প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৫৭
ফিজা সিদ্দিকী
রকিং চেয়ারে বসে দোল খাচ্ছে ধূসর। বন্ধ চোখ, কপাল কুঁচকে, পায়ের উপর পা তুলে বসে সে প্রতীক্ষায় যেন। গত পাঁচদিনে কুত্তার মতো ছুটিয়েছে সে জাওয়াদ শিকদারকে। দুইটা ফ্যাক্টরিতে পুলিশের রেড, দুটো হসপিটালে দশজন মানুষের অনাকাঙ্কিত মৃত্যু, আর তিনজন এখনও লাইফ সাপোর্টে। পোস্টমর্টেমে পাওয়া গেছে তাদের শরীর থেকে ইললিগ্যাল কিছু ড্রাগ। এশিয়ান দেশগুলতে পুরদস্তুর নিশিদ্ধ যেগুলো। চায়না থেকে কমদামে এসব ড্রাগ ইম্পোর্ট করে ব্যবহার করা হচ্ছে দেশী ওষুধের সাথে।
ফলস্বরূপ মেকিং কস্ট কমে যাচ্ছে প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ। মানুষের জীবনের সাথে এমন ঝুঁকিপূর্ণ খেলা খেলে মোটা অঙ্কের টাকা লুফে নিচ্ছে ফার্মা ব্র্যান্ড শিকদার মেডিকেয়ার। তাদের দুটো ফ্যাক্টরির একটাতে পাওয়া গেছে এসব বেআইনি ড্রাগ আর অন্যটাতে অর্ধনগ্ন কিছু মেয়ে। যাদের প্রত্যেকের শরীরে অজস্র প্রহারের দাগ। মেয়েগুলো ট্রিটমেন্টের জন্য পাঠানো হয়েছে স্পেশাল টিমসহ। ক্যান্সেল করা হয়েছে জাওয়াদ শিকদারের ভিসা। বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে তার পাসপোর্ট। যাবতীয় সব বাগানবাড়ি ও সম্পত্তির উপর পুলিশের তীক্ষ্ণ নজর। তন আশ্চর্যের বিষয় হলো এসবের একটাই খবর নিউজ চ্যানেলে নেই। কোনো নিউজ চ্যানেল কভার করেনি এগুলো। এখানেও নিশ্চয়ই জাওয়াদ শিকদারের কারচুপি রয়েছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কপালের উপর আঙুল চালাতে চালাতে প্রতীক্ষার অবসান হল ধূসরের। সশব্দে বেজে উঠলো তার ফোনটা। ফোনের স্ক্রিনে না তাকিয়েই রিসিভ করলো সে কলটা। রহস্যময় কণ্ঠে বলল,
“আপডেট কি জলিল সাহেব?”
“দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে স্যার।”
ধূসর মৃদু হাসল। বলল,
“পেট্রোলটা আর একটু বেশি করে ছড়িয়ে দিয়ে পুরো পেট্রোলের ডিব্বাটা ফেলে দাও দক্ষিণের ঘরগুলোর দিকে। ওদিকের ঘরগুলো থেকে ছাই ছাড়া কিছুই যেন পাওয়া না যায়।”
“ কিন্তু স্যার, আমি যদি ধরা পড়ি যাই?”
