সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ১৩

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ১৩
জাওয়াদ জামী

” কুহু, এই কুহু, চোখ খোল। ” সিক্তা মরিয়া হয়ে ডাকছে কুহুকে। সেই সাথে কুহুর চোখমুখে পানির ছিটা দিচ্ছে।
” কোকিলা রে, ও কোকিলা, চোখ খোল বইনা। আর কখনোই তোকে ছাদে একা রেখে আমি কোথাও যাবোনা। ” ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল আনান। বেচারা যেকোন মুহূর্তে কেঁদে ফেলবে।
বেশ কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে তাকাল কুহু। চোখ পিটপিট করল কয়েকবার। আনান আর সিক্তার চিন্তিত চেহারা দেখে মনে করার চেষ্টা করল কি ঘটেছে।
কুহুকে চোখ মেলতে দেখে হাঁফ ছাড়ল সিক্তা, আনান।

” বাঁচালি, বইনা। তোর কি হয়েছিল বলতো? হুট করেই জ্ঞান হারালি কেন? কোনকিছু দেখে ভয় পেয়েছিলি? ভাগ্যিস ভাই ছিল। নয়তো জানতেই পারতামনা, তুই ছাদে হুমড়ি খেয়ে পরে আছিস। ”
আনানের কথা শুনে কুহুর সব মনে পরল। হঠাৎই ভয় পেয়ে ঢলে পরেছিল ছাদের মেঝেতে। কিন্তু ও তো ছাদে ছিল? এটাতো সিক্তার রুম। এখানে আসল কিভাবে? নিশ্চয়ই হেঁটে আসেনি।
” ভাইয়া, আমি এখানে কিভাবে আসলাম? আমিতো ছাদে ছিলাম। ” ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল কুহু।
” ভাই তোকে কোলে করে এনেছে। তোকে অজ্ঞান হতে দেখে ভাই ভয় পেয়েছে। এতক্ষণ এখানেই ছিল। একটা ফোন আসায় বাহিরে গেছে। ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আনানের কথা শুনে কুহুর বুক ধড়ফড় করছে। ওকে নাকি তাহমিদ ভাইয়া কোলে করে নিচে এনেছে! এত বছর নিজেকে হেফাজত করে চলেছে কুহু। নিহান ভাইয়া, আনান ভাইয়া ছাড়া কোন ছেলের সাথে কথা পর্যন্ত বলেনি। কিন্তু আজ এ কি হয়ে গেল? তাহমিদ ভাইয়াই বা ওকে কি ভাববে? কথাটা ভাবতেই কুহুর কান্না পেল ভিষণ।
” সিক্ত, কুহুর জ্ঞান কি এখনো ফেরেনি? আমি ডক্টর আংকেলকে আসতে বলব? ” তাহমিদ রুমে ঢুকেই সিক্তাকে জিজ্ঞেস করল। ওর নজর ফোনের দিকে। কুহুকে এখনো লক্ষ্য করেনি।
” কুহুর জ্ঞান এসেছে, ভাইয়া। ”
সিক্তার কথায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল তাহমিদ। ও দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসল কুহুর দিকে। কিন্তু কুহু তাহমিদকে আসতে দেখেই পাশ ফিরে শুয়েছে। তাহমিদের মুখোমুখি হতে ওর লজ্জা লাগছে।
কুহুকে পাশ ফিরে শুয়ে থাকতে দেখে তাহমিদ সিক্তাকে বলল,
” ওকে ঘুমাতে বল। তবে তার আগে ওকে ফ্রুট জুস দিতে হবে। এক কাজ কর, তুই জুস এনে ওকে খাইয়ে দে। না থাক। তুই বরং এখানে থাক। আমি জুস আনছি। ” তাহমিদ কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পর ট্রেতে করে এক গ্লাস অরেঞ্জ জুস এবং এক গ্লাস গ্লুকোজ পানি নিয়ে আসল। সিক্তা কুহুকে বারবার পাশ ফিরতে বলল। কিন্তু কুহু একচুলও নড়লনা। কি মনে করে তাহমিদ রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

