তাজমহল পর্ব ৪৩
প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী
শাইনার আইইএলটিএস স্কোর সন্তোষজনক আসেনি। তবে এইটুকুই যথেষ্ট ছিল স্পাউস ভিসার জন্য। তাজদার সকাল থেকে তাকে ব্যঙ্গ করে যাচ্ছে।
“এটা কোনো স্কোর হলো? তোমাকে গাইড করায় আমি রীতিমতো অপমানিত বোধ করছি। ভালো স্কোর আনতে পারলে আমার নাম হতো। এখন এত বদনাম নিয়ে আমি ঘুমাবো কি করে? বরকে সময় না দিয়ে এত পড়াশোনা করে কি লাভ হলো?”
শাইনা চুপ করে দেখে যাচ্ছে। ইচ্ছে করে তাকে রাগাতে চাইছে। এই স্কোর তার জন্য অনেক বেশি। অনেক অনেক বেশি। তাজদার বকবক করছিল ঘরময় পায়চারি করে করে। সে ভীষণ হতাশ হয়েছে। স্টুডেন্ট বউ বলে বেঁচে গিয়েছে। অন্য কেউ হলে আজ মাইর একটাও মাটিতে পড়তো না।
শাইনার বাবা মিষ্টি পাঠিয়েছে বাড়িতে। শাইনা দুটো মিষ্টি প্লেটে তুলে নিয়ে ঘরে এল। তাজদারকে বলল,”নিন মিষ্টি খান। আব্বা পাঠিয়েছে।”
তাজদার ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। প্লেটে থাকা মিষ্টির দিকে তাকিয়ে বলল,”মিষ্টি?”
শাইনা আলতো হেসে বলল,”হুম, পাশ করেছি না?”
সে মিষ্টি কেটে তাজদারের দিকে বাড়িয়ে দিল। তাজদার চামচটা তার দিকে ঠেলে দিল। শাইনা মিষ্টিটুকু খেয়ে নিল কপাল কুঁচকে। তাজদার বলল,”মিষ্টিমুখ তোমার করা জরুরি।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“কেন?”
“কারণ খুশিটা তোমার বেশি।”
শাইনা একটু মনখারাপ করে বলল,
“আপনার তো জানা উচিত যে আমি ইংরেজিতে এতটাও ভালো না। এত স্কোর পেয়েছি এটা আমার কাছে অনেক।”
তাজদার আর কোনো কথা বললো না। শাইনা বলল,”মিষ্টি খাবেন না?”
তাজদার মিষ্টি খেল। শাইনা জানতে চাইল,”মজা?”
“মিষ্টি যেমন হয়।”
শাইনা মুখ মোচড় দিয়ে চলে গেল।
শাইনাদের বাড়িতে তার বড় আপা মেঝ আপা এসেছে। শাইনাকে যেতে বলেছে। শাইনা তিতলিকে নিয়ে ওই বাড়িতে গেল বিকেলের দিকে। আফসার সাহেব মেয়েকে দেখে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন,
“মাঝেমধ্যে তো আসতে পারিস রে মা।”
শাইনা কিছু বললো না। কেন সে আসে না সেটা সবাই জানে।
পুডিং খাওয়ার সময় শাইনা বলল,”আম্মা ডিমের গন্ধ লাগছে বেশি। এসেন্স দাওনাই?”
