তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ৪

তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ৪
অহনা আক্তার

রাত বারোটা। মুসকানকে খুব সুন্দর করে শাড়ি পরিয়ে দিলেন তাজমহল। চোখে কাজল, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, হাতে চুড়ি, নাকে নাকফুল, গলায় চেইন, পারিয়ে দিয়ে কপালে একটা চুমু দিলেন,,
— মাশাআল্লাহ, কি অপূর্ব লাগছে আমার পুত্র বধূকে। কারো নজর না লাগে। চলো তোমাকে ফারিশের ঘরে দিয়ে আসি রাত হয়ে গেছে অনেক।
ফাইজা তড়িঘড়ি করে বলল,
— একমিনিট দাঁড়াও মা আমি মুসকানের একটা ছবি তুলে নেই। আমার ফ্রেন্ডদের দেখাবো।
তাজমহল ফাইজাকে মৃদু ধমক দিলেন,
— এসব কি ফাইজা? তুমি মুসকান কে নাম ধরে ডাকছো কেন? আজকে গাড়িতেও ডাকলে। মুসকান এখন থেকে তোমার ভাবি ওকে ভাবি বলে ডাকবে।

— কিন্তু মা মুসকানতো আমার থেকেও ছোট । ওকে আমি কি করে ভাবি ডাকবো?
— এটা কি ধরনের কথা ফাইজা? মুসকান তোমার থেকে বয়সে ছোট হলেও সম্পর্কে বড়। আমি যেন দ্বিতীয়বার আর তোমার মুখ থেকে মুসকানকে নাম ধরে ডাকতে না শুনি! মনে থাকবে?
ফাইজা মন খারাপ করে ওপর নিচে মাথা নাড়ায়। মুসকান শুধু চোখ গুলগুল করে ওদের মা মেয়েকে দেখছে। কিছুক্ষণের মধ্যে তাজমহল তাকে ফারিশের ঘরে নিয়ে যেতে নিলে মুসকান টুকরো আওয়াজে বলে উঠে,
— আমি এখানেই থাকি বড়চাচি ফাইজার ঘরে।
হেসে দিলেন তাজমহল। মুসকানের থুতনিতে হাত রেখে বললেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— তা বললে কি হয় নাকি। ফারিশ তোমার স্বামী এখন থেকেতো তোমার তার ঘরেই থাকতে হবে।
স্বামীর খেয়াল রাখতে হবে,স্বামী কি খেতে পছন্দ করে সেইদিকে খেয়াল রাখতে হবে, স্বামীর ঘর, জামাকাপড়,বিছানা সবকিছু গুছিয়ে দিতে হবে। সে কখন বাড়িতে আসে কখন কাজে যায় সেদিকে নজর রাখতে হবে। আমি জানি প্রথম প্রথম এইগুলো মেনে নিতে তোমার অনেক অসুবিধে হবে। কিন্তু করতে করতে দেখবে ঠিকই অভ্যস্ত হয়ে গেছো। বিয়ের পর প্রতিটি মেয়েরই দায়িত্ব স্বামীর খেয়াল রাখা তার যত্ন করা। ঠিক তেমনই প্রতিটি ছেলেরও দায়িত্ব তার স্ত্রীর খেয়াল রাখা, তার আবদার গুলো পূরণ করা। স্বামীর স্ত্রীর সম্পর্ক হচ্ছে পবিত্র সম্পর্ক। আর না চাইতেও তোমরা এই পবিত্র সম্পর্কটাতে জড়িয়ে গেছো। এখন দুজনেই চেষ্টা করবে সম্পর্কটাকে মুল্যায়ন করতে। আশা করি তুমি বুঝতে পেরেছো মুসকান?
মুসকান হালকা করে মাথা দোলায়। তাজমহল মুচকি হেসে মুসকানের মাথায় ঘুমটা টেনে দিয়ে তাকে নিজের ছেলের ঘরের দিকে নিয়ে গেলেন।

