কাছে আসার মৌসুম পর্ব ৩৯
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
দূরের কড়াই গাছের সরু ডালটায় একটা শালিক এসে বসেছে। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে দেখতে। যেন এক চোট আকাশ-বাতাস তোলপাড় করে মাত্র একটু জিরোলো। সেদিকে উদাস মনে কিছুক্ষণ চেয়ে চেয়ে চোখ সরিয়ে আনলেন শওকত। শরীর গুছিয়ে বসলেন বারান্দার রকিং চেয়ারটায়। অন্যসময় এখানে বসলে মুক্ত বাতাসে মেজাজ ফুরফুরে হয়ে যায়। কিন্তু আজ মন-মস্তিষ্কে তেমন প্রভাব পড়ল না। বরং বুক থেকে ছিটকে বেরোল বিদীর্ণ দীর্ঘশ্বাসের ঝুলি। আজকাল সব কেমন পানসে লাগে। বিস্বাদ,বিশ্রী! চারপাশে যেন শুধুই মরিচীকা। কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না।
ইচ্ছে করে না নিজের আপনজনদের সামনেও দু সেকেন্ড বসতে। অফিসে যাচ্ছেন না প্রায় মাস দুয়েক গড়াবে। সবাই ভাবছে শরীরের অসুস্থতা,কিন্তু শওকত যে কারো মুখোমুখি হতে ভয় পাচ্ছেন,বোঝাবেন কাকে? খেতে নামেন না ছুঁতো দিয়ে। নিজেকে নিজের কাছে তুচ্ছ লাগে। অনেক বড়ো পাপী মনে হয়। ভুলে ভুলে তার জীবনটা যেন বিষাক্ত কাঁটা হয়ে গেছে। ডানে-বামে যেদিকেই ফিরছেন,বীভৎস রকম খোঁচা লাগছে গায়ে। অদৃশ্য আঘাত আর রক্তে কেবল বিধ্বস্ত তিনি। বিশেষ করে সার্থ,ওই ছেলেটার সাথে চোখ মেলাতে গেলে শওকতের নিঃশ্বাস থেমে আসে। আর তুশি, মেয়েটা তো জানেই না ও যাকে বাবার মতো ভালোবাসল, সম্মান দিলো, সে আসলে সেসবের যোগ্যই নয়।
শওকত হাতের বইটায় মন দিতে পারলেন না। বন্ধ করে রেখে দিলেন পাশে।
বিষণ্ণ চিত্তে রকিং চেয়ারে মাথা রেখে চোখ দুটো বুজলেন। এর মাঝেই দরজায় কেউ এসে দাঁড়াল। রিনরিনে স্বরে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ আসব?”
শওকত ফিরে চাইলেন। ওখানে বসেই পরিষ্কার দেখা গেল দোরগোড়া। তুশি এসেছে। অমনি চট করে সোজা হলেন ভদ্রলোক। মুখটা নেতিয়ে গেলেও, টেনেটুনে হেসে বললেন,
“ আয়।”
তুশি নাস্তার প্লেট নিয়ে এসেছে। শওকতও চেয়ার ছেড়ে উঠলেন।
আপ্রাণ চেষ্টা করলেন চেহারা হাসিহাসি রাখার। ঘরে এসে বললেন,
“ আজ হঠাৎ তুই নাস্তা আনলি?”
“ এমনি।”
তুশির চোখ নিষ্প্রভ। কণ্ঠেও স্ফূর্তি নেই। শওকতের মনে হলো এই চাউনি সার্থর মতো। গম্ভীর,এক রোখা। সহসা মাথা নুইয়ে নিলেন তিনি। গলা ঝেড়ে বললেন,
“ আচ্ছা রেখে যা। মাত্র ওষুধ খেলাম,দশ মিনিট পরে খাই।”
তুশি ট্রেটা টেবিলে রাখল ঠিকই,তবে গেল না। চুপচাপ চেয়ে রইল চাচার দিকে। শওকত চোখ নুইয়েই টের পেলেন মেয়েটা তাকে দেখছে। তাকালেন তিনি। মৃগনয়নের শীতলতা,আর মনের মাঝে অজস্র ভয়ে গায়ের লোমও যেন দাঁড়িয়ে যেতে চাইছে।
ঠোঁটে হাসি রেখে শুধালেন,
“ এ এভাবে কী দেখছিস?”
তুশির উত্তর না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করল,
“ আপনার খারাপ লাগে না বাবা? এতগুলো মানুষ আপনার জন্যে ভালো নেই,সুখে নেই, এ নিয়ে অনুশোচনা হয় না কখনো?”
শওকতের মুখের রক্ত সরে গেল। থমকাল অস্থির চাউনি। স্তম্ভিত শুধালেন,
“ সার্থ তোকে সব বলে দিয়েছে?”
তুশি কিছু বলল না। তবে বুঝে নিলেন তিনি। পরপরই মাথা নুইয়ে হাসলেন । ফোস করে শ্বাস ফেলে বললেন,
“ যাক,এত বছরে মনের কথা বলার জন্যে আমার ছেলেটা কাউকে অন্তত পেলো।”
তুশি শক্ত কণ্ঠে বলল,
“ আমার প্রশ্নের উত্তর এটা নয়।”
কথাটুকু ছুটে যাওয়ার ঠিক দু সেকেন্ড পরেই ডিভানে ধপ করে বসে পড়লেন শওকত। নেতিয়ে যাওয়া দেহটা দেখে মনে হলো,আকাশ থেকে একটা দূর্বল বস্তু ছুড়ে ফেলা হয়েছে। পরপরই ঝরঝর করে কেঁদে উঠলেন তিনি। তুশি চমকে গেল, থমকাল। চেয়ে রইল হাঁ করে। শওকত নিঃশব্দে কাঁদলেন কিছুক্ষণ। দুহাতে চোখের পানি মুছে আস্তেধীরে তাকালেন।
বললেন,
“ আমার কাছে একটু বসবি?”
