আপনাতেই আমি সিজন ২ পর্ব ৬৫

আপনাতেই আমি সিজন ২ পর্ব ৬৫
ইশিকা ইসলাম ইশা

এভাবেই সময় চলতে থাকল।
তখন দিয়ার ১৭ বছর বয়স।কিশোরি কন্যা থেকে ধীরে ধীরে যুবতি নারী হয়ে উঠেছে।সেই সাথে চোখে মুখের উজ্জলতাও বেড়েছে বহুগুণ।কলেজে ভর্তি হয়েছে বেশ কিছুদিন হয়েছে।এর মাঝেই তার দেখা হয় রুপেসের সাথে।রুপেস রোশানের বন্ধুর কাজিন ছিল।রোশানের কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতেই তারা এসেছিল মূলত।শেয়ারে ব্যাবসার মাধ্যমে রোশানের এতো দিনের স্বপ্ন পূরন হতে যাচ্ছে। বন্ধুর প্রচেষ্টা আর সবচেয়ে বড় স্বপ্ন পূরণে কিছুটা অংশীদার হতে পেরে খুবই খুশি হয়েছিল রোশানের বন্ধু নোমান।গ্রামের ও দিন দিন উন্নতি হচ্ছিল।

সেদিন ছিল রোশানের বাবা মায়ের বিবাহ বার্ষিকী।এই বয়সে এসে বিবাহ বার্ষিকী পালন করতে লজ্জা পেলেও ছেলে মেয়ের জেদের কাছে হার মেনে নিতে হয়েছে। রোশানের মা সাইরি বেগম ছিল ছেলে মেয়েদের সাথে।তাই বাধ্য হয়েই রাজি হন তিনি।পুরো গ্রাম দাওয়াত করে খাওয়ানো হয় দুপুরের দিকে।বিকাল হতে হতে বাড়ি ফাঁকা হয়ে যায়। শুধু কাছের আত্মীয়,কাজিন আর রাইফার বন্ধুরা ছিল।দিয়া যদিও থাকতে চাইনি রাইফা জোর করেই রেখেছে তাকে।সন্ধ্যার দিকে সবাই ছাদে বসেছে।রোশানের বন্ধু নোমান একটা গিটার এনে রোশানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
একটা গান ধর দোস্ত!!অনেক দিন তোর গান শোনা হয় না।
রোশান দ্বিমত পোষণ না করে গিটার হাতে সুর তুলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“””বলবো কবে তাকে ডেকে
আমি তোমাকে ভালোবাসি,
করেছে পাগল আমাকে
ওগো তোমার ওই মিষ্টি হাসি।
কবে জানবে তুমি,
কবে বলবো আমি
কেউ আছে গো তোমার আশায় ..
যার ছবি এই মন এঁকে যায়
যার কথা ভেবে দিন কেটে যায়,
সেকি জানে শুধু তাকে
ভালোবাসে আমার হৃদয়।
যার ছবি এই মন এঁকে যায়।”””

রোশানের গান শেষ হলে সবাই তালি বাজাতেই দিয়ার ধ্যান ছুটল। এতোক্ষণ মনোযোগ দিয়ে রোশানের গান শুনছিল ।গান শেষ হতেই দিয়া লাজুক হেসে হাত তালি দিল।রোশানের দিকে তাকাতেই চোখে চোখ পড়ল।দিয়া লাজুকতায় দৃষ্টি সরিয়ে নিল। কিন্তু রোশান দৃষ্টি সরালো না।সে তাকিয়ে দেখল লাল রাঙা থ্রিপিচ পড়ে মাথায় ওরনা দেওয়া লাল টুকটুকে কন্যাকে।

এসব কারো নজরে না এলেও দূর থেকেই লক্ষ্য করল রুপেস।সেও তাকিয়ে ছিল দিয়ার মুখের দিকে।দিনে দিনে মেয়েটাকে তার ভীষণ ভালো লাগছে।তবে এদের চোখাচোখি করা,মুচকি হাসি এসব সহ্য হলো না।
তারপর দিয়াকে একদিন প্রপোজ করে রুপেস। কিন্তু দিয়া তাকে মানা করে দেয়।কারন তার মন প্রাণ জুড়ে ছিল শুধু তার মাস্টার মশাই।তার মাস্টারমশাই ব্যাতিত তার মনে আর কাউকে দেওয়ার মতো জায়গা অবশিষ্ট নেই।এটা রুপেস কে জানিয়ে দেয়।দিয়া রুপেসকে মানা করার পরেও রুপেস দিয়ার পেছনে ঘুরত। একদিন দিয়া রেগে সবার সামনে অপমান করে। সবার সামনে অপমান করাই রুপেস প্রতিরোধ পরায়ন হয়ে উঠে।
এরপর সময় ঠিক তার বেগে চলতে লাগল।দেখতে দেখতে জীবন অনেকটা পরিবর্তন হলো।জীবনের ১৮ বছরে পা দিয়ে দিয়া বুঝল জীবন কতোটা কঠিন।প্রিয় মানুষ হারানোর ব্যাথা কতোটা গভীর।

