তাজমহল পর্ব ৪৪

তাজমহল পর্ব ৪৪
প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী

তাজদারের ঘুম ভাঙতেই কপাল আর পায়ে হালকা চিনচিনে ব্যথার টান অনুভব করলো। ধীরে ধীরে চোখ মেলে চারপাশটা দেখলো। বিছানার পাশের চাদর কুঁচকে আছে। সে হাত বুলিয়ে বুঝলো অনেকক্ষণ আগেই ঠান্ডা হয়ে গেছে। তার মানে শাইনা উঠে গেছে অনেক আগে।
আলসেমি ভরা ভঙ্গিতে আড়মোড়া ভেঙে তাজদার পা নামাল। ভারী শরীর নিয়ে ধীরপায়ে ওয়াশরুমের দিকে গেল। মুখে পানি ছুঁড়ে যখন সামান্য সতেজ হলো তখনই তার চোখ হঠাৎ থেমে গেল সিঙ্কের পাশে রাখা ছোট্ট বাক্সটার দিকে।

প্রেগন্যান্সি কিট!
চোখ বড় হয়ে গেল তার। চক্ষু ছানাবড়া! সাদা প্লাস্টিকের সরু দাগটার ওপরে স্পষ্ট লাল রেখা। বুকের ভেতর ঢাকের মতো বাজতে লাগলো তার হৃদস্পন্দন।
সে কি ভুল দেখছে? কপাল জুড়ে অদ্ভুত গরম লাগছে। দু’হাত ভরে বারবার পানির ঝাপটা দিল মুখে। শ্বাস দ্রুত ওঠানামা করছে।
পানির ফোঁটায় ভিজে যাওয়া চোখ মুছে আবার তাকালো সেই কিটটার দিকে। না… এটা কোনো ভ্রম নয়। এটা সত্যি। একেবারে স্পষ্ট লাল দাগ। চারপাশটা নিস্তব্ধ হয়ে গেল তার কাছে। কানে শুধু নিজের বুকের ভেতরের তীব্র ধকধক শব্দ হচ্ছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সে কিটটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর দ্রুত বেরিয়ে গেল ওয়াশরুম থেকে। ঘরের চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে থামলো টেবিলের দিকে। সেখানে নাশতার ট্রে রাখা আছে।
ট্রেটাতে সাজানো গরম দুধে ভেজানো ওটস, তার ওপর ছোট ছোট কাটা ফল আর ছড়ানো বাদাম। পাশে রাখা আছে হোল হুইট রুটি, সাথে সেদ্ধ ডিম আর টাটকা শসার টুকরো। তাজদার তিতলিকে ডাক দিল। কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর তিতলি এল। তাজদার রেগে জানতে চাইল,
“এতক্ষণ ধরে ডাকছি তোমাকে। এখন আসার সময় হলো? শাইনা কোথায়?”
“খাচ্ছে।”
তাজদার চিন্তিত মুখে ঘরে ঢুকে গেল দেখে তিতলিও চলে গেল। তাজদার চিন্তিত মুখে অল্প অল্প করে খেয়ে নিল। বেশ খিদে লেগেছে।

খাওয়ার ফাঁকে শাইনা ঘরে এসে কুঁচকানো বিছানাটা ঠিক করলো। তাজদার খাওয়া শেষ করে তার দিকে চেয়ে রইলো। শাইনা নাশতার ট্রেটা নিয়ে বেরিয়ে গেল। তাজদার কিছু বলতে চেয়েও আর পারলো না।
অনেকক্ষণ ঘরময় পায়চারি করার পর শাইনা ফের ঘরে এল। তাজদার তার মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করলো কিন্তু কোথাথেকে কথা শুরু করবে বুঝে উঠতে পারছেনা। শাইনা ওয়াশিং মেশিন থেকে কাপড়গুলো বের করে ভাঁজ করতে করতে ঘড়ির কাঁটার দিকে একবার তাকালো। তারপর আলমারি সামনে গিয়ে থামলো চাবিটা হাতে নিয়ে। চাবি মোচড় দিতেই তার হাতের উপর একটা হাত এসে থামলো। শাইনা থেমে গেল। তাজদার তাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে জড়িয়ে ধরে ফেললো। মাথাটা তার বুকের সাথে চেপে ধরে বলল,
“আমার কথাটা একবার শোনো প্লিজ।”