তুশি বুঝল না ওর কী করা উচিত! রাতের বেলা ইয়াসিরের ওই কান্না,ওই আর্তনাদে ঘৃণায় মুখ ফেরানো? নাকি সব ভুলে শুধু এক বাবার ডাকে গিয়ে পাশে বসা? মাথা ইয়াসিরের কথা বললেও,মন বাবার কথাই ভাবল। ধীরুজ পায়ে গিয়ে শওকতের পায়ের কাছে বসল মেয়েটা। ভদ্রলোকের চোখ পাপোসের গায়ে।
কিছুক্ষণ চুপ করে সেখানে চেয়ে রইলেন। তারপর থেমে থেমে বললেন,
“ আমাদের গোটা বংশে আমিই প্রথম আর্মিতে যাওয়ায়,সবাই এক রকম আমাকে মাথায় তুলে রাখতো। ভালো পার্ফমেন্সের কারণে,র্যাংকও বাড়ছিল সেখানে।
হঠাৎ আব্বা জানালেন আমার জন্যে মেয়ে ঠিক করেছেন। আমি আব্বার মুখে মুখে কখনো কথা বলিনি। চুপচাপ এসে বিয়ে করলেও তনিমার প্রতি আমার মুগ্ধতা ছিল না। সেজন্যে নীরব জেদ পুষে বিয়েতে কলিগদের কাউকে বলা তো দূর,বিয়ের কথাই বেমালুম চেপে গেলাম আমি। আব্বা-আম্মা আমাকে আর ওকে এখানে তুলে দিয়ে গেলেন। তনিমা ভর্তি হলো এখানকার কলেজে। আমাদের সংসার শুরু হলো । কিন্তু মফস্বলের লাজুক মেয়েটাকে মন থেকে মানতে সময় লাগছিল আমার।
আর সেটা বাড়ল,আমি যখন জেসমিনকে প্রথম একটা পার্টিতে দেখি। সার্থর বয়স তখন আট,যখন আমাদের প্রথম কথা শুরু হয়। জেসমিন সুন্দরী, শিক্ষিতা, আধুনিক নারী। ঠিক যেমনটা আমি চাই। বাড়ি এসে যখনই তনিমাকে দেখতাম,না চাইতেও মনের মধ্যে জেসমিনের সাথে তুলনা চলে আসতো। মুখে-গায়ে রান্নার মশলা মেখে, ছেলেদের পেছনে ছোটাছুটি করা তনিমা,আর সেখানে পারফিউমের গন্ধে ডুবে থাকা জেসমিন। আমি নিজের দোষে ওর ওপর ঝুঁকলাম। তবে তনিমার প্রতি আমার একটু চাপা রাগও ছিল। আমি এত তাড়াতাড়ি সন্তান নিতে চাইনি। সেখানে বছরের মাথায় সায়ন-সার্থ,আবার দু বছরের মাথায় অয়ন আসা। কিন্তু একটা কথা সত্যি,স্বামী হিসেবে যাই হই,বাবা হিসেবে আমি খারাপ হতে পারিনি।
স্ত্রীর প্রতি আমার অনুভূতি যেমন -তেমন হলেও,ছেলেগুলোর জন্যে পাগল ছিলাম খুব। ওরা সারাক্ষণ বাবা বাবা করত। কাজের মধ্যেও ফোন করে করে মাথা খেয়ে ফেলতো। বাবা এটা আনবে,ওটা আনবে…
সার্থকে খুব বকতাম। কথা শুনতো না। সারাক্ষণ ক্রিকেট, ছোটাছুটি। তাই বাড়ি এলে ও দূরে দূরে থাকতো। তবে সায়ন -অয়ন সব সময় পারলে আমার বুকে ঢুকে যায়।
ওদিকে জেসমিনের সাথে আমার সম্পর্ক গাঢ় হচ্ছিল। যত দিন যাচ্ছে আমি অস্থির হয়ে পড়ছিলাম। তনিমাকে ছেড়ে দিলেও,ছেলেদের ছাড়া আমার চলবে না। কিন্তু জেসমিনকে বলব কী করে? ওর কাছে আমি এক অবিবাহিত পুরুষ,যে চাকরির জন্যে এখনো বিয়ের কথা ভাবেনি। অনেক দোটানা পার করে একদিন সাহস করে জানালাম,আমার তিনটে ছেলে আছে। ছোটোটা হওয়ার সময় স্ত্রী মারা যায়। জেসমিন প্রথমে দুঃখ পেলেও,পরে আর মনে রাখেনি। সহাস্যে বলেছিল,
“ ওরা তাহলে এখন আমারও ছেলে।”
এদিকে
আমি শুধু ছুঁতো খুঁজছিলাম তনিমাকে ছেড়ে দেয়ার। কিন্তু ও এত পতিব্রতা স্ত্রী,আমাকে কোনো সুযোগই দিচ্ছিল না। তাই একদিন ইচ্ছে করে ওর সামনে জেসমিনের সাথে ফোনে কথা বললাম। যাতে ওর সন্দেহ হয়। হলোও। ও সব ধরে ফেলল । ব্যাস,তুমুল ঝগড়া শুরু হলো আমাদের। আমি ইচ্ছে করে নাটুকে ভাঙাচোরা করলাম। যেন এখান থেকে গেলেই বাঁচি। গিয়ে ডিভোর্স নোটিশ পাঠাব,তারপর কোর্টে লড়ব ছেলেদের কাস্টডি নিয়ে। তনিমা যা নরম,ও আমার সাথে পেরে উঠবে না শিয়র ছিলাম এটুকু। নিজের সার্থসিদ্ধির জন্যে এতটা মরিয়া ছিলাম সেদিন,সায়নের অসুস্থতার কথা আমার মাথাতেই ছিল না। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় পা ধরে তনিমা খুব মিনতি করছিল। আমিতো আমি! একটা শয়তান। পাষণ্ডের মতো লাথি মেরে এক ঝটকায় ফেলে চলে গেলাম। মাঝরাতে ওর কল এলো। আমি তখন জেসমিনের সাথে। ভাবলাম মাফ চাইতে কল দিচ্ছে। ঘ্যানঘ্যান শুনব না দেখে লাইন কেটে ফোন বন্ধ করে দিলাম । কিন্তু যখন সাইফুল জানাল,সায়ন আর নেই…..
