সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৫

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৫
জাওয়াদ জামী

” আরে কোকিলা নাকি! তোকে তো চেনাই যাচ্ছেনা। সবুজ শাড়িতে তোকে টিয়াপাখির মত লাগছে। শুধু ঠোঁটে লাল লিপস্টিক দিলেই টিয়াপাখির ফুল প্যাকেজ লাগত তোকে। ” কুহুকে কথাগুলো বলে এবার দৃষ্টির দিকে নজর দিল আনান।
” দৃষ্টি, তোকে তো জব্বর লাগছে রে। মনে হচ্ছে আজকে তোরই গায়ে হলুদ! এই তোর মতলব কি বলতো? ভালো ছেলে পেয়ে গেলেই কি তার গলায় ঝুলে পরার প্ল্যান করেছিস নাকি? আজকে চারপাশে অনেক হ্যান্ডসাম ছেলে দেখতে পাবি। কাউকে মনে ধরলেই আমাকে সিগন্যাল দিবি। আমি সেই ব্যাটার ঘাড় ধরে তোর সাথে বিয়ে করিয়ে দেব ”

” তোর কি এবার ঘটক হওয়ার সাধ জেগেছে রে, আনান? যে ছেলে এখন পর্যন্ত একটা মেয়ে পটাতে পারলনা, সে আবার করবে ঘটকালি! আগে নিজের জন্য একটা মেয়ে পটিয়ে দেখা, তাহলেই আমরা বুঝতে পারব, তুই দক্ষ ঘটক হবি একদিন। আর দৃষ্টি, এই ফটকার কথা শুনে তুই আবার কোন ছেলেকে পছন্দ করতে যাসনা৷ তুই এখনো আন্ডার সিক্সটিন। বাল্য বিবাহ দেয়ার অপরাধে আমরা জেলে যেতে চাইনা। ” তাহমিদ এবার আনানের কথায় বাগড়া দিয়ে বলল।
” আমাকে কি তোমার পাগল মনে হয়, ভাইয়া? আনান ভাইয়ার কথা শোনা মানে নিজের গলা নিজে কাটা। ভাইয়া কখন কি বলে সেটা সে নিজেও জানেনা। ”
” গুড। এভাবেই সব সময় আনানের বিপক্ষ দলের ভূমিকা পালন করবি। আর মাঝেমধ্যে আমার পক্ষে কথা বলবি। ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” আনান ভাইয়ার সাথে তোমার কিসের শত্রুতা, ভাইয়া? আনান ভাইয়াকে দেখি সব সময় তোমার পেছনে লাগে। আবার তুমিও সুযোগ পেলেই আনান ভাইয়াকে নাকানিচুবানি খাওয়াও? তোমাদের দু’জনের কেমিস্ট্রি বুঝতে পারিনা আমি৷ ”
” এতকিছু বুঝে তোর কাজ নেই। তোর কাজ মন দিয়ে পড়াশোনা করা। আর মাঝেমধ্যে আনানের বিপক্ষে কাজ করা। বাই দ্য ওয়ে, তোকে কিন্তু চমৎকার লাগছে। আরেকটা কথা, এখানের সবাইকে চিনতে পেরেছি কিন্তু বড়মার সাথের এই নারীকে চিনতে পারিনি। কে এই ভদ্র মহিলা? ”
তাহমিদের কথার ধরন শুনে হেসে উঠল দৃষ্টিসহ সকলেই। সকলকে হাসতে দেখে কুহু লজ্জায় কুঁকড়ে গেল। এই ছেলেটা যে ঠোঁটকাটা স্বভাবের সেটা বুঝতে পারল কুহু।