গ্রামের বাড়ি থেকে ফেরার পরপরই ফারিশ তাদের বাড়িতে দিয়ে বেড়িয়ে গেছে। এই কয়েকদিনের প্রচুর কাজ জমে গেছে তার। তাছাড়াও বিয়ের খবর শুনে বন্ধুরা ফোন দিয়ে দিয়ে ফারিশের মাথা খাইয়ে ফেলেছে। সবগুলো শুধু ট্রিট ট্রিট করছে। নতুন ভাবিকে দেখতে চাইছে। বারবার ফোন দিয়ে দেখা করতে বলছে। সে কোন পরিস্থিতিতে বিয়ে করেছে এটা যদি এই হতচ্ছাড়া গুলো বুঝতো। বন্ধুদের চাপে খেতে পর্যন্ত পারেনি বেচারা। ফ্রেশ হয়ে আগে তাদের সাথে মিট করতে যেতে হয়েছে। যখন জানতে পেরেছে ফারিশের বিয়ে তার হাঁটুর বয়সী চাচাতো বোনের সাথে হয়েছে,, না হয়নি তার বাপ,দাদা জোর করে বিয়ে দিয়েছে তখন তাদের মধ্যে ট্রলের শেষ ছিলো না। হাসাহাসি করে একেকটা গড়াগড়ি খেয়েছে। ফারিশের মতো রাগি মানুষকেও নাকি জোর করে বিয়ে দেওয়া সম্ভব! তাও আবার তার থেকে বারো বছরের ছোট মেয়ের সাথে। হাসবে নাতো কি করবে তারা!

ফারিশের রুমে বসে ঝিমাচ্ছে মুসকান। কটাদিন ধরে তার চোখে ঘুম নেই। বাবার মৃত্যুর পর থেকে বিন্দু মাত্র ঘুমাতে পারেনি সে। তাজমহল তাকে ঘরে বসিয়ে রেখে সেই কখন চলে গেছে। সে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ফারিশের পুরো ঘরটা দেখছে। ঘরের প্রতিটা জিনিসপত্রই আধুনিকতায় ঘেরা। ফারিশদের বাড়িটা মুসকানদের তালুকদার বাড়ির মতো বড় হলেও এখানের জিনিসপত্রে তালুকদার বাড়ির কোনো ছিটেফোঁটাও নেই। তালুকদার বাড়ির খাট থেকে নিয়ে সকল জিনিসপত্রে যেমন পুরনো আমলের নকশা করা,পুরনো ঐতিহ্যে ঘেরা এই বাড়ির সবকিছুতেই তেমন আধুনিকতায় ঘেরা। ফারিশদের বাড়িটা সিনেমায় দেখা কোনো নায়কের বাড়ি থেকে কম মনে হচ্ছে না মুসকানের কাছে। বাড়ির পাশে সুইমিংপুল টাও সে সিনেমায় ছাড়া এই প্রথম সরাসরি দেখেছে ।

সব দেখতে অসম্ভব সুন্দর হলেও মুসকান তার দাদুর বাড়িকেই ভিষণ মিস করছে। এসব বাড়ি কেবল সিনেমাতেই সুন্দর তার কাছে। আসল শান্তিতো গ্রামের নীড়ে। সেখানের খোলামেলা আবহাওয়ায়, শীতল বাতাসে, শিশির ভেজা ঘাসে, ভোরে পাখির কলকাকলিতে, গ্রামের আকাঁবাকাঁ মেঠো পথে, হাটে বসা মেলায়, হেমন্তের পিঠা উৎসবে, শীতের কুয়াশায়, খেজুরের রসের মনমাতানো স্বাদে, গ্রীষ্মের আম কুড়ানোতে, শরতের ঘুড়ি উড়ানোতে। গ্রামের প্রতিটা দৃশ্যই যেন ছবির মতো সুন্দর। সকাল হলেই আম্মার হাতে নাস্তা করে স্কুলে ছোটা, সেখানে গিয়ে সহপাঠীদের সাথে তাল মিলিয়ে পড়াশোনা করা, স্কুল মাঠে খেলা করা,ছুটির পর হাসাহাসি করে বাড়ি ফেরা সব কিছুতে যেন অন্যরকম একটা শান্তি পেতো মুসকান। যেটা এখানে এসে সব ধুয়াশা হয়েগেছে। নিজের গ্রাম, স্কুল, সহপাঠী, গ্রামে থাকা মানুষ, দাদু, মেজো চাচ্চু, মেজো চাচি, রাতুল, আম্মা সবাইকে ভিষণ রকমের মিস করছে মুসকান। আহ কি সুন্দর জীবন চলছিলো তার। দাদু কেন তার এতো সুন্দর জীবনটাকে এতো তাড়াতাড়ি শেষ করে দিলো। চোখ উপচে পানি আসছে মুসকানের। একদিনেই তার এখানে দমবন্ধ লাগছে। বাকি দিন পার করবে কি করে ।