আমার পৃথিবী ভেঙে গুড়িয়ে গেল মাটিতে। সাইফুল সেদিন প্রথম আমাকে খুব খারাপ খারাপ কথা শোনাল। বলল,চরিত্রহীন বাবা থাকলে সন্তানদের কপাল এরকমই হয়। ওই কথাটা বিষের মতো গায়ে লাগল আমার। আমার ছোটো ভাই যে কখনো মাথা উঁচু করে কথা বলেনি,তার মুখে এসব?
এমনকি যে আব্বা আমাকে তুমি ছাড়া কখনো তুই বলেননি,সে আমাকে সেদিন ধাক্কা মেরে বললেন, তুই আমার ছেলে না। আম্মা বললেন, যে ইচ্ছে করে নিজের এত সুন্দর সংসারটাকে নষ্ট করে দেয়, অমন ছেলে আমি পেটে ধরতেই পারি না। আর তার চাইতেও বড়ো ধ্বংস ছিল আমার সায়নের লাশ। ও দেখতে সার্থর মতোই রাজপুত্র ছিল জানিস। ওদের মুখের গড়ন প্রায় এক। শুধু ইয়াসিরের থেকে ও একটু খাটো। অথচ ওইদিন কেমন ফ্যাকাশে, ঠোঁটটা নীল,নাকের ডগায় রক্ত নিয়ে কাফনে মোড়া অবস্থায় খাটিয়ায় পড়ে ছিল ছেলেটা। আমার বাউন্ডুলে, বাড়ি মাতানো সার্থও পাথর হয়ে বসেছিল। বাড়ি ঢোকা মাত্রই বাঘের মতো তেড়ে এলো আমার দিকে।
বলল, আমি ওর বাবা না।
আর তনিমা… ওতো নিজের মাঝেই ছিল না তখন। আব্বা আমকে খাটিয়া ধরতে দিলেন না। বলছিলেন, তুই অপবিত্র, তুই সর। সবার সাথে মাটিও দিতে দেয়নি। যখন কবর ফাঁকা হলো,তখন এক মুঠো মাটি দিতে পারলাম। এই সব কিছু আমাকে নির্মম ভাবে ভেঙেচূরে শেষ করে দিলো। সায়নের কবরে মাটি দেয়ার সময় কাঁটায় কাঁটায় উপলব্ধি করলাম,আমার ভুল আমার পাপ,আমার অন্যায়।
ওইদিন আকাশ-বাতাস ভেঙে কেঁদেছিলাম আমি। হাহাকার করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইছিলাম। তনিমা তো আমাকে কোনোদিন অসুখী রাখেনি। উঁচু স্বরে কথাও বলেনি কখনো। ও যখন ইন্টারমিডিয়েটের ফাইনালে বসবে, তখন ও প্রথম কনসিভ করে। আমি শুনেই বলেছিলাম,বাচ্চা রাখতে হবে না, পড়াশোনা করো। কিন্তু ও তা করেনি। পড়া ছেড়ে দিলো। তারপর নিজের পুরোটা বিলিয়ে দিলো আমার সংসারে। আমি কতক্ষণই বা থাকতাম এখানে? পুরোটা সময় একা হাতে তিনটে ছেলেকে বড়ো করেছে ও। আর আমি ওকে কী দিলাম? প্রতারণা, বিশ্বাসঘাতকতা?
সেইদিন সায়নের কবর ছুঁয়ে শপথ নিলাম,যা করেছি করেছি। একজনকে হারিয়েছি ব্যস,আর না। সব ছেড়ে এবার নতুন করে বাঁচব। সংসারে মন দেবো। ভালো বাবা হওয়ার সাথে ভালো স্বামী হবো এবার।
গোরস্থান থেকে বেরিয়ে জেসমিনকে ফোন করলাম। বললাম,আমাকে ভুলে যেতে। সব সত্যি স্বীকার করে ক্ষমাও চাইলাম। কিন্তু জেসমিন ব্যাপারটা মেনে নিতে পারল না। ওইসময় কিছু না বললেও,পরদিন জানাল ও দেড় মাসের অন্ত্বঃসত্তা। আমি ধরেই নিলাম,কথাটা মিথ্যে। হয়ত বা আমাকে ফেরানোর জন্যে মিথ্যে বলছিল। রাগারাগি করে বলে দিলাম,
“ বাচ্চা থাকলে নষ্ট করে ফেলো। তাও আমাকে জ্বালিও না।”
তুশি প্রশ্ন করল মাঝপথে,
“ আর যদি জানতেন কথাটা সত্যিই ছিল,তাহলে কী করতেন? ওনাকে বিয়ে করে বড়ো মাকে ছেড়ে দিতেন?”
