আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ৪৮
সালমা খাতুন
মায়া মাথায় কারো স্নেহভরা ছোঁয়া পেয়ে ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো। পাশে বসে ছিলেন সাবিনা বেগম, নরম হাতে মায়ার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন নিঃশব্দ সান্ত্বনার মতো। চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো, সে শুয়ে আছে আরমানের বিছানায়। পাশে সামিরা, রুবি—চিন্তিত মুখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
তখন অতিরিক্ত মানসিক চাপ আর ধাক্কা সহ্য করতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল মায়া। এখনো মাথাটা যেন ভারী, আবছা, ক্লান্ত।
হঠাৎ সবটা মনে পড়ে গেলো—আরমানের চিঠি, ল্যাপটপে সেভ করে রাখা তাঁদের বিয়ের ছবি, মেডিকেল রিপোর্ট, আর সব শেষে… সেই কাবিননামা।
চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো নিঃশব্দে।
পাশেই সাবিনা বেগম বসা, মায়া উনাকে উদ্দেশ্য করে কাঁপা কাঁপা গলায় বলার চেষ্টা করলো, “আমি..আমি..উনার..”
“অর্ধাঙ্গিনী।”
মায়াকে শেষ করতে না দিয়েই বলে উঠলেন উনি। তারপর আবারও বললেন, “আমার আরমানের বউ তুমি। এই শাহরিয়ার পরিবারের বড়ো বউ। আমার আরমানের কলিজা তুমি, যাকে ছাড়া আমার আরমান একেবারে অচল।”
কথাটা বলেই উনি শাড়ির আঁচলের কোণা দিয়ে চোখ মুছলেন। মায়ার চোখ থেকেও তখন অশ্রুর বন্যা বইছে।
মায়া কান্না ভেজা কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলো, “এতোদিন কেনো আমার থেকে লুকানো হয়েছে সবকিছু? আমার এই অবস্থার জন্য উনি কি আমায় ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সাবিনা বেগম:- “তোমার সেটা মনে হয়? দেখোনি এতোদিন আমার ছেলেটা কতটা কষ্ট পেয়েছে? এখনো তো পাচ্ছে। তোমার থেকে সবকিছু লুকানো হয়েছিল মানে এটা নয় যে তোমাকে আরমান ছেড়ে দিতে চেয়েছিল। আমারা সবাই পরিস্থিতির কাছে অসহায় ছিলাম। জানাতে চেয়েও জানাতে পারেনি কিছু, কারণ ডক্টর বারণ করেছিলেন। তোমার ব্রেন এর কন্ডিশন ভালো ছিল না। বেশি চাপ সহ্য করতে পারবে না তুমি, তাই ডক্টরের নিষেধ ছিল।”
মায়া নিঃশ্চুপ। কি বলবে ও বুঝতে পারছে না। মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে ও। মাঝে মাঝেই সামিরা, রুবি ওকে ভাবী মনি ডাকতো, কিন্তু পরে ওরা কথা ঘুরিয়ে দিতো। মায়া ভাবতো হয়তো ও ভুল শুনছে। তখন তো নিজের ব্রেন কে নিজেই বুঝতে পারতো না ও। কিন্তু এখন সেই প্রথম থেকে ভেবে পুরো ঘটনা বুঝতে পারলো।
মিসেস সাবিনা বেগম রুবিকে দিয়ে খাবার আনিয়ে মায়াকে যত্ন সহকারে খাইয়ে দিলেন। এরপর ওর ওষুধ গুলোও খাইয়ে দিলেন। মায়া নিজের জীবনের হিসাব নিকাশ করতে করতেই কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমের অতলে গভীরে ডুব দিলো, ওষুধের প্রভাবে।
মায়ার ঘুম ভাঙ্গলো গাড়ির হর্নের আওয়াজে। ধরফর করে বিছানায় উঠে বসলো ও। আরমানের রুমেই এতোক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল। ঘুমের মধ্যেও হয়তো অপেক্ষা করছিল আরমানের ফিরে আসার। তাই গাড়ির হর্নের আওয়াজ শুনেই ঘুম টা ভেঙে গেছে ওর।
কোনো মতে গায়ে ওরনা টা জড়িয়ে ছুট লাগালো নিচে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। তারপর বাড়ির সদর দরজা খুলে একেবারে বাইরে চলে গেলো। সামিরা, রুবি মায়াকে এভাবে ছুটে আসতে দেখে ওরাও পিছু পিছু ছুটে এলো।
সামিরা:- “কি হলো, এভাবে ছুটে এলে কেনো? ভাবী..না মানে আপু।”
মায়া:- “এখনো কনফিউজড? কি ডাকবে বুঝতে পারছো না?
