তাজমহল পর্ব ৪০
প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী
শাইনার দাদীমা এসেছিল বাড়িতে। নাতজামাই এতদিন পর বাড়ি ফিরেছে। দেখতে না এলে কেমন দেখায়। আসার সময় অবশ্য বেশ নাশতাপানি নিয়ে এসেছে। নাতজামাইয়ের সাথে বসে গল্পসল্প করলেন। উনার নাতজামাই কথায় কথায় মানুষকে হাসায় কিন্তু নিজে হাসেনা।
দাদীমাকে স্পষ্টভাবে অভিযোগ জানালো, ” আমি দূরে গেলে উনি মায়া মহব্বত দেখায়। বাড়িতে থাকলে দুই পয়সার পাত্তা দেয় না। ইটস ক্রাইম।”
শাইনা তখন তার জন্য আনা জিনিসপত্র লুকোচ্ছিল। এতগুলো গাঁদাফুল কেউ আনে? সবাই দেখলে কি ভাববে? কাজের ফাঁকে ফাঁকে সে কথাগুলো শুনছিল চুপচাপ। আর কিছুক্ষণ পরপর দাদীমা আর তাজদার সিদ্দিকীকে দেখছিল। এত গুরুতর ভঙ্গিতে দাদীমাকে অভিযোগ দিচ্ছে যেন সে মস্তবড় পাপী।
দাদীমা বলল,”এ তো ভারী অন্যায় নাতজামাই। এমন মেয়ের সাথে কেউ সংসার করবে না।”
তাজদার মাথা নেড়ে বলল,”না না সংসার করবে। যেমন আমি করছি। এটা বেশিরভাগ মেয়েমানুষেরই ন্যাচার। এখানে শাইনা মমতাজের কোনো দোষ নেই। উনি একটা বড়সড় রোগে ভুগছেন। এটার ট্রিটমেন্ট জরুরি।”
শাইনা বিড়বিড়িয়ে বলল ভ্যাঁ ভ্যাঁ।
দাদী-শাশুড়ির সাথে কথাবার্তা বলে
তাজদার গোসল করতে চলে গেল এই বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“মমতাজ আমি ভাত খাব। ছোটলোকগুলো সস্তায় আজকে কোন চালের ভাত খাইয়েছে জানিনা। আমার খিদে মেটেনি। প্লিজ এখানে নিয়ে আসো।”
বলেই সে ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করে দিল। শাইনা হতভম্ব! নিজের বন্ধুদের ছোটলোক বলা?
দাদীমা বলল,”পেট ভরবে কেমনে। বউয়ের আদর তো পাইনাই।”
শাইনা দাদীমার দিকে খেপাটে দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,”উনি আসছেন সে খবর তোমাকে কে দিয়েছে শুনি?”
“বাতাসে। তুই বজ্জাত মেয়ে ছেলেটাকে জ্বালাস কেন?”
“কোথায় জ্বালিয়েছি?”
“তুই যখন রান্নাঘরে ছিলি তখন আমাকে সবটা বলেছে?”
“কি বলেছে?”
“বলেছে তুই নাকি কথা পেটে রেখে দিস। মন খুলে কথা বলিস না। ও এতদিন ছিল না তুই নাকি একটু কাঁদিসওনি। কত দুঃখ নিয়ে আমাকে বলল, উনাকে এখানে রেখে লন্ডনে চলে গেলে উনি আমাকে ভুলে যাবেন আমি সিউর।”
শাইনা হেসে বলল,”খোদা! আমি এ কোন পাগলের পাল্লায় পড়লাম।”
“ও এসেছে কিন্তু তুই নাকি একটু দৌড়ে এসে জড়িয়েও ধরলি না। ইংজিরিতে আরও কি কি বললো।”
শাইনা শব্দ করে হেসে উঠে বলল,”এগুলো কোনো দোষ হলো?”