শওকত থম ধরে রইলেন দু পল। শেষে বললেন,
“ জানি না কী করতাম! বড়ো জোর সন্তানের দায়িত্ব নিতাম হয়ত। কিন্তু জেসমিনকে মেনে নেয়া আর সম্ভব ছিল না।
আমার কাছে দুটো অপশন ছিল,হয় ও নাহয় আমার সংসার। আর আমি আমার ছেলেদের ছাড়ার কথা ভাবতেও পারি না।
তবে ওই বাচ্চাটা আমার জন্যে নষ্ট হয়নি। হয়েছিল ওর কারণে। ও আধুনিক,ড্রিংক করতো প্রায়সই। খবর নিয়ে জানতে পেরেছিলাম,মদ খেয়ে আমার ওপর জেদ মেটাতে অনেকগুলো স্লিপিং পিলস খেয়েছিল। হাসপাতালেও ছিল দুদিন। বাচ্চাটা তাতেই নষ্ট হয়েছে। আর সেই রাগ পুষিয়ে নিতে ও বেছে নিয়েছিল সাইফুলকে।
একটু থামলেন শওকত। দম নিয়ে বললেন,
“ জেসমিনকে আমি সত্যিই ভালোবাসতাম। কিন্তু আমার ছেলেদের ভালোবাসতাম তার চেয়েও হাজারগুণ বেশি। সায়নের পর আর কাউকে হারাতে চাইনি দেখে তনিমাকে নিয়েই বাকিজীবন কাটানোর সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলাম আমি। একজন ভালো স্বামী হয়ে পাশে থাকার চেষ্টা করলাম ওর। কিন্তু জেসমিন এত সহজে চুপ করল না। সাইফুল যে ওকে ফোনে গালাগাল দিয়েছে আমি জানতাম না। একে আমার ওপর ক্ষিপ্ত,তার ওপর ওর গালাগালি,আবার সবে সবে একটা বাচ্চা হারিয়ে ও প্রচণ্ড প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠল।
আয়াকে দিয়ে তোকে চুরি করাল। সুপাড়ি দিয়ে তোকে মারতে পাঠাল। আর এই সবটা যখন আমাকে ফোন করে বলল,আমি একটা লাশের মত নিস্তব্ধ হয়ে পড়লাম। মাথায় আকাশ ধ্বসে পড়ল আমার। বুঝতে পারছিলাম না, কী করব? বাড়িতে বলব কী করে? তনিমা সবে ছেলে হারানোর ট্রমা থেকে উঠেছে। সার্থ তো আমার ধারেকাছেই আসছিল না। বাবাও ঠিক করে কথা বলতেন না। সাইফুল, রেহণুমা ওরা তো সব জানলে থুথু দেবে আমাকে। তখন আমার সব শেষ হয়ে যাবে। আমি নিঃস্ব হয়ে যাব।
তাই সার্থপরের মতো পুরো সত্যিটা গিলে ফেললাম। ভাবলাম,বাচ্চাটাতো মরেই গেছে। ও তো আর ফিরবে না। তাহলে চুপ করে থাকলে ক্ষতি কীসের?
কিন্তু জেসমিনের ওপর থেকে আমার রাগ গেল না। ওর শত্রুতা আমার সাথে,বোঝাপড়াটাও আমার সাথেই করতো..
কিন্তু ও একটা নিষ্পাপ বাচ্চাকে টেনে আনল মাঝে। জেসমিনের বাবা-মায়ের সেপারেশন চলছিল। ওর বাবা বিদেশে থাকতেন। ও এখানে পড়তো। একাই থাকতো ফ্ল্যাটে। ভাবলাম বাড়ির ঝামেলা মিটলে ওর একটা বিহিত করব। কিন্তু তার আগেই খবর পেলাম,ও আত্মহত্যা করেছে। অথচ আমার কথা কোথাও লিখে যায়নি। একটা ছোট্ট চিরকুটে শুধু লিখেছিল- আমার মৃত্যুর জন্যে কেউ দ্বায়ী নয়। এই ব্যাপারটা আমাকে পুরো ঘেটে দিলো। অনুশোচনার আগুনে দাউদাউ করে পুড়ে গেলাম আমি। মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগতো। বুক ভার হয়ে আসতো। ছটফট করতাম। কিন্তু কাউকে কিচ্ছু বুঝতে দিতাম না। আর তার কিছুদিন পরেই
সার্থ সব জেনে গেল।
আমি ভয় পেলাম, এবার সবাইকে বলে দেবে ও। অথচ আমার ওইটুকু ছেলে কী ভেবে যেন আর কাউকে কিচ্ছু বলল না। উলটে আমার সাথে ওর যোজন যোজন দুরুত্ব তৈরি হলো। আমার সাথে কথা বলা তো দূর,আমার টাকায় পড়বে না দেখে লেখাপড়াই ছেড়ে দিলো। সবাই ভেবেছিল,ভাইয়ের মৃত্যুর জন্যে রাগ করে এমন করছে। সাইফুল ধরেবেঁধে,নিজের টাকায় ফি’স জমা করে ওকে এক্সামে বসাল। বলল,আচ্ছা বাবার টাকায় না পড়লেও আমার টাকায় তো পড়বি? তাহলে তাই পড়। কিন্তু আমি জানতাম,ওর এত ঘৃণার উৎস কোথায়! দিনের পর দিন ওর ওই অবজ্ঞা,ওই নীরব ঘৃনায় আমি অঙ্গার হতে থাকি। প্রতি প্রহর জ্বলতে জ্বলতে ছাই হয়ে যাই। এপাশ ফিরলে দেখি রেহনূমা ওর মেয়ের জন্য কাঁদছে,ওপাশ ফিরলে দেখি তনিমা কাঁদছে সায়নের শোকে। সামনে তাকালে ভাইয়ের ছলছলে চোখ দেখি। পিছু ফিরলে দেখি সার্থর উগড়ে দেয়া বিদ্বেষ। আমি দিশাহারা হয়ে পড়লাম৷ মরে যাচ্ছিলাম ভেতর ভেতর।
তুশি, মানুষের জীবনের সব থেকে ভয়ানক জিনিস কী জানিস? তার বিবেক। ও না একটা বিষধর সাপ পোষে। যার দংশনের বিষ এত তীব্র, এত মারাত্মক। ও একবার কামড়াতে শুরু করলে আর নিস্তার দেয় না। ছোবল দিতে দিতে তোর গায়ের চামড়া অবধি ঝলসে দেয়। আমার সাথেও ঠিক তাই হচ্ছে। দিনের পর দিন গুমড়ে ওঠা ব্যথায় আমি ক্ষয় হয়ে যাচ্ছি। জেসমিন আমার জন্যে মরেছে। সায়নও আমার ভুলের শাস্তি পেলো। তনিমা, সার্থ,রেহনূমা সাইফুল এমনকি তুইও আমার জন্যে ভুগেছিস। কত পাপী আমি। নিজেকে মেরে ফেলা ছাড়া
এই পাপের কী ক্ষমা আছে? বিশ্বাস কর আমি খুব ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। আর পারছি না আমি। আর না…
শওকত ছোট বাচ্চাদের মতো শরীর ভেঙেচুরে কাঁদছেন। তুশির সব রাগ গলে জল হয়ে গেল। চোখের পানি নেমে এলো গালে। সন্তান কাঁদলে মায়েরা যেমন করে? ঠিক তেমন করে ভদ্রলোকের গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“ বাবা শান্ত হন। কাঁদবেন না। আপনি তো আপনার ভুল বুঝতে পেরেছেন। ভুল বুঝে তওবা করলে আল্লাহও ক্ষমা করে দেন। সেখানে মানুষ আপনাকে ক্ষমা করবে না?”
