নূরজাহানের সংসার পর্ব ৬

নূরজাহানের সংসার পর্ব ৬
শ্রীমতি প্রজ্ঞা মঞ্জরী

অর্ণবের গাড়িটা নূরদের বাড়ির সামনে এসে থামলো। গাড়ির ভিতর থেকে প্রথমে অর্ণব তারপরে বেড়িয়ে এলো তাসিন। অর্ণব সোজা ঢুকে গেলো নূরদের বাড়িতে তার পিছনে তাসিনও ঢুকলো। সদরদরজার কাছে এসে কলিংবেল বাজানোর কিছু মূহুর্তে পরেই দরজা খুললেন রাহেলা। অর্ণবকে দেখে বলে ওঠেন, “তুমি?”
রাহেলার চেহারার অস্বাভাবিকতা নজরে পড়লো তাসিনের। অপরাধীদের সাথে ডিল করতে করতে সহজেই মানুষের মুখের অভিব্যক্তি ধরে ফেলে তাসিন। রাহেলার চোখে আছে ভয় আর আতংক তবে চেহারায়।বিরক্তিভাব।যেন এই সময়ে অর্ণবের আসায় কিছুটা হলেও বিরক্ত সে। তার উপর উটকো ঝামেলা হিসেবে সাথে তাসিন।
রাহেলা দরজার সামনে থেকে সরে গিয়ে অর্ণব আর তাসিনকে ভিতরে ঢুকতে দিলেন।তাসিন বাড়িতে ঢুকে আশপাশটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে কপাল কুচকে জিজ্ঞেস করলো।

“বাড়িতে কি আপনি একাই আছেন?”
তাসিনের কথায় কেমন যেন চমকে উঠলেন ভদ্রমহিলা।জড়তাগ্রস্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন, “এই সময়টাই আমি একাই থাকি বাড়িতে। আমার ছেলে স্কুলে থাকে।”
তাসিন রাহেলার উত্তরে সন্তুষ্ট না হলেও হালকা মাথা ঝাঁকিয়ে ব্যাপারটা আপাতত বন্ধ রাখলো।
“ফরিদপুরে কি আপনাদের কোনো আত্মীয় আছেন?”
“আমার জানা মতে নেই। নূরের দাদী মারা যাওয়ার পর আমাদের আর যাওয়া হয়নি গ্রামের বাড়িতে।”
রাহেলার কথায় অর্ণবের মনে যেই সামান্য আশার আলো দেখা গিয়েছিলো তা-ও নিভে গেলো।ফরিদপুর শহরটা মোটেই ছোট নয়। অন্তত নূরের কোনো আত্মীয় আছে কিনা ওই শহরে তা জানতে পারলে নূরকে খোঁজা সহজ হতো।
“অর্ণব, এখানে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। আমাদের ফরিদপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হতে হবে।”
তাসিনের কথা শুনে অর্ণব বলে ওঠে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“হ্যাঁ, আর উপায় নেই।”
“নূর কি ফরিদপুর আছে?” উৎসুক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে রাহেলা।
তাসিনের কাছে এই মহিলার আচরণ মোটেই স্বাভাবিক লাগছে না।নিজের মেয়ে প্রায় একদিন হতে চললো নিরুদ্দেশ অথচ এই মহিলার মধ্যে কোনো হেলদোল নেই? উনি কি কোনোভাবে জানেন নূর কোথায় আছে?
অর্ণবের উত্তর দেওয়ার আগেই তাসিন বলে ওঠে, “এখনো জানিনা। প্রাথমিক ধারণা করছি।”
তাসিন নিজের কথা শেষ করে রাহেলাকে আর কিছু।বলার সুযোগ দিলো না।অর্ণবের হাত ধরে বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে।
বাইরে এসে অর্ণবকে উদ্দেশ্য করে তাসিন বলে, “তোর শাশুড়ির হাব-ভাব আমার সুবিধার লাগেনি অর্ণব। উনি মিথ্যে বলেছেন আবারো।”
“তুই আবার কি মিথ্যে পেলি?”