এদিকে আবির গাড়ি গ্যারেজে রেখে গাড়ির চাবি আঙ্গুলে ঘোরাতে ঘোরাতে এগিয়ে আসছে।
আবির:- “বাহ বাহ তিন মূর্তি আমাকে ওয়েলকাম করার জন্য বাইরে দাঁড়িয়ে আছে? কি সৌভাগ্য আমার।”
রুবি মুখ বেঁকিয়ে বলল, “হুঁ বয়েই গেছে আপনাকে ওয়েলকাম জানানোর জন্য এখানে অপেক্ষা করতে। মায়া ম্যাম বাইরে এলো তাই আমরাও এলাম।”
মায়া বিরক্ত গলায় বলল, “ভাইয়া রাখো তো তুমি তোমার ফাজলামি, আগে বলো উনি কোথায়?”
আবির ভ্রু কুঁচকে বলল, “উনি? উনি টা কে?”
মায়া:- “তোমার অফিসের বস, গম্ভীর মুখো হুলো বিড়াল।”
আবির গম্ভীর হওয়ার ভান করে বলল, “তুমি জানো কাকে কি বলছো? অফিসের প্রত্যেকটা স্টাফ ওকে যমের মতো ভয় পায়। ওর একেকটা গলার আওয়াজ সিংহর গর্জনের মতো।”
মায়া মুখ বেঁকিয়ে বলল, “আর হ্যাঁ তার জন্যই তো ওই সিংহ এখন আমার থেকে হুলো বিড়ালের মতো পালিয়ে বেড়াচ্ছে।”
আবির:- “আরে পালিয়ে বেড়াবে কেনো? ও এখন একটু ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে।”
মায়া:- “হ্যাঁ কত ব্যাস্ত, সে আমার জানা আছে। কথা না ঘুরিয়ে বলুন উনি এখন কোথায়?”
আবির:- “কথা ঘুরাবো কেনো? আরমান এখনো অফিসেই আছে। একটু কাজের চাপ আছে তো তাই।”
মায়া:- “আচ্ছা ঠিক আছে। চলো আমাকে অফিসে নিয়ে চলো।”
আবির:- “হ্যাঁ চলো.. এ্যাঁ অ..অফিসে?”
মায়া:- “হ্যাঁ অফিসে।”
আবিরের এখন অবস্থা ফাঁইসা গেছি মাইনকার চিপায়। আরমান যে অফিসে নেই। আজ সারাদিনে একবারও অফিসে আরমানের দর্শন পাওয়া যায়নি। প্রচন্ড ঘেঁটে আছে ছেলেটা। মায়াকে কিভাবে সামলাবে? মায়াকে কিভাবে বোঝালে বুঝবে সেটাই বুঝতে পারছেনা আরমান। হ্যাঁ পালিয়ে বেড়াচ্ছে আরমান। মায়ার করা প্রশ্ন গুলোর থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
আরমানের আবিরের সাথে লাস্ট কথা হয়েছিল সেই সকাল দশটার দিকে। আরমান ওকে কল করে বলেছিল অফিসের সব কিছু সামলে নিতে। বাড়িও ফিরবে না আজ, বাড়ির সবাই যেনো মায়াকে দেখে রাখে। আর ওকে যেনো কেউ ডিস্টার্ব না করে।
আবির এখনো জানে না যে মায়া সবকিছু জেনে গেছে। ও কিছুটা হাসার চেষ্টা করে বলল, “কিন্তু
এতো রাতে অফিসে যাওয়া টা কি ঠিক হবে?”
