রোদ্দুর এবং তুমি পর্ব ৪

রোদ্দুর এবং তুমি পর্ব ৪
ফারহানা চৌধুরী

অরু আর শুভ্র যখন বাড়ি পৌঁছালো তখন দুপুর হয়েছে। অরু সারা রাস্তা কথা পর্যন্ত বলেনি শুভ্রর সাথে। অবশ্য এমনিতেও বলে না। শুভ্র গাড়ি থামালে অরু গটগট করে নেমে চলে গিয়েছে। শুভ্র পিছু পিছু এলো। ফ্লাটের দরজা খুলে দিলে অরু ভেতরে ঢুকে গেল। নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে গলার স্কার্ফটা খুলে বিছানায় ছুঁড়ে মারলো। মাথা চেপে বসল বিছানায়। এই ‘শুভ্র’ নামক প্রাণীটা প্রচন্ড বিরক্তিকর তার কাছে। প্রচন্ড! সে কি করে এতোগুলো দিন কাটাবে এটা ভেবে কতগুলো প্রলম্বিত শ্বাস ফেললো। অরু সময় নিয়ে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করলো। এরপর উঠে গিয়ে কাবার্ডের কাছে দাঁড়ালো। কাবার্ড থেকে একটা টি-শার্ট আর প্লাজো বের করলো। বাসায় পরার জন্য সাধারণত যা কম্ফোর্টেবল। অরু ঠিক করল গরম পানিতে লম্বা একটা শাওয়ার নেবে। সে ঘরের এটাচ বাথরুমে চলে গেল।

গোসল করে বের হলো চুল মুছতে মুছতে। তোয়ালে বেলকনিতে মেলে দিতে গেল। সেখানে দড়ির মতো একটা কিছু টানানো। নিচ থেকে কি অদ্ভুত লাগবে এখানে জামা-কাপড় শুকাতে দিলে? অরু তবুও তোয়ালে মেলে দিল। মাঝে-মধ্যে কিছু জিনিস অদ্ভুত লাগা খারাপ না। তোয়ালে মেলেও দাঁড়িয়ে রইল বেলকনিতে অনেকক্ষণ। এখান থেকে ভিউটা সুন্দর। অরুর পছন্দ হল। কিছু একটা ভেবে ঘর থেকে ফোনটা নিয়ে এল। কয়েকটা ছবি তুলল বাইরের। ক্যামেরা ঘুরিয়ে পাশে আনতেই থেমে গেল। স্ক্রিনের ভেতর থেকে বাঁদর দেখে ভ্রু কুঁচকে এলো। হাসি হাসি মুখ দুঃখে ভরে উঠলো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ফোন নামিয়ে দেখল, পাশের বারান্দায় শুভ্র দাঁড়িয়ে। কার সাথে হেসে হেসে ফোনে কথা বলছে। সে মুখ কুঁচকে ভেতরে চলে এল। এ নতুন না। এখানে এসেছে গতকাল। এর মধ্যে যখনই শুভ্র নামক প্রাণীটি তার সামনে পড়েছে, তখনই অরু তাকে কথা বলতে দেখেছে। অরুর ধারনামতে, শুভ্র ২৪ ঘন্টার ৩২ ঘন্টাই ফোনে বকবক করে। এত বকবক তো মানুষ প্রেমিকার সাথে লুতুপুতু করেও বলে না। তাও যদি কোনো ভালো কথা হতো! সারাক্ষণ অফিসের কাজ-বাজ নিয়ে বকবক করে। কিছুক্ষণ পর পর এসিস্ট্যান্ট, ম্যানেজার ফোন দিয়ে দিয়ে একেকটা কথা বলে, আর সেও তাদের পেছনে লেগে পড়ে।

