের জন্য। ধীর তালে নফল নামাজ আদায় করতে শুরু করল। পাশে শুয়ে থাকা দ্যুতি পিটপিট করে তাকাল।
“নিশু,কী করিস?”
সালাম ফিরিয়ে নিশু মৃদুস্বরে বলল,”নামাজ পড়ি। পড়বি?”
“হুম।”
“আয়।”
দ্যুতি উঠে বসল।
“আমাকে ডাকলি কেন না?”
মলিন হাসল নিশু।
“ঘুমাচ্ছিস ভেবেছিলাম।”
“তাই বলে ডাকবি না?”
“মায়া লাগে ঘুম ভাঙাতে।”
ওদের ধীরস্বরে বলা কথাগুলো কিছু কিছু কানে পৌঁছাল বুশরার। ঘুমের ঘোরে একবার তাকিয়ে আবারও চোখ বুজে ঘুমিয়ে গেল। দ্যুতি উঠে দাঁড়াল। জামা বদলে অযু করে নিশুর পাশে দাঁড়াল। তারপর নামাজ আদায় করতে লাগল। লক্ষ্য করল,বারো রাকাআত পড়া শেষ তার অথচ নিশু আরও পড়েই চলেছে।
“কীরে,কী পড়িস এত?”
“নামাজ।”
“বারো রাকাআত তো শেষ।”
“নফল পড়ি।”
“কেন রে?”
“এমনি।”
“এমনি আবার কেন?”
“অনিককে যেন আল্লাহ সুস্থ করে দেয়।”
আবারও নামাজে দাঁড়াল। দ্যুতি বসে রইল মূর্তির মতো। বুকের ভিতর হঠাৎ ভারি হয়ে এলো। নিশু অনিকের সুস্থতার জন্য নামাজ আদায় করছে,আর সে এত বড় কাণ্ড ঘটিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছিল! হঠাৎ অশ্রু গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। উঠে দাঁড়ানোর শক্তি যেন হারিয়ে ফেলল,তবুও দূর্বল পায়ে ধীরে উঠে দাঁড়াল। নিশুর পাশে সে-ও নামাজে দাঁড়িয়ে গেল। দু’জনের নিঃশব্দ প্রার্থনায় মিলেমিশে গেল ভালোবাসা,মায়া আর গোপন অশ্রুর ভার। একসময় ফজরের আযান ভেসে এলো বাতাসে। দু’জনেই থেমে গেল।
“নিশু,বুশরাকে ডাকি?”
একপলক তাকাল তার দিকে। ঘুমে বিভোর বুশরা। মায়া হলো।
“আজ থাক,কাল থেকে। বিশ্রাম নিক। নয়তো পরে বিরক্ত হতে পারে। ধীরে ধীরে অভ্যাস করতে হবে। ধরেই সব হবে না।”
সায় দিয়ে দু’জন ফজরের নামাজ শেষ করল।মোনাজাত শেষে শরীর ভেঙে এলো নিশুর। কোরআন তিলাওয়াত করার ইচ্ছে থাকলেও আর শক্তি পেল না। দ্যুতিরও অবস্থা একই,চোখে ঘুমের ঘোর,শরীর ক্লান্ত। অবশ্য এই কয়দিন যা অবস্থা গিয়েছে হসপিটালে।
“একটু হাঁটি চল। গায়ে শীতল হাওয়া মাখাই।”
হাত ধরাধরি করে ছাঁদের দিকে পা বাড়াতেই হঠাৎ ধূসরের রুম থেকে গোঙানির শব্দ শুনতেই চমকে দাঁড়াল। দু’জনের চোখে চোখ পড়ল।
“নিশু,চল তো!”
ভেতরে ঢুকতেই দেখল ধূসর গোঙাচ্ছে। জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে আগুনের মতো।
“জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে নিশু।”
নিশু দ্রুত ওয়াশরুম থেকে বালতি ভর্তি করে পানি নিয়ে এলো।
“মাথায় পানি ঢাল।”
দ্যুতি পাশে বসে কপালে পানি ঢালতে লাগল। ধূসরের চোখ আধো খোলা,নিভু নিভু দৃষ্টি। নিশুর দিকে তাকাল। গর্জিয়াস,আহামরি ধবধবে সাদা সুন্দরী নয় নিশু। তবে মন দিয়ে দেখলে মনে গেঁথে যায় এতটাই অপরূপ শান্ত এক সৌন্দর্য। মাথায় সাদা ওড়না পেঁচানো,মুখে ক্লান্তি তবু যেন পূতপবিত্র আভা। ধূসর জানে,নিশু রাত জেগে নামাজ পড়ে এসেছে। নিশুর অভ্যাস সম্পর্কে এ-টু-জেড সব জানা আছে তার।
“দ্যুতি!”