মায়া জেদি গলায় বলল, “হ্যাঁ ঠিক হবে। আমি যাবো মানে যাবো।”
রুবি বলে উঠলো, “কিন্তু স্যার আমাকে বলে গেছে আমি জানি আপনাকে কখনো একা না ছাড়ি।”
তখনি সামিরাও বলে উঠলো, “হ্যাঁ ভাইয়া আমাকেও বলে গেছে যেনো তোমাকে দেখে রাখি সব সময়।”
মায়া ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল, “ওকে! তাহলে তোমরাও চলো আমার সাথে।”
এরই মধ্যে মাইশাও ওখানে উপস্থিত হয়েছে। মাইশা নরম গলায় মায়াকে বোঝানোর চেষ্টা করে বলল, “কিন্তু মায়া, বোন আমার বোঝার চেষ্টা কর। তোর শরীরের অবস্থা এখন ভালো নয়। এইভাবে এতোটা চাপ নিস না।”
মায়া অসহায় গলায় বলল, “প্লিজ আপু তোমারা আমাকে একটু বোঝার চেষ্টা করো। আমি চাপ নিইনি। আমি শুধু উনার সামনাসামনি একটু কথা বলতে চাই। আচ্ছা ঠিক আছে তোমাদের কাউকে নিয়ে যেতে হবে না। আমি একাই যাবো।”
বলেই মায়া হাঁটা শুরু করলো। তখনি আয়ান আসছিল বাইরে থেকে। মায়াকে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে বলল, “এতো রাতে কোথায় যাচ্ছো ভাবী মনি?”
মায়া:- “অফিসে, তোমার ভাইয়ার কাছে। অনেক হয়েছে এই লুকোচুরি খেলা, আজ সব শেষ করবো।”
আয়ান ভ্রু কুঁচকে তাকালো পিছনে থাকা সামিরা দের দিকে। ওরা অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে। আবির কৌতুহল মিশ্রিত গলায় প্রশ্ন করলো, “কিসের লুকোচুরি খেলা মায়া।”
মায়া বিরক্ত গলায় বলল, “সব কিছু জানার সত্বেও একদম নাটক করবে না ভাইয়া।”
আবির হকচকিয়ে গেল। ও সামিরা দের দিকে প্রশ্ন বোধক চাহনি নিয়ে তাকালো। সামিরা মাথা নাড়িয়ে বলল, “মায়া আপু সব জেনে গেছে আবুল ভাইয়া।”
আবির অবাক হয়ে বলল, “কিহহ? মায়া জেনে গেছে যে আরমান ওকে এই বাড়িতে কাজের লোক বানিয়ে নিয়ে এসেছিল?”
দিলো। একেবারে হাটের মাঝে হাঁড়ি ভেঙে দিলো আবির। এই কথাটাই যথেষ্ট ছিল মায়াকে আরো একবার চমকে দেওয়ার জন্য। ও অবাক চোখে তাকালো আবিরের দিকে। মায়ার চোখ ছলছল করছে।
সামিরা, রুবি, আয়ান ওরা সবাই চোখ রাঙিয়ে তাকালো আবিরের দিকে। আবির সকলের চোখ রাঙানি দেখে মনে মনে কিছুটা ভয় পেলো।
আবির:- “কি হলো? সবাই আমার দিকে এভাবে তাকাচ্ছিস কেনো?”
আয়ান হায় হুতাশ করে বলল, “সেম অন ইউ ব্রো। এখনো শিখলে না তুমি কোথায় কি বলতে হয়।”
মায়া ছলছল চোখে তাকালো আবিরের দিকে, “বাড়ির কাজের লোক করে নিয়ে এসেছিল মানে?”
সামিরা:- “আরে ভাবী মনি তুমি বুঝতে পারছো না? ভাইয়া মজা করছে তোমার সাথে।”
রুবিও কথা ঘোরানোর জন্য বলল, “আমার তো মনে হচ্ছে উনি টাইম ওয়েস্ট করার জন্য এমন করছেন, ইচ্ছে করে।”
মায়া তাচ্ছিল্য হেসে বলল, “কোনটা মজা করে বলা, আর কোনটা সিরিয়াস ভাবে বলা, সেটা বোঝার মতো ক্ষমতা আমার আছে। আয়ান ভাইয়া তুমি নিয়ে যাবে? নাকি আমি একাই যাবো?”