তিতলি খেতে খেতে বলল,”কই? তেমন গন্ধ লাগছেনা।”
শাইনা বলল,”না, লাগছে। তাহলে তুমি খাও সব।”
নুডলসেও ডিম দিয়েছিল শাহিদা বেগম। শাইনা বলল, “নুডলসেও ডিম দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছ আম্মা।”
শাহিদা বেগম বলল,,”তোর হয়ছেটা কি বলতো।”
দাদীমা হেসে বলল,”কাজ সাড়ছে মনে হয়।”
বলেই তিনি ঠোঁট টিপে হাসলেন। শাইনার একটু রেগে তাকালো। শাহিদা বেগম চ বর্গীয় শব্দ করে বললেন,”আহা আম্মা আপনি ওকে খোঁচায়েন না।”
শাইনার মন খারাপ দেখে বড় আপা, মেঝ আপা বললো, “আল্লাহ চাইলে অসম্ভব সম্ভব হয়। এগুলো কোনো সমস্যা না। বিদেশে ভালো চিকিৎসা আছে। তাজ ভাই চিকিৎসা করাবে। চিন্তা করিস না।”
বড় দুলাভাই এসে বসলো তাদের সাথে। বসতে বসতে বলল,”শানু পড়ালেখা তাহলে ছেড়েই দিচ্ছিস।”
শাইনা চুপ। তিতলি মনে মনে বলল,”আবার খোঁচা দিচ্ছে দেখো।”
বড় আপা বলল,”ওখানে পড়ার সুযোগ হলে ভর্তি হয়ে যাস।”
শাইনা খেতে লাগলো চুপচাপ। শাহিদা বেগম বলল,”রাতে খেয়ে যাবি।”
শাইনা তিতলির দিকে তাকালো। তিতলি হাসলো। বলল,”থাক গে। ভাইয়াকে পরে বুঝিয়ে বলবে।”
শাহিদা বেগম রান্না করছিলেন মাটির চুুলায়। বেশি রান্না করতে হলে উনি মাটির চুলায় রান্না বসান। গ্যাসের চুলায় বড় পাতিল বসান না।
শাইনা মায়ের পাশে বসে বসে রান্না দেখলো। কথাবার্তা বললো। শাহিদা বেগম সাহস দিলেন। বললেন,”তাহাজ্জুদ পড়িস নিয়মিত। আল্লাহ ফিরাবেন না। এগুলো নিয়ে টেনশন করিস না শানু। জামাই কিছু বলছে?”
শাইনা দুপাশে মাথা নাড়লো। মায়ের সাথে গল্পগুজব করার সময় সে পেঁয়াজের বাটিটা সামনে থেকে সরিয়ে রাখলো। কাঁচা পেঁয়াজের গন্ধটা অসহ্য লাগছে। ভাতের মাড় উঠতেই শাইনা সেখান থেকে চলে গেল। মশলা কষার ঘ্রাণটাও নিতে পারছেনা সে।
শাহিদা বেগম তার আচরণ দেখে চিন্তিত হলেন। শাইনা রাতে খেয়েদেয়ে বাড়ি যাওয়ার সময় দেখলো তাজদার উঠোনে দাঁড়িয়ে আনিসের সাথে কথাবার্তা বলছে। বাচ্চারা ছোটাছুটি করছে তাদের আশেপাশে। তাসনুভা ফোনের ছবি দেখতে দেখতে তৌসিফের সাথে কথাবার্তা বলছে একপাশে দাঁড়িয়ে। কাল তাকে পনেরটা ড্রেস পরে শুট করতে হবে। তৌসিফ থাকবে ক্যামেরাম্যানের দায়িত্বে।
শাইনাকে দেখে তাজদার ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। শাইনা তার পাশ কেটে বাড়িতে ঢুকে পড়লো তিতলিকে নিয়ে।
ঘরে গিয়ে থ্রিপিসটা পাল্টে নিল। একটা কর্ডসেট পরলো আরাম দেখে। চুলটা বেঁধে ঘরটা গোছগাছ করছিল অমন সময় তাজদার ঘরে পা রাখলো। রকিং চেয়ারে বসলো আরাম করে। শাইনা প্রেসক্রিপশনগুলো ছবি তুলছিল ফোনে। ভাবি দেখাতে বলেছে। তাজদারের দিকে ফিরতেই দেখলো তার কাজ দেখছে চুপচাপ। সে জানতে চাইল,”কিছু বলবেন?”
তাজদার বলল,”হ্যাঁ।”
“কি?”