ধূসর হাসল নিঃশব্দে। বলল,
“প্যাকেটের মধ্যে একটা খাবারের বক্স আছে দেখো। ওটা দিয়ে অর্ধেক খাবার খেয়ে ফেলো।খবরদার পুরোটা খাবে না।”
জলিল ধূসরের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে। তার প্রতিটা নির্দেশ অনুগত ভৃত্তের মতো পালন করে সে আজকাল। এর অবশ্য একটা কারন আছে। জাওয়াদ শিকদারকে ধ্বংসের যে খেলায় ধূসর নেমেছে, সেখানে জাওয়াদ শিকদার ধ্বংস হলে সাথে শেষ হবে সেও। কিন্তু ধূসর ওয়াদা করেছে তাকে বাঁচানোর। এমনকি তার কথামতো চললে কাজ শেষে তার গোটা পরিবারকে নিয়ে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেবে সে। বেঁচে থাকার লোভে, পরিবারের সঙ্গে চিন্তামুক্ত শান্তির একটা জীবন পাওয়ার লোভে মানুষ তো কতো অনৈতিক কাজই না করে। জলিল নাহয় একটা ভাল কাজ করলো। লঙ্কা থেকে রাবণ ধ্বংস যেমন একটা ভালো কাজ ছিল তেমনই এ শহরের রাবণ জাওয়াদ শিকদারের ধ্বংস তেমনই একটা ভালো কাজ।
ধূসর ঝটপট ফোন লাগাল কাওকে। বেশ খোশমেজাজে বলল,
“গেট রেডি ফর দা নেক্সট স্টেপ।”
রাত সবে নটা পঁয়ত্রিশ। রাতের খাওয়ার টেবিলে বসে ধূসর, তৈমুর, লাবিব শিকদার। কামিনী শিকদার টেবিলে সাজিয়ে রাখছেন রান্নাঘর থেকে সার্ভেন্টদের এগিয়ে দেওয়া পদগুলো। এ বাড়ীতে একসাথে টেবিলে বসে খাওয়ার রীত নেই বললেই চলে। তবে মাঝে মাঝে আকাশে যেমন রংধনু দেখা দেয়, তেমনই জাওয়াদ শিকদারের পশুত্ব শরীরটা মানুষ হওয়ার বৃথা চেষ্টা চালায়। এই যেমন হুটহাট ছেলেদের জীবনে কি চলছে জানতে চান। কিংবা এমন এক ভুরিভোজের আয়োজন করেন।একসাথে খাবার টেবিলে বসে শুনতে চান সকলের কথা।
ছোট থেকেই এই দিনগুলোর জন্য হাপিত্যেশ হয়ে অপেক্ষা করত ধূসর। কবে জাওয়াদ শিকদার উন্মুখ হয়ে জানতে চাইবেন তার হালচাল, কবে একসাথে বসে মজা করে গল্পগুজব করবে সবাই। কিন্তু আজ তার গা ঘিনঘিন করছে। নিজের জন্মপরিচয়, পিতৃপরিচয় বদলানোর সুযোগ থাকলে সে তৎক্ষণাৎ তাই করত। এই জন্ম তার কাছে বৃথা লাগে। যে জন্ম, যে শরীর পুরোটাই পাপের ফসল; সেই শরীর, সেই জন্মকে ঘৃণা করে সে। চরম ঘৃণা।
জাওয়াদ শিকদার অবশ্য আজ সবাইকে একজোট করেছেন বিশেষ কিছু আলোচনা করতে। তাই তার প্রতীক্ষায় বসে সকলে। অবশেষে সাদা রঙের পাঞ্জাবী, পাজামা পরে নামতে দেখা গেল তাকে সিঁড়ি দিয়ে। ধূসর একপলক সেদিকে তাকিয়ে মুখ লুকিয়ে হাসল। ঘৃণায় বিড়বিড় করে আওড়ালো,
“ফেরেশতাও লজ্জা পাবে তাকে দেখে। দুই হাত যার খুনের রক্তে লেপটে, কী শুভ্র তার লেবাস।”
চেয়ার টেনে বসতে বসতে জাওয়াদ শিকদার সরাসরি তাকালেন ধূসরের দিকে। বললেন,
“শুনলাম অসুস্থ তুমি, ঘর থেকেও বের হচ্ছ না।”
“ শুনেছ তাহলে?”
“তোমার চাচি জানালো আমাকে। এখন কেমন আছো?”
ধূসর একপলক কামিনী শিকদারের দিকে তাকাল। সংক্ষেপে জবাব দিলো,
“ভালো”
“তুমি নাকি তোমার চাচির মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিয়েছ?”