“উনি বলেছেন উনি বাড়িতে একা আছেন।কিন্তু আমি সোফার সামনের সেন্টার টেবিলে দু’টো গ্লাস দেখেছি কোল্ড ড্রিংস এর। সাথে পপকর্ণ আর পাকোড়া ছিলো।সম্ভবত কোনো শো বা সিনেমা দেখা হচ্ছিলো। একা একা অবশ্যই উনি দু’টো গ্লাস নিয়ে বসে থাকবে না।”
অর্ণব চকিতে তাকালো তাসিনের দিকে।নূরের চিন্তায় আশেপাশে খেয়াল করেনি অর্ণব। “নূরজাহান কে খুঁজে পাচ্ছিনা প্রায় বারো ঘন্টা হতে চললো।আমার থেকে ওনার উদ্বিগ্নতা বেশি হওয়া উচিৎ ছিলো অথচ উনি বসে সিনেমা দেখছেন!” চোয়াল শক্ত করে বলে ওঠে অর্ণব।
“রিল্যাক্স অর্ণব।আমি যদি খুব বেশি ভুল না হই তাহলে ফরিদপুরে ওনাদের কোনো না কোনো আত্মীয় আছেই।ভাবী হয়তো সেখানেই গেছেন। নিজের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে অবগত হয়েও কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো মেয়ে ভাবী নয়।নিরুদ্দেশ হতে চাইলে চট্টগ্রাম বান্দরবন ও যেতে পারতেন;কিন্তু উনি ফরিদপুর গেছেন।পরিচিত কেউ আছে বলেই গেছেন।”

“তাসিন,আমি ফরিদপুর যাবো।”
“আমি না ব্যাটা;বল আমরা।ফরিদপুর সদর থানার ওসির সাথে যোগাযোগ করি দাঁড়া। ভদ্রলোক আমার পরিচিত,এক ট্রেনিং এ দেখা হয়েছিলো।” বলেই পকেট থেকে ফোনটা বের করে ওসির নাম্বার খুঁজতে থাকে তাসিন।
……………..
“ওর হাসবেন্ডের নাম তুই কি করে জানলি?” মারজানার প্রশ্নের জবাবে স্নেহা নূরের রিপোর্ট টা খুলে তার সামনে দিয়ে বলে,
“দেখো এখানে অভিভাবক এর যায়গায় শাফিকুল চৌধুরী অর্ণব এর নাম লিখা আছে।ঢাকার বড় হাসপাতাল গুলোতে রিপোর্ট এ পেশেন্টের নামের সাথে অভিভাবকের নাম ও লেখা থাকে মা।”

মারজানা রিপোর্ট টা হাতে নেন। নূরের নামের যায়গায় ও নূর চৌধুরী লেখা দেখে উনি শিওর হন নূর বিবাহিত।
নূরের সবে জ্ঞান ফিরেছে। পিটপিট করে চোখ খুলে হাসপাতালের সাদা সিলিং নজরে আসে তার। হাত নড়াতে গেলেই হাতে মৃদু টান লেগে অস্ফুট স্বরে “আহ্” বলে ওঠে নূর। আশেপাশে তাকাতেই বুঝে যায় হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে সে। গলায় একটু জোর সঞ্চয় করে “ফুপ্পি? স্নেহা?” বলে ডাক দেয় নূর।
কেবিনের বাইরে থেকে নূরের আওয়াজ পেয়ে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢোকে মারজানা আর স্নেহা। নূরের পাশে যেয়ে নূরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মারজানা বলে ওঠে, “খারাপ লাগছে মা? পানি খাবি?”
মারজানার কথায় উপর নিচ করে মাথা নাড়ায় নূর। ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা বের করে ছিপি খুলে নূরের সামনে ধরেন তিনি;স্নেহা ততক্ষণে নূরকে সাবধানে বিছানা থেকে উঠিয়ে বালিশে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিয়েছে। দূর্বল হাতে পানির বোতলটা নিয়ে কয়েক ঢোক পানি পান করে নূর;গলাটা একদম শুকিয়ে গেছিলো তার।