এই তো গতকালকে অরু ঘর থেকে বেরিয়েছিল পানি খেতে। সে যখন ড্রইংরুমে গেল দেখল সেখানে শুভ্র বসা। কোলে ল্যাপটপ। সামনের টেবিলসহ সোফা জুঁড়ে কিছু ফাইল ছড়িয়ে রয়েছে। খুব মনোযোগ সহকারে ফাইল ঘেঁটে কিবোর্ড চেপে যাচ্ছে অভ্যাসগত দক্ষ ও দ্রুত হাতে। অরু তাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে ছিল। যদিও অরুকে তখনও সে দেখেনি। অরু তার দিকে অদ্ভুতরকম ভ্রু কুঁচকে চেয়ে ঘরে ফিরে এসেছে। লোকটাকে তার যেই পরিমানের অপছন্দ, তাতে তাকে দেখে পানি খাওয়ার ইচ্ছে চলে গিয়েছে।
অরুর দরজায় নক হলো। অরু ভ্রু কুঁচকায়। ফোন রেখে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখে শুভ্র দাঁড়িয়ে। অরুকে দেখে অপ্রস্তুত গলায় বলল,

-‘ল-লাঞ্চ করবে না? টেবিলে খাবার বেড়ে রেখেছি। খেতে এসো?’
অরু তার দিকে চেয়ে তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
-‘খাবো না আমি।’
শুভ্র ভ্রু কুঁচকে তাকায়,
-‘কেন?’
-‘খিদে নেই।’
-‘সকালে তো ঠিক করে খাও নি। খিদে থাকবে না কেন তাহলে?’

অরু ভ্রু কুঁচকায়। এত খেয়াল কেন রাখছে তার? আজব ব্যাপার-স্যাপার। অরুকে তো তার পছন্দই না। তবে এতো আদর-যত্নের কারণ কি? এই লোক নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছু করেছে নাকি? বিয়েটাও তো নিজের স্বার্থের জন্যই করেছিল। রাগে-বিরক্তিতে অরুর জিহ্ব তেঁতো হয়ে এলো। এতক্ষণ অপ্রস্তুত বোধ করছিলো শুভ্র। অরুর কুঁচকে আসা মুখ-চোখ দেখে এবার আরো বেশি অপ্রস্তুত বোধ করলো।
-‘এত কথা না বলে খেতে এসো। আমার খিদে পেয়েছে।’
বলে শুভ্র চলে গেল ডাইনিংয়ের দিকে। অরু ক্ষেপে গেল। লোকটা নিজেকে হনু মনে করে।কি না কি যেন করে ফেলেছে সে। অরু রেগে তার পিছু পিছু ডাইনিং অবধি চলে এল। শুভ্র টেবিলে খাবার সাজাচ্ছে। অরু রেগেমেগে তার পিছে এসে দাঁড়িয়ে বলল,

-‘আপনার সমস্যাটা কি? এতসব কেন করছেন? আঙ্কেল-আন্টি, আম্মু-আব্বু; ওনাদের দেখাতে চান আপনি আমার খুব যত্ন-আত্তি করছেন? আপনি ঠিক আর আমি ভুল? আপনাকে বিয়ে না করলে আমার জীবন নষ্ট হয়ে যেতো? এমন জামাই পাওয়া সাত জন্মের কপাল, এসব বোঝাতে চাচ্ছেন আপনি?’
শুভ্র আচমকা পেছনে ফিরে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। অরু থতমত খেয়ে থেমে গেল। শুভ্র বলল,
-‘আমি এসব কখন বললাম? তুমিই তো সব বলছো৷ এখন নিজে থেকে যদি তুমি সব মেনে নাও, তবে সেটা কি আমার দোষ? আমাকে এসব কেন বলছো?’
-‘আপনার কোনো দোষ নেই? আপনি সাধু? নিজেকে নির্দোষ ভাবেন?’
-‘নিজেকে নির্দোষ না ভাবার মতো আমি কিছু করেছি বলে তো আমার মনে হয় না। শুধু শুধু সেঁধে ঝগড়া করার মানে কি?’