ধূসর এক লোকমা ভাত মুখে তুলতে তুলতে বলল,
“আমার ঘরে কেন ঢুকেছিল তার কৈফিয়ত দিয়েছেন?”
“ এই বাড়িতে তারও অধিকার আছে, আর তোমার উপরও। যেতেই পারে সে।”
ধূসর তৎক্ষণাৎ ঠোঁট এলিয়ে হাসল। বলল,
“যেমন করে মাঝরাতে তোমার ঘরে ঢোকার অধিকার তার আছে? নাকি যেমন করে আমার মায়ের সংসারে ঢোকার অধিকার তার ছিল?”
সাথে সাথেই তেতে উঠলেন জাওয়াদ শিকদার। ধমক দিয়ে বললেন,
“তুমি বোধহয় ভুলে যাচ্ছ তুমি কার সাথে কথা বলছ।”
ধূসর মাথা নিচু করে দৃষ্টি রাখল খাবারের প্লেটের দিকে। নিয়ন্ত্রণহীন শরীরটাকে কোনরকমে নিয়ন্ত্রণে আনলো সে। শেষ মুহূর্তে এসে কোনোভাবেই নিজেকে ধরা দেওয়া যাবে না লোকটার সামনে।
রাগে, যন্ত্রণায় চোখদুটো তার অসম্ভব রকম লাল হয়ে আছে। এই যন্ত্রনা সে কাওকে দেখাতে চায়না। তাই মিথ্যা হাসি মুখে ঝুলিয়ে বলল,
“আমার ঠিকই খেয়াল আছে। কিন্তু তোমরা ভুলে গেছ আমার মায়ের খাটিয়া কাঁধে তুলে আমার বলা কথাটা।”
জাওয়াদ শিকদার সাথে সাথেই ডুব দিলেন অতীতের পাতায়। ধূসর তখন বেশ ছোটো। স্কুল থেকে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে মায়ের ঘরে পাখার সাথে ঝুলন্ত দেহটা দেখে চিৎকার দিয়ে অজ্ঞ্যান হয়ে পড়েছিলো সেদিন। যখন চোখ খুলল, দেখল তার মাকে সাদা কাফনে মুড়িয়ে চিরবিদায় দেওয়ার আয়োজন হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। অল্প লোকজন নিয়েই চুপিসারে সেরে ফেলেছে তারা সব কাজ। ধূসর মায়ের বুকে মাথা সে কি কান্না না কেঁদেছিল সেদিন। মা অন্তঃপ্রান ছেলে কিনা!
মায়ের খাটিয়া ধরতে গিয়ে হাইটে খাটো হওয়ায় খাটিয়া বেঁকে গিয়েছিলো একদিকে। তাই জাওয়াদ শিকদার তাকে খাটিয়া তুলে দিতে বলেন অন্যজনের কাঁধে। কিন্তু নাছোড়বান্ধা ধূসর কোনমতে ছাড়বে না তার মাকে অন্য কারোর ভরসায় আর। অগত্যা একজন গার্ড কোলে তুলে নিলেন ধূসরকে। আর ধূসরের কাঁধে রইলো তার মায়ের শেষ বিদায়ের গুরুভার দায়িত্ব। সেদিন বাড়ির আঙিনা ছাড়ার আগে ধূসর গমগমে কণ্ঠে বলেছিল,
“তোমার আত্মহত্যার জন্য দায়ী যারা তাদেরকে আমি ছাড়বো না, মা। সব হিসেব দিতে হবে তাদের। একদিন ঠিক খুঁজে বের করবো তাদের।”
মায়ের কবরের মাটি ছুঁয়ে অবশ্য আরও কিছু প্রতিজ্ঞা সে করেছিল মনে মনে। কবরের ভেজা মাটির উপর শুয়ে ফিসফিসিয়ে বলেছিল,
“তোমার কবরের পাশের জায়গাগুলো খালি রেখো মা, এখানে এক এক করে শুতে আসবে সেই মানুষগুলো যারা তোমাকে এতখানি যন্ত্রণা দিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে।”
জাওয়াদ শিকদার নিভলেন যেন এবার খানিকটা। তবে থেমে রইলো না ধূসর। গমগমে কণ্ঠে বলল,