ফজরের নামাজ আদায় করে কিছুক্ষন বইয়ে চোখ বুলিয়ে কুহু নিচে নামল। ড্রয়িং রুমে কাউকে না দেখে রান্নাঘরে উঁকি দিল। আফরোজা নাজনীন এবং তাহমিনা আক্তার মিলে নাস্তা তৈরী করছেন। কুহুকে দেখে হাসলেন তাহমিনা আক্তার।
” উঠে গেছিস? আয় ভেতরে আয়। চা দেব? ” তাহমিনা আক্তার আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করলেন।
” এখন কিছুই খাবোনা, মামী। আমি পরোটা বানাই? ” তাহমিনা আক্তারকে পরোটা বানাতে দেখে কুহু জিজ্ঞেস করল।
” সে কি! তুই কেন কাজ করবি, মা? তুই গিয়ে পড়তে বস। কালকে তোর এডমিশন টেস্ট। আর তুই কিনা বলছিস পরোটা বানাবি! ” তাহমিনা আক্তার কুহুর কথা শুনে চমকে গেছেন।
” কুহু মা, কিসব কথা বলছিস তুই! তুই এসেছিস মামার বাড়িতে। মামার বাড়িতে আসলে কেউ কাজ করে? বা করতে চায়? তুই গিয়ে পড়তে বস। আমি চা-নাস্তা রুমেই পাঠিয়ে দেব। ” আফরোজা নাজনীন চোখ রাঙিয়ে বললেন।
কুহু বুঝল এরা দুই জা কেউই ওকে কাজ করতে দেবেনা। তাই রুমে যেতে মনস্থির করল।

” কুহু, এত সকালে উঠে গেছ তুমি? ” নাজমা আক্তার রান্নাঘরে ঢুকে কুহুকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
” আমার সকালে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস, মামী। ”
” খুবই ভালো অভ্যাস। এদিকে আমাদের বাড়ির ছেলেমেয়েদের দেখো। নবাবের বংশধরেরা নয়টার আগে ঘুম থেকে উঠতে পারেনা। সুপ্তি, দ্যুতি ওরাই একমাত্র ফজরের পর আর ঘুমায়নি। ”
” অন্যদের কথা বাদ দে। তাহমিদের কথা ভেবে দেখ। ছেলেটা তিনটার দিকে ঘুমায়। ও তো নয়টায় ঘুম থেকে উঠবেই। বাকি সবার সাথে তাহমিদকে গুলিয়ে ফেলিসনা নাজমা। ” আফরোজা নাজনীন তাহমিদের পক্ষ নিয়ে কথা বললেন।
” তাকে তো আগেই আমার লিষ্ট থেকে বাদ দিয়েছি, বড় ভাবী। আমি জানতাম আপনিই একমাত্র আপনার ছেলের পক্ষ নেবেন। ”

” কুহু মা, তুই রুমে যা। এদের ঝগড়া কেবলমাত্র শুরু হল। একজন বাড়ির সব ছেলেমেয়ের পিন্ডি চটকাবে, তো আরেকজন শুধু তার বাপের সাফাই গাইবে। আরেকজন সবশেষে এসে দু’জনের ঝগড়া দেখবে আর মিটিমিটি হাসবে। এটাই এই বাড়ির রোজকার কান্ডকারখানা। আর দুইদিন এই বাড়িতে থাকলে তুই আরও অনেককিছুই দেখতে পাবি। ” তাহমিনা আক্তার কুহুর হাতে চায়ের কাপ আর বিস্কুটের পিরিচ ধরিয়ে দিয়ে বললেন।
মামীদের খুনসুটি দেখতে কুহুর বেশ ভালোই লাগছিল। একে-অপরের সাথে ইনাদের কত মিল! কেউ কারো কথায় মন খারাপ করছেনা বা মুখ কালো করছেনা। বড় মামীকে সবাই সম্মান করছে। আবার বড় মামীও ছোট জায়েদের সাথে হাসিমুখে কথা বলছেন। এমন পরিবার সচারাচর দেখা যায়না। কুহুর মনে হল, এটা একটা আদর্শ পরিবার।
তাহমিনা আক্তার কুহুকে ঠেলে রান্নাঘরের বাহিরে পাঠিয়ে দিলেন। কুহু রুমে এসে দেখল সিক্তা এখনো ঘুমাচ্ছে। ওকে জাগানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হল। চুপচাপ চা শেষ করে বই নিয়ে বসল।