“স্নেহা তুই একটু বাইরে যা তো। নূরের সাথে কথা আছে আমার।”
মায়ের কথায় আর টু-শব্দ না করে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায় স্নেহা।
বেডের পাশের ধাতব টুল টা টেনে নিয়ে বসেন মারজানা।
“তোর সাথে কি খারাপ কিছু হয়েছে মা?তোর মা মানে সৎমা রাহেলা কি কিছু করেছে?”
মারজানার কথায় নূরের মুখটা ছোট হয়ে যায়। মাথাটা নিচু করে চোখের পানি ফেলে নূর।
“নূর? কাঁদেনা বাচ্চা। তুই কাঁদলে, তোর মন খারাপ থাকলে বাচ্চাদের কষ্ট হবে সোনা। ফুপ্পিকে বল কি হয়েছে? ”
“বাচ্চাদের” শব্দটা শুনে কান্না থামিকে অবাক চোখে তাকায় নূর।
“বাচ্চাদের? কয়টা বাচ্চা ফুপ্পি?”

নূরের এমন কথায় হেসে ফেলেন মারজানা।
“দু’ট পুচকু আছে নূর। এবার আমায় বল কি হয়েছে?”
নূর যেন খুশিতে বাকহারা হয়ে গেছে। নূরের রিপোর্ট গুলো নূর দেখার সুযোগ পায়নি। গতকাল রাতে অর্ণবদের বাড়ি ফিরেই এতসব ঘটনা ঘটে গেলো যে নূর আর সময়-ই পায়নি রিপোর্ট দেখার।
“নূর? বলবি না ফুপ্পি-কে?”
মারজানার কথায় নূরের মনটা আবার খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু মনের উপর এই বোঝা একা একা বয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে তার।মনের ভিতরটা বড্ড পুড়ে,যাদের আপন ভেবে জীবনের এতোগুলো দিন কাটালো তারাই দিনশেষে পিঠে ছুড়ি মারলো!
নূর এবার হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।নূরের কান্না দেখে মারজানা বসা থেকে উঠে দাঁড়ান;দু’হাতে নূরকে আগলে নিয়ে মাথায় চুমু দিতে থাকেন।

“আমায় সবাই ঠকিয়েছে ফুপ্পি। মামণি…মামণি আমায় ঠকিয়েছে। অর্ণব আমায় মিথ্যে অপবাদ দিয়েছে ফুপ্পি। আমায় সবাই কষ্ট দিয়েছে ফুপ্পি।” ক্রন্দরত কণ্ঠে মারজানাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো অভিযোগ করতে থাকে নূর।
“বাবা আমায় কেন একা রেখে গেলেন ফুপ্পি?বলো না আমায়,কেন? এতো খারাপ আমি? ছোট বেলায় মা ফেলে চলে গেলেন;যাকে মায়ের আসনে বসালাম সে আমায় না জানিয়েই এমন এক পুরুষের সাথে বিয়ে দিলেন যার আগেও সংসার ছিলো; এক সন্তানের বাবা।”
নূরের কথায় যেন আকাশ থেকে পড়লেন মারজানা। রাহেলা মেয়েটাকে এমন এক অথৈ সমুদ্রে ফেলে দিয়েছে? এমন জঘন্য কাজ সে কি করে করলো?

“আমি তাও মেনে নিয়েছিলাম ফুপ্পি। অর্ণবের স্ত্রী, তার সন্তানের মা হয়ে উঠেছিলাম। ভেবেছিলাম আমি যেভাবে মায়ের আদর ছাড়া আমার শৈশবটা কাটিয়েছি এভাবে যেন অভ্রকে না কাটাতে হয়। সব তো ভালোই ছিলো ফুপ্পি,অর্ণব আমায় অনেক কেয়ার করতো।কখনো আমায় অবহেলা করতো না।কিন্তু বাচ্চা হওয়ার কথা শুনে অর্ণব কেমন পালটে গেল। ও বললো আমায় বাচ্চা ন*ষ্ট করতে নাহলে ওর সংসার ছেড়ে দিতে। আমার সন্তান হ*ত্যার থেকে ওর সংসার ছাড়া সহজ মনে হয়েছিলো ফুপ্পি,তাই আমি চলে এসেছি। সব ছেড়ে চলে এসেছি।”