“নিজের ভালো চাইলে আমার থেকে দূরে থাকতে বোলো। ধূসর গুড বয় হলেও শিকদার বংশেরই ছেলে। খুন করতে বুক কাঁপবে তারও বাপ, চাচাদের মতো।”
পরিবেশ শান্ত করতে লাবিব শিকদার প্রসঙ্গ বদলালেন। বললেন,
“ব্যবসায় জয়েন করছ না কেন তুমি ধূসর? সারাদিন বাড়ীতে থাকতে থাকতে অলস মস্তিষ্ক রুক্ষ মেজাজের হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। ব্যাবসার কাজগুলো বুঝে নাও এখন থেকে, ভবিষ্যতে এসব তো তোমরা দুই ভাইই সামলাবে। নাঈম তো সাফসাফ জানিয়ে দিয়েছে শিকদার বংশের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই।”
“আমার এসবে কোনো ইন্টারেস্ট নেই চাচু। ভাইয়া তো আছেই, ও দেখুক এসব। এত জটিল বিষয় আমি বুঝব না।”
মনে মনে বেশ খুশি হল তৈমুর এই ভেবে যে, এই বিশাল সাম্রাজ্যে তার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। পুরোটাই তার।
আচমকা জাওয়াদ শিকদারের ফোনে কল এলো। ওপাশ থেকে কেউ উৎকণ্ঠা নিয়ে বলল,
“ফুলতলার বাগানবাড়িতে বীভৎস আগুন লেগেছে স্যার। জলিল বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে গেটের কাছে।”
কোর্টে যাতায়াত শুরু করেছে তনুজা। নতুন করে কাজে ফিরে মেজাজটা বেশ ফুরফুরে তার। অবশ্য নাঈমের শেষ অনুরোধটা সে রেখেছে। দিনশেষে শান্তির রাতটা কাটাতে সে ফিরে যায় নাঈমের বাড়িতেই। নাঈম অবশ্য খুব একটা সামনে আসেনা ইদানিং তার। কেমন যেন দূরত্ব বজায় রেখে চলে। মুখোমুখি না হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যায়।
তনুজা যখন বাড়িতে ফেরে নাঈম তখন বাড়িতে থাকে না। তবে একজন কাজের খালা রেখেছে সে নতুন করে। সকাল সকাল এসে সব কাজ সেরে যায় সে। আবার নাঈম ফেরার পর তার জন্য খাবার বেড়ে ঘরে দিয়ে এসে এরপর বাড়ি ফেরে সে। প্রথম প্রথম তনুজার বেশ ভালো লাগতো। ভারমুক্ত শান্ত নদীর মত জীবন। কাজ থেকে ফিরে টেবিলে সাজানো খাবার, আবার সেই একই টেবিলে বসে তাকে বিরক্ত করার কেউ নেই। এমনকি এটা সেটা বলে তাকে বিব্রত করে না আর কেউ। রোজ রোজ নতুন পয়তারা করে তাকে জ্বালানোও বন্ধ। হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে যেন। কিন্তু ইদানিং কিছু একটার শূন্যতা অনুভব করে সে। খাবার টেবিলে একাকীত্ব তার ভালো লাগে না মোটেও। একদিন তাই খালাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলো,
“আপনার স্যার টেবিলে এসে খায়না কেন? ডাইনিং থাকতে ঘরের মধ্যে ঢুকে খবর খাওয়া আবার কেমন নিয়ম? ডাক্তার মানুষ হয়ে এমন অনিয়ম মানায় নাকি?”