“হুম?”
“বুশরাকে ডাকলে ভালো হয়।”
“কেন?”
“ওর স্বামী তো! ও কাছে থাকলে সম্পর্কটা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হবে।”
“ও তো ঘুমাচ্ছে,নিশু। দশ-এগারোটার আগে ওঠবে নাকি! ওর যা অভ্যাস!”
ধূসর হঠাৎ বিড়বিড় করে বলল,”এইজন্যই বড়লোকের মেয়ে ভালো লাগে না আমার।”
নিশু বলল,”তোমার এত চিন্তা করার দরকার নেই। ওকে-ও আমাদের মতো করে গড়ে নিবো। কথায় আছে,‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস,অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।’ নিশ্চয়ই ভালো কিছু শিখব,শেখাবও।”
নিশু রুম থেকে বের হতে নিতেই হঠাৎ চোখ পড়ল টেবিলে রাখা ডায়েরিটির উপর। আকস্মিক বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠল। সারা রাত নিশ্চয়ই এই ডায়েরি নিয়ে পড়ে থেকেছিল আর সেই কারণেই শরীর ভেঙে আরও জ্বর এসেছে। ডায়েরিটা হাতে তুলে নিলো নিশু। ধূসর তাকিয়ে রইল বাঁধা দিলো না।
“তোমাকে নিয়ে আমার অনুভূতি যদি লিখতে যাই তাহলে হয়তো কেটে যাবে বহুযুগ। এই ছোট্ট জীবনে তোমার আগমন আর তোমার জন্য জমানো স্মৃতিগুলো এতই বিশাল যা লিখে শেষ করা যাবে না। তবুও কিছু অবহেলিত বাক্য তোমার তরে নিবেদিত। কাগজ-কলমের সাদাকালো কালিতে হয়তো প্রকাশ পাবে কিন্তু যথেষ্ট নয় তা। অনুভূতির তীব্রতা যদি লেখায় ধরা যেত,তবে বিচ্ছেদের লেলিহান শিখায় পুড়তে হতো না কতশত হৃদয়কে।”
মেজাজ খারাপ হলো নিশুর। দাঁতে দাঁত চেপে কঠিন গলায় বলল,”তোমার এইসব ঢং বাদ দাও এবার। বুশরা জানতে পারলে ভীষণ আঘাত পাবে। খবরদার,আর কখনো ডায়েরি লিখবে না।”
চমকে তাকায় দ্যুতি।
“কী হয়েছে,নিশু?”
“মহারাজ! সরি দেবদাস! উঁহু,চ্যাকা খাওয়া বাপ্পারাজ! উনি নাকি কাহাকে গভীরভাবে ভালোবাসিয়াছেন। এখন সেই বিরহে দিবা-রজনী পুড়িতেছেন; চোখে ঘুম নাই,মনে শান্তি নাই,বুকে শুধু হাহাকার। নিদ্রাহারা হইয়া ডায়েরির পাতায় পাতায় হাহাকার লিখিয়া চলিয়াছেন তিনি,অশ্রুর দাগে ভিজাইয়া ফেলিতেছেন কালি।
হায়,সেই মহারূপসী! কেন তুমি দূরে গেলে চলিয়া?তোমাকে ছাড়া আমাদের মহারাজ- সরি চ্যাকা খাওয়া বাপ্পারাজের শ্বাসে যেন বিষ,চোখে শুধু শূন্যতা!
আহা! দেবদাস না হয় নদীতে ডুব দিয়াছিল,আর আমাদের এই চ্যাকা খাওয়া বাপ্পারাজ শুধু কালি-কলমে ডুবিয়া মরিতেছেন।”
মায়াকুমারী পর্ব ৫২
তাচ্ছিল্যের সুরে বিদ্রুপ ছুঁড়ে দিলো নিশু। নির্বিকার হয়ে তাকিয়ে রইল ধূসর। নিশু হঠাৎ ডায়েরিটা ছিঁড়ে কুচিকুচি করে ব্যালকনির বাইরে ছুঁড়ে ফেলল।
“খতম! আজ থেকে বুশরা-ই তোমার সব। ওকেই ভালোবাসবে,ওর জন্য লিখবে। ও এখন তোমার বৈধ স্ত্রী।”
দ্রুত বেরিয়ে গেল নিশু। টুপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল ধূসরের চোখের কোণ বেয়ে।
“মেয়েটা কে,ভাইয়া?”
“বিষফুল!”