মারজানা আর কিছু বললেন না। সবটা তার কাছে পানির মতো পরিষ্কার। কিন্তু অর্ণবের বাচ্চা নষ্ট করতে বলার বিষয়টা তার বোধগম্য হয়না। নূরকে আস্তে করে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নেন মারজানা। নূর তখনো ফুঁপিয়ে কান্না করেই যাচ্ছে। মারজানা নূরের মুখটা দু’হাতের আঁজলায় নিয়ে চোখের পানিটুকু মুছিয়ে দিলেন।
“অর্ণবকে জিজ্ঞেস করিসনি? কেন সে বাচ্চা চায়না?কেন তোকে এমন কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন করলো?”
নূর ডানে-বামে মাথা নাড়ায়। অর্থাৎ সে জিজ্ঞেস করেনি অর্ণবকে। জিজ্ঞেস করার সুযোগই পায়নি;অর্ণব বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেছে আগেই। আর তার ফিরে আসার আগে নূর বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে।

অর্ণব আর তাসিন বেরিয়ে যাওয়ার পর সদরদরজাটা তাড়াতাড়ি বন্ধ করে সোফায় গিয়ে বসেন রাহেলা।
“চলে গেছে?” এক মধ্যবয়স্কা রমণী বের হতে হতে জিজ্ঞেস করে।
“হ্যাঁ, চলে গেছে। তুই না লুকালেও পারতি। অর্ণব তোকে চেনে না।”
“ও না চিনলেও তো আমি চিনি।সকালে এসে একবার আমায় দেখে গেছে, এখন আবার দেখলে সন্দেহ করতে পারতো। আর কি বলে গেলো? নূর ওদের বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে?”
“হ্যাঁ, সেটাই তো বললো সকালে।এখন এসে জিজ্ঞেস করলো ফরিদপুরে আমাদের কোনো আত্মীয় আছে কিনা। নূর কি ফরিদপুর আছে?” উৎসুক চোখে অপর রমণীর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে রাহেলা।

“মেয়েটা তাহলে মায়ের বর পেয়েছে বল? মায়েরও সংসার টিকলো না,মেয়েরও একই দশা।” বলেই কুটিল হাসি হাসলেন সেই রমণী।
“আমি আবার কবে সংসার ছাড়লাম?”
রাহেলার এমন কথার পিঠে রমণীটি বলে ওঠে, “তুই কি নূরের মা? তুই তো ওর সৎ-মা।”
রাহেলা মুখটা ভেঙচি দিয়ে বলে, ” পাকোড়া খা,ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
অত:পর দুই রমণী কোল্ড ড্রিংস এর গ্লাস হাতে নিয়ে পাকোড়া আর পপকর্ণ খেতে খেতে সিনেমা দেখতে থাকে।

নূরজাহানের সংসার পর্ব ৫

“অর্ণব? কথা হয়ে গেছে।উনি বলেছেন আমাদের সর্বোচ্চ সাহায্য করবেন। আমি বাসের টিকিট ও বুক করে নিয়েছি। সন্ধ্যা সাতটায় বাস;তুই বাসায় যা। একটু রেস্ট নে। আর পারলে দুই-তিন সেট কাপড় নিয়ে নিস।”
অর্ণব কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকায় তাসিনের দিকে। অত:পর দু’জন গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায়। তাসিনকে তার বাসায় ড্রপ করে নিজেও বাড়িতে যায়। রুমে গিয়ে কাপড়-চোপড় গুছিয়ে নেয় ব্যাগে।হাতমুখ ধুঁয়ে ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় ফেলে।ফোনে ছয়টা পনেরো তে এলার্ম সেট করে চোখ বন্ধ করে ঘুমের দেশে তলিয়ে যায়।

নূরজাহানের সংসার পর্ব ৭