“কাজানি বাবু। সাহেব তো খায়ও না ঠিকমতো। যা খাবার নিয়ে যাই, বেশিরভাগ ফিরিয়ে আনতে হয়। কী যে কাক কোকিলের মতো খাওয়া শহরের বাবুদের।”
তনুজা ভ্রু কুঁচকে ফেলল সাথে সাথে। নাঈমকে এত অল্প খেতে তো দেখেনি এতদিন। তবে এখন হঠাৎ কী হলো?
আজ বাড়িতে ফিরে অনেকদিন পর তনুজা রান্নাঘরে ঢুকলো। ফেরার পথে বাজারে গিয়েছিল আজ সে। হঠাৎ করে চোখের সামনে কুচোমাছ পড়তেই কেন যেন চট করে কিনে ফেলল সে। মাছগুলো খালার কাছে দিয়ে রুমে গেল সে। লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকতেই দেখলো মাছগুলো বেশ ঝকঝকে করে বেছে রেখেছে খালা। রান্নাটা অবশ্য সে করবে বলে হয়েছিল খালাকে।
নাঈম বাড়িতে ঢুকলো নিঃশব্দে। ফোনের দিকে চোখ রাখতে রাখতে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিল সে। আচমকা রান্নাঘরের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় খালাকে বলল,
“আমার জন্য খাবার আনতে হবে না আজ। বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি আজ। তুমি কাজ শেষ করে বাড়ি চলে যেও।”
খালা সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো। নিজের ঘর থেকে লুকিয়ে উঁকি দেওয়া তনুজা নাঈমের কথাটুকু শুনে বেজায় চটে গেল। ধুপধাপ করে ঘরে ঢুকে ধড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিলো।
রাত আনুমানিক এগারোটা। কিচেনে ঢুকে একটা প্লেটে ভাত বেড়ে নিলো তনুজা। সাথে আজকে খালার রান্না করা ভুনা মাংস, আলু ভাজি আর তার রান্না করা কুচোমাছ। এরপর ধীরে ধীরে পা ফেলে এগিয়ে গেল নাঈমের ঘরের দিকে।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলো তনুজা বেশ অনেকটা সময় ধরে। দরজার নীচ দিয়ে এখনও আলো দেখা যাচ্ছে, তার মানে জেগেই আছে নাঈম। ভেতরে যাবে কিনা ভাবতে ভাবতে নাঈমের ঘরের লাইট অফ হয়ে গেল। ঘুমিয়ে পড়লো ভেবে তনুজা তড়িঘড়ি করে ঢুকে পড়লো ঘরে। দরজার পাশের সুইচ বোর্ড থেকে আলো জ্বালিয়ে সামনে তাকাতেই হতভম্ব সে।
ব্লু রঙের শার্ট খুলে বিছানায় ফেলে সবেমাত্র ধূসর রঙের প্যান্টের বেল্ট খুলেছে সে। বাকিটা খোলার জন্য হাত বাড়িয়েছে, এমন সময় লাইট জ্বলে ওঠায় নিজেও হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো সে তনুজার দিকে। উদোম শরীরে নাঈম দাঁড়িয়ে তনুজার সামনে। শুধু তাই নয়, তার হাত দুইটা প্যান্টের বাটনে রাখা। আর কয়েক সেকেন্ড দেরী হলেই বিশাল একটা অঘটন ঘটে যেত। অবশ্য এখন অবদি কম অঘটন ঘটেনি। তনুজা সাথে সাথেই মৃদু চিৎকার দিয়ে উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেললো। নাঈমের চোখ মুখ থেকে এখনো হতভম্ব ভাবটা কাটছে না। সে ঠাঁয় তাকিয়ে তনুজার দিকে। এমন সময় উল্টোপাশ ফিরেই তনুজা তাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“চেঞ্জ করার সময় দরজা লক করতে হয় জানেন না?”
“কারোর রুমে ঢোকার সময় দরজা নক করতে হয় জানেন না?”
“বাড়ীতে এভাবে খোলামেলাভাবে চেঞ্জ করতে হয়না জানেন না?”