আয়ান:- “কিন্তু ভাইয়া তো অফিসে…”
আবির আয়ানকে কথার মাঝে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আরে চলো, আমি নিয়ে যাচ্ছি তো।”
এরই মধ্যে আবির আয়ানকে গাড়ি আনার নাম করে টেনে নিয়ে গেছে।
আবির:- “প্লিজ ভাই কিছু কর। আমি মায়াকে বলেছি আরমান অফিসে আছে।”
আয়ান:- “বাহ খুব ভালো করেছো। আর আমরা কেউ তো খোঁজই পাইনি সারাদিন, ভাইয়া কোথায় আছে।”
আবির:- “ফ্ল্যাটে নেই, মনে হয় মায়া কুঞ্জে আছে। ওখানে ছাড়া আর কোথায় থাকবে?”
আয়ান অবাক গলায় বলল, “মায়া কুঞ্জ! সেটা কোথায়?”
আবির একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, “মায়া কুঞ্জ, মায়াবতীর মায়া কুঞ্জ। আরমান অনেক আগে থেকেই শহর থেকে অনেক টা দূরে সেই পিচ্চি মায়াবতীর জন্য সকলের আড়ালে একটা বাড়ি বানাচ্ছিল। কিছু মাস আগেই ওই বাড়ির কাজ শেষ হয়েছে। মায়াকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল, কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেলো।”
মায়া গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়ে চারিদিকে নজর বুলিয়ে দেখতেই কেমন একটা অনুভুতি হলো। যেনো এর আগেও অনেকবার এসেছে এখানে। চোখ ঘুরিয়ে চারিদিকে দেখতে লাগলো ও। সব কিছু কেমন জেনো চেনা লাগছে।
মাইশা মায়ার কাঁধে হাত রেখে বলল, “কি হলো দাঁড়িয়ে গেলি কেন? শরীর খারাপ করছে না তো।”
মায়া:- “না ঠিক আছি আমি। চলো।”
আবির মায়াকে সোজা আরমানের কেবিনে নিয়ে আসলো। আসার পথে চারিদিক মায়া চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখেছে, করিডোর, অফিসের ফ্লোর, স্টাফ দের বসার জায়গা, রিসেপশন আর সবার শেষে আরমানের কেবিনের সামনে ওই যে হেড ডিজাইনার বলে লেখা আছে দরজার মাথার কাছে, ওই কেবিনে টা, প্রচন্ড চেনা চেনা লাগছে। মনে হচ্ছে আগেও অনেকবার এসেছে, অনেক বার দেখেছে এই জায়গা গুলো। খুব খুব চেনা সবকিছু, এমন অনুভূতি জাঁকিয়ে বসেছে ঠিকই কিন্তু মাথায় অনেক চাপ দিয়েও কিচ্ছু মনে করতে পারছে না মায়া।
মায়া আরমানের পুরো কেবিন ফাঁকা আর অন্ধকার দেখে অবাক হলো। অবাক গলাতেই বলল, “কি ব্যাপার পুরো কেবিন তো অন্ধকার। উনি কোথায়?”
আবির কেবিনের লাইট জ্বালিয়ে বলল, “হ্য.. হ্যাঁ সেটাই তো দেখছি। আমি বাড়ি যাওয়ার আগে তো এখানেই ছিল আরমান।”
মায়া:- “বাড়ি যাওয়ার আগে এখানে থাকলে এখন কোথায় গেলো। তুমি না বললে কাজের চাপ আছে উনার?
আবির তাড়াহুড়ো করে বলল, “হ্য.. হ্যাঁ তো কাজের চাপ। সেলাইয়ের কারখানায় গিয়েছে মনে হয়।”
মায়া তাচ্ছিল্য হেসে বলল, “অজুহাত টা একটু ভালো করে দাও। কোন পাগল এই এতো রাতে কারখানায় সেলাইয়ের কাজ করবে?”