দাদীমা ফিসফিস করে বললেন,”দোষ হবে না? শোন ব্যাটামানুষরা এইসব চায়। এর পরের বার কোথাও বেড়ানোর পর বাড়ি ফিরলে একদম কোলের উপর উঠে বসে থাকবি। ব্যাটামানুষরা বউয়ের কাছ থেকে এইসব চায়। তুই বুঝবিনা এইসব এখন। আরও কিছুদিন যাক তারপর বুঝবি।”
শাইনা বলল,”ধুর এইসব পারব না। তোমার মাথা গেছে? আমি উনার কোলে উঠে বসে থাকবো, মাথা খারাপ?”
“আশ্চর্য কথাবার্তা বলোস শানু। তোর জামাই তো এইসবই চায়। তার বউ তাকে একটু সোহাগ টোহাগ করুক। চাইলে দিবিনা? আমি তো তোর দাদার কোলে বসেই থাকতাম সে না চাইলেও।
শাইনা বলল,”ধুত্তেরি! যাও তো।”
“কোলে নাইবা উঠলি। কোলে নিলে আবার নেমে যাওয়ার পায়তারা করিস না।”
শাইনা রেগে বলল,”তুমি চা খেতে আসবা?”
দাদীমা হেসে বললেন,”তোর জামাইয়ের সাথে খাব।”
“উনি ভাত খাবেন। ওঠো।”
“তুই আগের মতোই বজ্জাত আছিস শানু।”
দাদীমাকে একপ্রকার টেনে নিয়ে গেল শাইনা।
তাজদার ভাত খাচ্ছে। হাতা কব্জি অব্দি গুটানো।
যদিও এটা ভাত খাওয়ার টাইম নয়। শাইনা শুধু ভাবছে কি না খেয়েদেয়ে চলে এসেছে নাকি? আচ্ছা ডেঞ্জারাস লোক তো। সে তরিতরকারি তুলে দিল পাতে। তারপর সামনের চেয়ারে গিয়ে বসলো। গালে হাত দিয়ে তাজদারের খাওয়া দেখলো। তাজদার খেতে খেতে আচমকা তার দিকে তাকিয়ে থেমে গেল।
“কারো খাওয়ার সময় তার দিকে এভাবে চেয়ে থাকা কোন ধরণের ম্যানার্স, মমতাজ?”
শাইনা বলল,”জানিনা, শিখিয়ে দিতে পারেন। আপনার মতো একজন ইংরেজ বাবু থাকতে আমি অশিক্ষিত থাকবো কোন দুঃখে?”
“বাড়তি কথা বলো না। খাবার টেবিলে বসে কারো খাওয়ার দিকে তাকিয়ে না থাকা গুড টেবল ম্যানার্স! এগুলো শিখে রাখা জরুরি।”
শাইনা বলল,”বেশ মনে রাখব। আগে খেয়ে নিন। পরে বাকি কথা।”
শাইনা চোখ সরিয়ে নিল। কথা বলার টপিক খুঁজে বেড়ায় খালি। পেলে গড়গড় গড়গড় কথা বলতে থাকে। বিয়ের আগে তো শুধু গলা ঝাড়তো। তখন মনে হতো কথা বলতেই জানেনা। এখন মুখে খালি খই ফুটে।
খাওয়া শেষে তাজদার হাত ধুয়ে নিল। শাইনা প্লেট নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল তাজদার দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,
“গুনে গুনে পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসবে।”
শাইনা চুপচাপ বেরিয়ে গেল। তিতলি নেচে-কুঁদে তার পেছন পেছন এসে বলল,”ভাবিইইই!”
শাইনা চমকে গেল। তিতলি হেসে বলল,
“একটা প্রশ্ন করবো? কিছু মনে করবে না তো?”
“বলো।”
“ভাইয়া ওগুলো কি এনেছে?”
শাইনা থতমত খেল। তিতলি বলল,
“পার্সোনাল হলে বলতে হবে না।”
শাইনা আমতাআমতা করে বলল,”না তেমন কিছু না। ওই কতকগুলো ফুল।”
তিতলি কপাল কুঁচকে ফেলে কি যেন ভাবলো। তারপর ফিক করে হেসে উঠে একদৌড়ে চলে গেল। সোজা তৌসিফের ঘরে ঢুকে পড়লো। বলল,
“ভাইয়ে মেঝ ভাই ওইসব কি এনেছে জানো?”