“ব্যক্তিগত রুমে ন্যকেড হয়েও থাকা যায়, জানেন না?”
“বাড়ীতে একজন মেয়ে আছে জানেন না?”
“এটা যে একটা ছেলের ব্যাক্তিগত রুম, এটা কি মেয়েটা জানে না?”
“তর্ক করবেন না একদম। স্বীকার করুন ভুল করেছেন।”
তনুজার ক্ষ্যাপাটে কথায় ঠোঁট এলিয়ে হাসলো নাঈম। তবুও মিথ্যা অভিমানের সুর টেনে বলল,
“ভুল তো করেছি অবশ্যই। আপনাকে জোর করে আটকে রেখেছি। আপনি চাইলে আপনার মতো থাকতে পারেন। আমি আর বাধা দেব না।”
তনুজা সাথে সাথেই ফিরলো নাঈমের দিকে। ফিরতেই চমকে উঠলো আরও একদফা। মানুষটা এখন একদম তার সামনে। দূরত্ব বোধহয় কয়েক ইঞ্চির মতো। কখন এলো সে এত কাছে? তার উদোম বুক, মাসেলড বডি, শরীর থেকে ভেসে আসা একটা গন্ধ কেমন যেন মিশ্র অনুভূতি তৈরি হলো তনুজার মনে। একদিকে মস্তিষ্ক চাইছে ছুটে পালিয়ে যেতে এখান থেকে, অন্যদিকে মন চাইছে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে।
কিশোরী চঞ্চল মেয়েদের মতো বাচ্চামি তনুজাকে শোভা দেয়না। একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী হিসেবে কোনো পুরুষের উদোম শরীর দেখা এমন আহামরি কিছু না। তবুও কেন যেন তার অন্যরকম একটা অনুভূতি হচ্ছে। আর সেই অনুভূতির তুশে আগুন দিতে নাঈম তনুজার দিকে খানিকটা ঝুঁকে তার মুখের উপর মুখ এনে মৃদু স্বরে বলল,
“আমি কিন্তু যাইনি আপনার কাছে, আপনি এসেছেন। একটা প্রবাদবাক্য শুনেছেন তো? মানুষ আসে নিজের ইচ্ছেতে আর ফেরে অন্যের ইচ্ছেতে।”
কথাটা শেষ করে তনুজার সারামুখে একটা ফুঁ দিলো নাঈম। জমে গেল তনুজা। চোখ বন্ধ করে।ফেললো। শরীর স্পর্শ না করেও কেমন করে যেন ছুঁয়ে দিলো লোকটা তাকে। কী বীভৎস রকম কাঁপুনি শুরু হলো তার শরীর জুড়ে। সে কি তবে মৃগী রোগীদের মতো কাঁপছে? আর এই অসভ্য, অভদ্র লোকটা কী তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ঠোঁট কামড়ে দেখছে তাকে? সব টের পাচ্ছে?
প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৫৬
লোহার জঞ্জিরে বাঁধা তালার ছিদ্রতে রোজ বেশ কয়েকবার হেয়ারপিন দিয়ে পিঞ্চ করে নন্দিতা। কিন্তু কিছুতেই এই লক খোলে না। এদিকে বসে বসে সে এখান থেকে পালানোর শক্তপোক্ত একটা প্ল্যান রেডি করে ফেলেছে। কিন্তু এই জঞ্জীর না খোলা পর্যন্ত এখান থেকে বেরোতে পারছে না সে। রাগে দুঃখে পা টা নিয়ে বাড়ি মারে সে দেয়ালে। একবার, দুইবার এমন করে বেশ কয়েকবার দেয়ালে বাড়ি মেরে নিজের মনের ক্ষোভ মেটানোর চেষ্টা করে সে। শরীর ক্লান্ত হতেই থেমে যায় সে। আচমকা পায়ের দিকে তাকাতেই চমকে ওঠে।