“প্রেসক্রিপশনের ছবি যাকে পাঠাচ্ছ তাকে বলে দেবে তোমার ব্যাপারে ওদের চাইতে বেশি কনসার্ন আমি।”
শাইনা বলল,”তারা সেটা জানে। তাও দেখতে চেয়েছে।”
শাইনা ছবি তুলে পাঠিয়ে দিল। তাজদার গম্ভীরমুখে গটগট পায়ে হেঁটে ঘর ছাড়লো। শাইনা বলল,”আশ্চর্য! কি হয়েছে আপনার?”
তাজদার জবাব দিল না। শাইনার তার পিছুপিছু কিছুদূর এসে হঠাৎ একটা চিৎকার দিয়ে বসে পড়লো পা ধরে। তাজদার হন্তদন্ত পায়ে হেঁটে এল। সামনে বসে বলল,” কি হয়েছে? দেখি।”
শাইনা তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,”কিছু হয়নি।”
তাজদার রেগে তাকালো। শাইনা বলল,”যতটা পথ হেঁটে এসেছি ততটা পথ এবার আমাকে দিয়ে আসুন।”
“মানে?”
“মানে কোলে তুলে ঘরে দিয়ে আসুন।”
“পারবো না।”
“তাহলে আমিও এভাবে পা ধরে বসে থাকবো। সবাইকে বলবো আপনি ধাক্কা দিয়েছেন?”
“হোয়াট ননসেন্স মমতাজ?”
“আমি এরকমই। কোলে নিন।”
তাজদার তাকে কোলে তুলে নিয়ে ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল,”যখন নিতে চাই তখন তুমি উঠবে না।”
“যখন নিতে বলবো তখনই নেবেন। আপনি পঙ্গু হয়ে গেলেও।”
“মগের মুল্লুক?”
“হ্যাঁ তাই।”
“বেয়াদব।”
“আপনি বেয়াদবের বর।”
“সেটাই কাল হয়েছে।”
“আরও হোক।”
শাইনাকে বিছানায় বসিয়ে দিল সে। শাইনা বলল,”একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দেই। যদি কখনো মনে হয় আমাকে সহ্য হচ্ছে না। দয়া করে সত্যিটা বলে দেবেন। আমার খুব উপকার হবে। আমিই আপনাকে ছেড়ে চলে যাব। এবার যান। দরজাটা টেনে দেবেন।”
তাজদার বেরিয়ে গেল দরজাটা আরও ভালো করে মেলে দিয়ে। শাইনা চিৎকার করে বলল,”টেনে দিন বলছি।”
“পারব না।”
সকালে ঝিমলির বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে শাইনা নিজের ঘরে নিয়ে এসেছে। কাকিয়ার কোল পেয়ে সে একদম শান্ত হয়ে শুয়ে আছে। শাইনা তার নাকের ডগায় চুমু খেয়ে বলল,
“কি ভালো সোনা বাবাটা!”
তিতলি এসে বলল,”ওকে আমি আর কোলেই নেব না। খালি গরম গরম হিসু করে।”
শাইনা হেসে বলল,”বাবা এবার থেকে একটু ঠান্ডা ঠান্ডা হিসু করবেন। কেমন?”
তিতলি হেসে উঠে বলল,”আচ্ছা শুনো না। বাবুর একটা বোন লাগবে কিন্তু। হুম।”
শাইনার ঠোঁট থেকে হাসি মুছে গেল। সে মৃদুস্বরে বলল,”বুঝলাম।”
তিতলি বলল,”বাবু ওই দেশে হবে নাকি? তাহলে তো বড় হওয়ার পর দেখবো। তুমি চলে গেলে আমি কিন্তু খুব একা হয়ে যাব।”
“বড়ো ভাবি আছেন।”
“আছেন কিন্তু উনিও ঢাকায় চলে যাবেন।”
“তুমি শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে।”
“সেটা আর হবে না। ওই নুভার বাচ্চা বিয়ে না করলে আমার বিয়ে অসম্ভব।”
শাইনা বলল,”বড় বোনকে এভাবে বলে নাকি কেউ?”
