সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ১০
জাওয়াদ জামী
” দৃষ্টি, আমরা আসছি, মা। শ্বাশুড়ির সাথে মিলেমিশে থাকবি। খবরদার পড়াশোনা রেখে কোন কাজ করতে যাবিনা। নিয়াজ, তোমরা কবে শহরের বাড়িতে যাচ্ছ? ” সাদিক আহমেদ রাশেদীন জিজ্ঞেস করলেন।
” তিন-চার দিনের মধ্যেই যাব, ভাইয়া। আগামী বৃহস্পতিবার থেকে ক্লাস নিতে হবে। ”
” দৃষ্টিকে তোমাদের সাথে নিয়ে যেও। ওর পরীক্ষার পরই আমরা ওকে ঢাকায় নিয়ে যাব। নিহানকে বল, ও যেন হোস্টেল ছেড়ে দিয়ে আমাদের বাসায় গিয়ে ওঠে। ”
” এটা করতে পারবনা, মামা। জানোই তো, তোমাদের বাসা থেকে ভার্সিটির দূরত্ব অনেক। প্রতিদিন বাসা থেকে ভার্সিটি দৌড়াতে দৌড়াতে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। ”
” তাহলে আর কি করা। তুমি নাহয় প্রতি বৃহস্পতিবার আমাদের বাসায় যেও। নাকি সেটাও পারবেনা? ”
” কেন পারবনা! খুব পারব। ”
” রাখি, দৃষ্টিকে দেখে রেখ। যখনই খাবে, ওকে সাথে নিয়ে খাবে। ওর যা যা প্রয়োজন সবকিছু ও যেন চাওয়ার আগেই পেয়ে। মনে রেখ, তুমি করছ না করছ সবকিছু আমি জানতে পেরে যাব। আল্লাহ তোমার পেটে কোন মেয়ে দেননি। তাই ছেলের বউকেই মেয়ে ভেবে তোমাকে চলতে হবে। তুমি বর্তমানে ওর সাথে যেরূপ আচরণ করবে, ভবিষ্যতে ও তোমাকে সেই আচরণটাই ফেরৎ দেবে। বিষয়টা মাথায় রেখে যা করার করো। ” আয়েশা সালেহা কঠিন গলায় মেয়েকে সাবধান করে দিলেন।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মায়ের কথা শুনে নীরব থাকল রাখী আক্তার। পরিবারের প্রত্যেকে তার বিপক্ষে চলে গেছে ভেবেই তার ভয় হচ্ছে।
” নিয়াজ, কুহু আর শিহাবের খোঁজ রেখ। তোমরা চলে গেলে মেয়েটা একা হয়ে যাবে। অতবড় বাড়িতে ছেলেমেয়ে দু’টো একা থাকবে, ভাবতেই আমার কেমন লাগে। ” তাহমিনা আক্তার আফসোস করে বললেন।
” খোঁজ রাখতে হবেই, ভাবী। আমি প্রতিবেশি এক চাচীকে ওদের কাছে থাকতে বলেছি। তিনিও রাজি হয়েছেন। চাচীকে দেখার কেউ নেই। তার ছেলেরা থেকেও নেই। চাচী ওদের সাথে থাকলে আমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারব। ”
” ভালো করেছ। রাতে অন্তত মেয়েটাকে একা থাকতে হবেনা। ”
” আম্মা, চলুন আমরা বেড়িয়ে পরি। এখন রওনা না দিলে ঢাকা পৌঁছাতে রাত হয়ে যাবে। আফরোজা তোমরা কুহুকে বলে এসেছ? ”
স্বামীর কথায় মাঝে নাড়লেন আফরোজা নাজনীন। তিনি শ্বাশুড়িকে ধরলেন। একে একে সবাই গাড়িতে উঠে বসলেন।
” বড়মা, আমি বোধহয় পাওয়ার ব্যাংক দৃষ্টিদের বাড়িতে রেখে এসেছি। একটু অপেক্ষা কর, আমি এক্ষুনি আসছি। ” তাহমিদ কারও উত্তরের অপেক্ষা না করে কুহুর বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল।