তৌসিফ ল্যাপটপের কিবোর্ড চেপে চেপে বলল,”কি?”
তিতলি তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। দুই কাঁধে হাতের ভর রেখে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে বলল,
“বলবো না।”
তৌসিফ গা ঝাড়া মেরে বলল,”তো এখানে আমার মগজ খেতে এসেছিস?”
তিতলি মুখ মোচড় দিল। যাওয়ার সময় তার দরজা দুইবার জোরে জোরো খুললো আর বন্ধ করলো। তৌসিফ বিরক্ত হয়ে বলল,
“তিতলিনী!”
তিতলি বলল,”চুপ চুপ।”
শাইনা কফিটা নিয়ে চলে এল। তাজদার তখন বিছানার উপর টুল রেখে তার উপর দাঁড়িয়ে কিছু একটা করছে।
শাইনা অবাক চোখে তাকালো। দ্রুত দরজা বন্ধ করে দিল। বলল,
“কফি এনেছি। এইসব কি করছেন?”
তাজদারের কাঠকাঠ জবাব,
“দোলনাটা নিশ্চয়ই জুনিয়রদের জন্য আনিনি। বেকুব কোথাকার।”
মজবুত হুক স্ক্রু করেছে সে। সেইসব করতে গিয়ে প্রায় ঘেমে উঠেছে। শাইনা বুঝতে পারছেনা এত পরিশ্রম করে এইসব করার কি দরকার? বাইরে থেকে এসেছে আরাম করবে তা না। এই লোকের মাথায় কি সমস্যা আছে?
সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো সব কাজ। বাড়ির সবাই মনে করছে ঘরের মধ্যে তারা আসবাবপত্র সরিয়ে অন্য জায়গায় বসাচ্ছে। কি লজ্জার কথা! তিতলি একবার বুঝতে পারলে হবে। তাকে পচাবে ইচ্ছেমতো।
তাজদার একটি মোটা রোপ নিয়ে হুকের সঙ্গে বেঁধে দিয়েছে। রোপ ঠিক ঠিক ভাঁজ হয়ে হুকের চারপাশে মজবুতভাবে আঁটকে যেতেই দোলনার লুপে রোপের শেষ প্রান্ত ঢুকিয়ে সেটি ঝুলিয়ে দিল সে। দোলনাটা ধীরে ধীরে দুলতে লাগল।
তাজদারের চোখে এবার সন্তুষ্টি দেখা দিল। কষ্ট হলেও পরিশ্রম স্বার্থক। কোমরে দুহাত চেপে ফোঁস করে একটা শ্বাস ছেড়ে শাইনার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচালো সে। শাইনা শক্ত হয়ে জমে গেল। দরজা খুলে দ্রুত বেরিয়ে যাওয়ার সময় তাজদার আঙুল তুলে বলল,
“এই এই বেরোবে না। কাম হিয়ার।”
শাইনা দরজার খিল ছেড়ে দিয়ে তার দিকে ফিরলো। তাজদার এগিয়ে আসতে লাগলো। শাইনা তার আগেই দরজা খুলে ভৌ দৌড়!
তখন পালাতে পারলেও সে তাজদার সিদ্দিকীর হাত থেকে পুরোপুরি পালাতে পারলো কই? তাকে লাল শাড়িটা ঠিকই পরতে হয়েছে। আলতোভাবে খোঁপা বেঁধে ঘরের অল্প আলোয় চোখে কাজল পরতে হয়েছে। কোমরে পুরুষালি হাতের চিমটিটাও মিস যায়নি। চমকে ওঠার পর তাজদার সিদ্দিকী তার কাজলপরা চোখদুটো দেখে বলল,”আমাকে ভয় দেখানোর জন্য পেত্নী না সাজলে চলতো না?”