ফারিশ বাড়িতে ঢুকতেই দেখে তার মা তার জন্য খাবার নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে আছে। বেশি রাত করে বাড়ি ফেরা ফারিশের নিত্য দিনের অভ্যাস। ছেলে গভীর রাতে বাড়ি ফিরবে আর মা তার জন্য খাবার সাজিয়ে অপেক্ষা করবে। এটাই চলে আসছে কয়েকবছর ধরে। তাজমহল ছেলেকে কতো করে বলেন একটু জলদি বাসায় আসার জন্য কিন্তু ফারিশ যেন কানেই তুলে না। উল্টো তার মাকে বলে, সে যেন ঘুমিয়ে পরে। তার খাবার সে নিজে নিয়েই খেতে পারবে। তাজমহল কথা শুনে না। তিনি জানেন উনি যদি খাবার নিয়ে ছেলের জন্য অপেক্ষা না করেন তাহলে ফারিশ নিজেই গিয়ে উনাকে ডেকে তুলে আনবে। এইভাবে যতই বলুক না কেন সে নিজে নিয়ে খেয়ে নিবে। তার সামনে যদি সব খাবার সারি সারি করেও সাজিয়ে রাখা হয় তবুও সে তাজমহল কে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে আসবেই। তার নাকি রাতে একা একা খেতে ভালো লাগে না। কেউ পাশে থাকলে শান্তি লাগে। তাজমহলতো এইজন্য এতোদিন ফারিশকে বিয়ে কর বিয়ে কর বলে পাগল করে ফেলতো। একটা বউ এলে অন্তত উনার জ্বালা কিছুটা কম হবে।
ফারিশকে দেখে তাজমহল চিকন সুরে বলেন,

–“বাড়িতে আসার সময় হয়েছে আপনার আব্বাজান? আর কয়েকটা ঘন্টা বাদেই আসতেন ভোর হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতেন?”
— মা তুমি জানোই আমার আসতে লেট হয় খাবার রেখে চলে গেলেই পারো।
— হ্যা, আমি খাবার রেখে চলে যাই আর তুমি আমাকে মাঝরাতে ঘুম থেকে টেনে উঠিয়ে আনো।
ফারিশ হেসে পেছন থেকে তার মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে। মাথায় চুমু দিয়ে বলে,
— দু-একদিন ডেকে তুলেছি বলে যে প্রতিদিন তুলবো তাতো নয়। তুমি কেন রোজ রোজ এতো রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করো বলোতো?
তাজমহল মেকি রাগ দেখিয়ে বলেন,

— হয়েছে হয়েছে এবার হাতমুখ ধুয়ে এসে খেতে বসো। আমি আর কয়দিন এবার তোমার বউ এসেছে। এখন থেকে সেই অপেক্ষা করবে।
ফারিশ বেসিনে হাতমুখ ধুতে ধুতে বলে,
— আমার জন্য কারো অপেক্ষা করতে হবে না মা। আমি নিজে নিয়েই খেতে পারবো।
তাজমহল খাবার বাড়তে বাড়তে বলেন,
— হ্যা, হ্যা তুমি কেমন নিজে নিজে বেড়ে খেতে পারবে তা আমার ভালো করেই জানা আছে। চোখের সামনে সব সাজিয়ে রেখে দিলে ওতো খোঁজে পাও না।

বাবার বাড়িতে গিয়ে একদিনও থাকতে পারিনা তোমাদের জ্বালায়। সকালে গেলে দুপুরের মধ্যে নিয়ে এসে পরো। সার্ভেন্টদের রান্না নাকি খেতে পারো না। ভালো হয়েছে মুসকান ছোট। ওকে এখন আমি নিজের মতো করে গড়িয়ে নিতে পারবো। আমার মতো করে রান্না শিখিয়ে দিবো যেন তোমাদের রেঁধে বেড়ে খাওয়াতে পারে।
ফারিশ হেসে বলল,
— বাচ্চা মেয়েটাকে এখন থেকেই খাটানোর ফন্দি আঁটছ?
তাজমহল মুখ বেঁকিয়ে বলেন,
— বা’বাহ বউয়ের জন্য দেখছি এখন থেকেই দরদ চালু হয়েগেছে! আর মা যে এতোগুলো বছর খেঁটে গেল তার বেলায়?
ফারিশ মুখের রং পাল্টিয়ে ফেলল। গম্ভীর ভয়েসে বলল,