কুহু উঠান ঝাড়ু দিচ্ছিল। তখনই গেটে কেউ নক করল। ঝাড়ু রেখে গেট খুলে দিতেই দেখল তাহমিদ দাঁড়িয়ে আছে। কুহু কপাল কুঁচকে তাকাল।
” চলে যাচ্ছি। আবার কবে দেখা হবে জানিনা। মন দিয়ে পড়াশোনা কর। ঢাকার যেকোনো ভার্সিটিতে যেন ভর্তি হতে পার, সেভাবেই পড়াশোনা কর। আমার ফুপু যদি কখনো তোমাদের সাথে দূর্ব্যবহার করে, তবে সাথে সাথে মা অথবা বড়মাকে জানাবে। যেকোন প্রয়োজনে মা কিংবা বড়মাকে ফোন দিও। সেটাও যদি করতে না পার, তবে আনানকে জানিও। প্রয়োজন ছাড়া অযথাই বাড়ির বাহিরে যেওনা। সন্ধ্যার পর তো অবশ্যই নয়। শিহাবকে দেখে রেখ। ভালো থেক। ” কথাগুলো বলেই কুহুকে অবাক করে দিয়ে রাস্তার দিকে হাঁটতে শুরু করল তাহমিদ। হাঁটতে হাঁটতে প্যান্টের পকেট থেকে পাওয়ার ব্যাংক বের করে হাতে নিল।
তাহমিদের এতগুলো উপদেশ শুনে কুহু অবাক হয়ে গেল। ওর বুঝে আসলনা কেন তাহমিদ ওকে কথাগুলো বলল। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল, ঐ বাড়ির বাকি সকলের মতই তাহমিদও হয়তো ভয় পাচ্ছে। ও এতবড় বাড়িতে ভাইবোনদের নিয়ে একা থাকে, এটা সকলেরই ভয়ের কারন। এছাড়াও আছে অভাব-অনটন। যার সাথে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত কুহু। সবাই জানে কুহু কষ্ট করে সংসার চালায়। হয়তো তাহমিদও জেনে গেছে। তাই যাওয়ার আগে ওকে এসব বলে গেল। হঠাৎই কুহুর কান্না পেল। বাবা-মার মৃত্যুর পর থেকে তিনবেলা পেটপুরে খেতে পারেনি। তবুও কারও কাছে কখনোই হাত পাতেনি।
ভবিষ্যতেও না খেয়ে মরে গেলেও কারও কাছেই বলবেনা সে কথা। মায়ের মৃত্যুর পর আনান ভাইয়ার মামীদের মত করে কেউ ওদের ভালোবাসেনি। নিজের মামা-মামীও দায়সারাভাবে ওদের সাথে যোগাযোগ রেখেছে। ফোনে প্রতিদিনই ওদেরকে যেতে বলে। কিন্তু মামাবাড়িতে গেলেই মামীর মুখে শুনতে হয় তাদের অভাবের কথা। কিন্তু কুহু জানে, সেগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা। ওর নানা গরীব ছিলেননা। এখনো তাদের যথেষ্ট সম্পদ আছে। কুহু বুঝতে পারে, ওদেরকে ন্যায্য হিস্যা না দেয়ার জন্যই মামী সব সময় অভাবের নাটক করে। সবকিছু জেনে-বুঝেও চুপ থাকে কুহু। মরে গেলেও কারও কাছে হাত পাততে পারবেনা। এতটুকু আত্নসম্মান ওর আছে।
” দৃষ্টি, খেতে আয়। তোর তো আবার নিজের পক্ষের লোকজন আছে। তারা যদি শোনে, তোকে না খাইয়ে রেখেছি, তবে তারা আমাকে জেলে পুরবে। আমার ছেলের বউ হতে না হতেই আমার বাপের বাড়ির লোকজনকে হাত করে নিয়েছিস। তারা আমার থেকেও তোদের তিন ভাইবোনকে বেশি ভালোবাসছে দেখে আমি সত্যিই অবাক হচ্ছি। এমন কপাল আমার, নিজের আম্মাই এখন আমাকে হুমকিধামকি দিচ্ছে! ”