” এই তোরা থামবি? এত হাসাহাসি কিসের? আমার বাপ কুহুকে না-ই চিনতে পারে
তাই বলে তোরা এত হাসবি? এদিকে আয়, বাপ। এ কুহু। কায়েসের বড় মেয়ে। আর কুহু মা, এটা আমার বাপ। তোর তাহমিনা মামীর ছোট ছেলে। ঢাকা মেডিকেলে পড়াশোনা করছে। ”
আফরোজা নাজনীনের কথায় ছোট্ট করে মাথা নাড়ল কুহু। তাহমিদ অবাক হয়ে দেখছে কুহুকে। এবার ও কুহুকে চিনতে পেরেছে। কায়েসকে ও ভালোভাবেই চিনত। ওর সাথে ভালো সম্পর্কও ছিল। কুহুকেও ছোটবেলায় দু-একবার দেখেছিল তাহমিদ। কিন্তু বড় হওয়ার পর আর তার সাথে দেখা হয়নি। কায়েস চাচা বেঁচে থাকতে নিয়মিত ওদের বাড়িতে যেতেন। সাথে দৃষ্টি আর শিহাব থাকত।

” বাপ, আমি যাই। তোরা আনন্দ কর। কুহু মা, তুই এখানে থাক। এক কাজ কর নিহানের পাশে গিয়ে বস। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার আগে যদি চলে যাস, তবে আমি আবারও তোকে ধরে নিয়ে আসব। মনে থাকবে? ”
” থাকবে, মামী। ” কুহু কথাটা মুখে বললেও ওর ভয় হচ্ছে। বড়মা এখনো ওদেরকে দেখেনি। যখন দেখবে, তখন কি প্রতিক্রিয়া দেবে সেটা ভেবেই ভয় পাচ্ছে ও।
” কুহু, দৃষ্টি এদিকে আয়। ” নিহান ডাকল ওদের দুি বোনকে।

রাখী আক্তার স্টেজে কুহু, দৃষ্টি আর শিহাবকে দেখে রেগে গেলেও কিছু বলতে পারছেনা। তার ওপর ওদেরকে হলুদের পোশাকে দেখে সে আরও রেগে গেল। সে ভেবে পাচ্ছেনা পোশাকগুলো ওরা কোথায় থেকে জোগাড় করেছে। একবার ভাবল, স্টেজে গিয়েই কুহুকে জিজ্ঞেস করবে, পোশাকগুলো কোথায় পেয়েছে। কিন্তু কাজ করতে করতে সময় না পাওয়ায় জিজ্ঞেস করা হয়ে উঠলনা৷ কারো ডাকে ছুটে গেল রান্নাঘরে। সেখানে তার ভাবীদের দেখল।
” বড় ভাবী, মেজো ভাবী, তোমরা এখনও তৈরী হওনি? সবাই তৈরী হয়ে হলুদের আসরে গেছে। কিন্তু তোমরা এখনও রান্নাঘরেই আছ।
” আমরা তৈরী হয়েই আছি। তুমি আর নিয়াজ নিহানকে হলুদ মাখানোর পর আমরা সবাই ওকে হলুদ দেব। নিয়াজ কোথায়? ওকে ডেকে নিয়ে নিহানের কাছে যাও। ” আফরোজা নাজনীন খাবারের পাত্রগুলো চেইক করতে করতে বলল৷

” তৈরী হয়ে আছ মানে? তোমরা হলুদের শাড়ি পরবেনা? ”
” আমাদের বয়স হয়েছে। হলুদের শাড়ি না পরলেও চলবে। আজকে বাচ্চাদের আনন্দ করার দিন। ওরা আনন্দ করবে, আমরা দেখব। এটাই সবচেয়ে শান্তির বিষয়। ” তাহমিনা আক্তার আফরোজা নাজনীনের হয়ে জবাব দিলেন।
” তোমাদের বয়স হয়েছে বলেই কি শাড়ি পরা বারণ? আমি কত শখ করে সবার জন্য শাড়ি কিনেছি৷ আর তোমরা সেই শাড়ি না পরেই বলছ বয়স হয়েছে। তোমরা আমার ভাবী। তোমরা শাড়ি পরবে, আনন্দ করবে। কিন্তু সেটা না করে কিসব কথা বলছ! ”