শাইনা আজ বাধ্য বউ হয়ে গিয়েছিল। আবছা অন্ধকারময় ঘরে গাঁদাফুলের পাপড়ি বিছানো বিছানায়ও গা ডোবাতে হয়েছে তাকে। তাজদার সিদ্দিকী দোলনায় শুয়ে দুলতে দুলতে তার মুখের উপর পাপড়ি ছুঁড়ে মারলো। সাথে স্পিকারে একটা ইংলিশ গানও ছেড়ে দিল।
“So honey now
Take me into your loving arms
Kiss me under the light of a thousand stars”
শাইনা মুখ থেকে পাপড়ি ঝেড়ে ধীরেধীরে তার দিকে তাকিয়ে বলল,”ভলিউম কমালে ভালো হয়। সবাই শুনতে পাবে নাহলে।”
তাজদার বলল,”সবাই জানে এটা নতুন দম্পতিদের ঘর।”
কি নির্লজ্জ! শাইনা মুখ থেকে পাপড়ি সরাতে সরাতে বলল,”এইসব গান ইংরেজরাই শোনে।”
“তুমিই আমাকে ইংরেজ বাবু ডেকেছ।”
শাইনা গড়াগড়ি খেয়ে বিছানা থেকে নেমে গেল। তার ভয় করছে। দোলনাটা ছিঁড়ে যদি পড়ে যায়?
তাজদার তাকে বলল, সে কিছুতেই দোলনা সরাবে না। শাইনা যেন দোলনায় উঠে আসে। এছাড়া উপায় নেই।
শাইনা উপয়ান্তর না দেখে দোলনায় উঠে এল। তাজদার সিদ্দিকীর পাশে। তাজদার দুইহাতের ভর রেখে শুয়েছে। শাইনার মাথাটা দোলনায় ঠেকলো।
রাত গভীর হচ্ছিল। চারদিক নিস্তব্ধ, শুধু জানালা দিয়ে আসা হালকা বাতাসে পর্দা দুলছে। স্পিকারে লো ভলিউমে বাজছে হাবীব ওয়াহিদের গান,
“ভালোবাসব বাসবোরে বন্ধু…”
তাজদার হঠাৎ কৌশলে দোলনার স্পিড বাড়িয়ে দিল। দোলনাটা একবার এদিকে, একবার ওদিকে দুলে উঠতেই শাইনা আঁকাবাঁকা হয়ে পড়ে যাচ্ছিল। সেই মুহূর্তে এক ঝটকায় তার হাত উঠে গেল তাজদারের গলায়। জাপ্টে জড়িয়ে ধরে ফেললো সে। মুহূর্তের ভেতর দু’জনের মুখ এসে পড়ল একেবারে মুখোমুখি। শাইনা এই প্রথম বোধহয় একদম কাছ থেকে মন থেকে তাজদার সিদ্দিকীর মুখটা দেখলো। কত ঘৃণা করতো সে এই মুখটাকে। কত ঘৃণা!
তাজদার তাকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো। শাইনা বুঝে গেল আর ভয় নেই। তাজদার তাকে ভয় পেতে দেখে বলল,
তাজমহল পর্ব ৩৯
“ভয় হলে আমাকে আরও একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে পারো। আমার গায়ে কোনো গন্ধ নেই।”
শাইনা জড়িয়ে ধরলো। নাকে এসে ঠেকলো অদ্ভুত একটা ঘ্রাণ! সে দীর্ঘসময় ধরে নিঃশ্বাস টেনে রাখলো। এটা কি সুগন্ধি নাকি বিচ্ছিরি? তার মস্তিষ্ক সঠিক বার্তা দেওয়ার আগেই তাজদার সিদ্দিকীর ঠোঁট নরমভাবে মিশে গেল তার কপালে। শাইনা তাজদারকে শক্ত করে ধরে রেখে আচমকা ফুঁপিয়ে উঠলো। ললাট চুম্বন পৃথিবীর সবচেয়ে কোমল যত্নের প্রকাশ বলে হয়তো!