আবির থতমত খেয়ে গেলো। এখন ওর নিজের মাথাতে নিজেই বাড়ি দিতে ইচ্ছে করছে।
আবির বিড়বিড় করে বলল, “আল্লাহ দড়ি ফেলাও উইঠা যায়। শালা আরমান আমাকে কোথায় ফাঁসিয়ে দিয়ে গেলো।”
আবির:- “আরে তুমি হয়তো জানো না, কারখানাতে মাঝে মাঝেই নাইট ডিউটি হয়। তখন সারা রাত খোলা থাকে।”
মায়া পুরো কেবিনের সব কিছু ঘুরে ঘুরে দেখছে। হঠাৎই ও আরমানের কেবিনে থাকা ওয়ার্ডরোব টা টেনে খুললো। লক করা ছিল না তাই সাথে সাথে খুলেও গেলো। পুরো ওয়ার্ডরোব টা ফাইলে ভর্তি। তারই এক পাশ থেকে একটা ফাইল টেনে বের করে আনলো। ফাইল টা মায়া খুলে মনোযোগ সহকারে দেখতে লাগলো। ফাইলে আছে বেশ কিছু মেয়ের ছবি আর তাদের ডিটেইলস।
সামিরা, মাইশা ওরা ইতিমধ্যেই কেবিনে থাকা সোফায় বসে গেছে। সবাই মায়ার কান্ড দেখছে। হঠাৎই মায়া বলে উঠলো, “এই আপনাদের ব্যাবসা টা কি বলুন তো? মেয়ে পাচারের নাকি?”
মায়ার কথা শুনে আবির শুকনো বিষম খেলো। কাশি উঠে গেলো ওর। সবাই বড়ো বড়ো চোখ করে তাকালো। এই মেয়ের মাথা মনে হয় সত্যিই গেছে। শেষ মেষ কিনা মেয়ে পাচার?
আর মায়া তো ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে প্রতিটা মেয়ের ছবি দেখে চলছে।
আয়ান:- “আরে ভাবী মনি কি যে বলো না তুমি। মেয়ে পাচারের ব্যাবসা হবে কেন? ভাইয়ার মেন বিজনেস সব ধরনের ড্রেস নিয়ে। সাথে আরো অন্যান্য কিছুও যোগ করছে ধীরে ধীরে। আর এই মেয়ে দের ছবি ডিটেইলস এগুলো এই অফিসের স্টাফ দের। এই অফিসে কাজ করা প্রতিটি ব্যাক্তিরই ছবি সহ ডিটেইলস রাখা আছে এইভাবে।”
মায়া:- “ওহ আচ্ছা বুঝলাম। কিন্তু উনি কোথায় গেলেন?”
আয়ান:- “সেটাই তো বুঝতে পারছি না ভাবী মনি।”
মায়া ফাইল রেখে দিলো। আয়ানের কথায় মায়া গভীর ভাবনায় ডুব দিলো। আবিরের কথা মতো আরমানের অফিসে থাকার কথা ছিল। আরমান সেটাই তো বলেছিল আবিরকে, কাজের চাপ আছে তাই বাড়ি ফিরবে না। কিন্তু আবির বাড়ি ফেরার সাথে সাথে আরমান অফিস থেকে উধাও। সন্দেহের বাসা বাঁধলো মায়ার মনে। আচ্ছা কোনো মেয়ের সাথে রিলেশন নেই তো উনার? থাকতেই পারে। এতো বড়ো বিজনেস ম্যান বলে কথা। তার উপর আবার মায়ার কিছু মনে নেই, এটা তো অনেক বড়ো সুযোগ হতে পারে উনার কাছে।
এইসব ভাবতে ভাবতেই মায়া এগিয়ে এলো সেই কাঁচের দেওয়াল টার দিকে। এখন এটা পর্দা দিয়ে ঢাকা নেই, তাই আরমানের কেবিনে থেকে স্পষ্ট সবকিছু দেখা যাচ্ছে। মায়া কি মনে করে হঠাৎ প্রশ্ন করলো, “আচ্ছা হেড ডিজাইনার মেয়ে না ছেলে?”
আয়ানের জানামতে আরমানের হেড ডিজাইনার মানে মিস দিশা। তাই ও কিছু না বুঝেই উত্তর দিলো, “হেড ডিজাইনার তো মিস দিশা নামের একটা মেয়ে।”
মায়া:- “আর এই কেবিন টা?”