শওকত কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
“ না রে মা, আমার এত জঘন্য পাপের বোধ হয় ক্ষমা পাওয়া হবে না। তুশি, তুই বরং আমাকে মেরে ফেল। আমার নিজেকে খুব ঘেন্না লাগে। খুব অসহ্য লাগে আমাকে।”
“ মৃত্যু যদি সমাধান হতো,তাহলে তো আয়ু বলে কোনো কথাই থাকতো না৷ বাবা,আমি আপনাকে বলছি আপনি যেভাবে অনুতপ্ত,আপনার চোখে আমি যে অনুশোচনা দেখছি এর একটুখানি দেখলেও আপনার ছেলে আপনাকে ক্ষমা করে দেবে।”
শওকত মুখ তুলে চাইলেন।
“ ও তোকে বলেছে এ কথা?”
তুশি চিবুক নামিয়ে মাথা নাড়ল দুপাশে। ভদ্রলোক নীরস হেসে বললেন,
“ আমি জানি ও আমাকে কখনো মাফ করবে না। আর কখনো বাবা বলে ডাকবে না আমাকে। এসবই বলেছে,তাই ত?”
“ না। তা বলেনি। শুধু বুঝিয়েছেন উনি আপনাকে এখনো খুব ভালোবাসেন! ”
“ সত্যি?”
“ হু। আপনি চান না ওনার সাথে আবার সেই আগের মতো হতে?”
শওকতের কণ্ঠে উদ্বেগ। বললেন,
“ চাই তো। খুব চাই। অনেক ইচ্ছে করে ওকে একটু জড়িয়ে ধরব, কপালে চুমু খাব। গর্ব করে বলব,আমার ছেলে। কিন্তু…
আচ্ছা তুশি, তুই একটু ওকে বলবি আমাকে ক্ষমা করে দিতে? একটু বোঝাবি যে আমি..আমি…”
শওকত আর বলতে পারলেন না। কাঁদলেন ঝর্ণার মতো।
তুশি চুপচাপ সেই কান্না দেখল। নিজের চোখ মুছে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবল,
“ আমি বললেই কি উনি শুনবেন? যার কাছে গোটা আমারই কোনো গুরুত্ব নেই,তার কাছে আমার কথার গুরুত্ব আদৌ থাকবে?”
নাস্তার টেবিল আজ জমজমাট। খেতে খেতে সবার বিস্তর গল্প চলছে। নাসীর আর সাইফুলের বয়স কাছাকাছি। তাই একসাথে হলেই খুব জমে যায়। আজ জয়নবও এসে ভিড়েছেন। বাড়িতে আজ গতানুগতিক পরোটা ছাপিয়ে গরম গরম লুচি আর আলুর দম তৈরি হয়েছে । আইরিন হাই তুলতে তুলতে এসে বসল। বৃদ্ধা শুধালেন,
“ তোমার মা ওঠেনি?”
“ না।”
নাসীর বললেন,
“ ওর চিন্তা করবেন না, আম্মা। ও বারোটার আগে উঠবে না।”
তনিমা হাসলেন,
“ জার্নি করে এসেছে, ঘুমাক। ক্লান্ত বোধ হয়।”
অয়ন পটাপট কতগুলো লুচি শেষ করে ফেলল। চিবোতে চিবোতে বলল,
“ ছোটো মা,ইউ আর আমেইজিং। আলুর দমটা এত জোশ হয় তোমার।”
রেহনূমা গদগদ কণ্ঠে বললেন,
“ আরেকটু দেই?”
দুজনের এত খাতির-যত্ন দেখে ইউশা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অয়ন ভাই ওকে ভালোবাসে না,আবার তুশিও ওনাকে ভালোবাসে না। সব দিক থেকে লস তাহলে ওনারই হলো। সাথে মিস করে ফেলল মায়ের হাতের জামাই আদর। একজন ডাক্তার মানুষ এত বোকা, এমন আহাম্মক হয়? যেটা খুব সহজে পাওয়া যেত, সেটা ফেলে অন্য থালায় মুখ দিতে চায়? অসহ্য! তিতিবিরক্ত ইউশা মাথা নুইয়ে অয়নের উদ্দেশ্যে ভেংচি কাটল একটা।
তক্ষুনি শব্দ তুলে ওপর থেকে নেমে এলো ইয়াসির। চুপচাপ এসে চেয়ার টেনে বসল। তনিমা বেশ অবাক হলেন। এক পল মুখ দেখলেন রেহনূমার। জিজ্ঞেস করলেন,
“ তুই নাস্তা করবি?”
ইয়াসির উপুড় করা প্লেটটা সোজা করে নিজের সামনে রাখল। বলল খুব গাম্ভীর্যের সাথে,
“ নাহলে এসে বসেছি কেন?”
তনিমা আর কথা বাড়ালেন না। মনটা কাল রাত থেকে ভালো নেই। ছোটো বারবার জানতে চাউছে,সার্থ কি বলল? কাজের ছুঁতো দিয়ে বারবার কথা এড়িয়ে যাচ্ছেন তিনি। এছাড়া আর কী জবাব দেবেন? বেচারি কত আশা করে বসে আছে,সার্থকে পাকাপোক্ত ভাবে নিজের মেয়ের জামাই বানাবে। ইস,খুব কষ্ট পাবে শুনলে।
তনিমা চুপচাপ ছেলের থালায় খাবার বেড়ে দিলেন। সাইফুল বললেন,
“ তোর কি শরীর খারাপ সার্থ?