অরু হতবাক হয়ে চাইল। এতকিছু করেও নিজেকে ঠিক ভাবে এই লোক? এতোটা খারাপ কেও কি করে হয়? অরুর কেমন যে লাগল তা বলার বাইরে। তার রাগে গা রি রি করছে। সে এগিয়ে এসে শুভ্রর মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াল। শুবৃর তখনও নির্লিপ্ত চোখে চেয়ে। অরু তীব্র ঘৃণা নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-‘আপনি আমার সাথে যা যা করেছেন শুভ্র, আই সয়্যার আমি আপনাকে কক্ষনো ক্ষমা করব না। মরে গেলেও না। এই বিয়ে মানা তো আরো দূরের ব্যাপার। এসব আদিক্ষেতা দেখিয়ে ভাববেন না, খুব বড় কিছু করে ফেলছেন। আমার আপনাকে একদমই পছন্দ নয়।’

শুভ্রর মাঝে বিশেষ ভাবাবেগ যে দেখা গেল তা-ও না। শুভ্র বিশেষ ভ্রুক্ষেপ না দেখিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
-‘শেষ? কথা শেষ, নাকি বাকি আছে এখনো? শেষ হলে প্লিজ খেতে বসো। নাহলে খেও না। তবে এসব কথা বলে ঘ্যানঘ্যান করো না। আমার মোটেও ভালো লাগছে না অরু।’
সে চলে গেল। ফেলে গেল ভঙ্গুর একটা মেয়েকে। যে এতগুলো বছর এতটা যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে ছিল। পাড়া-মহল্লায় যার বদনাম রটে ছিল। রাস্তায় হাঁটতে গেলে লোকের কত কি কথা শুনতে হতো। সেগুলো আজও কানে বাজে তার। লোকে আঙুল তুলে তাকে দেখিয়ে বলতো,
-‘ওই তো দেখ, অরু যাচ্ছে। ওরই না জামাই বিয়ার দিন রাইখে চলে গেছিল?’
-‘আরে, হ্যাঁ! বেচারি, কয়দিনও সংসার করতে পারলো না। তার আগেই স্বামী চইলে গেল। কোনো সমস্যা-টমস্যা ছিল নাকি মেয়ের?’

অরুর মাঝে মধ্যে মরে যেতে মন চাইতো। মনে হতো এমন জীবনের দরকার কি তার? বাবা-মা কেন এমন করেছিল তার সাথে? অরু নির্জীব হয়ে দেখল শুভ্রকে।অপমানে চোখে জল জমল। অরু আর দাঁড়াতে পারলো না সেখানে। ছুটে ঘরে চলে এল। শুভ্র এমন ছোটাছুটি দেখেও কিছু বলল না। অরু দরজা লাগিয়ে বিছানায় বসে পড়লো। আচমকা শব্দ করে কেঁদে উঠল। কান্নার আওয়াজ যেন বাইরে না যায় মুখ চেপে ধরলো। এমন লোকের সাথে সে কি করে থাকবে? মন-মানসিকতা কারো এমন কি করে হয়?

অরু মরে যাচ্ছে। কত আশা ছিল তার বিয়ে নিয়ে, সব ভেঙে গিয়েছে। তার জীবন ধ্বংস করেছে তার বাবা-মা, আঙ্কেল-আন্টি। আর এখনও করে যাচ্ছে শুভ্র। সে তাদের কক্ষনো ক্ষমা করবে না। কক্ষনো না। আচ্ছা, তার কি মরে যাওয়া উচিত? এতোকিছুর পরেও সে বেঁচে আছে কি করে? হাজারো বাজে চিন্তা আসছে মাথায়। তখন ফোন বাজলো তার। অরুর কান্না থেমেছে তখন। সে ফোন হাতে নিয়ে দেখল আননোন নাম্বার। গলা পরিষ্কার করে কল রিসিভ করে কানে ফোন ঠেকাল,

রোদ্দুর এবং তুমি পর্ব ৩

-‘হ্যালো?’
ওপাশ থেকে পরিচিত গলা এল,
-‘অরু! মা, আমার। কেমন আছিস সোনা?’

রোদ্দুর এবং তুমি পর্ব ৫