দৃষ্টি নিক্ষেপ অসহায় মুখভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছে ওর শ্বাশুড়ির অভিযোগ। সত্যি বলতে গেলে ওর ভিষণ হাসি পাচ্ছে। বড়মার বাবার বাড়ির সবাই যাওয়ার পর থেকেই বড়মা ওর সাথে ভালো করে কথা বলছে। এমনকি কুহু আর শিহাবের সাথেও তাই। দৃষ্টি বুঝতে পারছে বড়মা ভয় পেয়েছে তার পরিবারের সবার হুমকিতে। হঠাৎই দৃষ্টির মাথায় কুবুদ্ধি চাপল। ওর মন বলছে, সুযোগ যখন পেয়েছিস , তখন এই দজ্জাল মহিলাকে একটু জ্বালালে ক্ষতি কি? যেই ভাবা সেই কাজ। দৃষ্টি আলাভোলা চেহারা করে বলল,
” বড়মা, তুমি আমাকে বকছ! নানীমা বলেছেন, তুমি আমাকে বকা দিলেই যেন সাথে সাথে তাকে জানাই। সে তোমাকে বকে দেবে। আমি কি এখন নানীমাকে কথাটা জানাবো, বড়মা? নাকি নানীমা জিজ্ঞেস করলে তখন তাকে জানাব? ”
দৃষ্টির কথা শুনে বিষম খেল রাখী আক্তার। সে চোখ বড় বড় করে বিস্ময় নিয়ে তাকাল দৃষ্টির দিকে।
” কেন, আম্মাকে বলবি কেন? আমি তোকে কি এমন খারাপ কথা বলেছি যে সেগুলো আম্মাকে জানাতে হবে? আমার বাড়ির লোকজন যাবার পর থেকেই তোকে সাথে নিয়েই তিনবেলা খাবার খাই। তোকে নিয়ে শপিংয়ে গেছি। তোর পছন্দমত জিনিসপত্র কিনে দিয়েছি। তারপরও তুই আমার এই সামান্য কথাগুলো আম্মাকে বলে দিবি? ”
” হাজার হলেও নানীমা আমার গুরুজন। তিনি যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি আমার সাথে কোনরূপ খারাপ আচরণ করছ কিনা? তাহলে আমাকে তো সত্যি কথা বলতেই হবে। আমি কখনোই নানীমার সাথে মিথ্যা বলতে পারবনা। এমনকি মামীদের সাথেও নয়। সত্য আমাকে বলতেই হবে। সে যতই তেঁতো হোকনা কেন। তুমি আমাকে শপিংয়ে নিয়ে গিয়ে বলেছিলে, আমার জন্য কেনাকাটা করতে করতে তুমি ফকির হয়ে যাবে। সে কথাটাও আমি নানীমাকে বলে দিয়েছি। কথাটা শুনে নানীমা বলেছে, সুযোগ আসলেই তোমাকে এর জবাবদিহি করতেই হবে। ”
দৃষ্টির কথা শুনে চেয়ারে ধপ করে বসে পরল রাখী আক্তার। তার বুক ধড়ফড় করছে। সে ভাবছে, কথাটা শোনার পর আম্মার প্রতিক্রিয়া কেমন হয়েছিল? আর ঐ কথাটার জন্য আম্মা তাকে কি বলবে?
দৃষ্টি বাম ভ্রু উঁচিয়ে তাকিয়ে আছে বড়মার দিকে। বড়মা সত্যিই ভয় পেয়েছে। যদিও ও সেদিন শপিংয়ে গিয়ে বড়মার বলা কথাটা কাউকেই বলেনি। তাই বলে কি বড়মাকে একটু ভয় দেখাতে পারবেনা? ভয় থেকে যদি ভালো কিছু হয়, তবে দজ্জাল শ্বাশুড়িকে লাইনে আনার জন্য ভয় দেখাতে ক্ষতি কি?