থানায় যাবি না আজ?”
“ যাব,পরে।”
এরপর কেউ আর কোনো কথা বলল না। রেহনূমা, কয়েক বার মিন্তুর নাম ধরে ডাকলেন। সে নবাব এখনো খেতে আসেনি।
তারপর ডায়নিং টেবিলের ওইটুকু জায়গায় দফায় দফায় চোখাচোখি শুরু হলো। আইরিন বারবার ইয়াসিরকে দেখছে। হাফ হাতা টিশার্ট পরলে সার্থ ভাই ওর চোখে প্রিন্সের মতো। ফরসা পেশিবহুল বাহু দুটো কী চমৎকার লাগে! এদিকে ইউশা চেষ্টা করেও তার পুরোনো অভ্যেস ছাড়তে পারছে না। চোখজোড়া ঘুরেফিরে অয়নের মুখে পড়ছে। অথচ সে মানুষ? গলা উঁচিয়ে উঁচিয়ে দেখছে স্টোর রুমের দিকে। শেষে জিজ্ঞেস করেই বসল,
“ তুশি কোথায় বলত ইউশা,এখনো আসছে না কেন?”
তার প্রশ্নে অধৈর্য চিত্তটা স্পষ্ট বোঝা গেল। ইয়াসির তখন মন দিয়ে খাচ্ছে। হাতটা থামল একটু। ঠাড়, ঠান্ডা চোখ তুলে একবার দেখল অয়নকে। তার ধ্যান-জ্ঞান এখানে নেই। উৎসুক চোখে ওদিকেই চেয়ে। ইউশা জানতো এই প্রশ্ন তাকে শুনতে হবে। তৈরিই ছিল।
ছোটো স্বরে জানাল,
“ চাচ্চুর ঘরে খাবার নিয়ে গিয়েছে।”
“ ওহ।”
একটু সময় বাদেই হন্তদন্ত পায়ে নামল তুশি। অস্থির তার গতিবেগ। একেবারে এসে তনিমার সামনে দাঁড়াল। চোখ বড়ো বড়ো করে শুধাল,
“ কেক কীভাবে বানাতে হয়,বড়ো মা?”
তনিমা একটু চমকেছেন। তারপর
বিভ্রান্ত নজরে দেখলেন বাকিদের। সবার চোখে প্রশ্ন। অয়ন বলল,
“ কেক দিয়ে কী করবে?”
“ আমার মাথায় একটা ব্যাপার এসছে। ওটা পূরণ করতে হবে।”
সাইফুল বললেন,
“ তো অর্ডার করে আনি!”
“ না না আমাকেই বানাতে হবে। উফ বাবা,তুমি এসবে ঢুকো না। বড়ো মা তুমি বলো,কীভাবে বানাব? ইউশা তুমি বানাতে পারো?”
ইউশা উত্তর দিতে যাচ্ছিল,অধৈর্য মেয়েটা শুনল না। ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলল,
“ থাক গে,আমি দেখছি কীভাবে কী বানাতে হয়। উফ কত কাজ আমার!”
তারপর ছুটল সে। রান্নাঘরে ঢুকল দ্রুত।
ইউশা খাওয়া ছেড়ে তার পিছু পিছু চলল। সবাই একটু-আধটু অবাক হলেও,ভীষণ আশ্চর্য হলো ইয়াসির। কপাল কুঁচকে চেয়ে রইল তুশির যাওয়ার দিকে। তুশি এখানে আসার পর ও দুবার তাকিয়েছিল,অথচ ঐ মেয়ে একবারও ওকে দেখল না? একটা বারের জন্যেও না? আর চোখেমুখে এত আনন্দ,এত উল্লাস কীসের? কীসের এত আয়োজন!
তুশি রান্নাঘরে এসে আসমাকে পেয়েছে। চা জাল করছিল। ও এসেই প্রশ্ন করল,
“ এই তুমি কেক বানাতে পারো?”
হঠাৎ আওয়াজে মেয়েটা ভড়কে গেল। মাথা নাড়ল জোরে,
“ না।”
তুশি চ সূচক শব্দ করে বলল,
“ বেকারিতে কতবার দেখলাম! কিন্তু মনেই নেই। কী কী লাগে তাও জানি না।”
“ ছোটো খালায় বানাইছিল হেইদিন। ময়দা দিতে দেখছি।”
“ ভেরি গুড। ময়দা লাগবে তো। কিন্তু কোথায় ময়দা?”
আসমা ময়দার বৈয়াম বের করে দিল। তুশি এক খাবলা তুলে রাখল গামলায়। তারপর
বলল,
“ কিন্তু ময়দা তো সাদা। কেক তো দেখতে অন্যরকম হয়।”
আসমা বলল,
“ হয়,হলুদ রং হয়।”
“ হুম্ম, তাহলে একটু হলুদ আর একটু মরিচ দিতে হবে।”
“ হয়, লাগলে জিরার গুড়িও দেবেন,ঘ্রান করব।”
“ আরে বাহ,তোমার মাথায় তো অনেক বুদ্ধি। ইউ ইনটোলিজেন লেডি,ইউ হেল্প মি। ওকে?”
প্রথম লাইনটুক ধরেই লাজুক হাসল আসমা।
“ আমার আব্বায়ও কইতো, আমার অনেক বুদ্দি।”
“ আচ্ছা,এবার আমাকে ফটাফট তাহলে মশলা গুলো দাও।”
আসমা হাতের গতি বাড়াল। ইউশা এলো তখনই। ব্যস্ত তুশির কনুই টেনে একেবারে নিয়ে এলো এপাশে। ও চমকে বলল,
“ আরে কী হলো?”