দিয়া সেদিন কলেজ থেকে বাসায় ফিরতেই দেখে বাসায় বেশ কিছু মানুষ জড়ো হয়েছে।গ্রামের মানুষদের তার বাসায় দেখে রিদি অবাক হয়ে এগিয়ে গেল।সামনে তাকিয়ে দেখল আতাউর রহমান মাথা নিচু করে বসে আছে।দিয়া দৌড়ে বাবার কাছে যেতেই আতাউর রহমান তাকে টেনে থাপ্পর মারে।
আজ তুই প্রমাণ করে দিলি পর কখনো আপন হয় না!পাপের রক্ত পাপ ই বয়ে আনে!
দিয়া হতবাক হয়ে তাকালো বাবার দিকে।কিছু বোঝার আগেই চোখ গেল সামনে দাঁড়ানো রুপেসের দিকে।রুপেসকে এখানে দেখে রিদি অবাক হয়ে বলল,
তুমি এখানে??কি চাই??

গ্রামের একজন মুরব্বি তেরছা চোখে দিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
চিনছো তাহলে!! তোমার আশিক!!
দিয়া চেতে উঠে বলল,
একদম ফালতু কথা বলবেন না।আপ……
ঠাসসসসস……….ঠাসসস
পরপর দুটি থাপ্পর খেয়ে দিয়া ছিটকে গিয়ে দেওয়ালে বাড়ি খেল।কপাল কেটে রক্ত বেরিয়ে আসতেই দিয়া হাত দিয়ে চেপে ধরে সামনে তাকালো। অস্ফুটস্বরে বলল,
আম্মু…….

খবরদার!!খবরদার ঐ কলঙ্কিত মুখে আমাকে আম্মু বলে ডাকবি না।আমি তোর মা না।দেইনি আমি তোকে জন্ম।কুড়িয়ে পাওয়া সন্তান কখনো নিজের হয় না।
দিয়া রক্তাক্ত অবস্থায় ছুটে এলো মায়ের কাছে,
এসব কি বলছ আম্মু!!আব্বু ও বলছে পর আপন হয় না।আমি কি পর বলো!!তোমরা কেন এমন বলছ?কি করেছি আমি?

আকলিমা বেগম হাতে থাকা কাগজ ছুড়ে মারল দিয়ার দিকে।দিয়া অবাক হয়ে কাগজ গুলোর দিকে তাকালো।ছবি!অনেক গুলো ছবি!!দিয়া কয়েকটা ছবি তুলল একটাই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সে আর রুপেস খুব কাছাকাছি,অন্যটাই যেন অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি।দিয়া ঝট করে ওগুলো ফেলে দিয়ে বলল,
এসব মিথ্যা আম্মু!!আমি এসব কিছু করিনি!!ছি…..
আম্মু ও আম্মু বিশ্বাস কর আমি এসব কিছু করিনি।এই ছবি মিথ্যা!
এই ছবি না হয় মিথ্যা!এই নুপুর ও কি মিথ্যা! বল??কেন করলি এমন?রিদি চট করে নুপুরের দিকে তাকালো। আবার নিজের পায়ের দিকে তাকালো।তার এক পায়ে নূপুর নেই।
এসব মিথ্যা!আম্মু,আব্বু বিশ্বাস কর এসব মিথ্যা।

দিয়ার হাজারো আর্তনাদ শুনল না কেউ।আকলিমা বেগম দিয়াকে মোটা লাঠি দিয়ে মারতে লাগলো।তখনি রুপেস ছুটে এসে দিয়াকে জরিয়ে ধরে। আকলিমা বেগমের থেকে দিয়াকে ছাড়িয়ে নিয়ে রেগে বলে,
পাগল আপনি এভাবে মারছেন কেন?মানছি আমরা আবেগের বসে ভুল করেছি। কিন্তু আমি তো বিয়ে করতে প্রস্তুত।তাহলে আপনারা…….
রুপেসের কথা শেষ হওয়ার আগেই দিয়া ঢলে পড়ল মাটিতে।কপাল চুঁইয়ে রক্তাক্ত হলো মুখখানা।