তিতলি বলল,”আমি বলি। বজ্জাতটা বিয়ে করবে না মানে করবে না। নিজে চিরকুমারী থাকবে আমাকেও রাখবে।”
তাজদার ঘরে ঢোকার সময় শাইনার কোলে বাবুকে দেখলো। শাইনা তাকাতেই চোখ সরিয়ে নিল। শাইনা বাবুকে নিয়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বলল,”আপনি কোলে নিয়েছেন ওকে?”
“হ্যাঁ।”
“আরেকটু নিন।”
শাইনা জোর করে তার হাতে বাচ্চাকে দিল। তারপর বলল,”এটা কে জানো? চাচ্চু। চেনো চাচ্চুকে? চাচ্চুর কোলে চড়ছো?”
শাইনা বকবক করেই যাচ্ছিল বাচ্চার সাথে।
তাজদার তার মুখের দিকে চেয়ে রইলো। মনে মনে বিশাল আক্ষেপ করে বলল, খুশির খবরটা যদি তুমি জানতে!
শাইনার খাওয়াদাওয়ায় বাছাবাছি, গন্ধ সইতে না পারা, অল্পতেই হাঁপিয়ে উঠা, কিছুক্ষণ পর পর ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকা বিষয়গুলো রওশনআরা আর জোহরা বেগম খেয়াল করছেন কয়েক সপ্তাহ ধরে। উনাদের অভিজ্ঞ দৃষ্টি ফাঁকি দেওয়া অসম্ভব।
আনোয়ারা বেগম বসে নাশতা খাচ্ছিলেন। উনারা তখন সেটা বলাবলি করছিলেন। শাইনা রান্নাঘরে ঢুকতেই সবার কথা থেমে গেল। কাপে চা ঢেলে আনোয়ারা বেগমের সামনে রাখলো শাইনা। আনোয়ারা বেগম বললেন,
“তুমি খেয়েছ?”
“নাশতা খেতে ইচ্ছে করছেনা। পরে খাব।”
“সকাল থেকে কেউ খালি পেটে থাকে?”
শাইনা উত্তরে কিছু বললো না। রওশনআরার দিকে তাকিয়ে বলল,”বড়আব্বুর জন্য চা নিয়ে যেতে বলেছে।”
“সবার জন্য চা হবে কিনা দেখো। নাহলে আবার বসাতে হবে।”
“বড় আব্বু আর মেঝ আব্বুকে দিয়ে আসি।”
“যাও।”
শাইনা চা নিয়ে চলে গেল। তাজউদ্দীন সিদ্দিকীর সামনে চায়ের ট্রে রাখতেই উনি শাইনার দিকে তাকালেন কথা থামিয়ে দিয়ে। প্রশ্ন করলেন,
“ভিসার কাগজপত্র কখন আসছে?”
“চলে আসবে শীঘ্রই।”
“ও তো আমাদের কিছু বলেনি এখনো। তোমাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে।”
শাইনা বলল,”আজ বাড়ি ফিরলে জিগ্যেস করে নিয়েন।”
“তোমাকে কিছু বলেনি?”
“স্পষ্টভাবে কিছু বলেনি।”
তৈয়বউদ্দীন সিদ্দিকী বললেন,”তুমি বলোনি তিন চার বছর পর যেতে পারবে?”
শাইনা চুপ করে রইলো। বাড়ির সবাই উপস্থিত ছিল তখন। সবাই একেক কথা বলছিল। শাইনা চুপ করে শুনলো। তাসনুভা সবার কথা শুনে বিরক্ত হয়ে বলল,
“ওর লাইফ ওর ডিসিশন। তোমরা কেন ওকে এটা ওটা শিখিয়ে পড়িয়ে দিচ্ছ আমি বুঝতে পারছিনা। ওর কি মুখ নেই? কথা বলতে জানেনা? ও ওর জায়গায় স্থির থাকলে ভাইয়া কি করে ওকে সরাবে? ওর যেতে ইচ্ছে না করলে, অনার্স কমপ্লিট করার ইচ্ছা থাকলে যাবে না। ব্যস। এখানে এত কথা কীসের?”