— ওর জন্য আমার কেন দরদ চালু হবে মা? আমিতো জাস্ট এমনি বলেছি। মনে রাখবে ওকে আমি নই তোমরা এইবাড়িতে বউ করে এনেছো। তোমাদের জন্য বন্ধুদের কাছে এখন আমাকে ট্রলের শিকার হতে হচ্ছে।
তাজমহল অবাক হয়ে বলেন,
— আরে আরে তুমি রেগে যাচ্ছো কেনো? আমিও তো ফাজলামো করেই বলেছি। আর তোমার বন্ধুরাইবা কেমন !! মুসকানকে না দেখেই বিবেচনা করে ফেলেছে ওহ কেমন?! তাকে নিয়ে ট্রল করতে শুরু করেছে? মুসকানের মতো এমন সুন্দরী বউ তোমার আর কয়টা ফ্রেন্ডের আছে আমাকে দেখাওতো? আমিতো দেখেছি তোমার ফ্রেন্ডদের বউদের। একেকটার যা চেহারা… ‘কোনোটার নাক উঁচা তো কোনোটার দাঁত উঁচা।’ কোনোটা ইয়া লম্বা তো কোনোটা ইয়া বাঁটো। কয়েকটা তো আবার এতো মোটা যে গা নিয়ে নড়তেই পারেনা। একেকটা মনে হয় বুড়ি হয়ে, বিয়ের বয়স পার করে, জীবনের সব রঙ শেষ করে বিয়ের পিরিতে বসেছে। তাদের থেকে আমাদের মুসকান সব দিক দিয়ে পারফেক্ট। তুমি মুসকানের পাশে নিজেকে দাঁড় করিয়ে দেখেছো কখনো তোমাদের একসাথে দেখতে কতটা সুন্দর লাগে?

এতোক্ষণ মায়ের কথা শুনে শুনে খাবার খাচ্ছিল ফারিশ। মুখের খাবারটা শেষ করে জবাব দিল,
— তোমরাতো মনে করো তোমাদের মুসকান ডানাকাটা পরী। ওর থেকে সুন্দর কেউ হতেই পারেনা। আমার ফ্রেন্ডদের বউ যেমনই হোক না কেন তোমাদের মুসকানের মতোন স্কুল পরুয়া বাচ্চা নয়। যথেষ্ট মেচিয়োর। আর মুসকানের হাইটও কোন দিক দিয়ে আমার সাথে যায় ? পরেতো সেই কাঁধ বরাবরই!
— ওই কাঁধ বরাবরইন এখন বেস্ট জুটি। ‘তুমি কি বুঝবে?’ মুসকান কে খেয়াল করে দেখেছো কখনো?’ আর কি শুধু বাচ্চা বাচ্চা কর। মুসকান ওতোটাও বাচ্চা নয়। তোমার বাবাতো বলেছেন তোমার জাহিদ চাচা নাকি গ্রামের রাস্তায় বেরই হতে পারতেন না মেয়ের বিবাহের প্রস্তাবের জন্য।

ফারিশের খাওয়া শেষ। সে হাত ধুয়ে টেবিল থেকে উঠতে উঠতে বলল,
— তো দিয়ে দিতে সেখানের কারো সাথে বিয়ে আমার ঘাড়ে জুলিয়েছো কেন?
তাজমহল তেতে উঠে ছেলেকে ধমক দেন,
— “ফারিশ”
এসব কি ধরনের কথা ?? ঘাড়ে জুলিয়েছি মানে কি?
ফারিশ পাত্তা না দিয়ে নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল,
— মা গিয়ে ঘুমিয়ে পরোত অনেক রাত হয়েছে। সকালে দেখা হচ্ছে বাই।
তাজমহল সেদিকে তাকিয়ে বিড়বড়িয়ে বলেন,
— “অসভ্য ছেলে”

ফারিশ নিজের রুমে ঢুকেই বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পরলো। অন্ধকারে খুব মিষ্টি একটা ঘ্রাণ ভেসে আসছে তার নাকে। সে নাক উঁচিয়ে ঘ্রণটা আরেকটু বেশি করে শুকার চেষ্টা করলো। মনে হচ্ছে তার মাথার নিচ থেকেই আসছে ঘ্রাণটা। ফারিশ উবুড় হয়ে নাক ঘষতে লাগলো সেখানটায়। নাকের মাঝে এসে লাগলো কারো রেশমী চুলের মোলায়েম স্পর্শ। ফারিশ ধীরে ধীরে নিজের পুরো মুখটাই মজান করে দিল সেই মোলায়েম চুলে। ঘ্রাণটা মন্দ লাগছে না তার। চুলে টান অনুভব করতেই মুসকান দরফরিয়ে ঘুম থেকে ওঠে বসলো। অন্ধকারে কারো ছায়া মুর্তি দেখে ভয়ে একপ্রকার লাফিয়ে খাট থেকে নেমে পরলো,
— ভু ‘ভুত’ আম্মা ‘ভুতত’ ! আমাকে বাঁচাও আম্মা এখানে ভুত আছে।