শাইনার নড়চড় নেই। পাথরের মতো জমে গেছে সে। শুধু চোখজোড়া কেমন জ্বলজ্বল করছে।
তাজদার কথা শুরু করবে তার আগেই শাইনা তাকে ছেড়ে দাঁড়ালো। চাবি মোচড় দিয়ে আলমারি খুলে সব কাগজপত্র বের করলো। তাজদারের সামনেই ভুয়া রিপোর্টগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিল। তাজদার এত কথা বললো শাইনা একটাও শুনতে পেল না।
রিপোর্টগুলো একটা একটা পুড়ছে। তাজদার বলল,”তুমি আমার সাথে কথা বলো। মমতাজ আমার কথাটা শোনো। আশ্চর্য!”
শাইনার মুখে কোনো কথা নেই। শুধু গাল বেয়ে জল পড়ছে। তাজদার অবাক হয়ে দেখলো সেখানে শুধু রিপোর্টগুলো নেই তার অনার্সে ভর্তি সংক্রান্ত যত কাগজপত্রও আছে। এমনকি পাশে কয়েকটা সার্টিফিকেটও। তাজদার সার্টিফিকেটগুলো সরিয়ে ফেললো। দাদীমা এসে বলল,”ধোয়া কীসের?”
তিনি দরজার কাছে এসে থেমে গেলেন। চোখ বড়ো বড়ো করে চেয়ে রইলেন। তাজদার শাইনার হাত থেকে কাগজপত্রগুলো কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। শাইনা দিচ্ছে না। তাজদার গর্জে বলল,
“এগুলো পুড়ে গেলে সমস্যা হবে। ছাড়ো। আমার কথাটা শুনতে বলছি। শাইনা?”
শাইনা একটা কাগজ শক্ত করে ধরে আছে। কাগজটা ছাড়ছেনা দেখে তাজদার হাত তুলতেই দাদীমা ছুটে এসে শাইনাকে আড়াল করে দাঁড়ালেন।
“দাদুভাই!”

তাজদার হাঁপিয়ে উঠে কান্নারত শাইনার দিকে তাকিয়ে হতাশ কণ্ঠে বলল,”আমি কি বলতে চাইছি ও সেটা শুনবে না? আমি এইসব কেন করেছি ওকে বুঝতে হবে না?”
গায়ে হাত তুলতে চাওয়ার পর থেকে শাইনার কান্নার বেগ আরো বেড়েছে। দাদীমা বললেন,
“কি হয়েছে আমাকে বলবে তো।”
তাসনুভা এসে আগুনটা নিভিয়ে দিয়েছে বাথরুম থেকে মগে করে পানি এনে। সে তখন কিটটা দেখেছে। রওশনআরাকে সেটা বলেছে।
রওশনআরা ঘরে এসে শাইনাকে বলল,”এখান থেকে চলো। কথায় কথা বাড়বে। চলো, এইসময় এভাবে কেঁদো না। শরীর খারাপ করবে। চলো।”

দাদীমা তাজদারকে বলল,”তোমার দাদা কোনোদিন আমার গায়ে হাত তোলেনি। তোমার বাবা কোনোদিন তোমার মায়ের গায়ে হাত তুলতে পারেনি। আর তুমি কি করতে যাচ্ছিলে?”
তাজদার চুপ করে রইলো। কিছুক্ষণ পর বলল,”তোমরা প্লিজ সবাই যাও এখান থেকে। ওর সাথে আমার কথা আছে। শাইনা আমার সাথে কথা বলো। তুমি এদিকে এসো।”
দাদীমা আর রওশনআরার পেছনে দাঁড়িয়ে কাঁদছে শাইনা। তাজদার সবার উদ্দেশ্যে বলল,
“তোমরা যাবে?”
রওশনআরা বলল,”ও অসুস্থ এটা মাথায় রাখবে।”
দাদীমা বললেন,”রাগারাগি না করেও কথা বলা যায়।”