ইউশা ফিসফিস করে বলল,
“ কী করছো তুমি? সকাল সকাল কেক বানাচ্ছ কেন?”
“ কেন,কেক কি বিকেলে বানাতে হয়?”
“ উফ,আমি বলতে চাইছি এখন কেকের ভূত মাথায় চেপেছে কেন?”
তুশি হাসল। চোখ নাঁচিয়ে নাঁচিয়ে বলল,
“ হুহু মানুষ সব সময় আনন্দের দিনে কেক কাটে। কাউকে কখনো দুঃখ পেলে কেক কাটতে দেখছ?”
“ না। এমনটা আবার কে করবে?”
“ এই যে,আমি। দি এসকুলুসিভ সেলবিরিটি তুশি। মুহাহাহহা!”
ইউশা তাজ্জব হয়ে বলল,
“ মানে?”
“ মানে আমি আমার কষ্টটাকে সেলবেট করব ইউশা। গত কাল রাত বারোটার পরে উনি আমাকে রিজেট করলেন না? তাই আজ দিনের বেলা কেক কাটব। শুধু আজ না,এরপর প্রতি বছর যখনই এই দিন আসবে, প্রতিবার আমি একটা করে কেক কাটব। তুমি হাত তালি দেবে আর বলবে,
“ হ্যাপী মন ভাঙা ডে ফর তুশি…বুঝেছ?
এখন বিরক্ত কোরো না। খুব ব্যস্ত আমি।”
ও চলে গেল। ইউশা হতভম্ব হয়ে ভাবল,
“ এ মেয়ে কি পাগল? মন ভাঙার আবার সেলিব্রেশন হয়?”
তুশি কেক বানাতে গিয়ে বিপাকে পড়েছে। একেবারে কব্জি ডুবিয়ে ফেলেছে ময়দায়। আসমাও কিছু বুঝতে পারছে না। রেহনূমা ওর সামনেই সেদিন দু দুটো কেক বানাল কিন্তু ওর কিচ্ছু মনে নেই।
সে ভদ্রমহিলা রান্নাঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ দেখলেন তুশির কাণ্ড। মেয়ের হিমশিমে দশা দেখে মনটা উশখুশও করছে। কিন্তু কিছু বললেই যদি রেগে যায়। তুশি তখন মরিচের কৌটোয় হাত দিলো। ব্যাটারে ঢালতে দেখে রেহণুমা আঁতকে বললেন,
“ এই এই কেক বানাতে মরিচ লাগে না।”
তুশি ফিরল ঘাড় ঘুরিয়ে। মাকে দেখে মুখখানা থমথমে হলো। অথচ একটু থমকে কৌটো আটকে সরিয়ে রাখল পাশে। এরপর হলুদ নামাল। চামচে তুলে ঝিম মেরে রইল। যেন জানতে চাইছে এটা দেবো?
রেহনূমা হেসে কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। বললেন,
“ হলুদও লাগে না।”
তুশি ঠোঁট টিপে চুপ করে আছে। উনি বললেন,
“ আমি বানিয়ে দিই?”
মুখে কিছু না বললেও,গামলাটা মায়ের দিকে এগিয়ে দিলো তুশি। রেহনূমার খুশিতে ঠোঁট ভরে গেল। ত্রস্ত হাত দিলেন কাজে। মায়ের ওই প্রজ্জ্বল মুখশ্রীতে কিছু পল চেয়ে রইল তুশি। ওর খুব কষ্ট হয় মায়ের থেকে দূরে দূরে থাকতে। ছোটো থেকে আল্লাহর কাছে ও যদি কখনো কিছু চাইত,তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল একটা মা।
মা কেমন, কেমন তাদের শরীরী গন্ধ এখনো সে ঠিক করে জানে না। ভীষণ ইচ্ছে করে জানতে। মায়ের কোলে মুখ গুঁজে ঘুমাতে। কিন্তু কিছু অভিমান,কিছু রাগ আষ্ঠেপৃষ্ঠে ঠেসে আছে তাকে। ওরা যে এখনো প্রচণ্ড নারাজ মায়ের ওপর!
তুশির হঠাৎ মনে পড়ল দাদির কথা। ইস,দাদি তো এখানে একা পড়ে গেছে। নিজের দুঃখে ওর কোনোদিকে খেয়াল নেই। আচ্ছা তখন খাবার টেবিলে কী ছিল?
তুশি চটজলদি রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এলো। তক্ষুনি হাওয়ার গতিতে ছুটে নিচে নামল মিন্তু। প্রফুল্ল গলায় চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে বলল,
“ আমি পাশ করেছি,আমি পাশ করেছি। আব্বু,আম্মু,বড়ো মা,দিদুন সবাই মিষ্টি আনাও,আমি পাশ করেছি।”
নাস্তা শেষে সবাই চা খাচ্ছিল। তাকাল এত চ্যাঁচামেচি শুনে। মিন্তুর মুখে হাসি ধরছে না। যেন মাত্রই একটা শিরোপা জিতে এসেছে। জয়নব গদগদ হয়ে বললেন,
“ আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ!”
ইউশা নাকমুখ কুঁচকে বলল,
“ কীসের আলহামদুলিল্লাহ? এই, মে মাসে তোর আবার কী পরীক্ষা গেল,যে ভাল্লুকের মতো লাফাচ্ছিস?”
“ তুই চুপ কর। তোকে বলেছি?”
অয়ন বলল,
“ কিন্তু তুই কীসে পাশ করেছিস মিন্তু? এখন তো বছরের মাঝামাঝি,ফাইনাল হলো কবে?”
“ আরে ভাইয়া ফাইনাল না তো। গত সপ্তাহের ক্লাস টেস্ট গেল,ওটাতে পাশ করেছি।”
সকলের উদ্বেগ নেতিয়ে গেল। ইউশা দু ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“ ক্লাস টেস্টে পাশ করে এত লাফালাফি?”