মুসকানের চিৎকারে হুস আসে ফারিশের। কি করছিল এতক্ষণে বুঝতে পেরে সেও দরফরিয়ে খাট থেকে নেমে গেল। মুসকান এখনো চিল্লাচ্ছে। ফারিশ দ্রুত গিয়ে রুমের লাইট অন করলো।
ইতি মধ্যে ঘেমে গেছে মুসকান। গ্রামের মেয়ে বলে ভুত পেত একটু বেশিই বিশ্বাস করে সে। অন্ধকারে ফারিশের সুঠাম দেহের অবয়ব দেখে অসম্ভব ভয় পেয়েছে আজ। এখনো কাঁপছে।
ফারিশ গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করল,
— এইই মেয়ে তুমি আমার ঘরে কি করছো?
মুসকান কেঁপে কেঁপে উত্তর দিল,

— ব..বড় চাচি দিয়ে গেছে।
ততক্ষণে মুসকানের চিৎকার শুনে তাজমহলও রুমে হাজির,,
— কি হয়েছে ফারিশ মুসকান এভাবে চিৎকার করল কেন?
ফারিশ বিরক্তিকর কণ্ঠে বলল,
— ওহ আমার ঘরে কি করছে মা?
— মানে! মুসকান তোমার স্ত্রী ওহ তোমার ঘরে থাকবে নাতো কার ঘরে থাকবে?
— আরে ইয়ার বিয়ে করেছি বলে কি এখন এক ঘরে থাকতেও হবে? বাড়িতে কি রুমের অভাব পরেছে? ওতো ফাইজার ঘরেও থাকতে পারে?

— কেন? তোমার বউ ফাইজার ঘরে থাকবে কেন? তোমরা এখন একটা নতুন সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছো। চেষ্টা করো সম্পর্কটাকে মেনে নিতে। তোমার বিহেভিয়ার দেখে আমি অবাক হচ্ছি ফারিশ? এসব কেমন আচরণ করছো তুমি? মুসকান এখন থেকে তোমার ঘরেই থাকবে এটা নিয়ে আর কোনো কথা হবে না।
ফারিশ চোখমুখ অন্ধকার বানিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অতিষ্ঠ লাগছে তার।
মুসকান এক কোনায় কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তাজমহল মুসকানের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলেন,

— নতুন জায়গায় নতুন মানুষ দেখে তোমার অস্বস্তি হচ্ছে বুঝতে পারছি। এতো ভয়ের কিছুই নেই মুসকান। তুমি র্নিদ্বিধায় এই রুমে থাকতে পারো। ফারিশ কিছু করলে তোমার বড়চাচ্চু দেখে নিবে তাকে। মুসকান কথা বলে না। মাথায় আঁচল টেনে মুখ নুইয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুক ফেটে কান্না আসছে তার। সবাই তাকে কোথায় এনে ফেলল। এখানে একটুও ভালো লাগছে না মুসকানের। তাজমহল ফারিশের ঘরে মুসকানকে দিয়ে যাওয়ার পর মুসকানের ক্লান্তিতে চোখ বুঝে আসে। বিছানায় একটু হেলান দিয়ে বসতেই চোখে ঘুম চলে আসে। চুলগুলো ভেজা ছিল বিধায় সেগুলো বালিশে ছড়িয়ে দিয়ে সেও চোখ বুঝে ছিল। কখন যে ঘুমিয়ে পরেছে বুঝতে পারেনি।