” কি ব্যাপার রাখী, পক্ষাঘাতগ্রস্ত রুগীর মত বসে আছ কেন? তোমার কি হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক জাতীয় কিছু হয়েছে? ডক্টরকে ফোন দেব? ” নিয়াজ মাহমুদ ডাইনিং টেবিলের কাছে এসে স্ত্রীকে অস্বাভাবিকভাবে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন।
” তোমার মাথা হয়েছে। আমার হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক করে মরে গেলে তো তোমরা বেঁচে যাও। এই বাড়ির প্রত্যেকেই আমার শত্রু। যেখানে নিজের পেটের সন্তানরা পর্যন্ত আমার বিরোধিতা করে, সেখানে তুমি কোন আবদুল। তুমি তো আমার শত্রুদলের লিডার। এতদিন তিন বাপ ছেলের দল ছিল। এখন আবার তাদের পাল্লা ভারী হয়েছে। ছেলের বউ আরও এককাঠি ওপরে। ”
” বড়মা, তুমি আবারও আমাকে বকা দিচ্ছ। নানীমার সাবধান বানী কি ভুলে গেছ! ” কান্না জড়ানো গলায় বলল দৃষ্টি।
” আমার ভুল হয়েছে, বউমা। মাফ কর আমাকে। এখন দয়া করে খেতে আয়। তোর ক্ষুধা লেগেছে নিশ্চয়ই? ”
রাখী আক্তার দৃষ্টির হাত ধরে ওকে চেয়ারে বসালো। এরপর যত্ন সহকারে ওর প্লেটে খাবার বেড়ে দিল। ততক্ষণে নিহান, আনান চলে এসেছে। আনান অবাক হয়ে দেখছে, ওর মা ভালোবেসে দৃষ্টিকে খাওয়াচ্ছে। আনান বুঝল কাহিনী কি। মুচকি হাসল। কিন্তু মাকে খোঁচা মারার লোভ সামলাতে পারলনা।
” নারী তুমি কি? তুমি অভিনয়ে সেরা। সত্যিই নারী তুমি অভিনয়ে সেরা রে। ”
” ঐ নিমকহারাম ছেলে, মুখ বন্ধ করে খা। একটাও কথা বললে তোর মাথা আমি ফাটিয়ে ফেলব। নিমকহারামের গোষ্ঠী জুটেছে আমার কপালে। একেকটা কাল সাপ। ” রাখী আক্তার খেঁকিয়ে উঠল। সে বুঝতে পেরেছে আনান কথাগুলো তার উদ্দেশ্যেই বলেছে।
” আহ্ রাখী, কি শুরু করলে? একটু শান্তিতে খেতে দাও। বারবার কেন ভুলে যাও, এই নিমকহারামের গোষ্ঠীই তোমার কপালে লিখা ছিল। তোমাকে মনে রাখতে হবে, আমার গোষ্ঠী নিমকহালাল হলেও তুমিই আমার অর্ধাঙ্গিনী হতে। তাই আফসোস করোনা। তবে যদি চাও, কোন নিমকহালাল পরিবার দেখে গাট্টি বাঁধতে পার। আমরা কেউই তোমাকে বাঁধা দেবোনা। অন্তত এটা ভেবে আমরা খুশি হব, তুমি সুখী হয়েছ। তোমরা কি বল, আনান, নিহান? ” নিয়াজ মাহমুদ হাসিমুখে ছেলেদের জিজ্ঞেস করলেন।
” তোমার কথার সাথে আমরা একমত, আব্বু। আমরা আম্মুকে সুখী দেখতে চাই। ” দুই ভাই একসাথে বলল৷
” আমিও একমত, বড় চাচা। ” আগ বাড়িয়ে বলল দৃষ্টি।
সকলের কথা শুনে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইল রাখী আক্তার। সে কথা বলার ভাষা হারিয়েছে। তার ছেলেরাও যে স্বামীর এমন জঘন্য প্রস্তাবে সায় দেবে এটা তার কল্পনায়ও ছিলনা। অনেক চেষ্টার পর সে দৃষ্টিকে বলল,
” একমত হয়ে কোন লাভ নেই। ভেবেছিস আমি চলে গেলে তুই এই সংসারের কর্ত্রী হবি? সেটি হচ্ছেনা। আমি হতে দেবোনা। এই সংসার ছেড়ে আমি কোথাও যাচ্ছিনা। সে যতই তোরা নিমকহারামের বংশ হোসনা কেন। ”
সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৯
” তুমি সত্যিই যাবেনা! বড় চাচা, তোমার স্বপ্ন বোধহয় আর পূরণ হবেনা। ”
দৃষ্টির কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠল আনান। একে একে হাসতে শুরু করল নিহান আর নিয়াজ মাহমুদও। রাখী আক্তার অসহায় চোখে সকলের হাসি দেখছে আর রাগে গজগজ করছে। তবে সে তার রাগ প্রকাশ করতে পারলনা।