নাসীর হেসে হেসে শুধালেন,
“ তা কত মার্ক্সের মধ্যে কত পেলে?”
মিন্তু বুক টানটান করে বলল,
“ ১০০র মধ্যে ৩৩ পেয়েছি আঙ্কেল।”
নাসীর উদ্দিন একটা আওয়াজ করে মুখের চা বের করে দিলেন। একটু থমকালেও, পরপরই হুহা করে হেসে উঠল সবাই। মিন্তুর মুখটা কালো হয়ে গেল। সাইফুল হতাশ গলায় বললেন,
“ এই মার্ক নিয়ে তুমি আবার মিষ্টির কথা বলছো? তুমি জানো তোমার অয়ন ভাই সব সময় প্রতি সাব্জেক্টে ৯-এর ঘরে নম্বর পেত। তোমার মেজো ভাইয়া,সব সময় লেটার মার্ক্স পেত আর ইউশা…”
তুশি কথা টেনে নিলো,
“ থাক না বাবা, ছোটো মানুষ!
যা পেয়েছে তাই ভালো। এটুকু পেতেও তো কত কষ্ট হয়েছে তাই না? আমাদের এখন ওকে উৎসাহ দেয়া উচিত। এভাবে সবাই মিলে বললে ওর তো খারাপ লাগবে।”
মিন্তু খুশিতে এক লাফে গিয়েই জড়িয়ে ধরল ওকে।
আহ্লাদ নিয়ে বলল,
“ তুশিপু ইউ আর বেস্ট!”
ইউশা বলল,
“ এত আদর দিও না,তুশি। এটাকে তুমি এখনো ঠিক করে চেনোনি। লাই দিলে মাথায় উঠে নাচবে।”
মিন্তু অসহ্য হয়ে বলল,
“ এই তুই কি আগের জন্মে ঘষেটি বেগম ছিলি? আমি নিশ্চয়ই নবাব ছিলাম। এজন্যেই এত জ্বালাচ্ছিস।”
“ ইস, নবাবের কী ছিড়ি! তোর মতো ফেল্টু নবাব রাজ্যে থাকলে প্রজারা ঝাটা দিয়ে পেটাবে।”
মিন্তু উত্তর দিতে যাচ্ছিল,জয়নব দুহাত তুলে বললেন,
“ হয়েছে হয়েছে থামো এবার। সাইফুল,যা মিষ্টি নিয়ে আয়। মোটে ছেলেটা পাশ করতো না,তার চেয়ে ৩৩ পেয়েছে এই ঢেড়। যা।”
সাইফুল গাইগুই করলেন না। শ্বাস ফেলে উঠে এগিয়ে গেলেন টেলিফোনের দিকে। মিন্তু আগ্রহ নিয়ে বাবার পিছু ছুটল।
তুশি হাসছিল। উজ্জ্বল চোখদুটো হঠাৎ বর্তাল ইয়াসিরের ওপর। চা খাচ্ছে সে। এক হাতে কাপ,অন্য হাতে পত্রিকা। এখানে যা হচ্ছে তাতে আগ্রহ নেই। তুশি মরা চোখে চেয়ে রইল দু পল। জিভে ঠোঁট চুবাল,ঢোক গিলে ভেজাল শুকনো গলা। অথচ এক ফোঁটাও কমল না তার হাসি। ইয়াসির তাকাল হঠাৎ। দেখল তুশি অন্যদিকে চেয়ে।
ছেলেটা আর বসল না। কয়েক চুমুকে চা শেষ করে,রওনা করল ঘরে।
তখন অয়ন এসে তুশির পাশে দাঁড়াল। বলল,
“ তুমি জানো তুশি,তুমি খুব লাকি!”
“ কেন?”
“ মিন্তু কোনোদিন ক্লাস টেস্টে পাশ করেনি। এই প্রথম!”
তুশি হেসে ফেলল। চুল ঠিক করতে গিয়ে হাতের আটা একটু লেগে গেল গালে। অয়ন খেয়াল করতেই বলল,
“ তোমার গালে কিছু লেগেছে।”
তুশি ওই হাত দিয়েই অন্য গাল হাতায়। এবার লাগল সেখানে। জিজ্ঞেস করল,
“ এখানে?”
ব্যাপারটায় মজা পেয়ে অয়ন মাথা নেড়ে হাসে। দু গালে ময়দা মাখা মেয়েটাকে দেখতে দেখতে টিস্যু এগিয়ে দেয়।
তুশি হাতে নিয়ে ফের হাসল,
“ থ্যাংকিউ।”
অয়ন বুকে হাত দিয়ে বলল,
“ মাই প্লেজার।
তার চকচকে মুখটা থেকে ইউশা চোখ ফিরিয়ে নিলো।
হঠাৎ নজর পড়ল সিঁড়িতে। ইয়াসির ওপরে উঠতে গিয়েও দাঁড়িয়ে গেছে। কপালের ভাঁজ স্পষ্ট। সরু চোখজোড়া এদিকেই চেয়ে। ইউশা এক বার ওকে দেখল,একবার তুশিদের। অয়নের সাথে কথা বলতে বলতে হাসছে মেয়েটা। ইয়াসিরের মুখটা দেখে ইউশার দুঃখ উবে গিয়ে, কেন যেন হাসি পেলো খুব। চোখ ঘুরিয়ে ভাবল,
কাছে আসার মৌসুম পর্ব ৩৮
“ কোথাও কি কিছু পুড়ছে?”
ইয়াসির দু সেকেন্ড দাঁড়িয়ে ফের হাঁটা ধরল।
ঘরে গিয়ে ধড়াম করে আটকাল দরজাটা। থানায় পরে যাবে বললেও খসখসে হাতে কাবার্ড খুলে ইউনিফর্ম বের করল।
বোতাম আটকাল ফোস ফোস করে। দাঁত চেপে বিড়বিড় করল,
“ যেই আমি বললাম ভালোবাসি না, অমনি অয়নের সাথে হাসাহাসি শুরু হয়ে গেছে। ”