এবারও আয়ান কিছু না বুঝেই উত্তর দিলো, “আরে এই কেবিন টা তো ভাইয়া স্পেশাল ভাবে বানিয়ে ছিল, আমার জানামতে।”
আবির কপাল চাপড়ে বিড়বিড় করে বলল, “এতোক্ষণ আমি একাই ফেঁসে ছিলাম, এখন এই ব্যাটা আরমান কেও ফাঁসিয়ে দিলো। ঠিক হয়েছে। এবার আরমান বাবু ঠ্যালা সামলাও।”
আয়ানের কথায় মায়া নিজের সন্দেহকে নিশ্চিত রুপে ধরে নিলো মায়া। মায়া আরমানের স্ত্রী কিন্তু, মায়া সবকিছু ভুলে যাওয়ায় আরমানকে তো নিজের কাছে আসতে দেয় না অনেক দিন হলো। আর একটা পুরুষ মানুষ কত দিনই বা একা থাকবে? উনারও তো নারী সঙ্গীর প্রয়োজন। তাই হয়তো নিজের চাহিদা মেটানোর জন্য…
না আর ভাবতে পারছে না মায়া। বুকের ভিতর টা ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে যেনো। আরমান এখন হয়তো অন্য কোনো মেয়ের সাথে আছে ভাবতেই ওর হৃদয় টা জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়তে শুরু করলো। সবাই হকচকিয়ে গেলো মায়াকে হঠাৎ করেই কাঁদতে দেখে।
সামিরা মায়ার কাছে ছুটে এসে প্রশ্ন করলো, “কি হলো ভাবী মনি কাঁদছো কেন তুমি?”
মায়া কান্না ভেজা কন্ঠে বলল, “উনার ওই হেড ডিজাইনার এর সাথে সম্পর্ক আছে তাই না?”
সবাই অবাক হলো মায়ার কথা শুনে। মেয়েটা কি জানে ও কি বলছে?
আবির:- “কি সব বলছো তুমি মায়া? পাগল হয়েছো নাকি?”
মায়া উত্তেজিত হয়ে বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ এখন তো আমাকে পাগলই মনে হবে। সব তো বোঝাই যাচ্ছে। উনি স্পেশাল কেবিন বানিয়েছেন স্পেশাল মানুষের জন্য। আর এই কেবিন টা কার? উনার হেড ডিজাইনারের। উনি উনার স্পেশাল কেবিন হেড ডিজাইনার কে দিয়ে, কাঁচের দেওয়ালের এই পাড়ে বসে স্পেশাল মানুষটিকে স্পেশাল ভাবে দেখে।”
এরপর মায়া মাইশার কাছে গিয়ে, উত্তেজিত হয়ে ওকে দেখিয়ে বলে উঠলো, “দেখো আপু! দেখো। ওই যে হেড ডিজাইনার এর ডেস্ক আর উনার ডেস্ক একদম সোজাসুজি। এখান বসে খুব সুন্দর ভাবে দেখা যায় তাকে। এর মানে কি আপু?”
মাইশা অসহায় চোখে তাকালো মায়ার দিকে। ও কি উত্তর দেবে বুঝতে পারছে না।
এদিকে মায়ার কথা শুনে আবির ধপ করে বসে পড়লো সোফার উপর। এখন তো ওর দেওয়ালে মাথা ঠুকতে ইচ্ছে করছে ওর। হায় হুতাশ করে বলে উঠলো, “আরমান ভাই তুই কোথায়? তোর বউ কে তুই সামলাতে পারবি, আমাদের দাঁড়া সম্ভব নয়। নিয়ে যা এই পাগলী কে। যেমন স্বামী তেমন তার বউ।”
মায়া কাঁদতে কাঁদতে বলল, “হ্যাঁ আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিউর উনি ওই মেয়ের সাথেই আছে। আর কালও ছিল তাই না আবির ভাইয়া। কাল রাতেও তো অনেক রাতে ড্রিঙ্ক করে বাড়ি ফিরেছিল। আর তুমি তো কাল উনার সাথেই ছিলে।”
আবির কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “বিশ্বাস করো বোন আমার আরমানের কোনো মেয়ের সাথে সম্পর্ক নেই। আজ পর্যন্ত তুমি ছাড়া কোনো মেয়ের কাছে ঘেঁষে নি ও। আর কাল আমি ওরা সাথেই ছিলাম, কিন্তু বিশ্বাস করো কোনো মেয়ে ছিল না ওর সাথে। এই কথা গুলো একদম সত্যি। একটুও মিথ্যে না। এই যে সামিরার হবু বরের কসম করে বলছি।”
শেষের কথা টা সামিরার মাথায় হাত দিয়ে বলতে চাইলো। কিন্তু সামিরা লাফ দিয়ে সরে গেলো।
সামিরা তেজি গলায় বলল, “এই একদম আমার না হওয়া বরের কসম কাটবে না বলে দিচ্ছি।”
মায়া আবারও কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠলো, “আচ্ছা ভাইয়া, এই কথা গুলো একদম সত্যি। একটুও মিথ্যে না। তাহলে আগের কথা কি গুলো সব মিথ্যা ছিল?”