উনারা বেরিয়ে যেতেই তাজদার শাইনার দিকে তাকালো। ধীরেধীরে সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তার হাতটা তুলে চুমু খেতেই শাইনা গা দুলিয়ে কেঁদে উঠলো। তাজদার তার হাতের তালু থেকে ঠোঁট তুলে বলল,”তোমার যদি মনে হয় আমি অনেক বড়ো অপরাধ করে ফেলেছি তাহলে আমাকে শাস্তি দাও। কিন্তু যা মনে আসে তা করে বসো না। আমার দিকে তাকাও। আমার সাথে কথা বলো। আমাকে বকো কিন্তু এভাবে চুপ থাকাটা আমি মানব না।”
শাইনা তার দিকে তাকালো না। তাজদার বলল,”আমি কেন তোমাকে মিথ্যে বলেছি তুমি একবার ভাবো। তুমি আমার সাথে যেতে চাইতে না। পরীক্ষা দিতে চাইতে না। আমি তোমাকে সাথে করে নিয়ে যাওয়ার জন্য এমনটা করেছি।”
শাইনা তার মুখের দিকে ভুলেও তাকালো না। কাঁদছে আর চোখ মুছছে। নিজের শর্তে নিজে হেরে যাবার ভয়ে তার মাতৃত্বকে কাজে লাগিয়েছে এই মানুষটা। নিজের ছোট্ট একটা শর্তের কাছে তার মাতৃত্বটা ঠুনকো মনে করেছে। তার কাছে জিতে যাওয়াটাই বেশি মনে হয়েছে।

আর সে তার সব স্বপ্ন, সব ইচ্ছেকে কবর দিয়ে তার সাথে চলে যাচ্ছিল লন্ডনে। সে এত এত কিছু বিসর্জন দিয়েছে, নিজের মর্জির বিপক্ষে গিয়ে মানিয়ে নিয়েছে আর তাজদার সিদ্দিকী?
সামান্য ইগোটুকুকে জিতিয়ে দেওয়ার জন্য তার মাতৃত্ব অস্বীকার করেছে। তার জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভুল তাজদার সিদ্দিকীর মতো স্বার্থান্বেষী মানুষকে বিয়ে করা, দ্বিতীয়ত অন্ধের মতো বিশ্বাস করা।
শাইনা ধীরেধীরে তার হাতটা ছাড়িয়ে নিল। তাজদার বলল,”আমি তোমার প্রেগন্যান্সির খবর শুনে খুব খুশি হয়েছিলাম কিন্তু……

শাইনা তার দিকে চোখ তুললো এবার। নিজেকে জেতাতে বাচ্চাটাকে কবর দিতে হলেও দিত এই তাজদার সিদ্দিকী? তাজদার তার দুই গালের পাশে আলতো করে হাত রাখলো। বলল,”আমি তোমাকে বলতাম সময় করে। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল আমি নিজেই…
শাইনার মুখ দিয়ে কথা বেরোলো না। সে কথা বললো না। তার কোনো কথা কোনোদিন তাজদার সিদ্দিকী মূল্যায়ন করেনি। চেঁচিয়ে বললেও শোনেনি। তাই আজকের পর তার কাছে নিজের কোনো কথা সে বলবে না। একটা কথাও না। সে যদি মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তেও দাঁড়িয়ে থাকে তাহলেও তাজদার সিদ্দিকীর কাছে যাবে না সাহায্য চাইতে। তাজদার সিদ্দিকী কথা রাখতে জানে না।
তাজদার তাকে ঝাঁকিয়ে বলল,”স্যে সামথিং। এভাবে চুপ থাকলে সমস্যা আরও বাড়বে। শাইনা!”
শাইনা পারছেনা কথা বলতে। শক্তি পাচ্ছে না শরীরে। সার্টিফিকেটগুলোর দিকে একবার তাকালো সে। আরেকফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে।
এগুলো সে পুড়িয়ে ফেলতে চেয়েছে সে কারণ জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় গুলোর অপচয় সে নিজের সাথে বহন করতে চায় না। আর রইলো ভালোবাসার কথা।