রওশনআরা বলল,”আচ্ছা এত কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। শাইনা তুমি ওকে বলে দিও তুমি যাবে না। এখনো সংসারের সব কাজবাজ জানোনা। একা একা ওখানে সব সামলাবে কি করে? একজন মুরব্বিও নেই।”
তাজউদ্দীন সিদ্দিকী বলল,”হ্যাঁ, ওকে বুঝিয়ে বলবে। আমরাও বলবো। ওখানে ওর জায়গাটা আরও পাকাপোক্ত হোক। তারপর দেখা যাবে। কোর্সটোর্স করেছ ভালো কথা। ওগুলো পরে কাজে লাগবে।”
শাইনা চুপ থাকতে পারলো না। বলল,”আমি এভাবে বললে আবারও অশান্তি তৈরি হবে।”
সবাই চুপ রইলো। শাইনা জানে অশান্তি লাগলে তখন কেউ তার হয়ে কথা বলবে না। নিজেদের ছেলের সামনে কথা বলার মুরোদ নেই কারো।
রাতে তিতলি ঝালমুড়ি মাখছে তৌসিফ আর শাইনার সাথে মিলে। ড্রয়িং রুমে সবাই হৈহল্লায় মেতে আছে। তাসনুভা তার বাবা চাচার সাথে জরুরি আলাপে ব্যস্ত। রায়হানও তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছে। তার বিজনেস স্ট্রেটেজি নিয়ে কথা বলছে।
তিতলি একটা বোল নিয়ে ঝালমুড়ি মাখছে ফ্লোরে বসে। তৌসিফ চানাচুরের প্যাকেট ছিঁড়ে বোলে ঢালছে। শাইনা সব পেঁয়াজ মরিচ কাটাকুটি করে এনেছে। মশলার সাথে সব মিশিয়ে মুড়ি মাখছে তিতলি।
শাইনা তার পাশে বসে রইলো। তিতলি বলল,”ব্রো কাগজ নিয়ে আসো। কাগজে দেব সবাইকে।”
তৌসিফ বলল,”তুই ঝালমুড়ি বেঁচবি?”
তিতলি দাঁত দেখিয়ে হেসে বলল,”ইয়েস। অ্যাই অ্যাই ঝালমুড়িহ ঝালমুড়িহ! কে নিবেন ঝালমুড়ড়িহ। ও ভাই ঝালমুড়িহ!”
তাসনুভা ধমকে উঠলো,
“তিতলি স্টপ! কি শুরু করেছ? জরুরি কথা চলছে এখানে।”
তিতলি মুখ মোচড় দিল। তাসনুভা বলল,”তুমি মুখ মোচড়ালে কেন? আব্বু তুমি দেখলে? ভাইয়া তুমি দেখেছ?’
রায়হান বলল,”তিতলি স্যে সরি।”
তিতলি জিহবা দেখিয়ে বলল,”ষরি।”
তাসনুভা আরও খেপে গেল। তাজউদ্দীন সিদ্দিকী বললেন,”তুমি কিন্তু খুব দুষ্টমি করছো কিন্তু।”
তিতলি বিড়বিড়িয়ে বলল,”বিয়ে দিয়ে দাও। ভালো হয়ে যাব প্রমিজ।”
তৌসিফ আর শাইনা তার কথা শুনে একসাথে হেসে ফেললো। তৌসিফ তার মাথায় চাটি মেরে বলল,”ও ভাই এই পাগল নিয়ে কই যাইতাম?”