দিয়ার ঙ্গান ফিরেছে।তখন রাত প্রায় বারোটা। পিটপিট করে চোখ খুলতেই সামনে রোশান কে দেখে দিয়া চট করে উঠে প্রথমবার রোশানকে জরিয়ে ধরে কেঁদে উঠলো।রোশান দিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
দুষ্টু পাখি! কাঁদে না!আমি তো আছি!!
দিয়া রোশানের কথায় আরো জোরে কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
সব মিথ্যা।সব মিথ্যা মাস্টারমশাই আমি কিছু করি নি।আমাকে বিশ্বাস করুন।
আমি জানি আমার দুষ্টু পাখি পবিত্র।প্লিজ শান্ত হও!

রোশান সেদিন দিয়াকে বিশ্বাস করেছিল।রোশানের পাশে আরও একজন দিয়াকে বিশ্বাস করেছিল সে ছিল রাইফা।রোশান দিয়ার মা,বাবার সাথেও কথা বলে।দিয়ার বাবা মা রোশানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।তারা জানে তাঁদের দিয়া এমন মেয়ে না। কিন্তু তখন এতোকিছু সামনে আসায় নিজেকে ধরে রাখতে পারে নি।গ্রামের মানুষের তিক্ত কথা তাঁদের পাষান বানিয়ে দিয়েছিল।সব ঠিক ছিল। রোশান দিয়াকে ওয়াদা করল কালই তারা বিয়ে করবে।রাইফাও ভাইয়ের সাথে সেদিন মত দিয়েছিল।রাতেই কেনাকাটা করতে বেরিয়ে পড়ল তারা।
কিন্তু পরের দিন।সব বদলে গেল।কি থেকে কি হল সবটা পাল্টে গেল। সকাল তখন ৮:৫০ । রোশান খুরে খুরে প্রবেশ করল দিয়াদের বাসায়।হাতে তার একটা সুটকেশ। সেখানে খুব যত্ন করে আগলে নিয়ে এসেছে তার দুষ্টু কন্যা থেকে মিষ্টি বৌ হবার লাল টুকটুকে শাড়ি।

কয়েকবার দিয়াকে ডাকতেই দিয়া বেরিয়ে এলো। রোশান দিয়াকে দেখে কেমন করে চাইল।দিয়ার পরনেও সেদিন ছিল লাল টুকটুকে শাড়ি।সাজটা ঠিক বৌদের মতোই। রোশান দিয়াকে এভাবে দেখে কিছু বলার আগেই বেরিয়ে এলো রুপেস।বর সেজে। রোশান অবাক হয়ে বলল,
তোমার পাশে……..
আমার পাশে আমার বর মাস্টারমশাই!বিয়ে হয়েছে আমাদের।
রোশান দিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। দিয়ার চোখে,মুখে আলাদা এক দৃঢ়তা।মুখে টেনে রাখা হাসি।বৌ সাজে দিয়াকে ঠিক তার কল্পবধূ লাগছে।তবে বরের পাশের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে অন্য একজন।এই ব্যাথা বোঝানো সম্ভব নয়।না এই ব্যাথা ভাষায় প্রকাশ করা যায়। রোশান হাতের লাগেজটা ছেড়ে মাটিতে বসে পড়ল।রাইফা হতবাক হয়ে ছুটে এলো ভাইয়ের কাছে।রাইফা কি বলার আগেই রোশান ধীর কন্ঠে বলল,

কেন করলে এমন?
কলঙ্কিনীর হাত থেকে মুক্ত করলাম শুধু!
আমিও যে সেই কলঙ্কে কলঙ্কিত হতে চেয়েছি!
দিয়া উওর করল না।জোরে শ্বাস নিয়ে মলিন হেসে বলল,

আপনাতেই আমি সিজন ২ পর্ব ৬৪

“”সব গল্পে কি পূর্নতা থাকে মাস্টারমশাই
কিছু গল্পে থাকে অপূর্ণতা।
আমাদের গল্পটাও ঠিক তেমনি অপূর্ণ!””

আপনাতেই আমি সিজন ২ পর্ব ৬৫ (২)