আবিরের অবস্থা নাজেহাল। থতমত খেয়ে গেলো ও। মায়া আয়ানের কাছে গিয়ে বলল, “ভাইয়া তোমার ফোন টা দাও তো।”
আয়ান নির্দ্বিধায় পকেট থেকে ফোন বের করে আনলক করে দিলো। মায়া কল লাগালো আরমানের নাম্বারে। কিন্তু রিসিভ করলো না আরমান। একবার..দুই বার..তিন বার.. এইভাবে বহু বার চেষ্টা করলো। কিন্তু আরমান একবারও রিসিভ করলো না। আর এই কারণেই আরো উত্তেজিত হয়ে পড়লো মায়া। পাগলের মতো বিহেভ শুরু করলো। আবির, সামিরা, রুবি সবার ফোন থেকে কল দিলো। একবার না বহু বার। কিন্তু ফলাফল শূন্য।
মায়া রেগে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়লো। আরমানের ডেস্ক থাকা সমস্ত জিনিস ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতে শুরু করলো। সাথে ওর পাগলের মতো কান্না তো আছেই। মুখে উচ্চারণ করছে আর কেবিনে থাকা প্রত্যেকটা জিনিস ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছে, “সব বুঝে গেছি আমি। সব বুঝে গেছি। আমি উনাকে নিজের কাছে আসতে দিইনি বলে অন্য মেয়ের সাথে রিলেশনে গেছে। আর এখন নিশ্চয় তার সাথে রাত কাটাতে ব্যাস্ত। তার জন্যই তো কারোর ফোন রিসিভ করছে না। বাড়িও ফিরছে না। মজা মস্তি করতে ব্যাস্ত এখন উনি।
হঠাৎই মায়া থেমে গেলো। তারপর পাগলের মতো হেসে বলল, “আচ্ছা উনি যদি নিজের বউয়ের মরার খবর শুনে তাহলে নিশ্চয় বাড়ি ফিরবে তাই না।”
মায়ার কথা শুনে আঁতকে উঠলো সবাই।
এদিকে আরমান গাড়ি থেকে চাবিটা দারোয়ানের হাতে ধরিয়ে দিলো, গাড়ি পার্ক করে দেওয়ার জন্য। প্রচন্ড টায়ার্ড লাগছে। এখন ও মায়া কুঞ্জে আছে। গাড়িটা গেটের কাছেই থামিয়ে ছিল তাই এখন হাঁটতে হাঁটতে ভিরতে প্রবেশ করছে। হাঁটতে হাঁটতেই পকেট থেকে মোবাইল টা বের করলো আরমান। মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ পড়তেই চমকে উঠলো ও। বাড়ির সবার অনেক গুলো মিসডকল আর কিছু ম্যাসেজ। শেষ ম্যাসেজ টা এসেছে আবিরের ফোন থেকে। থমকে গেলো আরমানের হৃদয়। স্ক্রীনে জ্বল জ্বল করছে,
আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ৪৭
“মায়া সুইসাইড করেছে। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আয়।”
ম্যাসেজ এসেছে প্রায় দুই ঘণ্টা আগে। আরমানের পুরো শরীর কেঁপে উঠলো। হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেলো।
ঠিক তখনি আরমান কিছু বুঝে উঠার আগেই হঠাৎ করে কেউ একজন রুমাল জাতীয় কিছু একটা দিয়ে আরমানের মুখ বেঁধে দিলো। আরো দুই জন আছে হয়তো। পিছনে দিকে নিয়ে গিয়ে হাতও বেঁধে ফেললো। এরপর কালো কোনো কাপড় দিয়ে পুরো মাথা ঢেকে ফেললো আরমানের। আরমান এমনিতেই একটা শকড এর মধ্যে ছিল, তাই চেয়েও কিছু করতে পারলো না ও।