তিতলি বলল,”তোমাকে আর ঝালমুড়ি দেব না। পায়ে ধরলেও দেব না। মারলে কেন?”
বলেই সে বোলটা নিয়ে দৌড় দিল। তৌসিফ তার পেছনে ছুটলো। তাজউদ্দীন সিদ্দিকী বলল, এরা কি শুরু করেছে?
তৈয়বউদ্দীন সিদ্দিকী বলল, দুটোকেই ঘর থেকে বের করে দাও। তৌসিফ!
তৌসিফ বলল, আরেহ আমি কি করেছি? এখন সব দোষ আমার হয়ে গেল?
রায়হান বলল, তুই বড়ো না?
তৌসিফ তিতলির দিকে তাকিয়ে বলল, তোকে মাথায় তুলে আছাড় দেব একটা। হাতের কাছে পাই।
তিতলি হাসতে লাগলো। রওশনআরা ধমক দিতেই তিতলি সুরসুর করে নেমে এল। সবাইকে কাগজে করে ঝালমুড়ি বিলি করলো। শাইনাকে দুটো দিল। বলল, “একটা তোমার জন্য। আরেকটা তোমার বরের জন্য।”
শাইনা বলল,”বর খাবে এসব?”
“কেন? তোমার বর শুধু মিষ্টি খায় নাকি?”
শাইনা তার ইঙ্গিত বুঝে পিঠে চড় দিয়ে বলল,”দুষ্টু।”
তিতলি হেসে সরে গেল।
তাজদার কিছুক্ষণ পর বাড়ি ফিরেছে। শাইনা দরজার কাছে এগিয়ে এসে তার হাত থেকে ফলমূলের ব্যাগটা নিয়ে নিল। বলল,
“আজ এত দেরী কেন?”
তাজদার বলল,”বন্ধুদের সাথে ছিলাম।”
শাইনা বলল,”বন্ধুদের সাথে ঘুমাতে পারলেন না?”
তাজদার তার দিকে কপাল কুঁচকে তাকালো। শাইনা তার কপালে আঘাতের মতো কিছু একটা দেখলো।
“কপালে কি হয়েছে?”
“কিছু না।”
শাইনা আর কিছু বললো না। তাজদার ভেতরে আসতেই সবাই একসাথে জানতে চাইল কপালে কি হ’য়েছে। তাজদার বলল, একটা অটোরিকশা চলে এসেছিল গাড়ি থেকে নামার সাথে সাথে। ওটার সাথে ধাক্কা লেগেছে। সিরিয়াস কিছু না।
সবাই তাকে আর কোনোরকম প্রশ্ন করলো। খেয়েদেয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিল। মাঝরাত তখন। হঠাৎ শাইনার ঘুম ভেঙে গেল। সে দেখলো তাজদার বিছানায় বসে মেঝেতে পা রেখে নিচু হয়ে কিছু একটা দেখছে। শাইনা উঠে বসলো। বলল,
“কি হয়েছে?”
তাজদার তার দিকে তাকিয়ে বলল,”একটু গরম পানি আনা যাবে?”
“কি হয়েছে সেটা বলবেন তো।”
শাইনা কৌতূহলে হেঁটে এসে সামনে বসলো। দেখলো তাজদারের পায়ে মারাত্মক জখম হয়েছে। শাইনার গা গুলিয়ে এল। সে গরম পানিটা নিয়ে এসে আচমকা বমি করা শুরু করলো।
তাজদার মহাবিপদে পড়ে গেল। পায়ে ভর রেখে শাইনাকে ধরতেও পারছেনা আবার ওর বমি থামাবে এমন কোনো পথও খুঁজে পাচ্ছে না।
শাইনার পেট বুক খিঁচে গেছে। গলা তেঁতো পানি বের হচ্ছে। আনোয়ারা বেগম এসে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন। বললেন,
“এমা তোমরা বর বউ এখনো ঘুমোওনি? তোমার পায়ে একি অবস্থা! বউ এভাবে বমি করছে কেন?”