কুহু সিক্তা আর আনান ভাইয়াকে রাতেই রিকুয়েষ্ট করেছিল রাতের ঘটনা যেন কারো কাছে না বলে। তারা দু’জনেই কথা দিয়েছে কাউকেই জানাবেনা। তাই কুহু নিশ্চিন্তমনে পড়ায় মনযোগ দিল। এগারোটার আগে রুম থেকে বের হলোনা। যখন শুনল তাহমিদ বেরিয়ে গেছে তখনই রুম থেকে বের হল। নিচে এসে শুনল তাহমিদ শিহাবকে নিয়ে মেডিকেলে গেছে। সাথে আনানও গেছে। ঢাকায় আসার পর থেকে শিহাবকে কাছে পাওয়াই যাচ্ছেনা। সারাদিন হয় তাহমিদের সাথে, নয়তো আনানের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

” আপু ,জানো আজ তাহমিদ ভাইয়ার সাথে অনেক জায়গায় বেড়িয়েছি? খুব মজা হয়েছে আজকে। ” শিহাব কুহুর পাশে বসে সারাদিন কি কি করেছে, কোথায় কোথায় গেছে সেই গল্প জুড়ে দিল।
কুহু মনযোগ দিয়ে শিহাবের কথা শুনছে। শিহাব আগে থেকেই এই বাড়িতে আসত বাবার সাথে। তাই এই বাড়ির সকলের সাথেই ওর সুসম্পর্ক রয়েছে।
” এখানে আসার পর থেকে বই হাতে নিসনি একথা মাথায় আছে? স্কুল হচ্ছেনা কয়েকদিন থেকে। কিন্তু তাই বলে পড়তেও বসবিনা? এত ফাঁকিবাজ হয়েছিস কেন বলতো তুই? ”

” আমি তো পড়ি, আপু। রাতে তাহমিদ ভাইয়া আমাকে পড়ায়। যেদিন আমরা ঢাকায় এসেছি, তার পরদিনই ভাইয়া আমার জন্য বই এনেছে। রাতে দুই ঘন্টা ভাইয়ার কাছে পড়তে হয়। ভাইয়ার একটাই শর্ত ছিল। সেটা হল, যে কয়দিন ঢাকায় আছি, সে কয়দিন প্রতিদিন তার কাছে পড়তে হবে। নয়তো আমাকে বেড়াতে নিয়ে যাবেনা। ”
শিহাবের কথা শুনে অবাক হয়ে গেল কুহু। ও দৃষ্টির মুখে শুনেছিল, তাহমিদ ভাইয়া ওদেরকে খুব ভালোবাসে। শিহাবও একই কথা বলত। আজ কুহুর মনে হচ্ছে সত্যিই তাহমিদ ভাইয়া ওদেরকে ভালোবাসে। কিন্তু কুহু এই লোকটার মতিগতি বুঝতে পারেনা। কুহুর প্রতি তার মনোভাবও বুঝতে পারেনা। কখনো মনে হয়, সে কুহুকে খোঁচা মেরে কথা বলে, আবার কখনো মনে হয় সে কুহুর ভালো চায়। সে আদতেই চায় কি সেটা কুহুর বোধগম্য হয়না।

” বড়মা, কালতো সিক্ত, কুহুর এ্যাডমিশন টেস্ট? ওদের সাথে কে যাবে? ” রাতের খাবার খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল তাহমিদ।
” এক কাজ কর বাপ, তুই, তোর বড় চাচা ওদেরকে নিয়ে যাস। দরকার হলে আমি অথবা তাহমিনাও যাব। তুই যেতে পারবি? ”
” সিনিয়র ভদ্রলোকের গিয়ে কাজ নেই। এমনিতেই তার শরীর চলেনা। কালকে ভীড়ের মধ্যে তাকে নিয়ে না যাওয়াই ভালো। শেষে দেখবে পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষার বদলে তার মাথায় বাতাস করছে। তারচেয়ে বরং আমি, আনান আর তুমি যাব। মা বাসায় থাকুক। ছোট চাচী পিচ্চিদের নিয়ে স্কুলে যাবে। মেজো চাচীর একা একা রান্না করতে কষ্ট হবে। ”
তাহমিদের কথা শুনে নাজমা আক্তার একগাল হেসে বললেন,

” আমার ছেলেমেয়েরাও তোর মত করে আমাকে বোঝেনা। এজন্যই তোকে এত ভালোবাসি রে, তাহমিদ। ”
” থাক অনেক হয়েছে, নাজমা। অপদার্থটা তোমাকে অয়েলিং করল এটা যদি তুমি বুঝতে তবে ওকে ভালোবাসাতো দূরের কথা ওর প্রতি বিরক্ত হতেও তোমার বিরক্ত লাগত। ” সাদিক আহমেদ রাশেদীন বিরক্তি নিয়ে বললেন।
” বড়মা, সিনিয়রের আঁতে ঘা লেগে গেছে। এক কাজ করলে কেমন হয়, তাকে নিয়ে গিয়ে কোন কফিশপে বসিয়ে রাখব? ”