মুখে তাজদার সিদ্দিকী যতই বলুন কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে সে তার কাছ থেকে পাওয়া সুবিধাগুলোকে ভালোবাসে। বাচ্চা না হলে, ইউকে সিটিজেনশিপ না পেলে তাকে দুই পয়সার পাত্তা দিত না।
এই সংসারটা এমন একটা ভিতের উপর দাঁড়িয়ে আছে যে এটাকে ধরে রাখার জন্য একটা শক্ত হাতও নেই। সবাই এটাকে তার উপর চাপিয়ে দিয়েছে। সে এটাওটা করলে, মানিয়ে নিলে সম্পর্কটা থাকবে নইলে রাতারাতি কাবিনের টাকাসমেত তাকে বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হবে। কথাটা সে অনেকবার শুনেছে। সেই ভয়েই হয়তো সে সংসার করছে। আর তাজদার সিদ্দিকী করছে বাচ্চার লোভে, ইউকে সিটিজেনশিপের লোভে, একটা পার্মানেন্ট কেয়ারটেকার পাওয়ার লোভে।

তার ভেতরে এতদিন ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল এটা ভেবে যে সে সব ছেড়েছুড়ে, সব কিছু ফেলে চলে যাচ্ছিল সেটা কি ভালো হচ্ছে? উচিত হচ্ছে? আজ তাজদার সিদ্দিকী তার সব প্রশ্নের উত্তর একসাথে দিয়ে দিল। যে নিজের বাচ্চা নিয়ে মিথ্যে গল্প সাজাতে পারে সামান্য একটা শর্তের জন্য সে নিজের স্বার্থে আর কত কী না করতে পারে। তাজদার সিদ্দিকীকে শাস্তি দেওয়ার কোনো এনার্জি নেই তার। তাকে সবচেয়ে বড়ো শাস্তি যদি কেউ দিতে পারে সেটা সে নিজেই।

বাইরে থেকে রওশনআরা বলল,”শাইনা তোমার আব্বা এসেছে। বাইরে এসো।”
শাইনা ওড়না দিয়ে চোখদুটো চেপে চেপে মুছে নিয়ে চলে যাচ্ছিল তাজদার তাকে টেনে ধরে কপালে, গালে চুমু খেয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,”আমাকে কিছু বলে যাও। তুমি কিছু না বললে আমি শান্তি পাব না।”
শাইনা নিঃশব্দে কাঁদছে। তাজদারের হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতে না পারার জন্য নয় বরং নিজের ভেতরের অসহায়তাকে হঠাৎ করে নগ্নভাবে আবিষ্কার করার যন্ত্রণায়।
“তাজ শাইনাকে আসতে দাও। ওর আব্বা এসেছে।”
রওশনআরার কণ্ঠ শুনে তাজদার শাইনাকে নিজের সাথে আরও চেপে ধরে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,”তুমি কথা না বললে আমি তোমাকে ছাড়ব না। যে আসার আসুক। কথা বলো।”
শাইনার বুক ওঠানামা করছে ফোঁপাতে ফোঁপাতে। সারা শরীর কাঁপছে তার। তাজদার দু’হাতে তাকে কাছে টেনে নিয়ে একের পর এক চুমু রাখল গালে, ঠোঁটে। কণ্ঠটা কাঁপছে..
“তুমি বকো, চেঁচাও কিন্তু কেন কথা বলা বন্ধ করবে? শাইনা?”

তাজমহল পর্ব ৪৩

শাইনা দম বন্ধ হয়ে আসা অবস্থায় ছটফট করছে, বারবার তাজদারের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইল। কিন্তু তাজদার আরও প্রবল হয়ে তার মুখ দু’পাশ চেপে ধরে রেখে ঠোঁটের ওপর নিজের ঠোঁট রেখে জেদি চুমু খেল একের পর এক। ওদের নিঃশ্বাস জড়িয়ে গেল, শাইনার ছটফট আরও তীব্র হলো। অসহায় প্রতিরোধে মুহূর্তটা নিস্তব্ধ হয়ে উঠল। সে ছটফট করলেও তাজদারের আঁকড়ে ধরে রাখা শক্ত হাত তাকে আর পালাতে দিল না। শাইনা ক্লান্ত হয়ে তার মুখের দিকে তাকালো। তাজদার তাকে জড়িয়ে ধরে গালে দীর্ঘ একটা চুম্বন করে গালে গাল চেপে ধরে বলল,
“আমি তোমাকে ছাড়বো না।”

তাজমহল পর্ব ৪৫

1 COMMENT

  1. আপু পর্ব গুলো তাড়াতাড়ি দিবে দয়া করে … তাহলে গল্প পরে আনন্দ পাওয়া যায়…..

Comments are closed.