” তুমি আমাদের জন্য শখ করে শাড়ি কিনেছ। কিন্তু কুহু, দৃষ্টির জন্য কেনোনি কেন? আর শিহাবের পাঞ্জাবি কোথায়? আমরা যদি এই বয়সে নিহানের হলুদের অনুষ্ঠানে শাড়ি পরতে পারি, তবে কুহু, দৃষ্টি কেন পারেনা? আমরা নিহানের মামী। কিন্তু ওরা তিন ভাইবোন নিহানের আপন চাচাতো ভাইবোন। নিয়াজের ভাইয়ের ছেলেমেয়ে। আমাদের থেকেও এই বাড়িতে ওদের অধিকার বেশি। তোমার ছোট ভাইয়ের ছেলে আসবেনা জেনেও ওর জন্য পাঞ্জাবি কিনেছ। আর শিহাব নিহানের বিয়েতে গ্রামেই থাকবে, তবুও তুমি ওর জন্য পাঞ্জাবি কেনোনি। এটা কেমন বিচার? তুমি হয়তো ভুলে গেছ, কায়েস তার ভাতিজাদের জন্য কি কি করেছে। তোমার জন্য কি করেছে। তবে আমি কিন্তু ভুলিনি। কায়েস প্রতিবছর আমার শ্বাশুড়িকে কাপড় দিত। আমাদেরকে দিত। আজ সেই কায়েসের ছেলেমেয়েরাই নিহানের বিয়েতে নতুন পোশাক পায়নি। এই তোমার দ্বায়িত্ববোধ? তুমি আজকের দিনে ওদের সাথে দ্বিচারিতা করতে পারলেো আমরা পারলামনা। তাই আমাদের শাড়ি ওদের দুই বোনকে পরতে দিয়েছি। ”
বড় ভাবীর কথাগুলো শুনে রাখী আক্তার ভড়কে গেল। সে অপ্রস্তুত হেসে বলল,

” ওদের জন্য কাপড় কিনতে ভুলে গিয়েছিলাম, ভাবী। ওরা সেটা জানে। তাই একটুও মন খারাপ করেনি ওরা। ”
” ওরা কায়েস আর আইরিনের সন্তান। মন খারাপ করলেও সেটা তোমার বোঝার সাধ্য নেই। হাজার কষ্ট পেলেও ওরা টু শব্দটি করবেনা। এটা আমি এই দুই দিনেই বুঝতে পেরেছি। আর কোন কথা নয়। হলুদের আসরে যাও। মেহমানরা সবাই চলে এসেছে। কতক্ষণ তাদেরকে বসিয়ে রাখবে? ”
বড় ভাবীর কথার ওপরে কথা বলার সাহস পেলোনা রাখী আক্তার। কারন সে জানে, তার ভাবী জেদী প্রকৃতির মহিলা। সেই সাথে তার প্রচন্ড আত্মসম্মানবোধ। সে যেটা বলে সেটা করেই ছাড়ে৷ অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়না কখনোই। বাধ্য হয়েই রাখী আক্তার ভাবীদের নিয়ে হলুদের আসরে গেল।

” একটু হাস, নিহান। মুখ গোমড়া করে থাকবি কতক্ষণ? ”
” তুমি তো জানোই ভাই, আমার এসব ভালো লাগেনা। এত মানুষজন, চ্যাঁচামেচি আমার পছন্দ নয়। ”
” ভালো না লাগলেও দুইটা দিন চোখ-কান বন্ধ রেখে এসব তোকে সহ্য করতেই হবে। তোর মনে রাখতে হবে, নিজের খারাপ লাগাকে এক পাশে ঠেলে দিয়ে অন্যের খুশির কারন হতে হবে তোকে। আগামী দুই দিন তোকে বলির পাঁঠার ভূমিকায় অভিনয় করতে হবে। ”
” তুমিও মজা নিচ্ছ, ভাই! অথচ তোমাকে আমি নিজের আইডল ভেবে এসেছি এতদিন। কিন্তু দিনশেষে তুমি আমার সাথে শত্রুর মত আচরণ করছ। ”
নিহানের কথা শুনে হাসল তাহমিদ।