” থাক, আর দয়া দেখাতে হবেনা। আমি কোথাও যাচ্ছিনা। এরা আমাকে বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছে। আফরোজা, এই বেয়াদবকে বলে দাও, একসময় আমারও যৌবন ছিল। আমিও ভার্সিটি দাপিয়ে বেড়িয়েছি। আজ বয়সের কারনে আমাকে সে অবহেলা করছে! তারও জেনে রাখা উচিত, একদিন সে-ও আমার মতই বুড়ো হবে। ”
বড় চাচার কথা শুনে তাহমিদ কপাল কুঁচকে তার দিকে তাকাল। প্লেটটা একটু ঠেলে দিল। আফরোজা নাজনীন বুঝতে পারলেন তাহমিদ রেগে গেছে।

” বড়মা, এই ভদ্রলোক যদি আর একটাও কথা বলে, তবে আমি বাড়ি থেকে চিরদিনের জন্য বেরিয়ে যাব। আমি সর্বদা তার চিন্তায় অস্থির থাকি, আর সে আমাকে দোষারোপ করছে! যে-কোন সময় সে অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। রাস্তায় কোন দূর্ঘটনা ঘটলে কি হবে ভাবতে পারছ? ”
” তাহমিদ, শান্ত হ, বাপ। আমারই ভুল আমিই তাকে যাবার কথা বলেছি। বুঝিসই তো তার বয়স হয়েছে। কখন কি বলে সেটা ভেবে দেখেনা। তুই খেয়ে নে। আজকে মেডিকেলে যা। কালকে তো যেতে পারবিনা। ” আফরোজা নাজনীন তাহমিদকে বোঝাতে শুরু করলেন।

” তাহমিদ, খেয়ে নেয়ে। খাবার রেখে উঠবিনা বলে দিচ্ছি। বড় ভাই, কি এমন অন্যায় কথা বলেছেন? তারও তো বাহিরে যেতে ইচ্ছে করে। বড় ভাই তিনমাসের বেশি সময় হয়েছে ঢাকায় এসেছেন। এরমধ্যে কোথাও বেড়াতে যাননি। তুই ও তে তাকে বাহিরে নিয়ে যাসনা। কেমন ছেলে তুই? ” তাহমিনা আক্তার ছেলেকে ধমক দিলেন।
” ভাই, বড় মামা, সবাই শান্ত হও। কালকে কোকিলা, সিক্তার পরীক্ষা হোক তারপর আমরা সবাই মিলে কোথাও বেড়াতে যাব। মেজো মামা, সেজো মামা, ছোট মামাকেও ছুটি নিতে বলব। খেয়ে নাও, ভাই। খাবারের ওপর রাগ করতে নেই। ” আনানও তাহমিদের রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করল।
” আনান ঠিক বলেছে। কালকে ওরা পরীক্ষা দিয়ে আসুক। তার পরদিন আমরা কোথাও বেড়াতে যাব। খেয়ে নে, তাহমিদ। ” নাজমা আক্তার প্লেট এগিয়ে দিলেন তাহমিদের দিকে।
তাহমিদ আর কিছু না বলে চুপচাপ খেতে শুরু করল।

কুহু ভেবেছিল ওদের সাথে বড় মামী, মেজো মামী আর বড় মামা যাবেন। কিন্তু যখন শুনল তাহমিদ যাবে ওদের সাথে, তখন আবারও ওকে ঘিরে ধরল লজ্জা। তাহমিদের সামনে কিভাবে যাবে সেই চিন্তা করতে গিয়ে ওর ঘাম ছুটল।

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ১২

কুহুকে বাহিরে যেতে গড়িমসি করতে দেখে ওর হাত ধরে সিক্তা টেনে নিয়ে গেল। নিচে এসে তাহমিদকে দেখেই মুখ নিচু করল কুহু। তাহমিদ সেটা লক্ষ্য করল। তবে এখন কিছুই বললনা। দিদুনের কাছ থেকে দোয়া নিয়ে, মামীদের বলে বড় মামীর হাত ধরে কুহু বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। আফরোজা নাজনীন এক হাতে কুহুকে আরেক হাতে সিক্তাকে ধরলেন।

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ১৪