তাজদার বলল,”আগে ওকে ধরো। ভেবেছিলাম এটা তেমন সিরিয়াস কিছু হবে না। এখন দেখছি রক্ত পড়ছে। মেবি একটা সেলাই দরকার।”
আনোয়ারা বেগম শাইনার পিঠে মালিশ করে দিতে লাগলো। তিতলি চলে এসেছে। আনোয়ারা বেগম বললেন,”যাও, মাল্টা অথবা লেবু নিয়ে এসো।”
রওশনআরা ঘুম থেকে উঠে তাজদারের ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। শাইনা মুখে পানির ঝাপটা দিল। কুলি করলো। আনোয়ারা বেগম তার চোখমুখ তোয়ালে দিয়ে মুছে দিতে দিতে হাসিমুখে বললেন,
“বুঝলে দাদুভাই মনে হচ্ছে আমরা খুশির সংবাদ পেতে চলেছি।”
শাইনা হকচকিয়ে গেল। জোহরা বেগম বললেন,”আমি সবার আগে বলেছি কিন্তু আম্মা। আপনারা আমার কথা বিশ্বাস করেননি। ওই ডাক্তারগুলো কি ফালতু কথা বলেছে কে জানে।”
তিতলি বলল,”আমি আপুকে বলে আসি?”
রওশনআরা তাকে থামিয়ে দিলেন।
“না, এভাবে বলা ঠিক হবে না।”
সবাই শাইনাকে ঘিরে কথাবার্তা বলছিলো। শাইনা একফাঁকে তাজদারের দিকে তাকালো। সে তাকানোর সাথে সাথেই তাজদার চোখ সরিয়ে নিল।
পা নিয়ে সোজা দাঁড়িয়ে পড়লো। বলল,
“তিতলি তৌসিফকে ডাকো। বেরোবো। এভাবে বসে থাকলে সমস্যা হবে।”
সবাই এবার ওকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ঘর খালি হতেই শাইনা তাজদারের দিকে আবারও তাকালো। তাজদার তার দিকে তাকাল না। শাইনা তার মুখের দিকে চেয়ে রইলো যতক্ষণ ঘরে ছিল।
সকালে কাজে বেরোনোর সময়ও শাইনার সাথে কোনোরকম কথা বললো না তাজদার। শাইনার খটকা লাগছিল কেমন।
সকালে এইসব নিয়ে শাহিদা বেগমের সাথে বেশ কথাবার্তা বলছিলেন রওশনআরা। বললেন,”আমি বাড়িতে এই ব্যাপারে কিছু বলতে পারবো না। তুমি যদি কিছু করতে পারো দেখো। আরেকটা ডাক্তার দেখানো উচিত ছিল। যে দেখছে সেই বলছে তোমাদের বউয়ের অসুখে ধরেছে। কিন্তু রিপোর্ট তো অন্য কথা বলছে। বুঝতে পারছিনা কিছু।’
শাহিদা বেগম চালাকি করে বললেন, “শানুকে একবার বাড়ি পাঠান তাহলে । আমি দেখি কিছু করা যায় কিনা।”
রওশনআরা তিতলির সাথে করে শাইনাকে পাঠালো ওই বাড়িতে। যদিও তাজদার বলেছে তার অনুমতি ছাড়া কোথাও না যেতে।
বাড়িতে মেঝ আপা ছিল। স্বাভাবিক কথাবার্তা, খাওয়াদাওয়া চললো।
শেষের দিকে শাইনাকে ঘরে ডোকে নিয়ে শাবরিন বলল, “এই কীটটা নে।”
শাইনা কীটটা চেনে। অবাক হয়ে বলল,”এটা কেন আপা?”
“এটা দিয়ে একবার চেক দিস তো। আম্মা বলতেছে তোর সব লক্ষ্মণ নাকি অন্য কথা বলতেছে। আওয়াজ করিস না। কেউ না জানতোমতো। একবার দেখ। পিরিয়ড মিস গেছে না?”