” আমাকে শত্রু মনে হলেও তোর মাথায় রাখতে হবে, আমার কথায় ভুল কিছুই নেই। তুই বলির পাঁঠা আর বাকি সবাই তোকে ঘিরে উচ্ছাস করতে থাকা উৎসাহী জনতা। ”
” জ্ঞান দিচ্ছ? দাও৷ তোমার বিয়েতে তুমিও নিশ্চয়ই বলির পাঁঠাই হবে? আর আমরা উৎসাহী জনতারা সবাই আনন্দ করব। সেদিন বুঝবে কেমন লাগে। ”
” তোকে কে বলেছে আমি নিজেকে বলির পাঁঠা ভাবব! আরে আমি রাজ রাজাদের মত বহর নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে আসব। বিয়ের অনুষ্ঠানের মধ্যমণি হব আমি। তোরাই আমাকে ‘ মধ্যমণি ‘ উপাধি দিবি। ”
” তোমাকে আমরা ‘ মধ্যমণি ‘ উপাধি দেব! কেম্নে, ভাই? এই অধম বান্দাকে বুঝিয়ে বলবে? ”
” সময় আসলেই সবকিছু বুঝবি। আগে বুঝতে গিয়ে ব্রেইন ক্ষয় করার দরকার নেই। এবার মন খুলে হাস। বন্ধুদের সাথে হেসে ছবি তোল। পরিবারের সবার সাথে হাসিখুশি আচরন কর। ”

” এই মেয়ে, সাবধানে হাঁটতে পারোনা? আরেকটু হলেই তো পা ভাঙতে বসেছিল। যেটা পরতে পারোনা, সেটা পরার দরকার কি? ” তাহমিদ কুহুর হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে।
কুহু কাঁপছে। এই ছেলেটা না থাকলে আর ওর পা ভাঙত এটা নিশ্চিত। আগে কখনোই শাড়ি পরেনি। তাই ঠিকমত হাঁটতেও পারছেনা। একটা কাজে বাড়িতে গিয়েছিল। কাজ সেরে এ বাড়িতে আসতে গিয়ে সিঁড়িতে ওঠার সময় শাড়িতে পা বেঁধে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিল কুহু। তখনই তাহমিদ এসে ওকে ধরে ফেলে।
” আগে কখনোই শাড়ি পরিনি। তাই বুঝতে পারিনি। ” রিনরিনে গলায় উত্তর দিল কুহু।
” চেঞ্জ করে এস। ” কুহুর রিনরিনে গলা তাহমিদের মস্তিষ্কে জায়গা করে নিল। কুহুর গলার স্বর ওকে মুগ্ধ করেছে।
” জ্বি? ” কুহু তাহমিদের অধিকারবোধ দেখে অবাক হয়ে গেল।
” শাড়ি চেঞ্জ করে এস। শাড়ি যখন পরতে পারোনা, তখন পরতে গিয়েছিলে কেন? ” এবার একটু জোরেই বলল তাহমিদ।

” বড় মামী জোর করে পরিয়ে দিল যে। ” কুহু কৈফিয়ত দেবার মত করে বলল।
” তাহলে ঠিক আছে। এবার গিয়ে চেঞ্জ করে এস। আমি বড়মাকে বলব। ”
” ন..না ঠিক আছে। এরপর থেকে সাবধানে চলাফেরা করব। হাতটা ছাড়ুন। ” কুহু চায়না এই মুহূর্তে ঘটে যাওয়া ঘটনা কারো কানে যাক। বড়মা শুনলে ওকে কথা শোনাবে এটা নিশ্চিত।

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৪

” তোমার যা ইচ্ছা। সাবধানে যাও। ” কুহুর হাত ছেড়ে দিয়ে বলল তাহমিদ।
তাহমিদ হাত ছেড়ে দিলে কুহু শাড়ি ধরে সাবধানে হাঁটতে থাকে। গমনরত কুহুর দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে থাকল তাহমিদ। নিজের ডান হাতে ঠোঁট ছোঁয়াল। কুহুর হাত এই ধরেছিল সে।

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৬