___তাজমহল চলে গেলে ফারিশ ঘরের দরজা চেপে বিছানায় উবুড় হয়ে শুয়ে পরলো। মুসকান অবুঝের মতো দাঁড়িয়ে আছে। কি করবে বুঝতে পারছে না। কোথায় শুবে সে! ফারিশের পাশে শুবে ভেবে ভিষণ অস্বস্তি হচ্ছে। জীবনের প্রথমবার কোনো পুরুষের সাথে এক রুমে থাকতে যাচ্ছে সে। ভয়ে আর অস্বস্তিতে তার হৃদপিণ্ড ঢিপঢিপ করছে।
মুসকানকে অবুঝের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফারিশ মাথা উঠিয়ে ধমকে উঠলো,
— এভাবে আহাম্মকের মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন এখানে? ঘুমাতে ইচ্ছে হলে ঘুমাও নাহলে লাইট অফ করে চলে যাও। আমি টা’য়ার্ড ঘুমাবো!
মুসকান নিচু স্বরে বলল,
— আমি কোথায় ঘুমাবো?
ফারিশ বেশ বিরক্ত হলো,

— কেন আমার মাথায়। কোনো অসুবিধা হবে তোমার আমার মাথায় ঘুমাতে? ডাফার!’
মুসকান হকচকিয়ে গেল। ঢুক গিলে মিনমিনিয়ে বলল,
— আসলে আমার আপনার সাথে এই বিছানায় ঘুমাতে কেমন যেন**
— ওহ্ প্লিজ ইয়ার। সিরিয়ালের নাইকাদের মতো একদম নেকামো করবা না আমার সাথে। স্বামীর সাথে এক বিছানায় ঘুমাতে যদি তোমার এতোই অসুবিধা হয়ে থাকে তাহলে ওইযে সোফা আছে,, ওখানে গিয়ে ঘুমাও। আমাকে জ্বালানো বন্ধ করো দয়া করে।

‘আই ওইল স্লিপ’ তোমার ওই বুড়ো দাদুর ট্রিপিকাল জেদের জন্য কটাদিন আমি দুচোখের পাতা এক করতে পারিনি । এই বলে ফারিশ মাথায় বালিশ চেপে আবার শুয়ে পড়ল। মুসকান একবার সোফায় তাকাচ্ছে আরেকবার বিছানায়। মনে মনে ভাবছে,’তার যেভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমানোর অভ্যেস’ এইলোক যদি সেজন্য তাকে আবার বিছানা থেকে ফেলে দেয়। ভয়ে আতঙ্কে মুসকান লাইট বন্ধ করে সোফায়ই শুয়ে পরলো। কিন্তু যার পুরো বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমানোর অভ্যেস তার কি আর ওইটুকু সোফায় চলে। সোফায় শুয়ে সমানে ছটফট করতে লাগলো মুসকান। একবার ডানপাশ হচ্ছে তো একবার বামপাশ। একবার ওঠে বসছে তো আবার শুয়ে পরছে। কোনো ভাবেই স্বস্তি পাচ্ছে না সে। এভাবেই হাসফাস করতে করতে একসময় সোফা থেকে ধপাস করে নিচে পরে গেল মুসকান। কোমরে বেশ লেগেছে। সেখানে হাত দিয়ে হু হু করে কেঁদে দিল সে। মুসকানের পরার শব্দে ফারিশ দ্রুত বিছানা থেকে উঠে আসলো। সোফার দিকটায় আসতেই ড্রিম লাইটের আলোয় দেখতে পেল মুসকান কোমর চেপে ফুপিয়ে কাঁদছে। বুকের উপর থেকে শাড়ির আঁচল কখনই খসে পরেছে। সেদিকে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল ফারিশ,

— কি করছো এখানে?
মুসকান হিচকি তুলতে তুলতে বলল,
— আ’আমি বাড়িতে যা’যাবো! আমার এ’এখানে এ..একটুও ভালো লা’গছেনা।
ফারিশ বুঝতে পারলো ভালোই লেগেছে। গাল ফুলিয়ে শ্বাস ছাড়লো সে। এ নাকি আবার বাচ্চা নয়। মুসকানের কান্নার মাঝেই তাকে কোলে তুলে নিল ফারিশ। বিছানায় ঠাস করে ফেলে মাঝখানে কোল বালিশের বর্ডার দিয়ে দিল। ধমকে উঠে বলল,

তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ৩

— চুপচাপ ঘুমাবে। আর একটু সাউন্ড হলে হাত-পা বেঁধে ছাদে নিয়ে ফেলে আসব। তখন চিৎকার করে কাঁদলেও কেউ দেখতে আসবে না।
ফারিশের ধমকে কোমরে অসহ্য ব্যাথা থাকা সত্যেও চুপ হয়ে গেল মুসকান। অপর পাশ ফিরে ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করল। ফারিশও অপর পাশ ফিরে ঘুমানোর চেষ্টা করল। এবার ভূমিকম্প হলেও চোখ খুলবে না সে..

তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ৫