শাইনা কপাল কুঁচকে চেয়ে রইলো। আস্তে করে বললো,”হ্যাঁ।”
কীটটার দিকে চেয়ে রইলো সে। শাবরিন বলল,
“সকালে দিস। তাহলে ভুলভাল আসবে না। তাজ ভাইকে এই ব্যাপারে কিছু বলিস না।”
শাইনার বুকটা ধড়ফড় করছিল তখন। তাহলে ওই রিপোর্টটা? রিপোর্ট ভুল আসবে কেন?
সে শ্বশুরবাড়িতে চলে এল। রাতে তাজদার বাড়ি ফিরতেই সে ধীরেসুস্থে তাজদারের সামনে গিয়ে বলল,”আমার মনে হয় অন্য একটা ডাক্তার দেখানো উচিত।”
তাজদার কপাল কুঁচকে তাকালো তার দিকে। শাইনা চোখ সরিয়ে নিল। তাজদার জগ থেকে পানি ঢাললো গ্লাসে। পানি খেয়ে নিয়ে বলল,
“তুমি আমাকে অবিশ্বাস করছো? আমি তোমাকে মিথ্যে বলছি?”
“না মানে, সবাই বলছে এককথা ডাক্তার বলছে অন্য কথা।”
“সবাই কি বলছে?”
শাইনা মুখফুটে কিছু বললো না। তাজদার বলল,
“ওরা কি ডাক্তার যে ওদের কথা বিশ্বাস করছো? ওরা বললো আর সেটা সত্যি হয়ে গেল?”
“আম্মা বলছে আপনি না দেখাতে চাইলে ভাইয়া…
তাজদার গ্লাসটা শব্দ করে রাখলো টেবিলে। শাইনা হালকা কেঁপে ওঠে গ্লাসটার দিকে ফিরে তাকালো। তাজদার গর্জে বলল,”তুমি আবারও ওই বাড়িতে গিয়েছ?”
“আমার বাড়িতে আমি যাব না?”
“না যাবে না। আমার অনুমতি ছাড়া তুমি কোথাও যাবে না।”
কথাটা শাইনার ভালো লাগেনি। তাই সে তাকে আর কিছু বললো না। রাতে তার ঘুম হলো না। পাশে ঘুমিয়ে থাকা তাজদার সিদ্দিকীর মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো সে। পা টা দেখলো। কপালের ক্ষতটা দেখলো। তারপর গ্লাসে পানি ঢেলে পানি খেয়ে গলা ভিজালো।
তারপর ফোনটা হাতে নিয়ে স্প্যারোস গ্রুপে একটা পোস্ট করলো। কমেন্টে সবাই আম্মা আর বড় আম্মার মতো বললো।
বললো, এটা আপনার বরের চালাকি হতে পারে আপনাকে দমিয়ে রাখার জন্য কিংবা পড়াশোনা থামিয়ে ইউকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এখন এমন রিপোর্ট বানানো যায়। আপনি বাপের বাড়ি চলে যান। ভালো একটা ডাক্তার দেখান। আর রিপোর্ট ভুল হলে আপনি ওই ডাক্তারের নামে মামলা করবেন। আর আপনার হাসবেন্ডকে কি করবেন সেটা আপনার ব্যাপার।
তাজমহল পর্ব ৪২
শাইনা সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে প্রেগন্যান্সি টেস্ট করলো। থরথর করে কাঁপছিল তার হাতজোড়া রেজাল্ট পজিটিভ দেখে। চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো তার গাল বেয়ে। ওয়াশরুম থেকে বেরোনোর শক্তি পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছে সে। যে মানুষটা তাকে এত জঘন্য একটা মিথ্যে কথা বলতে পারে তার বাচ্চার মা হতে পারবে না ভেবে সে ক্ষণিকের জন্য আফসোসে মরে যাচ্ছিল? বুকভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়লো সে।